মনের কোণে গল্পের লিংক || আফনান লারা

মনের কোণে পর্ব ১
আফনান লারা

ব্যস্ত শহর,ব্যস্ত শহরের অলিগলি সব।এসব আবাসিক এলাকায় তারাই জায়গা করে নিতে পারে যারা এই এলাকারই মানুষ।
কড়া রোদ!মাথার উপর সূর্যটা খিলখিলিয়ে হাসে।তার হাসি কেউ মুখ তুলে দেখছেও না,বরং মাথায় হাত দিয়ে তার হাসি দেখার ভয়ে মুখ ঢাকছে।
সেই দৃশ্য দেখে সূর্য রাগ করে তাপ বাড়িয়ে দিলো।এরপর কেউ একজন চেয়ে বলবে’কেন এত গরম আজ?’
সূর্যের তখন পৈশাচিক আনন্দ হবে।

ঐসব ব্যস্ত অলিগলির একটি গলির কথা বলবো আজ।অনাবিল মেনশন থেকে একটু দূরে একটা ফাঁকা ভ্যানগাড়ি থেমে ছিল অনেকক্ষণ যাবত।চালক মনে হয় গরমে অতিষ্ঠ হয়ে ঠাণ্ডা আখের শরবত খেতে কাছাকাছি কোথাও গেছে।আখের শরবত বানায় একজন আখওয়ালা।আখ মেশিনে চেপে রস বের করে।রসটাকে ঠাণ্ডা রাখতে বিরাট বড় বরফের টুকরা বসিয়ে রেখেছে সামনে।গলাও ভিজবে,পুষ্টিও হবে।
সেই ভ্যানগাড়িটাতে বসে আছে দুজন মানুষ।
একজনের বয়স ২৪/২৫ হবে,আর আরেকজন একেবারেই ছোট।বয়স তার ৬/৭বছর হবে।দুজনে পা দুলাচ্ছে ভ্যানগাড়িতে চড়ে বসে।যিনি বড় তিনি বাচ্চা ছেলেটার গালে একটা করে থাপ্পড় মারছে আর বলছে’কি বললাম মনে থাকবে?’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

বাচ্চাটা চড় খাওয়া গালে হাত দিয়ে মাথা নাড়ছে আর সাথে সাথে ঐ বড় ছেলেটার হাত জড়িয়ে ধরে বলছে,’প্লিজ ভাইয়া যেও না’
পঁচিশ বছরের যুবকের কপাল কুঁচকে গেলো।রাগ হলো সাথে হলো মায়ার প্রস্ফুটন।বাচ্চা ছেলেটার কান টেনে ধরে সে বললো,’দেখো নাহিদ,কতগুলো চড় মারলাম।ভাইয়ার কথা শুনতে হয়।যাও বাসায় ফিরে যাও।আর হ্যাঁ!তুমি বাবাকে ভুলেও বলবেনা আমি কোনদিকে গেছি।ঠিক আছে?’

নাহিদ মুখ বাঁকিয়ে গাল ফুলিয়ে বললো,’না তুমি যেতে পারবেনা।আমি তোমায় যেতে দেবোনা।তোমার হাতের চড় না খেলে পড়ায় মন বসেনা আমার।আমায় সাথে করে নিয়ে যাও না ভাইয়া। দেখো আমি হাতে করে আমার একটা জামা,টুথপেস্ট আর পেন্সিল বক্স ও নিয়েও এসেছি তোমার মত করে।
আমার আর কিছু লাগবেনা বাসার,চলো যাই’
‘রাতের বেলা যে ভূতের ভয়ে আম্মুর রুমে গিয়ে ঘুমাও সেটা??তোমায় নিয়ে গেলে আমার কত সমস্যা হবে জানো??তাহলে কেন বাচ্চামো করতেছো?তুমি দুধের শিশু?ক্লাস ওয়ানের ছেলে দুধের শিশু?’

‘আমি হয়ত দুধের শিশু না,তবে আমি ললিপপের শিশু।ভাইয়া আমায় নিয়ে চলোনা,চলোনা,চলোনা’
নাবিল নামের ছেলেটা ভ্যান থেকে নেমে নিজের জামাকাপড়ভর্তি ব্যাগটা ঘাড়ে তুলে নিয়ে বললো,’আমি তোমায় নিয়ে যেতে পারবোনা,শেষ কথা।বাসায় ফিরে যাও,বাবা এখন অফিস থেকে ফিরবে।’
নাবিল চলে গেলো।নাহিদ ওর ছোট ব্যাগটা নিয়ে নাবিলের পিছু পিছু চললো।নাবিল থেমে পেছনে তাকিয়ে কোমড়ে হাত দিতেই নাহিদ কাঁদো কাঁদো চোখে তাকিয়ে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো নাবিলকে।নাবিল ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে কিছুক্ষণ পর ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বললো,’যে জিনিস আদরে মাথায় ওঠে সেই জিনিসকে আমি বেশি আদর দিই না।তোমায় ও দিচ্ছিনা,কখনও দিই ও নাই তারপরেও তুমি মাথায় উঠে গেছো।আমার হাতে উড়াধুরা মাইর খাওয়ার আগো আমি ১-৩ বলার আগে দৌড় দিয়ে বাসায় চলে যাবে,তা নাহলে মারতে মারতে গেট অবধি দিয়ে আসবো’

নাহিদ ছলছল চোখে তাকিয়ে চলে গেলো বাসার দিকে।নাবিল ও চলে যাওয়া পর্যন্ত তাকিয়ে ছিল।এখান থেকে সে বাড্ডায় যাবে সোজা।সেখানে তার জরুরি একটা কাজ আছে।আজকের পর থেকে সেই জায়গাটি তার বর্তমান থাকার জায়গা।
বাসে উঠে ফোন নিয়ে সিমটা খুলে জানালা দিয়ে ফেলে দিয়েছে নাবিল।মুখে হাসি ফুটিয়ে অন্য একটা সিম ফোনে ঢুকিয়ে নিয়েছে এবার।
বাড্ডার একটা প্রাইভেট আবাসিক ছাত্রাবাসে থাকবে সে এখন থেকে।সব রেডি করতে এক মাসের মতন লেগে গিয়েছিল।

সব চেয়ে বেশি কষ্টকর হয়েছিল বাবা মায়ের পরিবর্তে ভাড়া করা বাবা মা নেওয়া নিয়ে।চাইলেই কি কেউ আসল বাবা মা হতে পারে?তাদের বাবা মায়ের জায়গা দিতে গেলে সব শিখিয়ে নিতে হয়,সেই শেখানো যে কি কঠিন!একটা সময় নাবিলের মনে হয়েছিল ঐ নকল বাবা মাকে ট্রেনিং সেন্টারে ভর্তি করিয়ে দিতে।।
অনেক কষ্টে তাদের শিখিয়ে পড়িয়ে সে অভিভাবকের সাইনটা করিয়ে সেখানে থাকার সব বন্দবস্ত করে তারপর বাসা থেকে পালালো আজ।তার পালানোর কারণ পরে জানা যাবে।
যোহরের আজান দিচ্ছে।ভবনের পাশেই মসজিদ আছে।ওখানে নামাজ পড়ে নিয়ে তারপর ঢুকে যেতে হবে।

‘আমি জুতো খুলিয়া নামাজ পড়তে ঢুকেছিলুম মসজিদে।সন্নিহিত স্থানে আমার জুতোখানা গুছিয়ে রাখিয়াছিলাম।এরপরে নামাজ শেষে এসে দেখি আমার সেই কোমলমতী জুতো জোড়া গায়েব।জিলাপির খোঁজে আমার কোমলমতী জুতো খানা আমি হারাইলাম।আহা দুঃখ,তবে আমার দুঃখ কিঞ্চিত বিলীন হইলো দুটো জিলাপি আর আরেকটা ভাঙ্গা জিলাপি পাইয়া,সর্বমোট আড়াইখানা জিলাপি আমার হাতে হেলছে এবং দুলছে,নাচিয়া নাচিয়া’

‘কবি রামেশচন্দ্র সরি রামিশ ভাই! আপনার কবিতা বন্ধ করিয়া আমায় আমার জুতাটা খুঁজে দিবেন?’
‘তার আগে আমাকে আমার সাধু আর চলিত ভাষা সঠিকভাবে মিশ্রিত করতে সহায়তা করো ভৎস!!’
রামিশের কথায় জুনায়েদ হাসলো।হাসতে হাসতে নিজের জুতা খুঁজতে গিয়ে দেখলো নাবিলকে।সেও তার জুতা খুঁজতেছে।জুনায়েদ ওর দিকে চেয়ে বললো,’কি ভাই এলাকায় নতুন নাকি?’
‘হ্যাঁ,তবে মসজিদে নতুন না।জুতা আরও হারিয়েছি তবে…’
‘তবে?’

‘তবে এই জুতোটা আমার অনেক প্রিয়। আমার বাবা কিনে দিয়েছিল জন্মদিনে।এটা হারালে আমার ভীষণ খারাপ লাগবে’
রামিশ চশমা ঠিক করে বললো,’হারালে কি বলছো ভৎস?হারিয়ে গেছে।মাটি ভেদ করলেও আর পাবেনা।এই এলাকার চোরেরা খুব ডেঞ্জারাস।আমার কোমলমতী জুতাখানা হারাইলাম আমি’
জুনায়েদ কপাল কুঁচকে বললো,’দামি জুতা নাকি?’

‘বাবা দিয়েছে তাই দামি।দাম ৫হাজার হবে।সেটা বিষয় না, স্মৃতি বলেও তো কিছু আছে’
‘আমাদের তো ভাই দুশো তিনশো টাকার জুতা।তবে তোমার যেহেতু স্মৃতির জুতা, তোমায় আমি চোরের খোঁজ দিতে পারি।সিওর না,তবে তুমি গিয়ে দেখে আসতে পারো।ইশ!!গলির নাম ভুলে গিয়েছি।
রামিশ তোর মনে আছে?’

রামিশ তার ধুলোমাখা পাঞ্জাবি ঝেরে চশমাটা টেনে টুনে বললো,’চন্দ্রাহাট চিনো?ওখানে যে বস্তিটা আছে সেখানে গেলে পেতে পারো।কারণ ঐ জায়গায় চোরের আস্তানা অনেক বেশি,তবে সেটা তাদের বাসস্থান কিনা জানিনা।ধারণা দিলাম আর কি।ওখানে চুরি বেশি হয়।দেখো যেটা আছে সেটাও হারিয়ে ফেলোনা’
নাবিল ওদের ধন্যবাদ জানিয়ে চন্দ্রাহাটের দিকে চললো।এখান থেকে দশ মিনিটের পথ।গুগল দেখে হাঁটছে সে।
চন্দ্রাহাটে এসে তার চোখ কপালে।এত মানুষ হয়ত এর আগে সে কখনও দেখেনি।এখানে তো মানুষ উঠিয়ে নিয়ে গেলেও কেউ খেয়াল করবেনা।সবাই ব্যস্ত।

এত ভীড়ের মাঝে নাবিল হা করে চারিদিকটা দেখছে।কই থেকে কই খুঁজবে??
ঠিক সেসময়ে মনে হলো কাঁধের ব্যাগটা টান খাচ্ছে।মনে হলো কেউ কিছু নিচ্ছে নতুবা ছিঁড়ছে।
চোর ছাড়া আর কে হতে পারে ভেবে নাবিল না তাকিয়েই পিছনে ফিরেই ঘুষি মেরে দিলো।যাকে মারলো সে একটি মেয়ে ছিল।ঘুষি খেয়ে নিচে পড়ে গেছে মেয়েটি।গায়ে সাধারণ সেলোয়ার স্যুট।দেখে বোঝা যাবেনা এ চোর হতে পারে।

এত বড় দূর্ঘটনা ঘটে যাবার পরেও ঐ ব্যস্ত জায়গার কেউ ওদের দিকে তাকালোনা।যে যার গন্তব্যে যেতে ব্যস্ত।
নাবিল মেয়েটার হাতের দিকে চেয়ে দেখলো ধারালো ছুরি।
এরপর ব্যাগটা হাতে নিয়ে দেখলো অনেকটা কেটে ফেলেছে এত কম সময়ে।
মেয়েটা নাকে হাত দিয়ে উঠার চেষ্টা করতেই নাবিল আঙ্গুল তুলে বললো,’খবরদার!বসে থাকো।এত বড় মেয়ে হয়ে চুরি করতে লজ্জা করেনা তোমার?’

মেয়েটা এমন ভাবে তাকিয়ে আছে যেন সে ছুরিটা এবার নাবিলকেই মেরে দেবে।নাবিল মেয়েটার কোমড়ে ফুলে থাকা দেখে ভাল করে খেয়াল করে দেখলো ওর জুতার ফিতা ঝুলছে।তার মানে এই সেই চোর যে মসজিদের সামনে থেকে তার জুতা নিয়ে এসেছিল।
সাথে সাথে নাবিল হাত দিয়ে জুতাটা নিয়ে নেওয়া ধরতেই মেয়েটা পিছিয়ে গিয়ে বললো,’খবরদার! আমার গায়ে হাত দেবেন না’

‘আমার জুতাটা ফেরত দাও’
‘ওটা আমার।আপনার কে বললো?’
‘তুমি ছেলেদের জুতা পরো?দাও বলছি?নাহলে আমি কিন্তু!!’
মেয়েটা কিছু বোঝার আগেই নাবিল ওর কোমড় থেকে টান দিয়ে জুতাজোড়া নিয়ে নিলো।মেয়েটা এবার ওর হাত থেকে কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে।নাবিল এদিকে টানছে আর মেয়েটা অন্যদিকে টানছে।
‘দেখে তো চোর মনে হয় না।এসব কে শেখালো?লজ্জা শরম কি কিছুই নাই তোমার?হাত সরাও,আমার কিন্তু মাথা সব সময় চড়গ গাছ হয়ে থাকে।চড় মেরে দেবো’

‘আপনার যে ঘুষি!! খেয়েই বুঝেছি আপনি কি জিনিস,তবে আমি সেই রকমই তৈরি অন্য জিনিস।আমি এটা ছাড়বোনা।এটা নিয়েই ছাড়বো।এই জুতাটা আমার লাগবে।দেড় ঘন্টা সময় নষ্ট করেছি এমন একটা দামী জুতা পাবার লক্ষ্যে।এটা আমি মরে গেলেও হাত ছাড়া করবোনা’

মনের কোণে পর্ব ২

1 COMMENT

Comments are closed.