অতঃপর প্রেমের আগমন সিজন ২ পর্ব ৩

অতঃপর প্রেমের আগমন সিজন ২ পর্ব ৩
ইরিন নাজ

মেডিকেল পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। ভালো ফলাফলের সাথেই চান্স পেয়েছে আয়ানা। আদ্রিশদের বাড়িতে যেনো আজ খুশির বন্যা বয়ে যাচ্ছে। খুশিতে সবার চোখ মুখ জ্বলজ্বল করছে। আনিকা তো পারলে ড্যান্স দেয়। আদ্রিশ আর আহিল বেরিয়ে গেছে মিষ্টি কিনতে।

শুধুমাত্র থম মে’রে বসে আছে আয়ানা। বসে বসে সবার হাস্যজ্জ্বল মুখ দেখছে। সে এখনো নিজেকে সামলে উঠতে পারে নি। রেজাল্ট দেয়ার আগ মুহূর্তে ভয়ে কেঁদেই ফেলেছিলো সে। সেটার রেশ এখনো কা’টে নি। তার বিশ্বাস হচ্ছে না সে চান্স পেয়ে গেছে।
আয়ানা কে এভাবে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে এগিয়ে আসলেন অনু বেগম। গালে হাত ছুঁয়িয়ে কপালে গভীর চুম্বন করলেন। অতঃপর হেসে বলে উঠলেন,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

— “কি হয়েছে আম্মা? খুশি হোন নি বুঝি?”
ছলছল চোখে তাকালো আয়ানা। অনু বেগমের হাতের উপর হাত রেখে বলে উঠলো,
— “আমি বলে বোঝাতে পারবো না আম্মু আমার এখন ঠিক কেমন অনুভূতি হচ্ছে। আমি খুশি হয়েছি আম্মু, ভীষণ রকমের খুশি হয়েছি। আমার বিশ্বাস হচ্ছে না আমি চান্স পেয়ে গেছি। আমার স্বপ্নের প্রথম ধাপ সফল ভাবে পার করে ফেলেছি।”
গাল ভর্তি হাসলেন অনু বেগম। আয়ানার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

— “আমার বিশ্বাস ছিলো তুমি চান্স পাবে। এতো পরিশ্রম যে করেছো। আর যারা পরিশ্রম করে তারা সফল হবে না তা কি করে হয়!”

অনু বেগমের কথার মাঝে তার ফোনটা বেজে উঠলো। মিথি ভিডিও কল করেছে। অনু বেগম ফোন আয়ানার কাছে দিয়ে চলে গেলেন। মিথির কল দেখে দ্রুত রিসিভ করলো আয়ানা। সামনে ভেসে উঠলো দ্বীপ আর মিথির মুখাবয়ব। মিথি জানালো সে আর দ্বীপ দুইজনই চান্স পেয়েছে। আয়ানাও জানালো তার চান্স পাওয়ার খবর। তিনজনেরই নিজেদের জেলায় একই মেডিকেলে চান্স হয়েছে জানার পর আনন্দ দ্বিগুন হলো তাদের। মিথি পাশে বসা দ্বীপের দিকে তাকিয়ে মুখ বাঁকা করে বললো,

— “জানিস এই গাধা টা একটুর জন্য ঝু’ই’ল্লা গেছে। নাইলে ওরে অন্য মেডিকেলে পাঠায় দিতো।”
মুখের হাসি টা নিভে গেলো দ্বীপের। সে তেতে উঠে মিথির মাথায় একটা চা’টি বসিয়ে দিয়ে বললো,
— “ওই পে’ত্নী চান্স পাইছি সেটাই শুকরিয়া কর। এতো কথা বলোস কেন? অন্য মেডিকেলে পাঠাইলে আমি পড়তাম ই না।”
মিথি ভাব নিয়ে বললো,

— “কেন, কেন? ওহ, আচ্ছা বুঝছি। আমার ল্যাজ ধইরা না ঘুরলে তোর ভাল্লাগে না মনে হয়! কেউ পাত্তা দিবো না তো আমার মতো। আমিই একমাত্র মানুষ যে তোর মতো পোলারে সহ্য করি। হুহ…”
দ্বীপ শ’য়’তানি হাসি দিয়ে বললো,

— “আমার উপ্রে কতো মেয়ে ফিদা জানোস? আর এখন তো আরও হইবো। কারণ শুধু দ্বীপ থেকে ডাক্তার দ্বীপ হমু বলে কথা। আর, আর তোর ল্যাজ ধইরা ঘুরি মানে! তোর ল্যাজ ও আছে, বাঁদর নাকি তুই?”
কথাগুলো বলে ফিক করে হেসে দিলো দ্বীপ। মুখ চেপে হাসলো আয়ানাও। দুইজন কে হাসতে দেখে রে’গে গেলো মিথি। ধুমধাম দ্বীপ কে মা’র’তে লাগলো সে। দ্বীপ চিল্লিয়ে বলে উঠলো,

— “মাগো রা’ক্ষ’সী টা মাইরা ফেললো আমারে উহঃ। ছাড় মিথি পে’ত্নী, ছাড় আমারে….”
হাত থামলো না মিথির। আরও জোরে জোরে দ্বীপ কে মা’র’তে লাগলো সে। ওদের মা’রা’মা’রি দেখে খিলখিল করে হাসতে লাগলো আয়ানা। শেষে না পেরে বললো,

— “ওই তোরা আমাকে লাইনে রেখে এসব কি শুরু করেছিস!”
আয়ানার কথায় মা’র থামিয়ে শান্ত হয়ে বসলো মিথি। দ্বীপ চোখ মুখ কুঁচকে আছে। ভালোই ব্য’থা পেয়েছে বেচারা। মিথি আয়ানার দিকে চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে বললো,

— “অনেক দাঁত কে’লি’য়েছো বন্ধু, একবার দেখা হোক। তোমার পিঠ ও আস্ত রাখবো না।”
মিথির শান্ত কণ্ঠের থ্রে’টে হাসি থেমে গেলো আয়ানার। চো’রা চোখে তাকালো সে। আয়ানার ভী’ত মুখ, চো’রা দৃষ্টি দেখে বাঁকা হাসলো মিথি। আরও কিছুক্ষন টুকটাক কথাবার্তা বলে ফোন রাখলো তারা।

বাড়ি ফিরেছে আদ্রিশ আর আহিল। সাথে নিয়ে এসেছে এক গাদা মিষ্টি। দেখে মনে হচ্ছে দোকান উঠিয়ে নিয়ে এসেছে। এতো এতো মিষ্টি দেখে চোখ কপালে উঠলো আয়ানার। শেষবার ক্লাস থ্রি তে থাকতে তার রেজাল্ট উপলক্ষে বাড়িতে মিষ্টি এসেছিলো মনে আছে তার। আর আজ এতো বছর পর….

মিষ্টির বাক্স রাখতেই তা খুলে টপাটপ তিনটা কালো মিষ্টি খেয়ে ফেললো আনিকা। কালো মিষ্টি তার অনেক ভালো লাগে। আঙ্গুল চে’টে’পু’টে তাকাতেই দেখলো সবাই তার দিকে গোল গোল চোখে তাকিয়ে আছে। বোকা বোকা হাসি দিলো সে। বললো,

— “সবাই এভাবে তাকিয়ে আছো কেনো? একটু মিষ্টি ই তো খেয়েছি। আমার বুঝি ক্ষুধা লাগে নি? এতক্ষন তো চিন্তায় ছিলাম তাই ক্ষুধার কথা মনে ছিলো না। কিন্তু এখন মিষ্টি দেখে মনে পড়ে গেলো।”
আনিকার কথায় সবার খেয়াল হলো আজ তাদের নাস্তা হয় নি। অনু বেগম তাড়া দিয়ে বললেন,

— “প্রীতি আয় তো বোন, খাবার রেডি করি। তোমরা সবাই ও চলে আসো টেবিলে।”
অনু বেগম আর প্রীতি চলে গেলেন। আদ্রিশ দুটো বড়োসড়ো আকারের রসমালাই এর বক্স আয়ানার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,
— “এটা তোমার…”
চমকালো আয়ানা। চোখ বড় বড় করে তাকালো আদ্রিশের দিকে।

— “মীরা বললো তোমার নাকি রসমালাই অনেক পছন্দ। তাই নিয়ে আসলাম।”
আয়ানা অবাক চোখে তাকালো মীরার দিকে। রসমালাই আসলেই তার অনেক পছন্দের। কিন্তু মীরা এটা খেয়াল করেছে ভাবতেই অবাক হচ্ছে আয়ানা। বাবার বাড়িতে তারা একে অপরের সংস্পর্শে খুব কম থেকেছে। কথাও খুব কম হতো তাদের। আয়ানা বাড়ির কাজ কর্ম করতো সেই সুবাদে সকলের পছন্দ অপছন্দ সে জানে। কিন্তু তার পছন্দ অপছন্দ একমাত্র তার মা ছাড়া আর কারোর খেয়াল করার কথা না। সেখানে মীরা যে খেয়াল করেছে সেটাই অবাক করছে আয়ানা কে।

আয়ানা নীরবে বক্স টা নিয়ে রান্নাঘরের দিকে অগ্রসর হলো। মীরাও গেলো আয়ানার পিছু পিছু। এই সুযোগে আদ্রিশের পাশে এসে দাঁড়ালো আনিকা। হালকা কাশি দিয়ে দাঁত কেলিয়ে বললো,
— “বাহ্ বউয়ের তো ভালোই খেয়াল রাখা হচ্ছে। এবার একটু বোনের দিকে খেয়াল করলেও পারো!”
চোখ মুখ কুঁচকে তাকালো আদ্রিশ। কিছু বলবে তার পূর্বেই পিছন থেকে আহিল বলে উঠলো,
— “তোর মতো পে’ত্নীর যে আমরা দুই ভাই এতো খেয়াল রাখি এটাই তো বেশি। আরও খেয়ালের প্রয়োজন হলে বিয়া কর আর জামাই রে ক খেয়াল রাখতে।”

আহিলের কথায় ফু’লে ফে’পে উঠলো আনিকা। আনিকা কে রে’গে যেতে দেখে মজা পেলো আহিল। আরও রা’গিয়ে দিতে বললো,
— “আর আরেকটা কথা কি জানিস? তোর জামাই তো টাকলু হবে। কারণ তোর জ্বা’লা’য় বেচারার মাথায় চুল ই থাকবে না।”
বো’মা এবার ফা’ট’বে বুঝতে পেরে দৌড় দিলো আহিল। আনিকা ফোঁ’স’ফোঁ’স করতে করতে ধাওয়া করলো আহিল কে। চিল্লিয়ে বলে উঠলো,

— “ভাইয়ুর বাচ্চা, আজকে তোর খবর আছে। একবার শুধু হাতে পাই, তোরে আমি আস্ত রাখবো না।”
আহিল দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে বললো,
— “তোর ভাইয়ুর এখনো কোনো বাচ্চা হয় নাই তবে জলদি ই হবে চিন্তা করিস না।”
আহিল, আনিকা দৌড়ে বেড়াচ্ছে। আর ওদের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে হাসছে আদ্রিশ। এই দুইজন না থাকলে তাদের বাড়িতে বোধহয় কোনো আনন্দ ই থাকতো না। এরা আছে বলে সারাদিন বাড়িটাকে মাতিয়ে রাখে।

খাওয়া দাওয়ার পাট চুকিয়ে সবকিছু গুছিয়ে রুমে ফিরলো আয়ানা। দেখলো আদ্রিশ রেডি হচ্ছে। আয়ানার দিকে চোখ যেতেই আদ্রিশ গম্ভীর স্বরে বললো,
— “জলদি রেডি হয়ে নাও। আমি যাচ্ছি প্রতিবেশী সবাইকে মিষ্টি দিতে। এসে যেনো রেডি পাই তোমাকে।”
কপালে ভাঁজ পড়লো আয়ানার। বললো,

— “কোথাও নিয়ে যাবেন আমাকে? হাসপাতালে যাবেন না আজ?”
আদ্রিশ চুল ঠিক করে আয়ানার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললো,
— “সেটা যখন যাবে তখন বুঝতে পারবে। আর হ্যা, হাসপাতালে যাবো। হাফ বেলা ছুটি নিয়েছিলাম। এখন আর প্রশ্ন না করে রেডি হয়ে যাও।”
আয়ানা কে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বেরিয়ে গেলো আদ্রিশ।

গাড়িতে উঠে মীরা কে দেখে অবাক হলো আয়ানা। তবে কোনো প্রশ্ন করলো না। গাড়ি নিজেদের এলাকার দিকে যেতে দেখে আয়ানার বুঝতে বাকি রইলো না তারা নিজেদের বাসায় যাচ্ছে। মন টা আনন্দে নেচে উঠলো আয়ানার। কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকালো আদ্রিশের দিকে।

কলিং বেল দিতেই দরজা খুললেন অনামিকা বেগম। সামনে দুই মেয়ে কে দেখে আনন্দে কেঁদে ফেললেন উনি। দুই মেয়ে কে বুকে জড়িয়ে কিছুক্ষন আদর করলেন। এর মাঝেই ফল, মিষ্টি নিয়ে ওদের পিছনে হাজির হলো আদ্রিশ। অনামিকা বেগম মেয়েদের ছেড়ে সবাই কে ভেতরে আসতে বললেন। আদ্রিশের সাথে কুশল বিনিময় করলেন। আদ্রিশ জানালো তাকে হাসপাতালে যেতে হবে। অনামিকা বেগম শুরুতে আপত্তি করলেও শেষমেষ আদ্রিশ বুঝিয়ে বলায় রাজী হলেন। আদ্রিশ চোখের ইশারায় আয়ানা কে তার সাথে আসতে বললো।
দরজার কাছাকাছি আসার পর আদ্রিশ বললো,

— “আম্মু জানেন না তোমার মেডিকেলে চান্স পাওয়ার খবর। ইচ্ছে করেই জানাই নি। তুমি নিজের মুখে বলে উনাকে সারপ্রাইজ দিবে তাই। আর শোনো, রাতে নিতে আসবো। এখন তাহলে আসি।”
কথাগুলো বলে আয়ানার ঠোঁটের উপর জমে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘাম আঙুলের সাহায্যে মুছে বেরিয়ে গেলো আদ্রিশ। আদ্রিশের হঠাৎ এমন স্পর্শে থমকালো আয়ানা। থম মে’রে দাঁড়িয়ে রইলো কিছু সময়। তাকিয়ে রইলো আদ্রিশের যাওয়ার পানে।

— “আম্মু তোমাকে কিছু বলার ছিলো….”
অনামিকা বেগম কে জড়িয়ে ধরে বললো আয়ানা। অনামিকা বেগম মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললেন,
— “কি বলবি বল।”
— “আম্মু তোমার মেয়ে মেডিকেলে চান্স পেয়ে গেছে।”
থমকালেন অনামিকা বেগম। কথা টা বুঝে আসতেই ছলছল চোখে তাকালেন আয়ানার দিকে। বললেন,
— “সত্যি বলছিস?”

মাথা ঝা’কা’লো আয়ানা। আনন্দে মেয়ের মাথায় পরপর কয়েকবার চুমু খেলেন উনি। বিড়বিড় করে বললেন,
— “আলহামদুলিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ…. অনেক বড় হ মা, অনেক উন্নতি কর।”
আয়ানা ফের বলে উঠলো,

— “জানো আম্মু ওই বাড়ির সবাই অনেক ভালো। তারা আমাকে অনেক ভালোবাসে, আমার অনেক যত্ন নেয়। আমি না খেলে আম্মু আমাকে নিজের হাতে খাইয়ে দেয়। মন খারাপ থাকলে সবাই মিলে আমার মন ভালো করে দেয়। আনিকা আপু বন্ধুর মতো আমার সাথে মেশে, আহিল ভাইয়া তো আমাকে ছোট বোনের মতো ভালোবাসে। আর উনি মানে তোমার জামাই, সে তো আমার পড়াশোনার ব্যাপারে আমার চেয়েও বেশি সিরিয়াস। ওরা সবাই সাপোর্ট না করলে আমি কখনোই এতো দূরে আসতে পারতাম না।”

আয়ানার মুখে কথাগুলো শুনে ভীষণ শান্তি অনুভব করলেন অনামিকা বেগম। অবশেষে তার মেয়ে টা বুঝি সুখের দেখা পেলো। মেয়ের সুখের সংসারে যেনো কারোর নজর না লাগে সেই জন্য দোয়া করতে লাগলেন উনি।
আয়ানার বলা কথাগুলো অনামিকা বেগম ছাড়াও আরও একজন শুনেছে। তবে সে এসব শুনে শান্তি অনুভব করে নি।

অতঃপর প্রেমের আগমন সিজন ২ পর্ব ২

বরং তার মনের মাঝে আ*গু’ন জ্ব*ল’ছে। সেই মানুষ টা আর কেউ নয় সারা। ছোট বেলা থেকেই আয়ানার ভালো সহ্য হয় না তার। আর আজ আয়ানা এতো ভালো আছে শুনে তার মনের মাঝে আ*গু’ন জ্ব*ল’ছে। সে ঠিক করে নিলো কিছু একটা সে করবেই। শুধুমাত্র সুযোগের অপেক্ষা।

অতঃপর প্রেমের আগমন সিজন ২ পর্ব ৪