অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব ৪

অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব ৪
জিন্নাত চৌধুরী হাবিবা

বৃষ্টি থামার পরের মুহূর্ত। আকাশে কালো মেঘ কে*টে গিয়ে পরিষ্কার দেখাচ্ছে। গাছপালা ফিরে পেয়েছে তার সতেজতা। শীতল বাতাস শরীর ছুঁয়ে এক রোমাঞ্চকর পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। এই সময়ে হয়তো কোন এক দম্পতি ভীষণ কাছাকাছি, আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে, ভরসায় কাঁধে মাথা ঠেকিয়ে ঝুম বৃষ্টির পরাজিত দৃশ্য দেখছে। করছে মনের চিঠি আদান-প্রদান। হয়তোবা হচ্ছে কোন এক গাছের মগডালে বসে নাম না জানা একজোড়া পাখির নব-নব প্রেমের সূচনা।

ক্ষণকাল পূর্বে তর্জনগর্জন করে বেশ আয়োজিতভাবেই ঝুম বৃষ্টি হলো। প্রকৃতি এখন বেশ শান্ত রূপ ধারণ করেছে। ঝুল বারান্দায় দাঁড়িয়ে এক কাপ ধোঁয়া ওঠা চায়ে চুমুক দিয়ে মুহূর্তটি উপভোগ করলো তরী। হাতে এখনো চায়ের শূন্য কাপ ঝুলে আছে। পাশেই হুমায়ুন আহমেদের ❝বৃষ্টি বিলাস❞ বইয়ের নজরকাড়া মলাট উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। বইটি অর্ধেক পড়া হয়েছে তরীর। বৃষ্টি শেষে পরিচ্ছন্ন আকাশ, বই আর সে। ভীষণ রোমান্টিক আবহাওয়া।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আকস্মিক এমন প্রেমময় পরিবেশে তারও বড্ড প্রেম প্রেম নে*শা চড়লো মনে। ঝড়ো বাতাসেও যেন মিষ্টি ভালোলাগার গন্ধ, ঢেউ তোলা প্রেমের অনুভূতি। দিন দুনিয়া ভুলে তরী প্রেমে পড়তে চাইলো। আকাশ-পাতাল এক করা প্রেম। হৃদয় এফোঁড়ওফোঁড় করা প্রেম। দুঃখ দুঃখ প্রেম! কঠিন প্রেম। সবরকম প্রেম একবার করে ছুঁতে চাইলো সে। যে প্রেম তার মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকবে। লুকোচুরি প্রেমে শিহরণ জাগবে মনে। পৃথিবীর কোন মানুষ জানবেনা তার নয়া প্রেমের গল্প। কেবল সে জানবে। দুরুদুরু বুক কাঁপবে। প্রেমের বিষন্নতায় মরিয়া হয়ে হাউমাউ করে কাঁদবে।

হুট করেই ভীষণ ভালোলাগায় মুখ লুকিয়ে হাসবে। উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখবে, কেউ দেখেনি ভেবে বুকে হাত চেপে প্রলম্বিত শ্বাস ছাড়বে। তার প্রেম হবে জীবন-মরণ প্রেম। লাল-নীল রঙবেরঙের প্রেম। অনুভূতি হবে সদ্য প্রেমে পড়া কিশোরীর মতো।

পাহাড় থেকে সমুদ্র, এই বিশাল আকাশ থাকবে তার তীব্র প্রেমের সাক্ষী। মানুষটি হবে তার কল্পিত পুরুষ। চোখ বুজলো তরী। কল্পনায় তার কল্প পুরুষকে আঁকার চেষ্টা করলো। মনের গোপন রংতুলিতে নিখুঁত এক চিত্র আঁকলো। বারবার চেষ্টা করেও মুখটি সে কিছুতেই আঁকতে পারছেনা। ছবিতটিতে কোন মুখ বসাতে পারছেনা। খাপ খাচ্ছেনা। এবার ভীষণ মন খা*রা*প হলো তরীর! কঠিন মন খারাপ!

সে প্রেমে পড়তে চাইলো। যেন-তেন প্রেম নয়, উচ্ছল কিশোরীদের মতো প্রেম। ঘন আবেগের পসরা সাজানো প্রেম। অথচ এই সুখ সুখ মুহুর্তেও খুশি হতে পারলোনা তরী। সে সঠিক কল্পিত পুরুষের চেহারা নির্ণয় করতে পারলোনা। তার ভীষণ দুঃখ হলো। তেইশ বছরের জীবনে সে কঠিন আবেগি প্রেমে পড়তে চাইলো। এমন টুপ করে ধুপধাপ প্রেমে পড়ে যাওয়া এই বয়সের মেয়েদের মানায় না। তবুও সে প্রেমে পড়তে চাইলো। কিন্তু সফলতাকে ছুঁতে পারছেনা। এই কঠিন দুঃখে আজ আর ঘর থেকে বের হবেনা তরী। বাড়ির ফটক দিয়ে প্রবেশ করলো এক চেনা পুরুষ। তরী ভুলে বসলো সব মন খা*রা*পি। সবকিছু ভুলে-টুলে তাকিয়ে রইলো ফটক পেরিয়ে এগিয়ে যাওয়া মানুষটির দিকে।

মাহমুদের শরীরে ফর্মাল ড্রেস। কলেজ থেকেই ফিরছে বোধহয়। এলো চুল কপালের উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। অল্পসল্প ঠান্ডা অনুভূত হলেও সটান হয়ে হেঁটে আসছে। কিছু না ভেবেই একবার উপরে তাকালো সে। তরী আরও একবার অপ্রস্তুত হলো। এমন একটা ভাব করার চেষ্টা করলো, যেন সেও হুট করেই তাকিয়েছে। মাহমুদ কোন প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে ব্যস্ত পায়ে সিঁড়ি মাড়ালো। তিনতলা পৌঁছাতেই মা দরজা খুলে দিলেন।

বৈঠকখানায় হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে রামি।
অরু নুডলস খাচ্ছিল বসে বসে। মিঠু নিজের খাবার শেষ করে অরুর পাশে বসলো। আদুরে আদুরে ভাব নিয়ে বলল,
-“ভাইয়া তোমার থেকে একটুখানি খাই?”

আজ মন ভালো ছিল অরুর। স্কুল থেকে ফেরার সময় ভাইয়া তার জন্য চকলেট এনেছে। তাই একটুখানি নুডলস খাওয়ার পারমিশন দিলো। মিঠু দুচামচেই প্রায় বাটি শূন্য করে ফেললো। তা দেখে গগনবিদারী চিৎকার করলো অরু। টেবিল-চেয়ার ছেড়ে ধুপ করেই শুয়ে পড়লো ফ্লোরে। হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দিলো। মা দৌঁড়ে আসলেন অরুর কাছে। অরুর পার*মাণ*বিক বো*মা হামলায় পড়েও পালানোর চেষ্টা করলোনা মিঠু। দাঁত কেলিয়ে হাসলো। মা বকাঝকা করার পরও হাসছে। রামি ফট করেই বলে ফেললো,

-“দাঁত বের করে কী প্রমাণ করতে চাইছিস? তুই ফেয়ার এন্ড লাভলী ক্রিম দিয়ে দাঁত ব্রাশ করিস? লজ্জাটজ্জা করছেনা তোর? ”
তরী ফিক করে হেসে ফেললো। বলল,
-“ওর আবার লজ্জা আছে নাকি? গতবছর বর্ষাকালের কথা। রাস্তায় বড়োসড়ো সমস্যায় পড়লো। মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। কোথাও গিয়ে কাজ সারার উপায় নেই। বৃষ্টির মধ্যে প্যান্ট ভিজিয়ে বাড়িতে এলো। কোনটা বৃষ্টির পানি আর কোনটা কী বোঝা গেল না। বাড়িতে এসেই তার হেসে গড়াগড়ি। ঢাক-ঢোল পিটিয়ে সবাইকে তার অকাজের কথা শোনাচ্ছে। এমন ছেলের লজ্জা আছে বলে তোর মনে হয়?”

মিঠু মুখ ভেঙচি কেটে তরীর উদ্দেশ্যে বলল,
-“যাকে বলেছো, সে-কি তোমায় দু-টাকা দিয়েছে?”
বলা শেষ করার পরপরই পিঠে পড়লো মায়ের হাতে শক্ত থা*প্প*ড়।

একহাতে শাড়ির আঁচল মুঠোয় নিয়ে মিঠুকে কিছু নিয়ে শাসাচ্ছে তরী। ঝড়ো হাওয়ায় অবাধ্য চুলগুলো বড্ড খামখেয়ালিপনা করছে। এলোমেলো হয়ে ছুটতে চাইছে এদিকসেদিক। একটুখানি বিরক্ত করার প্রয়াস। বিরক্ত হওয়ার কথা থাকলেও তরী বিরক্ত হচ্ছে না। এই মুহূর্তে সে চোখমুখ কঠিন করে আছে। মাহমুদ সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে থেকেই লক্ষ করলো বেশ ক্ষে*পে আছে মেয়েটা। ঠিক আহত বাঘিনীর মতো। রেগে গেলে তার তেজী মুখটি লাল হয় কি? কাছে থাকলে হয়তো ব্যাপারটা স্পষ্ট হতো। তবুও মাহমুদ আন্দাজ করে নিলো রেগে গেলে মেয়েটার গালে লাল আভা ছড়ায়। তখন তরীকে দেখতে কেমন লাগে সেটাও একবার কল্পনায় এঁকে নিলো। মেয়েটার প্রতি তার কৌতুহলের একমাত্র কারণ তার ওই অশান্ত রূপ। ভয়*ঙ্কর লজ্জায় পালিয়ে বেড়ানো।

তরীকে সে এই প্রথম রেগে যেতে দেখলো। মেয়েটা যখনই তার সামনে পড়েছে, তখনই পালিয়ে বেড়িয়েছে, অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে ঘুরে বেড়িয়েছে।
তার সামনে পড়লেই কেন মেয়েটাকে এমন অপ্রতিভ হতে হবে?
মিঠুকে ধমকে উঠলো তরী।
-“আমার চোখের দিকে তাকা। এদিকওদিক কী?”

মিঠু এক কান দিয়ে শুনছে আরেক কান দিয়ে সব বের করে দিচ্ছে। শরীরে এখনো স্কুলের সাদা ইউনিফর্ম, কাঁধে ব্যাগ ঝোলানো। রামি আগে সুযোগ বুঝে কে*টে পড়েছে। বাবাকে ছাড়া আর কাউকে ভয় পায়না মিঠু। গতকাল স্কুলে মা*রা*মা*রি করে এসেছে সে। সকাল সকাল ব্যাপারটা তরীর কান পর্যন্ত গড়াতেই ভাইকে শাসন করতে চাইলো। মিঠু কি ভয় পাওয়ার পাত্র? এদিক-ওদিক তাকিয়ে তরীর কথাগুলো তুচ্ছ করার চেষ্টায় নেমেছে। তরী যখন তাকে বকতে ব্যস্ত তখনই ঝোপ বুঝে কো*প মা*র*লো সে। মুহুর্তেই হাওয়া হয়ে গেল। ভোঁদৌড় দিয়ে তরীর নাকের নিচ দিয়ে পালিয়ে গেল।

রা*গে নাকের পাটা ফোলে উঠলো তরীর। এই ছোট্ট ছেলেটা তাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করলো?
মাহমুদ এগিয়ে এলো। কলেজ যাওয়ার জন্যই বেরিয়েছে। মাঝখানে তরী আর মিঠুকে দেখে থেমে যাওয়া। মাটিতে কারো কদম ফেলার মৃদু শব্দে পিছু ফিরলো তরী। মাহমুদকে দেখে দৃষ্টি নিচু করে নিলো। পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সুযোগ দিলো। আর তাকাবেনা সে। বিব্রত হতে হতে সে ক্লান্ত। পরক্ষণেই টনক নড়লো তার।

খেয়াল করে দেখলো তার শাড়ির সাথে মাহমুদের শার্টের রং মিলে যাচ্ছে। হুবুহু না হলেও আংশিক মিলছে। নীল শার্ট পরেছে মাহমুদ। তরী নীল সাদার মিশ্রনে মায়ের তাঁতের শাড়ি পরে বেরিয়েছে। লেকচার শেষে বন্ধুদের সাথে একটু ঘোরাঘুরির প্ল্যান আছে তার। সেই সুবাদেই শাড়ি পরা। পরিস্থিতির সাথে তার কোনকালের শ*ত্রু*তা ভেবে পেলোনা তরী। সে যা খেয়াল করেছে একই ব্যাপার যদি মাহমুদও খেয়াল করে, তখন ব্যাপারটা কতটা বিদ*ঘুটে দেখাবে? লোকটি যদি ভেবে বসে তরী তাকে দেখেই এমন সাজ সেজেছে, নীল সাদায় নিজেকে জড়িয়েছে!

নিজেকে নিয়ে কে কি ভাবলো না ভাবলো তা নিয়ে অন্যদের কিছু না হলেও তরীর যায় আসে। কেউ তাকে নিয়ে উল্টোপাল্টা ভাবলে তার ভয়া*বহ মন খা*রা*প হয়। পুরো একদিন তার মন খা*রা*পে কা*টে। খাওয়াদাওয়া, পড়াশোনা সব লাটে ওঠে। তরী ভীষণ দুর্বল মনের মানুষ। কেউ দুঃখ পাবে এমন কঠিন সে হতে পারেনা। লোকের দুঃখেও তার কান্না ঠে*লে আসে। এজন্য মিঠু তাকে বি*দ্রু*প করে “দিল দরদী” বলে ডাকে।

তরী যখন আকাশ-পাতাল ভাবনায় ব্যস্ত, মাহমুদ তখন তার নারী নারী সত্তায় নজর বুলাতে মগ্ন। সদ্য ভূপৃষ্ঠে নেমে আসা এক টুকরো আকাশ তার সামনে। কাজল টা*না চোখ, দুই ভ্রুয়ের মাঝ বরাবর ঠিক মাঝ বরাবর নয়, ডান ভ্রুয়ের পাশ ঘেঁষে যাওয়া কুচকুচে কালো তিল। দূর থেকে দেখলে মনে হবে আন্দাজে টিপ পরার মতো। মাহমুদ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। জড়তাহীন ঢিমে স্বরে বলল,

অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব ৩

-“ কপালের তিলটা ঠিক মাঝ বরাবর হওয়া উচিত ছিলো।”
তরী ভারি চমকালো। লোকটি যায়নি এখনো? দাঁড়িয়ে থেকে তাকে লক্ষ করছে? সর্ব*নাশ! এক্ষুনি না আবার শাড়ি-টাড়ি নিয়ে কিছু বলে বসে!

অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব ৫