অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব ২৩

অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব ২৩
ইফা আমহৃদ

পরিবেশ টা কোলাহল পূর্ণ। আমি অনুষ্ঠানের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছি। এদিক ওদিক তাকিয়ে লোকজনের আনাগোনা দেখছি। ইভু এসেছে। আদ্রিতা ইভুর সাথে নিরিবিলি জায়গা বলে গল্প করছে। ইভুর গাড়িতেই আমরা এসেছি। প্রথমে তো আদ্রিতা কিছুতেই কথা বলবে না, কিন্তু ইভুর কাছে হেরে গেছে। অনেক কষ্ট করে রাগ ভাঙিয়েছে তার। আমার থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে রৌধিক। আজ তার বান্ধবীর জন্মদিন। অথচ আমায় বলেছে, তার বন্ধু। আচ্ছা, রৌধিক তো আমাকে বলেনি। বলেছে আদ্রিতা। আদ্রিতা কী মিথ্যা বলছে, না-কি রৌধিক এটা বলতে বলেছে।

কী আদ্যিক্ষেতা। আমার অনুমতি না নিয়েই টানতে টানতে নিয়ে গেছে রৌধিককে। বিরক্ত লাগছে আমার। বাড়িতে থাকলে এতোক্ষণে ঘুমের দেশে পাড়ি জমাতাম। মুখ ভার করে রইলাম। ওয়েটারকে ট্রে নিয়ে যেতে দেখে ডাক দিলাম। একগ্লাস সফ্ট ডিঙ্ক নিয়ে খাওয়ার চেষ্টা করলাম। দেয়ার ঘড়ির কাঁটা তখন কাঁটায় কাঁটায় বারোটা। একটু জোরে ঢং ঢং করে বেজে উঠে। আমি হকচকিয়ে গেলাম। গ্লাসের কিছুটা আমার শাড়ির উপরে পড়ল। আমি চিন্তিত হয়ে পড়লাম। ডানপাশে তাকালে রৌধিককে দেখা গেল না। আদ্রিতা ইভুও নেই। সবাই নিজ নিজ কাছে ব্যস্ত। কেক কাটার সময় হয়ে গেছে। বারোটা একে কাটবে। সবাই তোড়জোড় করতে ব্যস্ত। ধীরে ধীরে আঠালো হয়ে আসছে শাড়ি। একজন মেয়ের কাছ থেকে ওয়াশরুম কোনদিকে জেনে নিলাম। অতঃপর পা টিপে টিপে সেদিকে গেলাম।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ফাঁকা হয়ে গেছে আশপাশ। শাড়ির আঠালো অংশ ধুয়ে বেরিয়ে এলাম। বিপত্তি বাধল অন্যজায়গায়। প্রায় অর্ধেকটাই ভিজিয়ে ফেলেছি। ভিড় ভাট্টার দিকে আর পা বাড়ালাম না। উল্টো দিকে হাঁটা দিলাম। পাশেই সিঁড়ি পেয়ে গেলাম। সিঁড়ি বেয়ে ছাদে গিয়ে দাঁড়ালাম। প্রচণ্ড দক্ষিণা হাওয়া বইছে। মনে হচ্ছে এই বুঝি উড়িয়ে নিয়ে গেল। লোমকূপ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে গেছে। এককোণে রিলিয়ের উপর গিয়ে বসলাম। এদিকটায় কেউ নেই বিধেয় মন মেজাজ একদম ফুড়ফুড়ে। দূরে অস্পষ্ট নদী দেখা যাচ্ছে। ছোট নদী হওয়াতে নৌকা চলাচল করে শুধু। নিভু নিভু আলো জ্বলছে। এভাবে কেটে গেল কিছু সময়। নিচে যেতে ইচ্ছে করছে না। তাই নিচে বসে পড়লাম। রেলিং এ মাথা ঠেকিয়ে দিলাম। ঘুম ঘুম আসছে। ধীরে ধীরে তলিয়ে গেলাম অতল নিদ্রায়। জানা নেই, কতক্ষণ এভাবে ঘুমিয়ে ছিলাম।

ঘুম ভাঙল হাতে টান পড়াতে। হাত ধরে টেনে ফেলে দিল মাটিতে। অকস্মাৎ ঘটা ঘটনায় আমি হতভম্ব। ঘুমের রেশ কাটতে কাটতেও বেগ পেতে হলো আমাকে। কনুয়ে বেশ কিছুটা ছিলে গেছে। জ্বলছে প্রচুর। আমার সামনে রৌধিক দাঁড়িয়ে আছে। ক্ষিপ্ত তার দৃষ্টি। মাথার উপর খোলা আকাশ দেখতেই বোধগম্য হলো ব্যাপারটা। উঠে বসার চেষ্টা করতেই হাঁটুতে টান পড়লো। চাপা আর্তনাদ করে উঠলাম। জায়গাটাও প্রচুর জ্বলছে। তবুও দাঁতে দাঁত চেপে উঠে বসার চেষ্টা করলাম। কি বলব খুঁজে পেলাম না।
“শুনছেন..

বাক্য শেষ করার আগেই গাল কাঁপিয়ে চড় পড়ল। পুড়ে উঠলো জায়গাটা। গালটা ডানদিকে ঘুড়ে গেল। আপনাআপনি হাত গিয়ে ঠেকলো বামগালে। আহ্ করে উঠলাম। বাকশক্তি হারিয়ে গেল। চোখের কোণে অশ্রু চিকচিক করছে। এই বুঝি, গড়িয়ে পড়লো। রৌধিক আমার বাহু ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকতে বলল,
“শান্তি পেয়েছ তুমি? প্রাণটা জুড়িয়েছে? কেন‌ এখানে এসেছ, আমাকে শাস্তি দিতে। মানছি, আমি আমার কথা রাখি নি। বন্ধুদের সাথে একটু ব্যস্ত হয়ে গেছিলাম। তাই বলে তুমি এখানে এসে ঘুমিয়ে থাকবে? হ্যাভ অ্যানি আইডিয়া, কতোটায় ভয় পেয়েছিলাম?”

রৌধিক আমাকে ছেড়ে উল্টো ঘুরে ঘনঘন শ্বাস নিচ্ছে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে, কতোটা রেগে আছে। অনুসূচনা হলো আমার। ঠিকই তো! কেন চলে এলাম এখানে? আমারও তো প্রচণ্ড রাগ লাগছিল। পার্টিতে এনে দাঁড় করিয়ে রেখেছে।
তিনিই বা কি করতেন? বার্থডে পার্টিতে মানুষ আসে কেন? একটু আড্ডা দিতে, বন্ধুদের সাথে আনন্দ করতে। তিনি যখন আমাকে বলেছিলে, যাওয়ার দরকার নেই। তখনই আমার আসা উচিত হয়নি। আমাকে খুঁজতে খুঁজতেই হয়তো পুরোটা সময় কেটে গেছে। আ’ম স্যরি রৌধিক। রিয়েলি স্যরি। কিছু বলার ক্ষমতা নেই। তবুও বিরবির করে শুধালাম,
“শুনছেন?”

“একদম চুপ। একটাও শব্দ মুখ থেকে যাতে বের না-হয়। মাথা নিচু করে চুপচাপ গাড়িতে গিয়ে বসবে। আমার মন মেজাজ ভালো নেই, একটা শব্দ করলে আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না। আউট!”
আমি মাথা নিচু করে শাড়ির আঁচল টেনে চলে এলাম। চুপচাপ গাড়ির কাছে গেলাম। আমাকে দেখে আদ্রিতা নেমে এলো। উত্তেজিত হয়ে বলল,
“কোথায় গিয়েছিলিস তুই? জানিস তোকে খুঁজতে খুঁজতে ভাইয়ার কী অবস্থা হয়েছিল।”
“ইভু ভাইয়া, আপনি একটু সামনের সিটে বসবেন। প্লীজ।”
আদ্রিতা আর ইভু নিজেদের মধ্যে চাওয়াচাওয়ি করে গাড়ি থেকে নেমে ফ্রন্ট সিটে বসল। আমি পেছনে বসতেই রৌধিক এসে উপস্থিত হলো। ডাইভিং সিটে বসে কঠিন ভাষায় বললেন,

“ঢং না করে সামনে এসো।”
চোখের পানিটুকু মুছে নিলাম। আমি ঢং করছি, এটা রৌধিক বলতে পারল। আমি যাবো না। কিছুতেই যাবো।
রৌধিক লুকিং গ্লাসে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
“দশ সেকেন্ড সময় দিলাম। এর ভেতরে না আসলে হাত ধরে টেনে গাড়ি থেকে বের করে দিবো। এখানে ফেলেই চলে যাবো।”
আমি প্রত্যুত্তর করলাম না। ধীরে ধীরে নেমে রৌধিকের পাশে গিয়ে বসলাম। রৌধিক আমার দিকে তাকায় নি। আমি বসতেই ড্রাইভ করতে লাগলেন।

অনেকক্ষণ না খাওয়াতে মাথা ঝিমঝিম করছে। হাঁটু, হাতের কনুই জ্বলছে। সাথে যুক্ত হয়েছে গাড়ির ঝাঁকুনি। কান্নার ফলে চোখে ঝাঁপসা দেখছি। সিট বেল্ট না লাগানোর ফলে শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখতে ব্যর্থ হচ্ছি। অসাবধানতায় রৌধিকের হাতের উপর হাত রাখল। রৌধিক হাতের দিকে না চেয়েই হাতটা ছুঁড়ে ফেললেন।
গাড়ি যত চলছে তত অস্বস্তি বেড়েই চলেছে আমার। আমি নিশ্চুপ। স্তব্ধ। মাথাটা রৌধিকের কাঁধে রাখলাম। তিনি আমাকে তোয়াক্কা করলেন না। ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলেন। মাথা গিয়ে ঠেকল গাড়ির সাথে। ভন ভন করে উঠলো। ব্যাথাটা চাড়া দিয়ে উঠল। গাঁ গুলিয়ে এলো। তট জলদি গাড়ির কাঁচ খুললাম। কাঁচের ফাঁক দিয়ে মুখ হেলিয়ে দিতেই বমি করে দিলাম। গাড়ি তখন চলন্ত। আদ্রিতা চিৎকার করে গাড়ি থামাতে বলল। রৌধিক কিছু বলার নিমিত্তে পেছনে ফিরতেই থেমে গেল। নিঃপলক ভঙ্গিতে চেয়ে থেকে চোখ সরিয়ে নিল। অন্য দিকটার কাঁচ খুলে বাইরে তাকিয়ে মৃদু শব্দে বলে, “ঢং।”

“ভাইয়া তুই দেখতে পাচ্ছিস মেয়েটা অসুস্থ। তবুও বলছিস ঢং। কী দিয়ে গড়া তুই?”
আদ্রিতা ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে এগিয়ে দিল। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। আমি পানির সাহায্যে কুলি করে বললাম,
“আমি তো ঢং করছি, তুমি কেন বুঝতে পারছ না আদ্রিতাপু। তোমার ভাই এতো সুন্দর বুঝে গেল, তার বোন হয়ে তুমি বুঝতে পারছ না?”
কথার মাঝে ফোড়ন কেটে বলে ইভু,
“থামো তো তোমরা! আগে বল, তোমার কী হয়েছে?” [আমাকে উদ্দেশ্য করে ইভু]
“বেশিক্ষণ না-খেয়ে থাকলে এমন হয়। তবে এতটা হয়না, তোমার ভাই ঢং মনে করে ধাক্কা দেওয়ার পরে এমন হচ্ছে।”
আমার কথার মাঝে রৌধিক নেমে গেল। বিকট শব্দে দরজা বন্ধ করে দিল। কেঁপে উঠলাম আমি। আমার পাশের দরজা খুলে গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
“নামো!”

পরক্ষণেই হাত ধরে টেনে নামালেন। ভারসাম্য বজায় রাখতে গাড়ি ধরে দাঁড়ালাম। রৌধিক এবার আমায় তার বুকের সাথে জড়িয়ে নিলেন। সরে আসার প্রয়াস করলাম। রৌধিক ছাড়ল না। ইভুকে উদ্দেশ্য করে বলে, ” তোমরা যাও, আদ্রিতাকে বাড়িতে পৌঁছে দিও।”
আমাকে নিয়ে উল্টো পথে হাঁটা দিলেন। আমি বুক থেকে মুখ তুলে বিরবির করে বললাম, ” বিশ্বাস করুন, মাথাটা প্রচুর ব্যাথা করছে। হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। সত্যি বলছি, আমি আর একটি কথাও বলব না। প্লীজ!”
“আশেপাশে কোনো দোকান এই সময়ে খোলা নেই। সামান্য একটু দূরে টঙ্কের দোকান খোলা আছে। সেখান থেকে কিছু খেয়ে নিতে হবে। তারপরে বাড়ির পথে হাঁটা ধরবো।”

অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব ২২

মিনিট পাঁচেক পর আমরা এসে উপস্থিত হলাম দোকানের সামনে। অনেক অনেক খোদ্দেরের ভিড়। রৌধিক আমাকে নিয়ে বেঞ্চিতে বসলেন। দু’কাপ চা এবং বনরুটি অর্ডার করলেন। আমাকে বসতে বলে চলে গেলেন তিনি। দক্ষিণা হাওয়াতে ফুলের সুবাস আসছে। তবে ভিড়ের কারণে সুবাস ঠিকভাবে কানের দোরগোড়ায় পৌঁছাচ্ছে না। এতো ভিড় দেখে আমার মনে অনেক প্রশ্ন,
আচ্ছা, এরা কী রাতে ঘুমায় না। আচ্ছা, এই দোকানটা কতক্ষণ খোলা থাকে? রৌধিক এই দোকানে সন্ধান পেল কোথায়? রৌধিক গেল কোথায়? ফুলের সুবাস কোন দিক থেকে ভেসে আসছে? ইত্যাদি! ইত্যাদি!

অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব ২৪