বুকে যে শ্রাবণ তার পর্ব ৮

বুকে যে শ্রাবণ তার পর্ব ৮
নিশাত জাহান নিশি

“হ্যাঁ থাক তুই তোর বোনকে নিয়ে। কিন্তু কখনও আমার মামা এবং মামার পরিবার নিয়ে মাথা ঘামাবিনা তুই! তাদের দায়িত্ব শুধু আমার। এমনকি সামান্তাও শুধু আমার!”
সাহিল তার অনধিকারচর্চায় নিজেকে হাসির খোঁড়াক বানালো! জেচে পরে কেউ নিজেকে এমন হাসির খোঁড়াক বানায়? সাহিলকে অপদস্ত করার সুযোগ পেয়ে ক্রুর হাসল মিশাল। নাক ঘঁষে পিছু ঘুরে দাড়ালো৷ গাঁ ছাড়া ভাব নিয়ে শ্লেষাত্মক গলায় বলল,

“হাউ ফানি সাহিল ভাই! ছোটো চাচা এমনকি তাঁর বড়ো মেয়ের দায়িত্ব যদি শুধু তোমারই হতো তবে নিশ্চয়ই ছোটো চাচা সেদিন আমাকে ফোর্স করতনা সামান্তাকে বিয়ে করার জন্য? তোমাকেই ফোর্স করত! এবার ঠাণ্ডা মাথায় হিসেবটা তুমি মিলিয়ে দেখো। কে কাকে দায়িত্ব দিতে চেয়েছিল। আর কার দায়িত্ব কতটুকু। অযথা তোমার সাথে তর্কে জড়াতে চাইনা আমি। সত্যিই বড়ো ভাই হিসেবে আমি তোমাকে যথেষ্ট সম্মান করি। আমি চাইব, সেই সম্মানের জায়গাটুকু তুমি আজীবন ধরে রাখো।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মধুর ভাষায় সাহিলকে হেস্তনেস্ত করে ছাড়ল মিশাল। প্রত্যত্তুরে কিছু বলার উপায় রাখলনা। রিকশায় ওঠে বাসস্ট্যান্ডের উদ্দেশ্যে রওনা হলো মিশাল। জেনিয়াকে এগিয়ে আনতে হবে। কী এক উটকো ঝামেলা এসে তার ঘাড়ে পরল! কাজকর্ম ব্যতিরেকে এখন তাকে বাসস্ট্যান্ডের উদ্দেশ্যে দৌড়াতে হচ্ছে। নির্বাক মূর্তির ন্যায় জায়গায় দাড়িয়ে সাহিল। হাত-পা তার হিম হয়ে এলো। সত্যিই তো সেদিন তার মামা ঐ বেকার ও অপদার্থ মিশালের কাছে সামান্তাকে বিয়ে দিতে চেয়েছিল! যে জায়গায় প্রতিষ্ঠিত ও যোগ্য ছেলে হিসেবে সাহিল নিজেও সেখানে উপস্থিত ছিল! মাথায় এই কঠিন প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে লাগল সাহিলের। পূর্বের তুলনায় অধিক রাগান্বিত ও উত্তেজিত হয়ে উঠল সে। হাতদুটো মুষ্টিবদ্ধ করে চোয়াল উঁচালো। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

“মামাকে আজ আমার প্রশ্নের উত্তর দিতেই হবে। কেন মামা সেদিন আমাকে রেখে মিশালকে তাঁর মেয়ের জন্য সিলেক্ট করেছিল? আমি সামান্তার জন্য কোনদিক থেকে খারাপ ছিলাম? আজ আমাকে এর একটি বিহিত করতেই হবে।”
হম্বিতম্বি হয়ে বাইকে উঠল সাহিল। মাথায় হেলমেট নেই উপরন্তু বাইকটিও উর্ধ্বগতিতে ছাড়ল! রাগ নিয়ন্ত্রণের বাইরে তার। প্রয়োজনে মানুষ খু*ন করতেও পিছপা হবেনা সে। ভাগ্যিস রাস্তায় কোনো ট্রাফিক পুলিশ সামনে পরেনি তার। জরিমানার সম্মুখীনও হতে হয়নি।

তুখোর রেগে মিনিট পনেরোর মধ্যে সাহিল তার মামার বাড়িতে এসে উপস্থিত হলো। বাড়ির সদর দরোজা খুলে দিলেন জেসমিন বেগম। সাহিলকে হঠাৎ দেখে তিনি খুশি হয়ে গেলেন। সাদরে আমন্ত্রণ করলেন তাকে। মলিন হেসে বললেন,
“আরে সাহিল যে? এসো এসো ভেতরে এসো।”
মামীর সাথে নম্রতা বজায় রাখতে ব্যর্থ হলো সাহিল! রাগে রক্তিম মুখশ্রী তার। বড়ো, ছোটো কাউকে তোয়াক্কা করার পর্যায়ে নেই সে। গলা উঁচিয়ে রূঢ় গলায় তার মামীকে বলল,

“মামা কোথায়?”
সাহিলের উগ্র আচরণ ও ব্যবহারে কপাল কুঁচকে নিলেন জেসমিন বেগম। অসন্তুষ্ট হলেন তিনি। এভাবে কেউ বড়োদের সাথে গলা উঁচিয়ে কথা বলে? যদিও তিনি সাহিলের এই আচরণের সাথে পূর্ব পরিচিত। সাহিলের পথ থেকে সরে দাঁড়ালেন তিনি। ক্ষীণ গলায় বললেন,

“বেডরুমেই আছে। যাও।”
জেসমিন বেগমকে উপেক্ষা করে সাহিল তড়িঘড়ি করে হেঁটে তার মামার বেডরুমে গেল। সাহিলের যাওয়ার পথে বিরক্তিকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন জেসমিন বেগম। তিক্ত গলায় বললেন,
“এই ছেলে আর শুধরাবার নয়!”

রকিং চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছেন মিজানুর রহমান। চোখ বুজে তিনি গভীর চিন্তায় মগ্ন। সেই চিন্তায় হঠাৎ এসে তাল কাটল সাহিল। রগচটা ভাব নিয়ে তার মামার মুখোমুখি দাড়ালো। রুমে দ্বিতীয় কারো উপস্থিতি টের পেয়ে চোখ মেলে তাকালেন মিজানুর রহমান। সাহিলকে দেখামাত্রই তিনি মৃদু হাসলেন। উদ্বেলিত গলায় শুধালেন,
“কী রে? কখন এলি?”
“এসব পরে হবে মামা। আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও?”
“কী প্রশ্ন?”

“তুমি সেদিন আমাকে রেখে মিশালকে কেন সিলেক্ট করলে সামান্তার জন্য? কাম অন আনসার মি?”
কিয়ৎক্ষণ সূক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সাহিলকে পর্যবেক্ষণ করলেন মিজানুর রহমান। রাগ, জেদ এবং দাম্ভিকতায় পরিপূর্ণ সাহিল। বয়োজ্যেষ্ঠদের সাথে কথা বলারও আদব নেই তার! সাহিলের আচরণে তিনি রীতিমতো অসম্মানবোধ করলেন। বাচবিচার শেষে তিনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন সাহিলের দিকে। রুক্ষ গলায় বললেন,

“আয়নায় দাড়িয়ে নিজেকে একবার দেখো। নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করো কেন আমি সেদিন আমার মেয়েকে তোমার হাতে তুলে না দিয়ে বরং মিশালের হাতে তুলে দিতে চেয়েছিলাম! বেকার হোক কিংবা মধ্যবিত্ত হোক আর যাই হোক একজন দাম্ভিক, জেদী, অহংকারি ও হিতাহিতজ্ঞানশূন্য ছেলের হাতে নিশ্চয়ই আমি আমার মেয়েকে তুলে দিতে পারিনা। নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করার আগে বরং নিজেকে কোমল ও উদার মনের মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করো সাহিল। যদিও তুমি মিশালের মতো কোনোদিনও হতে পারবেনা! মিশাল একজনই। তার মতো ছেলে হয়না! আমার মেয়েরই ব্যাড লাক। কারণ, সেদিন সুযোগ থাকা সত্ত্বেও মিশালকে অস্বীকার করেছে সে।”

সাহিলকে কিছু কঠিন ও তিক্ত সত্যির মুখোমুখি দাড় করিয়ে দিয়ে জায়গা থেকে ওঠে গেলেন মিজানুর রহমান। শেষ ভরসার জায়গা মামার কাছ থেকে রীতিমতো অপমানিত হয়ে সাহিল রকিং চেয়ারে জোরে এক লাথ মারল! বিষধর সাপের ন্যায় ফোঁস ফোঁস করে ঘুরে দাড়ালো সামনের দিকে। ইতোমধ্যেই অপ্রত্যাশিতভাবে ড্রেসিং টেবিলের মুখোমুখি হয়ে গেল সে।

আয়নায় তার প্রতিবিম্বের দিকে তাকাতেই দেখল জঙ্গলে থাকা হিংস্র পশুর চেয়ে কোনো অংশে কম মনে হচ্ছেনা তাকে! তবে কী তার মামা যথার্থই বলেছে? সবদিক থেকে সে সামান্তার জন্য যোগ্য হলেও এই দিক থেকে সে সম্পূর্ণ অযোগ্য? তবুও মিশালের সাথে তুলনা দেওয়াটা সাজেনি মিজানুর রহমানের! তার কাছে এই দিকটা রীতিমতো বাড়াবাড়ি মনে হলো। কোথায় সাহিল আর কোথায় মিশাল? আকাশ পাতাল ব্যবধান তো তাদের মধ্যে! অহংকারে টইটম্বুর সাহিল। প্রয়োজনে মিশালকে সে উচিৎ শিক্ষা দিয়ে ছাড়বে!

জেনিয়ার জন্য বাসস্ট্যান্ডে দাড়িয়ে মিশাল। এখনও অবধি জেনিয়া ও তার বাসের দেখা মিললনা। এত শত যাত্রীর মাঝে জেনিয়াকে খুঁজে বের করাটাও তো দুষ্কর হয়ে পরেছে। ফোন যে করবে সেই নাম্বারটিও তো তার কাছে নেই। এ কোন মহা মুসিবতে ফেঁসে গেল মিশাল? এদিকে সন্ধ্যে থেকে রাত ঘনিয়ে এলো। বিরক্ত হয়ে মিশাল সিগারেট ফুঁকতে লাগল। আর কতক্ষণ এভাবে দাড়িয়ে থাকা যায়?

এই মেয়েটা মাস খানিক পরে এসে এসে তাকে বিরক্ত করে! হয় বাসস্ট্যান্ডে দাড়িয়ে রাখবে নয় কলেজের কাজে তার পেছনে পেছনে ঘুরাবে। এতকিছু না করে কলেজ হোস্টেলে থাকলেই তো পারে মেয়েটা। একঘেয়ে হয়ে দাড়িয়ে থাকার এক পর্যায়ে মিশালের সেলফোনটি হঠাৎ সাইলেন্ট মোডে বেজে উঠল। রুমকির নাম্বার থেকে কল এলো। তাড়াহুড়ো করে কলটি তুলল মিশাল। হ্যালো বলার পূর্বেই ফোনের ঐ প্রান্ত থেকে সামান্তার গলার স্বর ভেসে এলো। ব্যস্ত সুরে সামান্তা শুধালো,

“এই কই তুমি?”
“তুই কেন? রুমকি কোথায়?”
“রুমকির ফোন থেকে আমি তোমাকে কল করেছি।”
“ওহ্ আচ্ছা। ভাবলাম খারাপ কিছু হলো না-কি। বাই দ্য ওয়ে, তোর ফোন কোথায়?”
“তার জন্যই তো তোমাকে কল করা।”
“বুঝিয়ে বল?”

“একচুয়েলি আমার ফোনটা সার্ভিসিং দোকানে দিয়ে আসতে হবে। তুমি একটু দিয়ে আসবা প্লিজ?”
“হাহ্! সার্ভিসিং করার কী দরকার? নতুন ফোন কিনলেই পারিস। চাকরী বাকরী করিস টাকার কী অভাব আছে তোর?”
“এখন থেকে অভাব লাগবে!”
“কেন?”
“চাকরী থেকে রিজাইন নিয়েছি!”
“সিরিয়াসলি?”

“তোমার কী মনে হয়, এতকিছুর পরেও আমি চাকরীটা করব? যেখানে বস ও বসের ছেলে আমার সাথে প্রতারণা করল।”
“আহা। এজন্যই তো তোকে এত ভালো লাগে! এসব মেয়েই তো ওয়াইফ ম্যাটারিয়াল!”
“হাহ্। উপহাস! তবে তুমি কিন্তু মোটেও হাসবেন্ড ম্যাটেরিয়াল নও!”
“বিয়ে করে দেখেছিস আমায়? বুঝবি কী করে?”

“তুমিই বা কখন আমাকে বিয়ে করে দেখলে? হুট করেই যে ওয়াইফ ম্যাটেরিয়াল বলে বসলে!”
ইতোমধ্যেই কেউ পেছন থেকে এসে মিশালের কাঁধে হাত রাখল! নরম ও মোলায়েম হাতের স্পর্শ। ব্যতিব্যস্ত হয়ে মিষ্টি সুরে তাকে ডেকে বলল,
“মিশাল ভাই?”
থতমত খেয়ে তৎক্ষণাৎ পিছু ফিরে তাকালো মিশাল। আচ্ছন্ন দৃষ্টি ফেলে জেনিয়ার দিকে তাকালো! ব্যস্ত সুরে ফোনের ঐ প্রান্তে থাকা সামান্তাকে বলল,

“আচ্ছা ফোনটা রাখ। আমি একটু পরে আসছি।”
সামান্তার মুখের উপর কলটি কেটে দিলো মিশাল। মলিন হেসে পিছু ঘুরে দাড়াতেই জেনিয়ার ভয়ার্ত দু’চোখে তাকিয়ে ভড়কে উঠল! এইতো কিছুক্ষণ আগেও জেনিয়ার চোখ দুটি কত প্রফুল্ল দোখাচ্ছিল। ক্ষণিকের মধ্যে কী এমন ঘটে গেলো যার কারণে জেনিয়া এতো শঙ্কিত হয়ে উঠল? জিনিয়ার দৃষ্টিকে অনুসরণ করে মিশাল পিছু ঘুরে যে পরিস্থিতির মুখোমুখি হলো তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলনা মিশাল!

ফোনটি কান থেকে সরিয়ে সামান্তা পাশ ফিরে রুমকির দিকে তাকালো। কপাল কুঁচকে এলো তার। ভাবনায় ডুবে গেল। চিন্তিত হয়ে রুমকির দিকে প্রশ্ন ছুড়ল,
“কোনো মেয়ের কণ্ঠস্বর শোনলাম বোধ হয়? কার সাথে আছে মিশাল ভাই?”
“জেনিয়া আপু হয়ত। আজ তো আপুর আমাদের বাড়িতে আসার কথা ছিল।”
জেনিয়ার কথা শুনতেই আচমকা নিস্তব্ধ হয়ে গেল সামান্তা! অবিলম্বেই মাথা নুইয়ে নিলো। ফোনটি ধরিয়ে দিলো রুমকির হাতে। বিষণ্ন সুরে বলল,

“নে তোর ফোন।”
মনোক্ষুণ্ণ হয়ে সামান্তা রুমকির সম্মুখ থেকে প্রস্থান নেওয়ার জন্য অগ্রে পা বাড়ালো। অমনি রুমকি পেছন থেকে সামান্তার হাতটি টেনে ধরল। সঙ্গে সঙ্গেই হাতের ব্যথায় উহ্ করে উঠল সামান্তা। ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠল রুমকি। সামান্তার হাতটি মেলে ধরে লাল হয়ে থাকা হাতের তালুতে আলতো হাত বুলালো। উদ্বিগ্ন সুরে বলল,

“হাত দুটো তো এখনও তো লাল হয়ে আছে আপু। বরফ ঘঁষোনি তুমি?”
“ঠিক হয়ে যাবে। তুই এত ব্যস্ত হোস না তো।”
“একসাথে এতগুলো কাপড় ধোঁয়ার অভ্যেস নেই তো তোমার। তাই হাতে এত জ্বালা করছে। তুমি বসো আপু। আমি বরফ আনছি।”
“বললাম তো কিছু হবেনা। তুই প্লিজ শান্ত হ রুমকি।”

“এই তুমি চুপ করো তো। বরফ না ঘঁষলে হাতের জ্বালা কমবেনা। কত করে বললাম আমি কাপড়গুলো ধুঁতে পারব। তুমি শুনলেই না।”
হেঁচকা টানে হাতটি সরিয়ে নিলো সামান্তা! জায়গা থেকে প্রস্থান নিতে নিতে সে মলিন সুরে রুমকিকে বলল,
“মিশাল ভাইয়াকে এই সম্পর্কে কিছু বলিসনা প্লিজ! তোর কাছে রিকুয়েস্ট রইল।”

বুকে যে শ্রাবণ তার পর্ব ৭

রুম থেকে বের হয়ে গেল সামান্তা। কিয়ৎক্ষণ সরু দৃষ্টিতে সামান্তার যাওয়ার পথে তাকিয়ে থেকে রুমকি ফিক করে হেসে দিলো! বিড়বিড় করে বলল,
“ভাঙবে তবু মচকাবেনা! এরা দুজন দুজনকে পছন্দ করে তবুও মুখ খুলে কেউ কাউকে কিছু বলবেনা। কীসের এত বাঁধা তাদের?”

বুকে যে শ্রাবণ তার পর্ব ৯