অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব ২২

অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব ২২
ইফা আমহৃদ

আঁধারে আবৃত শহর। নিভু নিভু আলো জ্বলছে। মস্ত চাঁদের জ্যোৎস্না। যাকে বলে জ্যোৎস্নাময় রাত্রি। তারাস্তীর্ণ অন্তরিক্ষ। বেলকেনির রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছি। রাত দশটা ছাড়িয়েছে। বিদ্যুৎ নেই ঘণ্টা খানেক। সহসা হৃৎপিণ্ড কাঁপানো শব্দে বিষ্ফোরণ হয়। তৎক্ষণাৎ আঁধারে মিলিয়ে যায় সবকিছু। আজ রাতে বিদ্যুৎ আসবে কি-না জানা নেই। সারাদিন উত্তপ্ত পৃথিবী। রাতের বেলায়ও উত্তপ্ত। বর্ষণের পূর্বাভাস। বর্ষণমন্দ্রিত শ্রবণ করার অপেক্ষায় বসে আছি। মাঝখানে কেটে গেছে চারদিন। একটু কথা বলতে পারি আমি। কর্ণপথে এসে হানা দিল পায়ের শব্দ। আমি পিছু ফিরলাম।

মানুষটিকে দেখার প্রয়াস পূর্বেই পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল কেউ। সেকেন্ড খানেকের জন্য মনে হলো, বিদ্যুৎ ফিরে এসেছে। তার স্পর্শে প্রতিবারই বিদ্যুতের মতো শর্ক খাই আমি। রৌধিক এসেছে। নড়াচড়া করলাম না আমি। রৌধিক কাঁধে মুখ গুঁজে দিল। তার মুখের ঘামগুলো আমার কাঁধে লেপ্টে গেল। উষ্ণ গরম লবণাক্ত জলকণা। এক সেকেন্ডের জন্য মনে হলো, যদি তাকে সুইচ বোর্ডের সাথে মিশিয়ে দেই তাহলে বিদ্যুৎ চলে আসবে। তাকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে ফিরলাম আমি। রৌধিক আমার কাঁধে দুইহাত রেখে নিচু হলো। আমি নিজের গায়ের ওড়নাটা খুলে তার নামগুলো মুছে দিলাম। তিনি ওড়নাটা নিজের গলায় পেঁচিয়ে নিলেন। তৎক্ষণাৎ ফোন বেজে উঠল। রৌধিক ওড়না না দিয়ে ঘরে চলে গেলেন। মোজা খুলতে খুলতে কথা বলছেন। মায়া লাগল আমার। ক্রমাগত গরমে ঘামছেন তিনি। আমি নিচে নেমে গেলাম। একগ্লাস শরবত বানিয়ে উপরে চলে এলাম। পড়ার টেবিল থেকে বই এনে হাওয়া করতে লাগলাম। রৌধিক জামা কাপড় না ছেড়েই বেডের উপর শুয়ে পড়লেন। কান থেকে কিছুটা দূরে ফোন নিয়ে ফিসফিস করে বলল,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“আজকে কত তারিখ?”
” ৩১ মার্চ।”
“কী বার?”
“বৃহস্পতিবার। এখন কী সালটাও জিজ্ঞাসা করবেন?”
রৌধিক প্রত্যুত্তর করলেন না। কাবার্ড থেকে নিজের প্রয়োজনীয় জামাকাপড় গুলো নিয়ে বললেন,
“আমি আদ্রিতার ওয়াশরুমে যাচ্ছি। দশ মিনিট সময় দিলাম, তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও। বার্থডে তে যাবো। ফাস্ট।”
“মানে?”
রৌধিক হাই তুললেন। আমার হাত থেকে শরবতের গ্লাস নিয়ে এক ঢোকে অর্ধেকটা শেষ করে হাতে ধরিয়ে দিলেন। বাকিটা আমাকে খেতে বলে তিনি চলে গেলেন। আমি বেডের উপর বসলাম। পুরোটা শেষ করে টেবিলের উপর রাখলাম।‌ কী বলে গেলেন তিনি? এখন বার্থডেতে যাবো।

আমি গভীর ভাবনায় লিপ্ত হয়ে স্থির হয়ে বসে রইলাম। দশ মিনিট ফুরিয়ে গেল কিন্তু আমার ভাবনা মস্তিষ্ক থেকে সরল না। রৌধিক ফিরে এলো। কালো পাঞ্জাবি পড়নে। তাকে দেখেই টাস্কি খেলাম আমি। চোখ কপালে। চোখ ঢলে পরিস্কার করে পুনরায় তাকালাম। না তিনি রৌধিকই। অনেক বেশি কিউট লাগছে তাকে। পার্টিতে অনেক মেয়েরা যাবে, তাই তিনি এতো সেজেছেন। নিশ্চয়ই তাই। আমি ভ্রু যুগল ঈষৎ উঁচু করলাম। কই বাড়িতে থাকতে তো এমন করে সাজে না। আমি কি মেয়ে না? ধ্যান ভাঙল আমার। ফট করে উঠে কাবার্ড খুঁজতে লাগলাম। কালো রঙের একটা শাড়ি খুঁজছি। একদম রৌধিকের সাথে মিলিয়ে। রৌধিক ফিরে এলেন। হাতে তার মোমবাতি। ড্রেসিং টেবিলের উপর গলিত মোম রাখলেন। তার উপরে ফিট করে দিলেন মোমবাতি। চুলগুলো মুছতে মুছতে বললেন,
“এখনো চেঞ্জই করতে পারো নি? তোমাকে আর চেঞ্জ করতে হবে না। যেতে হবে না। ঘুমিয়ে পড়। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।”

আমি থেমে গেলাম। নাক ফুলিয়ে রইলাম। রৌধিক আমাকে না নিয়ে একা একা পার্টিতে যাচ্ছে। আমার সন্দেহটাই ঠিক। রাগ দেখিয়ে কাবার্ডের জামা কাপড়গুলো ফেলে দিলাম নিচে। রৌধিক বিষ্ময়িত চোখে তাকাল। আমাকে পাশে দাঁড় করিয়ে একটা গাঢ় সবুজ রঙের শাড়ি বের করে হাতে ধরিয়ে দিলেন। হাত জোর করে টেনে টেনে বললেন,
“যাও। চেঞ্জ করে আসো।”
আমি তার পাঞ্জাবীর কলার টেনে বললাম, ” আপনারটা কালো হলে আমি কেন সবুজ পড়ব? কেন?”
“কালো শাড়ি নেই।”
“তাহলে আপনি এটা চেঞ্জ করে সবুজ রঙের টা পড়বেন।”

আমার হাত ছেড়ে পাঞ্জাবি ঠিক করতে করতে বললেন, ” সারাদিন ড্রেস চেঞ্জ করতে পারব না। ইচ্ছে হলে এটা পড়। নাহলে যাও। পড়তে হবে না। যেতেও হবে না।”
আমি মুখ ভার করে রইলাম। ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়াতে গিয়েও থেমে গেলাম। তৎক্ষণাৎ আদ্রিতা হাজির হলো। শাড়ির কুচি ঠিক করতে করতে প্রবেশ করল। না তাকিয়েই বলল,
“জোনাকি, আমার কুচিগুলো একটু ঠিক করে দে তো!”
ওয়াশরুমে না ঢুকে দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে বললাম, “আদ্রিতা তুমি।”
“হ্যাঁ তো! ভাইয়া তার বন্ধুর বার্থডেতে নিয়ে যাচ্ছে। কতো করে বললাম, যাবো না। কে শোনো এখন আমার কথা। আমাকে ধমকে ঘুম থেকে উঠিয়েছে। ভালো লাগে না।”

ভেতরে ভেতরে ফুঁসতে ফুঁসতে আগ্নেয়গিরির লাভার মতো রুপ ধারণ করলাম। আদ্রিতাকে কেন নিচ্ছে? যাতে আমি আদ্রিতার সাথে ব্যস্ত থাকি আর তিনি মেয়েদের সাথে পার্টিতে ইনজয় করতে পারে। মোমবাতির হলদেটে আলোয় আমার মুখটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। পা টিপে টিপে আদ্রিতার কাছে গেলাম। হাঁটু মুড়ে বসে কুচিগুলো ঠিক করে দিলাম। আদ্রিতা চলে গেল। আমি সবুজ শাড়িটা কাবার্ডে রেখে বেডের এককোণে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। গরমের মাঝেও কাঁথা মুড়ি দিলাম। যাবো না আমি পার্টিতে। কেঁদে দিলাম আমি। নাকের জলে চোখের জলে একাকার অবস্থা।

রৌধিক নিজের কাজে এতোটাই ব্যস্ত ছিল আমাকে খেয়াল করে নি। হুট করে আমাকে দেখতে‌ না পেয়ে বেশ কয়েকটা ডাক দিলেন। একদম সাড়া দিলাম না আমি। খুঁজুক তিনি। খুঁজতে খুঁজতে সময় চলে যাক। তিনি যাতে আমাকে খুঁজে না পায়। আমিও তার সামনে যাবো না। যাবো না মানে যাবো না।
কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি ওঠে গেছে আমার। হেঁচকির শব্দে রৌধিক আমায় খুঁজে পেলেন। কাঁথা সরানোর প্রয়াস করলেন। আমি খামচে ধরে রইলাম যাতে কিছুতেই তিনি কাঁথা সরাতে না পারে।
তার পুরুষালি শক্তির কাছে আমার শক্তি তুচ্ছ। কাঁথা সরিয়ে টেনে বসিয়ে দিলেন আমায়। সহজ স্বরে বললেন,
“কী হয়েছে তোমার? আ’ম স্যরি। তোমার সাথে ওভাবে কথা বলা ঠিক হয়নি। আমিই বা কী করব? অফিস থেকে এসেই যেতে হচ্ছে। একটু বিরক্ত তো লাগছেই!”

ফুঁপিয়ে কেঁদে দিলাম আমি। তিনি তো ঠিকই বলছেন। রৌধিক পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে স্বল্প রাগান্বিত স্বরে বললেন, ” আবার কী?”
“আপনি আদ্রিতাকে কেন নিচ্ছিস আমাদের মাঝে। নিশ্চয়ই আমার জন্য। আমি আদ্রিতার সাথে বসে থাকব আর আপনি বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিবেন?”
রৌধিক একগাল হাসলেন। বামগালে টোল পড়ল। মাতাল করা মুগ্ধকর সেই হাসির রেশ। আমি জন্ম জন্মান্তর এই হাসির জন্য দিন রাত পার করে দিতে পারি।
“ইভু আসছে। হসপিটালের চাপে আদ্রিতাকে সময় দিতে পারে না। আদ্রিতা তাই রাগ করে নিজের একাউন্ট থেকে ইভুকে ব্লক করে দিয়েছে। ফোন দিলে রিসিভ করছে না, কথা বলছে না। যাকে বলে এড়িয়ে চলা। তার রাগ ভাঙানোর জন্য ইভু আসবে। তাই ওকে নিচ্ছি। এক মুহুর্তের জন্যও তোমার হাত ছাড়ছি না আমি। যাও! এবার তৈরি হয়ে নাও।”

অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব ২১

বলেই রৌধিক উঠে দাঁড়ালেন। ফোন নিয়ে গেমস খেলতে বসলেন আসন পেতে। আমি নিজের মাথায় চপল মা’রলা’ম। তুই সত্যি একটা অপদার্থ জোনাকি। গাধা। কি ভাবল রৌধিক তোকে। হ্যাংলা কোথাকার। নিশ্চয়ই ভাবছে, আমি তাকে নিয়ে জেলাস। তার বোনটাকেও সহ্য করতে পারি না।
জোনাকি এখনো সময় আছে, অপদার্থ থেকে পদার্থ হ। নাহলে এই রৌধিকটা, জোনাকি নামের ওই অবুঝ বাচ্চাটাকে গাধা ভেবে হাঁটে বিক্রি করতে উঠে পড়ে লাগবে।
যেহুতু যেতেই হবে, সময় অপচয় ঠেকাতে আমি তৈরি হয়ে নিলাম। অতঃপর বেরিয়ে এলাম বাড়ি থেকে।

অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব ২৩