অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব ২১

অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব ২১
ইফা আমহৃদ

পৃথিবীর সবচেয়ে সুখের জায়গা মায়ের কোল। কিন্তু সেই সৌভাগ্যটা অনেক বছর পূর্বেই হারিয়ে ফেলেছি। তবুও আমি সুখে। মায়ের ভালোবাসাগুলো বাবা পূরণ করে দেওয়ার চেষ্টা করে সর্বক্ষণ।
বাবার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছি আমি। শুধু আমি নই, জয়াও। দু’জনে বাবার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছি। বাবা ছোটবেলার মতো রাজপুত্রের কল্পকাহিনী বলছেন। যখন গল্পের মাঝখানে ছিলেন তখন কেবিনে ঢুকলেন রৌধিক। সাথে দুজন নার্স। তারা আমার সমস্ত জামা কাপড় গুছিয়ে দিচ্ছেন। রৌধিক এগিয়ে এলেন। তার হাতে দুই কাপ চা। বাবার নিকট এক কাপ চা এগিয়ে দিলেন। অন্যকাপ জয়াকে। বাবা তা দেখে বলেন,” কী করছ? তুমি খাবে না?”

“আমি কফি ছাড়া আর কিছু খাই না।”
তুই তো বেডা, করলার রসই খাবি। চা তো মিষ্টি পানীয়। খাবি কীভাবে? তোর গলা দিয়ে নামবে? ঢং!
টুল টেনে সামনের বসলেন। উঠে বসলাম আমি। আমাকে উঠতে বারণ করে বললেন,
“জোনাকি, টেইক রেস্ট। উঠতে হবে না।
বাবা আমি জোনাকিকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে যেতে চাই। আপনার অনুমতি দরকার।”
বাবা একগাল হাসলেন। অফুরন্ত হাসিমাখা মুখ নিয়ে বললেন, ” তোমাদের বাড়ির বউ। তোমার যা ইচ্ছে তাই করতে পারো।”
রৌধিক ওষ্ঠদ্বয় কামড়ে ধরলেন কিয়ৎক্ষণ। কিছু বলার প্রয়াস করেও শব্দ মেলাতে পারছেন না। টেনে টেনে বললেন, ” আমি আপনার ছেলের মতো নই, আপনার একটা ছেলে। আমি আপনার মেয়েসহ আপনার পরিবারের দায়িত্ব নিতে চাই।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

বাবা দ্বিমত পোষণ করলেন। আত্মসম্মানের প্রশ্ন এখানে। রাজি হতে পারছেন না। রৌধিকও নাছোড়বান্দা। বাবাকে অনেক কথা বুঝিয়ে অবশেষে রাজি করলেন। ততক্ষণে আমার জিনিসপত্র গুছিয়ে দিয়েছেন নার্সরা। ড্রাইভারও চলে এসেছেন ব্যাগপত্র নিতে। রৌধিক মালপত্র ড্রাইভারের হাতে দিয়ে বললেন,
“বাবা আর জয়াকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে এইগুলো বাড়িতে রেখে আসবেন।”
ড্রাইভার যেতেই রৌধিক বাবাকে আলিঙ্গন করলেন। জয়াকে এক বক্স চকলেট উপহার দিল। জয়া আকাশের চন্দ্রটা হাতে পেল এমন উচ্ছাস প্রকাশ করল। আমি নামতে নিলে রৌধিক থামিয়ে দিলেন। হুট করে কোলে তুলে হাঁটা দিলেন। গলায় স্বর নত। তবুও মুখ ফুলিয়ে বিনা শব্দে শুধালাম,
“নামান আমাকে। আমি হাঁটতে পারবো!”

“আমি জানি তুমি হাঁটতে পারবে।‌ পারলে কথা বলে দেখাও। দেখি কত পারো? পারবে কী?”
থেমে গেলাম আমি। রৌধিকের মুখের দিকে বিনা বাধায় চেয়ে আছি। অগোছালো চুলগুলোর মাঝে ঝাপসা রোদ চিকচিক করছে মুখে। নীলাভ রঙের তিলটা জ্বলজ্বল করলে লালচে হয়। এই প্রথম নয়, আমি তার কাছাকাছি। তবুও একেক সময়ে একেক রকমের দেখতে লাগে। আমি কী সাধে তাকে গিরগিটি বলি।‌ এরজন্যই তো বলি। তিনি গিরগিটির খালাত ভাই। হি! হি! হি!

আলাদা গাড়িতে করে আমি আর রৌধিক বেরিয়ে এলাম। গাড়ি এসে থামালেন অফিসের সামনে। আমি বাড়ি মনে করে, বাইরে একনজর তাকালাম। কিন্তু সাইনবোর্ডে লেখা দেখে বুঝলাম। বাকহীন আমি রৌধিকের মুখের দিকে উত্তরের আশায় চেয়ে রইলাম। রৌধিক পুনরায় কোলে তুলে নিলেন। শব্দ করে পা ফেলতে ফেলতে বললেন, ” আমার ছোট একটা কাজ বাকি আছে, সেটা করতে হবে।”

আমাদের এভাবে দেখে সবাই কাজ রেখে তাকিয়ে আছে। আমি লজ্জায় রৌধিকের বুকে মাথা গুঁজে আছি। আরু কফি খাচ্ছে আর কাজের তদারকি করছে। রৌধিক আমাকে নিয়ে দাঁড় করালেন তার সামনে। আরু কফি অধরের সাথে চেপে আছে। হাতে নিতে ভুলে গেছে। অসাবধানতায় ছ্যাঁকা খেল সে। রৌধিক সময় নিল না।‌ কফির মগটা নিজের হাতে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলল আরুর মুখে। গরম কফির কারণে মুহূর্তেই লালচে হয়ে গেছে। চোখজোড়াও টলটল। পিছিয়ে গেল দুই’পা। মুখে হাত দিয়ে আহ্ করে জোরে চিৎকার দিয়ে উঠল। সবাই হতভম্ব। চিৎকার করে পানি আনতে বলছে। স্টার্ফরা পানি নিয়ে ছুটে এলো। আরুর হাতে দেওয়ার পূর্বে হাতের ইশারায় রৌধিক থামিয়ে দিল। আঙুল মুষ্টিবদ্ধ করে তর্জনী দিয়ে না বোধক বোঝালেন। স্টার্ফরা পিছিয়ে গেল। রুদ্ধ কন্ঠে বললেন,

“একদম না। এক পা সামনে আগাবেন না কেউ।”
রৌধিক ক্ষিপ্ত হয়ে গেছে। আমি গুটিসুটি হয়ে পশ্চাৎ লুকিয়ে রইলাম। রৌধিক আমাকে বাহুডোরে আবদ্ধ করে নিলেন। আঙুল তুলে বললেন,
“সাহস হয় কী করে তোমার, আমার ওয়াইফকে বন্ধ করে রাখার।‌ আর আপনারা সত্যিটা না জেনে ওকে বা’জে কথা কেন বলেছেন? হোয়াই? সি ইজ মাই ওয়াইফ। আমার এই অফিসে জয়েন করার আগেই এই মেয়েটির সাথে বিয়ে হয়েছে এবং সর্বদা যাতে তাকে দুচোখ ভরে দেখতে পারি তাই অফিসে আসা। যদি আমার সেই জানের সাথে কেউ খারাপ বিহেবিয়ার করে আপনাদের কী মনে হয়, আমি চুপ করে থাকব?
সবাই রৌধিকের কথায় সায় দিল। রৌধিক পুনরায় বলতে লাগলেন,

“তাহলে আশা করি বুঝতে পেরেছেন।
আর এই মেয়েটা (আরুকে উদ্দেশ্য করে) জোনাকিকে মে’রে ফেলার চেষ্টা করেছে। এসির পাওয়ার হাই করে দরজা জানালা বন্ধ করে দিয়েছে। ও কী জানত না, জোনাকি আমার ওয়াইফ?”
সবাই হতভম্ব। অসন্তুষ্ট চোখে তাকিয়ে আছে আরুর দিকে। আরু তাকানোর স্পর্ধা নেই। তবুও সহানুভূতি অর্জন করতে চেপে চেপে বলে,

“ইয়েজ। আই নো। হু আর সি! জোনাকি ইউর ওয়াইফ। আই ওয়ান্টেড টু কিল হার, দ্যান টক টু জোনাকি।”
আরুর প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি বাকহীন। স্থির। শব্দ নেই কন্ঠে। কিছু বলার দৌবল্য নেই। আমাকে প্রশ্নের জবাব দিতে না দেখে ক্ষিপ্ত হল সে। বসার উপযোগী চেয়ারটা ছুড়ে ফেলল পায়ের কাছে। তৎক্ষণাৎ পিছিয়ে গেলাম আমি। পায়ের উপরে পড়লে ভেঙেই যেন পায়ের পাতা। এতোবড় বিপদ থেকে বেঁচে গিয়েও বড় বিপদে পড়তে হতো আমাকে। রৌধিক সময় নিল না। কিছু বলার প্রয়াস করার পূর্বেই অবিলম্বে বিকট শব্দে চড় বসিয়ে দিল আরুর গালে। আরুর বাহু টেনে ধাক্কা দিয়ে ছুড়ে ফেলল মেঝেতে। স্টার্ফদের পানি নিয়ে আসতে বললেন। পানি দিয়ে হাত ধুয়ে টিসু দিয়ে হাত মুছল। এমন ভাবে বিহেবিয়ার করল, যেন তার হাতটা খোয়া গেছে। ছুঁয়ে বড় অন্যায়ের ভাগীদার হয়েছে সে। রাগান্বিত স্বরে বললেন,

“একটাও কথা বলবে না তুমি। একটাও নয়। তুমি জানো, জোনাকি কথা বলতে পারে না। তাই ওকে ইউস করার চেষ্টা করছ।
নেক্সাস টাইম তোমাকে আমার আশেপাশে যাতে না দেখি, মাইণ্ড ইট। আমার কোম্পানির সম্মানের কথা ভেবে আপনাকে পুলিশে দিলাম না। তবে আপনি যাতে অন্য কোথাও চাকরি না পান, সেই ব্যবস্থা করব। আউট..
দৌবল্য চরণে প্রস্থান করল সে। রৌধিক সবাইকে নিজেদের কাজে মনোনিবেশ করার নির্দেশ দেয়। অতঃপর নিজের কেবিনে যায়। আমিও তার পিছুপিছু কেবিনে গেলাম। রৌধিক ওয়াশরুমে গেছে। আমি টেবিলের উপরে বসে পা দুলাচ্ছি। মানুষটা বড়ই অদ্ভুত। ভিন্ন! আলাদা সে। দ্বার খুলে ভেতরে ঢুকলেন তিনি। পড়নের জামা পাল্টে নিয়েছেন। মুক্তার ন্যায় জ্বলজ্বল করছে বিন্দু বিন্দু জলকণা। নিজের চেয়ারে বসলেন। একহাত গালে দিয়ে অটল নেত্র যুগলের সহায়তায় চেয়ে রইলেন। প্রানোজ্জল।

“কবে তুমি শব্দ করে হাসবে? তোমার বাচ্চা বাচ্চা অট্টহাসিতে আমার হৃদয়ে শীতল ছোঁয়ার পরশ পাবে! আমি তৃষ্ণার্ত। তোমার হাসিতে মাতানো শব্দগুলো শোনার তীব্র আকাঙ্ক্ষা আমাকে ছেড়ে যাবে।”
“তখন তো দিব্যি আরুকে ছুঁয়ে ছিলেন?”
“আর জন্যই তো ড্রেস চেঞ্জ করেছি, হাত পা ঘসে ঘসে পরিষ্কার করেছি।”
আমি অবুঝ। বোধগম্য হলো না কথার মানে। ভ্রু যুগল ঈষৎ উঁচু করে তুললাম। রৌধিক প্রত্যুত্তর করলেন না। হাত টেনে কোলের উপর বসিয়ে দিলেন। টাল সামলানোর পূর্বেই আমি তার দখলে। গলায় পেঁচিয়ে রাখা মাফলার আরেকটু পেঁচিয়ে দিয়ে বললেন,
“তো কী খাবেন মেডাম, চা না কফি?”

মাথা দুলিয়ে না বোধক বুঝালাম আমি। রৌধিক তোয়াক্কা করলেন না। দুই কাপ চা আনতে বললেন। আদা চা। কথা বলতে না পেরে মুখ ফুলিয়ে বসে রইলাম। তিনি আমার রাগ ভাঙাতে ভেজা গালটা আমার গালের সাথে চেপে ধরল। চমকে উঠলাম আমি। গাল ঘুরিয়ে তাকানোর প্রয়াস করতেই দৃঢ় করে চেপে ধরলেন।‌ নরম, কোমল, তুলতুলে গাল ভেদ করে ভেতরে ঢুকে গেল তার খোঁচা খোঁচা দাড়ি। দাড়ির সাথে লেপ্টে থাকা পানিগুলোতে কম্পন সৃষ্টি হলো আমার। ঈষৎ ফাঁক হয়ে গেল ওষ্ঠদ্বয়। তাকে সরানোর প্রয়াস করলাম। কিন্তু রৌধিক হাতটাও নিজের আয়ত্তে নিয়ে নিল। দুঃখ, অভিযোগে কপাল কুঁচকে গেল আমার। অটুট তার হাত। রৌধিক অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন। কপালের সাথে কপাল ঠেকিয়ে বললেন,

অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব ২০

“ফুস। ক্ষমতা শেষ। তোমার দৌড় কতোদূর আমার জানা আছে। তাই চুপচাপ বসে থাকো, নাহলে এবার মরিচের গুঁড়ো দাঁড়ির সাথে মিলিয়ে একদম গুঁতা দিবো।”

অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব ২২