অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব ১৯

অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব ১৯
ইফা আমহৃদ

“আপনারাই বলেন, এই মেয়েকে অফিসে রাখা উচিত কিনা? যে মেয়ের জন্য আমাদের স্যারকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। তাকে অফিসে রাখার কোনো মানেই হয়না।”
সবাইকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বলল আরু নামক মেয়েটা। সে বর্তমানে অফিসের ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করছেন।‌ ভিড় জমে গেছে আমাকে ঘিরে। আমি হাত মুষ্টিবদ্ধ করে খুকখুক করে কেশে উঠলাম। সবাই আরুর সাথে তাল মিলিয়ে বলল,

“হ। এই অ’সভ্য মেয়েটাকে এখানে রাখা যাবে না। এই মেয়ে ছলচাতুরি করে আমাদের স্যারকে উস্কেছে। এতো দিন ভালোই মনে করছিলাম। কিন্তু বুঝিনি, এর পেটে এতো দূর। কতো ছেলের সাথে থেকেছে হিসেব নেই।”
আমি স্থির। চোখজোড়া মাটির দিকে নিবদ্ধ। তিক্ত কথাগুলো দেহটাকে দহনে ভরিয়ে দিচ্ছে। দেহের লোমকূপ বন্ধ হয়ে গেছে। নিঃশ্বাস ভারী ঠেকছে। অক্সিজেনের মাত্রা কমে গেছে। কথা বলার শক্তি হারিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। আহির সারা একপাশে দাঁড়িয়ে সব শুনছে। কিছু বলতে পারছে না। আমার কাছে এগিয়ে এলো। আমাকে ধরে ধীরে ধীরে বলল,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“কিছু হয়নি জোনাকি।”
আমি মিনমিনে স্বরে বললাম, “ব্যাগের চেইন খুলে দেখ, একটা পেপার আছে। ওটা বের করে পড়ে শোনা সবাইকে।”
কনুইতে চেপে রাখা ব্যাগটা আলগা করে দিলাম। সারা ব্যাগের চেইন খুলে কাগজ বের করে পড়তে লাগল,
“আমি আদ্রিক আহম্মেদ। কিছুদিনের জন্য আমার কোম্পানির যাবতীয় দায়িত্ব জোনাকির নিকট অর্পণ করলাম। আশাকরি, আপনারা আমার মতামতকে গুরুত্ব দিবেন। ধন্যবাদ।”
সবাই একে অপরের মুখের দিকে চাওয়া চাওয়ি করল। আরু কাগজটা ছিনিয়ে নিয়ে চোখ বুলিয়ে নিল। রুদ্ধ কন্ঠে বলল, ” এটা কিছুতেই হতে পারে না।”

আমি কাগজটা নিয়ে দেখার ভান ধরে বললাম, “কী হতে পারি, কী পারে‌ না। বিশ্বাস করবে, কি করবে না। এটা আপনার ব্যাপার। নিচে বাবার সিগনেচার রয়েছে। চাইলে ফোন দিয়েও জানতে পারো।”
বাবা হিসেবে সম্মোধন করাতে সবার চোখ চড়কগাছ। অবিশ্বাসের চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে রৌধিকের কেবিনের দিকে পা বাড়ালাম। আসার আগে বলে এসেছি, সবাইকে কাজ করতে। তাই যে যার কাজে ব্যস্ত। কিন্তু অদ্ভুত লাগছে, আরুর ব্যবহার। রৌধিককে নিয়ে এতো দরদ কেন তার। কেবিনের ভেতরে রৌধিকের আসনটা দেখে বুকে তার অনুপস্থিতি অনুভব করলাম।

তিনি বরাবর এই চেয়ারে বসে ঘুরতেন আর মুখে কলম পুড়ে, সেটা কামড়াতেন। বড্ড ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। আজ দুদিন হয়েছে রৌধিককে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। মিঃ নিহালের অবস্থা শোচনীয়। মাথা ফেটে গেছে। মাথায় আঘাত পাওয়ার কারণে হসপিটালের ইমার্জেন্সিতে এডমিট করা হয়েছে। অনেক প্রয়াস করেও বেইল করাতে পারি না। সকালের দিকে জ্ঞান ফিরেছে মিঃ নিহালের, তাই আজকে বেইল হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে। অফিসের অবস্থায়ও ভালো নয়, তাই আদ্রিক আহম্মেদ আমাকে অফিসের দায়িত্ব দিয়েছেন। তিনি আর মৌমিতা আজকে জর্জ কোর্টে যাবে।
আদ্রিক আহম্মেদ আগেই অনুমান করেছিলেন এমন কিছু হতে পারে, সিগনেচারসহ তিনি লিখিত দিয়েছেন। মন খারাপ হওয়ার সত্বেও অফিসে এসেছি। তারপরে এমন ঝামেলা শুরু করল আরু।

সূর্য ডুবে গেছে অন্তরিক্ষ থেকে। আকাশে বাঁকা চাঁদের ফালি। অফিস ছুটি হয়ে গেছে। সবাই চলে গেছে। অফিসের এতো এতো কাজের কারণে সারাদিন ব্যস্ততায় কেটে গেছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম, নয়টা ছাড়িয়েছে। ফাইলপত্র গুলো গুছিয়ে রেখে উঠে দাঁড়ালাম। নিশ্চয়ই রৌধিকের বেইল হয়েছে। দরজা খুলে পা বাড়াতেই ধাক্কা দিল কেউ। পিছিয়ে গেলাম আমি। আচম্বিতে ধাক্কা দেওয়াতে নিজের ব্যালেঞ্জ হারিয়ে ফেলি। ফ্লোরে ছিটকে পড়ি। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল আরু। বিরক্ত নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ব্যাগ তুলে হাঁটার চেষ্টা করলাম। বাহু টেনে ধরল। এই মুহূর্তে আমি এই মেয়েটির সাথে কথা বলে মুড নষ্ট করতে চাই না। রৌধিককে দেখার তৃষ্ণায় বড্ড কাতর আমি। পেছনে না ফিরে ধীরে ধীরে বললাম,

“সমস্যা কী তোমার? হাত ছাড়ো। আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে।”
দ্বিমুহূর্ত অতিবাহিত হওয়ার পূর্বে হাত ছেড়ে দাঁড়ালো আরু। কপালের পেছনটায় স্লাইড করতে করতে বলল, ” স্যরি। আসলে আমার একা একা ভয় করছে।এই কক্ষটা লক করা বাকি আছে শুধু। তুমি যদি একটু থাকো, তাহলে আমার ভালো লাগছে।”
“ঠিক আছে।” বলে হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে রইলাম। আরু দরজা জানালা। এমনকি ওয়াশরুমের দরজাও লক করে দিল। মোটেও সন্দেহজনক লাগে নি আমার। আরু রিমোট দিয়ে এসির পাওয়ার বাড়িয়ে দিল।‌ হতবাক হলাম আমি। এখন এসি বন্ধ করে দেওয়ার পরিবর্তে পাওয়ার কেন হাই করল। সন্দিহান স্বরে বললাম, ” মিস্ আরু, আপনি হয়তো ভুল করে ইসির পাওয়ার বাড়িয়েছেন। যেটা দিয়ে বাড়িয়েছেন। তার বিপরীত দিকেরটা দিয়ে কমাতে হয়। এবং প্রথমটা দিয়ে অফ করে।”

“আমি জানি মিস্ স্যরি মিসেস জোনাকি। কিন্তু আপনি জানেন না।”
“কী জানি না..
আর কিছু বলার আগেই আরু নামক মেয়েটি বেরিয়ে গেল। হঠাৎ তার আক্রমনে স্থির আমি। এসির পাওয়ার বাড়িয়ে দেওয়ার কারণে শীতলতায় দেহ বরফের আঁকার ধারণ করছে। আমি হাত গুটিয়ে নিলাম। দরজা ধাক্কাতে লাগলাম। মনে হচ্ছে, দরজা বাইরে থেকে বন্ধ। গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিলাম,
“আরু, এটা মোটেও ফাজলামির জিনিস নয়। দরজা খোল। শুনতে পারছ? আরু?”
“রৌধিকের দিকে হাত বাড়ানোর দুর্সাহস দেখিয়েছ তুমি, এখন তার ফলাফর ভুগো।”

বাইরে থেকে আর কারো কোনো শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। এদিকে শীতলতা ক্রমশ বাড়ছে। থরথর করে কাঁপছে আমি। ছুটে জানালা কাছে গেলাম। জানালা খুলতে পারছি না। মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। ওয়াশরুমের দরজাও বন্ধ। মাথায় একটু পানি দিবো, তারও উপায় নেই। হুট করে আরো নিভে গেল। বিদ্যুৎ বিভ্রাট হয়েছে ভেবে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলাম। কিন্তু বিদ্যুৎ বিভ্রাট হয়নি। হলে শুধু আলো কেন নিভে যাবে? ইসিও বন্ধ হয়ে যেত। এদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার অন্যদিকে হাড় কাঁপানো ঠান্ডা। শরীর জমাট বেঁধে যাচ্ছে। বসে পড়লাম নিচে। কাঁতরাতে কাঁতরাতে জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম সেখানে।

বিন্দু বিন্দু জলকণা চোখের উপর পড়তেই নড়েচড়ে উঠলাম আমি। তখনও মাথাটা ঝিমঝিম করছে। শরীর অকেজো। নিভু নিভু চোখজোড়া মেলে তাকাতেই রৌধিকের কাতরতা ছড়ানো মুখমণ্ডল নজরে এলো। আবছা আবছা। দুই দিনে একদম শুকিয়ে গেছে। চোখে মুখে ভাঁজ পড়েছে। মুখের ওয়ান টাইম লাগানো। নিশ্চয়ই তাকে প্রচণ্ড মে’রেছে। জ্ঞানহীনতার মাঝেও বুক কেঁপে উঠল আমার। একেমন অবস্থা হয়েছে তার। আমার শরীরের কম্পন বাড়ছে। রৌধিক আমার গালে হাত রেখে অসহায় কন্ঠে বলে,
“জোনাকি, আমার কথা শুনতে পারছ? আমি রৌধিক। দেখ আমি এসেছি। কথা বলো? কীভাবে হয়েছে এইসব? বলো আমাকে?”

ইসি বন্ধ থাকলেও শরীরের ভেতরের শীতলতায় কাতর আমি। সাথে যুক্ত হলো রৌধিকের স্পর্শ। অতিশয় বেড়ে গেল কম্পন। এই মানুষটিকে দেখার জন্য আমি অধিক আগ্ৰহে প্রহর গুনছিলাম। তার স্পর্শ পাওয়ার জন্য চাতক পাখির ন্যায় হাপিত্যেশ করে ছিলাম। জড়তার মাঝেই অদ্ভুত ক্ষমতা উপলব্ধি করলাম দেহে। টেনে টেনে বললাম,
“আরু, আরু ইচ্ছে করে আমাকে..
আঁটকে রেখেছে। দরজা জানালা বন্ধ করে চলে গেছে। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল জানেন। আমি অনেক ডেকেছি। কিন্তু কেউ আসেনি।”

অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব ১৮

রৌধিক সময় নিল না। আমাকে জড়িয়ে ধরে অজস্র চুমুতে ভরিয়ে দিল। আমার নিস্তেজ হাতটা রৌধিকের পিঠে রাখার চেষ্টা করলাম। কিন্তু ভারী হাতটা শক্তিতে পেরে উঠল না। আপ্রাণ চেষ্টা করে হাতটা রৌধিকের পিঠে রাখলাম। রৌধিকের চোখের অশ্রু গড়িয়ে পড়ল আমার চোখে। একত্রিত হয়ে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল নিচে। আমাকে পাঁজাকোলা করে তুলে হাঁটতে লাগল। আমি ভারী চোখের পাতা নিয়ে নিজের সাথে যুদ্ধ করে তার দিকে তাকিয়ে আছি। আজ তাকে প্রাণ ভরে দেখতে ইচ্ছে করছে। ক্ষমতা শক্তি দুটোই হ্রাস পেতে লাগল। ধীরে ধীরে জ্ঞান হারালাম। ঢলে পড়লাম রৌধিকের বাহুডোরে। অস্ফুট কষ্ঠস্বর শ্রবণ হলো। রৌধিক আমার নাম ধরে ডাকছে। সাড়া দেওয়ার ক্ষমতাটুকু লোপ পেয়েছে আমার। অতঃপর কী হয়েছে, জানা নেই।

অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব ২০