অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব ২০

অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব ২০
ইফা আমহৃদ

গভীর নির্জন রাত। ভারী মাথাটা ধীরে ধীরে হাল্কা হয়ে এলো। শত বাঁধা অগ্রাহ্য করে চোখের পাতা খুলতে সক্ষম হলাম। সর্বপ্রথম নজরে এলো মাথার উপরে থাকা মস্ত সবুজ রঙের সিলিং ফ্যানটা। দেয়ালের রং ধবধবে সাদা। দৃষ্টি সরিয়ে ডানপাশে তাকাতেই দেখলাম স্যালাইন চলছে। প্রায় শেষের দিকে। বুক পর্যন্ত শুভ্র রঙের কাপড় টানা। শরীরটা বড্ড ভারী। ধীরে ধীরে গতরাতের ঘটনা মনে করার প্রয়াস করলাম। ধীরে ধীরে পরিষ্কার হলো সবটা। রৌধিক কী সত্যিই এসেছিল নাকি পুরোটা আমার সাজানো জল্পনা, কল্পনা।

তলপেটের ভেতরে মোচড় দিয়ে উঠল। দাঁত চেপে সহ্য করে নিলাম। ধীরে ধীরে উঠে বসার প্রয়াস করলাম। কিন্তু সম্ভব হলাম না। ওয়াশরুমটা কোনদিকে তাও জানা নেই। আশেপাশে কাউকে দেখতে পেলাম না। ধীরে ধীরে কাউকে ডাকলাম। কিন্তু শব্দগুলো গলায় দলা পাকিয়ে গেছে। অধর জোড়াই একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারছি না। শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। ধীরে ধীরে তলপেটে ব্যাথা প্রকট হতে লাগল। তৎক্ষণাৎ কেউ দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করল। শুভ্র রঙের পোশাক পড়া নার্স এসেছে। আমি স্থির। হাতে মেডিসিনের ট্রে। আমাকে সজাগ দেখে মৃদু হাসলেন তিনি। পাশে বসতে বসতে বললেন,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“বাহ্ পেশেন্টের জ্ঞান ফিরেছে দেখছি। আমাদের তো চিন্তায় ফেলে দিয়েছিলেন। রৌধিক স্যার বাইরে বসে আছেন। আপনার কখন জ্ঞান ফিরবে, জিজ্ঞাসা করতে করতে পা’গল করে দিচ্ছিলেন।”
আমি মুচকি হাসলাম। কিছু বলতে পারলাম না। চোখের ইশারায় ওয়াশরুমের দরজার দিকে অবলোকন করলাম। তিনি বুঝতে পারলেন আমার সমস্যাটা। আমার হাত ধরে ধীরে ধীরে উঠে বসানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু ব্যর্থ হলেন। আমার শরীরের ভার তুলনামূলক বেড়ে গেছে অনেকটা। বড় বড় পা ফেলে বেরিয়ে গেলেন তিনি। মিনিট পাঁচেক অতিবাহিত হওয়ার পর সাথে করে নিয়ে এলেন আরো একজন নার্স। দুইজনে তুলে নিয়ে গেলেন। ওয়াশরুমের দরজার ভেতরে রেখে বেরিয়ে এলেন। স্বাভাবিক স্বরে বললেন,

“দরজা বন্ধ করো না। তুমি জ্ঞান হারিয়ে ফেললে, বের করতে কষ্ট হবে।”
আমি দরজা ভিড়িয়ে রাখলাম। পরবর্তীতে দরজায় নক করতেই ছুটে এলেন তারা। আমাকে ধরে ধরে বেডের কাছে নিয়ে গেলেন। স্যালাইন লাগিয়ে দিলেন। পাশে বসে দু’জনে হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন,
“তুমি বরফের মতো শক্ত এবং লোহার মতো ভারী হয়ে গেছ!”
আরেকজন বললেন, ” হ্যাঁ! সেদিন ঠাণ্ডায় কাঁপছিল। কতো ভারী হয়ে গেছিল, দেখিস নি। রৌধিক স্যার কিভাবে ওনাকে কোলে তুলে নিয়ে এসেছে, ভাবা যায় না।”
“হ্যাঁ। ভালোবাসা আছে, বলতে‌ হবে।”

এদের কথার মাথা মণ্ড বুঝতে পারলাম না। রৌধিক আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে। তারমানে আমার দেখা সেটা কল্পনা ছিল না। রৌধিক ছিল। তিনি সত্যিই আমার সুপারম্যান। সব বিপদ থেকে সুপারম্যানের মতো আমাকে বাঁচিয়ে নেয়। আমি মিনমিনে গলায় বললাম,
“উনি কোথায়? উনি কী বাড়িতে চলে গেছে?”
ওরা নিজেদের দিকে তাকিয়ে আমার দিকে তাকালেন। আমার দিকে তাকিয়ে সন্দিহান গলায় বললেন, ” তুমি কী বলছ, একটু জোরে বলো। শুনতে পারছি না।”
আমি তো যথেষ্ট জোরে বলছি, তাহলে?

আমাকে কিছু না বলে তারাই বিদ্রুপ করে বলল, “পেশেন্ট হয়তো তার উনাকে খুঁজছেন। তাই আস্তে আস্তে লজ্জা পেয়ে কথা বলছে।”
“উনি তো রৌধিক স্যার, তাই তো! দাঁড়া আমি স্যারকে ডেকে আনছি।”
বলেই একজন নার্স রৌধিককে ডাকতে চলে গেল। মিনিট পেরুবার পূর্বেই রৌধিক হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইল আমার মুখের দিকে। দু’জনের চোখজোড়া একত্রিত হলো। পলক ফেলতে ভুলে গেল। নার্স সরে দাঁড়াল। রৌধিক ভেতরে ঢুকল। কাউকে কিছু না বলে হুট করে জড়িয়ে ধরলো আমায়। আকস্মিক ঘটা এই ঘটনার স্তব্ধ আমি। অজস্র চুমুতে ভরিয়ে দিয়েছে আমায়। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,

“কিছু হবে না তোমার। আমি জানতাম কিছু হবে না।”
আমি নির্বিকার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। সন্তর্পণে নিজের বাম হাতটা রৌধিকের পিঠে রেখে বললাম,
“শান্ত হন আপনি। আপনি ঠিকই জানতেন, আমার কিছু হবেনা।”
রৌধিকের পা’গলা’মির পূর্বের তুলনামূলক বেড়ে গেল। আমার কথা তার কর্ণপথে গেল কি-না জানা নেই। মনে হলো না গেছে। কোনো প্রত্যুত্তর করল না। সবাই মিটিমিটি করে হাসছে। আমি পিঠে চপল মা’রলাম! পুনরায় রিনরিনে গলায় বললাম,
“ছাড়ুন। সবাই দেখতে পারছে।”

রৌধিক ছাড়লেন আমায়। গালে হাত রেখে ললাটের মাঝবরাবর অধর ছুয়ে দিয়ে বললেন,
“আমি আসতে দেরি করেছি বলে তুমি আমার সাথে কথা বলবে না। আ’ম স্যরি। কিছু অন্তত বলো।”
কিংকর্তব্যবিমূঢ় হলাম আমি। কি বলছেন রৌধিক। আমি তো তখন থেকেই কথা বলে চলেছি। তিনি কী শুনতে পারছেন না। আমার উপর কী কোন জ্বীন ভর করেছে। কিন্তু তা কি করে সম্ভব? রৌধিক তো আমাকে ছুঁয়ে আছেন। তাহলে জ্বীন ভর করার প্রশ্নই আসেনা।

রৌধিকের পিঠে রাখা হাত সরিয়ে নিজের গলায় রেখে খুকখুক করে কাশি দিলাম। কিন্তু কোনো শব্দ হলো না। গলা স্লাইড করে কথা বলার প্রয়াস করলাম। কিন্তু বৃথা হলো আমার প্রয়াস। গলা থেকে একটি শব্দও বের হলো না। আমি উত্তেজিত হয়ে উঠলাম। সবাই স্তব্ধ। বারবার বলার চেষ্টা করছি, আমি কথা বলতে পারছি না।
স্যালাইনের ক্যানেলে টান অনুভব করলাম। রক্ত উঠে গেল। নার্স এসে টান দিয়ে খুলে ফেলল ক্যানেল। রৌধিক আমাকে পেঁচিয়ে ধরে বলল,

“শান্ত হও জোনাকি। শান্ত হও। এতো হাইপার হয়ো না।
আশ্চর্য, আপনারা এখানে দাঁড়িয়ে কী দেখছেন? যান। ডাক্তারকে ডেকে আনুন।”
তারা দু’জনেই ছুটে গেল। আমি রৌধিকের বুকে চুপটি করে মাথা গুঁজে রইলাম। রৌধিক মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে আমাকে শান্ত করলেন। পানির বোতল বের করে এক ঢোক মুখে দিয়ে বললেন,
“ডাক্তার এক্ষুনি চলে আসবে। তুমি একটু অপেক্ষা করো।”

নার্স ডাক্তারকে নিয়ে ভেতরে ঢুকলেন। রৌধিক আমাকে ছেড়ে দাঁড়ালেন। পরীক্ষা করে বললেন,
” আমি বুঝতে পারছি, তুমি কথা বলতে পারছ না। আর চেষ্টা করো না। দুদিন আগে হসপিটালে ভর্তি করা হয়েছে তোমায়। তখন তোমার ওজন স্বাভাবিক ছিল না, পাঁচ গুণ বেড়ে গেছিল। তোমার পুরো শরীর বরফের চেয়েও ঠাণ্ডা হয়ে গেছিল। গলা শরীরের সাধারণ একটা অঙ্গ। হাল্কা ঠাণ্ডা লাগলেই কথা বলা যায় না। অনেকক্ষণ ঠাণ্ডায় থাকার কারণে তোমার গলা বসে গেছে। কিছুদিন কথা বলতে পারবে না। ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে।
এবার কিছু খেয়ে ঘুমিয়ে পড়। একদম প্রেশার দিও না।”

সবাই চলে গেল। আমি চুপ করে রইলাম। রৌধিক হাসতে হাসতে মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। তার গড়াগড়ি খাওয়ার মানেটা না জানলেও আমার কথা বলতে না পারাকে ঘেরা, সেটা বুঝতে অসুবিধে হলো না। চোখ রাঙালাম।
রৌধিক হেসে আরো‌ গড়াগড়ি খেলেন। হাসতে হাসতে বললেন, ” তো ঝাঁঝের রানী। ফুড়ৎ। সব তেজ হাওয়া। যা হয় ভালোর জন্যই হয়। কিছুদিন কথা বলতে পারবে না।

অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব ১৯

আমি অসহায় চোখে চেয়ে রইলাম। এটা কেমন শাস্তি? এই ছেলেটা আমাকে নিয়ে হাসছে আর আমি কিছুই বলতে পারছি না। নার্স খাবার দিয়ে গেলেন। আমি খাবো না মানে খাবো না। এই ছেলেটা যতক্ষণ পর্যন্ত না স্যরি বলবে, কোন কথা নেই। ধ্যাত আমি তো কথাই বলতে পারি না। খাওয়া বন্ধ।
কিন্তু রৌধিক তা তোয়াক্কা করলেন না। গাল চেপে ঈষৎ ফাঁক করে মুখে পুড়ে দিলে‌ন। রাগান্বিত স্বরে বললেন,
” চুপচাপ খেয়ে কালকে সকালের ভেতরে সুস্থ হয়ে যাও। যে তোমার এই অবস্থা করেছে, তাকে তো শাস্তি পেতে হবে।”

অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব ২১