অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব ১৮

অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব ১৮
ইফা আমহৃদ

আমার কান্নার গতি তুলনামূলক বেড়ে গেল। কথা বলার প্রয়াস করছি, কিন্তু কোন রুপ শব্দ বের হচ্ছে না। মনে হচ্ছে, কেউ শক্ত করে আমার গলা চেপে রেখেছে। বাবা নিজের হাতে চোখের অশ্রু মুছে দিলেন। মাথায় হাত রেখে বললেন,
“আমার ছোট মেয়েটা আজ কতো বড় হয়ে গেছে, ভাবা যায় না। বাবাকে বাঁচাতে নিজের জীবনকে বিক্রি করে দিতে একবারও ভাবে নি। আমি কিছু করতে পারলাম না।”

চমকে উঠলাম আমি, ভিশন চমকালাম। কি বলছে বাবা এইসব? কথাগুলো আমার বুকে তীরের মতো বিঁধছে, তিনি কী বুঝতে পারছে না। আমি তো আমার বাবার জন্য করেছি। তাহলে?
“তুমি তো অনেক দিয়েছ, এবার নাহয় আমি দিলাম।”
বাবা নেত্র যুগল গ্ৰথণ করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। মন ভরে দোয়া করলেন আমায় এবং রৌধিককে। সেদিন রৌধিকের ব্যবহারে বাবার মন জয়ে করে নিয়েছি। রৌধিক আমার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসলেন। কষ্ট লাগল, জয়ার জন্য।
আমরা আসার আগেই জয়া পরীক্ষা দিতে গেছে। পরীক্ষা দিয়ে ফিরতে ফিরতে তিনটা বেজে যাবে। আমরা দুইটার আগেই বের হবো।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

শুভ্র রঙের শাড়ি পড়ে তৈরি হয়েছিল আমি। একদম সিদ্ধ লাগছে আমায়। আমার সাথে মিলিয়ে রৌধিকও ওয়াইট ব্রেজার, ওয়াইট সুজ, ওয়াইট জিন্স পড়েছে। রৌধিকের বাবা মা চলে গেছে। আমি আর রৌধিক আরো দুদিন থাকবো। তাই ল্যাকেজ ভর্তি জামা কাপড় নিয়ে এসেছি।
রেস্তোরাঁর সামনে এসে গাড়ি থামল। জনশূন্য নির্জন রেস্তোরাঁ। চারিপাশে কারো দেখা নেই। রেস্তোরাঁর ভেতরেও কেউ নেই। অজানা আশঙ্কা দুমড়েমুচড়ে দিল দেহের অন্তর্ভাগ। ভীত হলাম আমি। রৌধিকের বাহু চেপে মিনমিনিয়ে বললাম,
” শুনছেন? আমার ভয় করছে। খুব ভয় করছে।”

রৌধিক সন্তর্পনে আমার হাতের উপর হাত রেখে আশ্বাসের স্বরে বললেন, “এতো ভয় কিসের? আমি আছি না। আমি থাকতে কখনো তোমার কোন বিপদ হবে না।”
রৌধিক আর আমি ভেতরে ঢুকলাম। স্টার্ফরা নেই। বড্ড বেশি পরিপাটি করে সাজানো ভেতরটা। একপাশের টেবিলের উপর খাবার রেখে অন্য প্লেট দিয়ে উবুত করে ঢেলে রাখা। রৌধিক ক্লাইন্টদের ফোন করার প্রয়াস করলেন। অন্যপাশে গেলেন। আমি সেখানে দাঁড়িয়ে উঁচু স্বরে বললাম,
“হ্যালো। কেউ আছেন? আমার কথা শুনতে পারছেন?”

বিনিময়ে কোন প্রত্যুত্তর শোনা গেল না। আমার কন্ঠ ধ্বনি হাওয়ার সাথে ঘর্ষণ সৃষ্টি করে ফিরে এলো। রৌধিক ততক্ষণে ফিরে এসেছে। সাথে নিয়ে এসেছে তিনজনকে। তাদের চিনতে মোটেও অসুবিধে হয় নি আমার।‌ দূরত্ব রেখে বসে কিয়ৎক্ষণ বিশ্রাম নিল সকলে। দুপুরের খাবারের সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে। তাদের যেহুতু লাঞ্চের সাথে ডিল ফাইনাল করার জন্য ডাকা হয়েছে। তাই আগে লাঞ্চ করে নিলাম। বস নামক নিহাল ছেলেটিকে আমার একদম ভালো লাগল না। পায়ের পাতায় অপ্রত্যাশিত স্পর্শ নড়ে উঠলাম আমি। নিচের দিকে তাকাতেই দেখলাম, পা উধাও। সবাই নিজেদের মতো খাচ্ছে। দৃষ্টিভ্রম মনে করে খেতে লাগলাম। পুনরায় একই ঘটনা ঘটল। কানের কাছে রৌধিক এসে বললেল,

“এনি প্রবলেম জোনাকি?”
“না।”
রৌধিকের কথার সাথে তাল মিলিয়ে নিহাল বললেন,
“আমারও মনে হচ্ছে, তুমি কোনভাবে ডিস্টার্ব? তোমাকে অনেক চিন্তিত লাগছে।”
হুট করে কাউকে দেখেই তুমি সম্মোধন, অস্বস্তি এবং অসন্তুষ্ট হলাম। রৌধিকও অসন্তুষ্ট তা কাল রাতেই বুঝতে পেরেছি। কাঁটা চামচ টেবিলের উপর গেঁথে একহাতের উপর আরেক হাত রেখে বললেন,

“মিস্টার নিহাল। একবার দেখাতে অপরিচিত একটা মেয়েকে তুমি করে বলাটা শোভা পায় না, এম আই রাইট।”
নিহাল অপমান বোধ করল। গলা খাঁকারি দিয়ে খেতে লাগলেন। তবে শান্ত হলেন না। খাচ্ছে আর নিজের পা দিয়ে আমাকে ডিস্টার্ব করছে। অফিসের কথা ভেবে ছিল বলতেও পারছি না। শুধু পা জোড়া পশ্চাৎ সরিয়ে ফেললাম।
খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ হলো। অন্য টেবিলের গিয়ে বসলাম আমরা। রৌধিক একবার ফাইল পরে শোনালেন সবাইকে। নিহাল ফাইল নিয়ে আরো একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন। কলমটা কপালের পাশে স্লাইড করতে করতে বললেন,
“আমি সাইন করব, মিঃ রৌধিক। কিন্তু আমার একটা শর্ত আছে।”

রৌধিক ভ্রু কুচকালেন। তেমন কোন শর্তের কথা বলা হয়নি। তাহলে এখন কেন শর্তের কথা বলছে। রৌধিকের ললাটে রুদ্র ভাঁজ ফেলে সোজাসাপ্টা বললেন,
“কী শর্ত? কিসের শর্ত? আপনার সাথে শর্ত কি কোন কথা হয়নি। তাহলে হঠাৎ এখন শর্ত আসছে কেন?”
“সো ওয়ার্ট? ইউ সুড হ্যাভ থ্রো বিফর। হোয়াই ইউ সুড আই একসেপ্ট দা ডিল দ্যাট এই হ্যাভ ক্যান্সেল্ড? হোয়াই?
”কি শর্ত?”
আমার দিকে বাঁকা হেঁসে তাকালেন নেহাল। ঘোর লাগা কন্ঠে বললেন, ” আপনার অফিসের এই স্টার্ফকে আমার চাই‌।”
“স্যরি। আই ক্যান নট আন্ডাস্ট্যাণ্ড।”

রৌধিক অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন। এদিক আমার শরীর উত্তপ্ত হয়ে আসছে আর তিনি হাসছেন? নিহাল কি হাসির কথা বলেছেন? আশ্চর্য! রৌধিক হাঁসি থামিয়ে বিদ্রুপ করে বলল, ” এখন কী আমি অফিস ছেড়ে ঘটকালি করব? আর তাছাড়া সি ইজ ম্যারিড এবং মাই অনলি ওয়াইফ।”
আমার দিকে খানিকটা এগিয়ে আসার প্রয়াস করলেন। আমি পিছিয়ে গেলাম।
“তাহলে ওয়ান নাইট। জাস্ট টুয়েলভ অ্যায়ার। দেখতে দেখতে কেটে যাবে। আমি এক্সট্রা পেমেন্ট করব। আপনার ব্যবসায়ও উন্নতি হবে, আমার আকাঙ্ক্ষাও পূরণ হবে।”

বলেই ওষ্ঠদ্বয় কা’মড়ে ধরলেন। ঘৃণায় গুলিয়ে উঠল আমার দেহ। রৌধিকের মুখের হাসিটা ইতোমধ্যে মিলিয়ে গেছে। রাগে ফোঁস ফোঁস করছে। আগে পেছনে না ভেবেই খপ করে শার্টের কলার চেপে ধরল নিহালের। তার গার্ডরা রৌধিককে থামানোর চেষ্টা করল। আমি ছুটে গেলাম রৌধিকের কাছে। নির্ঘাত আজ নিহালের খবর আছে। রৌধিক এতোটাই হিংস্র বাঘের ন্যায় হয়ে আছে, তাকে থামানোর চেষ্টা করাই বৃথা। এমনিতেই তার শক্তির কাছে আমি মশা। এখন তো আরো আগে পারব না। আমি অসহায় কন্ঠে বললাম,

“রৌধিক প্লীজ থামুন। কি করছেন আপনি? ভয় করছে আমার।”
রৌধিক শান্ত হয়ে গেল। হাত আলগা করে সরে এলো। আমার সামনে দাঁড়িয়ে গভীর ভাবে তাকিয়ে রইল। হুট করেই বাহু চেপে ধরল। বাম হাতের তর্জনী ও মধ্যমা আঙুল গুড়িয়ে গুড়িয়ে আমায় নিয়ে বেরিয়ে এলেন। হাতে টান পড়ছে তবুও নিশ্চুপ আমি। রৌধিকের সাথে কথা বাড়ানো মানেই নিজের বিপদ নিজে বয়ে আনা।
গাড়িতে এসে ফেলে দিলেন আমায়। উল্টো ঘুরে গাড়িতে বসে পড়লেন। বোতলের ছিপি খুলে এক ঢোক পানি খেল। বাকি পানিগুলো মাথায় ঢেলে দিল। অতঃপর মাথা চেপে বসে রইলাম। ফোন বের করে কাউকে একটা ফোন করে বললেন,

“আমি এড্রেস পাঠাচ্ছি। দ্রুত যাও। ওদের তিনজনকে আঁটকে রাখবে। আমি আসার আগ পর্যন্ত কিছুতেই না যেতে পারে।”
বলেই লাইন কেটে কিছু একটা টাইপ করল। আমি ফোন নিয়ে নিলাম। কিন্তু ততক্ষণে এড্রেস সেন্ড করে দিয়েছে। ক্ষোভে ফোনটা ছুড়ে ফেললাম। হুট করেই ড্রাইভ করতে লাগল রৌধিক। ব্যালেঞ্জ হারিয়ে খামচে ধরলাম রৌধিককে। ফুল স্পিডে গাড়ি ড্রাইভ করে বাড়ির সামনে এনে দাঁড় করালেন। গাড়ির উপর চোখ বন্ধ করে রেখে বললেন,

“ভেতরে যাও জোনাকি।”
“আপনি যাবেন না?” জিজ্ঞাসা সূচক দৃষ্টি।
“আমি এখন যেতে পারব না। তুমি যাও। কিছু হিসেব নিকেশ বাকি আছে। সেগুলো পূরণ করে আসছি।”
“শুনেন!”
রৌধিক চলে গেলেন পূর্বের পথ ধরে। কেমন শূন্য শূন্য লাগছে নিজেকে। কোথায় গেছে তিনি। ক্ষোভের বশে কিছু করে ফেলবে না তো? আমি নিজের ভাঙা ফোনটা দিয়ে রৌধিকের বাবাকে ফোন করলাম। রিং বাজতেই রিসিভ হলো। আমাকে সহজ ভাষায় বললেন,

“হ্যালো। জোনাকি।‌ অববেলায় ফোন করেছ, কিছু হয়েছে?
“বাবা..
থেমে গেলাম আমি। ফুঁপিয়ে উঠলাম। মিনমিনে স্বরে বললাম,” বাবা প্লীজ রৌধিককে বাঁচান। প্লীজ।”
আশ্বাসে মাখা গলায় বললেন, “কি হয়েছে রৌদুর। কেঁদো না, শান্ত হও। আমাকে খুলে বলো।”

অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব ১৭

ভেতরে চাপা আঘাত রেখে ধীরে ধীরে সবটা খুলে বললাম তাকে। অতঃপর বাড়ির ভেতরে গেলাম। বাবা ঘুমিয়ে আছে। জয়া দুপুরে খেয়ে ঘুমানোর অভ্যাস আছে, তাই সেই ঘুমিয়ে আছে। ঘুম নেই আমার চোখ। শাড়িটা চেঞ্জ করে বেলকেনিতে গেলাম। রেলিং এ হাত রেখে মেইন দরজার দিকে তাকিয়ে রইলাম। মনে হলো, এই বুঝি রৌধিক আসবে। কিন্তু এলো না। মাথা রাখলাম দেয়ালে। তার অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে কখন যে চোখের পাতা বুজে ভারী ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে গেছি‌। জানা নেই। নিদ্রার মাঝেও ভীত আমি। ভয়ে শরীর কাঁপছে।

অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব ১৯