অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব ৫

অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব ৫
জিন্নাত চৌধুরী হাবিবা

গেইট পেরিয়ে রাস্তায় জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়ালো তরী, পাশেই মাহমুদ। দুজনই গাড়ির খোঁজে দাঁড়িয়েছে। সিএনজি বা রিকশা যেকোন একটা হলেই চলল। মিনিট পাঁচেক পরই একটা রিকশার দেখা মিললো। হাত উঁচু করে ইশারায় ডাকলো মাহমুদ। তরীর উদ্দেশ্যে বলল,

-“উঠুন।”
অপ্রস্তুত চোখে তাকালো তরী। তার ভাবনা আকাশচুম্বী। সেদিন সিএনজি ছিলো বলে দূরত্ব বজায় রেখে বসেছে। আজতো তা সম্ভব নয়। মিলেমিশে বসতে হবে। একে অপরের শরীর ছুঁয়ে যাবে ভেবেই বুকের ভেতরটা ধুকধুক করে উঠলো।
আ*ত*ঙ্ক ভর করলো মনে। শ্বাস আটকে রেখেই অনিচ্ছাকৃত ঠোঁট প্রসারিত করলো। মৃদুস্বরে বললো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

-“না না ঠিক আছে, আপনি যান। আমি রিকশা দেখছি।”
শান্ত চোখে একপলক তাকালো মাহমুদ। তরীর অস্বস্তি সে আগেই বুঝতে পেরেছে। সে কেন? যেকোন মানুষ মেয়েটার জড়তায় পরিপূর্ণ মুখ দেখে বলে দিতে পারবে সে বিব্রত। মাহমুদ দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিলো। ভীষণ শীতল কন্ঠে বলল,
-“ভয় নেই তরী, রিকশায় আপনি একা যাচ্ছেন। আমি যাচ্ছিনা আপনার সাথে।”
তরী দৃষ্টি লুকানোর চেষ্টা করলো। সে তো মুখ ফোটে বলেনি তার সমস্যা হবে। তবে লোকটি কিভাবে বুঝলো?
বিব্রত কন্ঠে বলল,

-“ভয় পাবো কেন?”
-“আচ্ছা, ভয় পাচ্ছেন না তাহলে?”
-“ভয় পাওয়ার কী আছে? আপনি কি বাঘ?”
-” ঠিক আছে চলুন একসাথে যাই।”
বলে তাকালো মাহমুদ। আঁধার নামলো তরীর চোখেমুখে। করুণ দেখালো তার চেহারা। মাহমুদ আলগোছে একটুখানি হাসলো বোধহয়! পরক্ষনেই অভয় দিয়ে বলল,

-“আপনি নিশ্চিন্তে যেতে পারেন। আমার একটা কাজ আছে। কাজ সেরে পরে গেলেও চলবে।”
স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো তরী। সব ভাবনা বাদ দিয়ে এক প্রকার পালিয়ে বাঁচতে উঠে পড়লো রিকশায়। মাহমুদের সাথে আর কথা বলার প্রয়োজন মনে করলোনা। শ্বাস আটকে লোকটিকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গেলো। একটিবার পিছু ফিরলোনা। তবুও পেছন থেকে গম্ভীর কন্ঠ স্বর শোনা গেল।
-“এত অশান্ত হলে চলবে, তরী? শাড়িটা অন্তত সামলে রাখুন।”

তরী পাশ ফিরে তাকালো। একটুর জন্য শাড়ির আঁচল রিকশার চাকায় পেঁচাতে গিয়েও বেঁচে গিয়েছে। ঝট করেই আঁচল গুটিয়ে বসলো। তবুও পিছু ফিরলোনা।
মাহমুদ আরেকটি রিকশা নিয়ে কলেজ পৌঁছালো। তরীকে আর বিব্রত করা উচিত হবেনা ভেবেই এমন সিদ্ধান্ত নিলো। তার কোন কাজ ছিলোনা। এটুকু মি*থ্যা সে অনায়াসে বলে ফেললো। এই কয়েক মিনিটে বেশ বিব্রত হয়েছে মেয়েটা।

স্তব্ধ ঘরের নিরবতায় ছেদ ঘটিয়ে দেয়াল ঘড়িটি ডংডং শব্দ করে নয় এর ঘরে স্থির হলো। সময়টা রাত্রি নয়টা। ঘরের সবগুলো আলো নেভানো। শুধু একটিমাত্র টেবিল ল্যাম্প জ্বলছে। পাশেই অর্ধ খাওয়া চা কাপের তলায় পড়ে আছে। গভীর মনযোগে বইয়ের মুখ গুঁজে আছে তরী। হুট করে ঘরের অন্য আলো জ্বলে ওঠায় মনযোগে ব্যাঘাত ঘটলো। মেজাজ খা*রা*প হলো তার। যাকে বলে প্রচন্ডরকম মেজাজ খা*রা*প! পড়ার সময় এমন ডিস্টার্ব তার কোনকালেই পছন্দ নয়। পড়তে গেলে কারো বিন্দুমাত্র শব্দ সে সহ্য করতে পারেনা।
ঘরের প্রতিটি কোণে মিঠুর চোখ বুলানো শেষ। কোথাও ফোনের দেখা না পেয়ে বলল,

-“তোমার ফোন কোথায় আপু?”
কঠিন দৃষ্টিতে তাকালো তরী। ফোঁস ফোঁস করে নাকের পাটা ফোলে উঠলো। এই মুহূর্তে মিঠু নামক প্রাণীকে তার চারতলা বিল্ডিং এর ছাদ থেকে ফেলে দিতে ইচ্ছে করছে। এরপর জেল হলে হোক। অন্তত সেখানে মনযোগ দিয়ে পড়তে পারবে। এতটা হাইপার হওয়ার কথা ছিলানা তরীর। একটা একুয়েশন কিছুতেই মাথায় ঢুকাতে পারছেনা। তার মাঝে মিঠুর বিরক্ত করা সহ্য হলোনা। সজোরে ধমকে উঠলো।

-“সারাদিন কিসের ফোন? এই তোর পড়ালেখা নেই? ডাকবো বাবাকে?”
বাবা পাশ দিয়েই যাচ্ছিলেন। তরীর উচ্চস্বর শুনে দরজায় দাঁড়ালেন। মিঠু তার যমদূত দেখে কুঁকড়ে গেলো। বাবা প্রতিদিন ধরেন না, একদিন ধরতে পারলে হাড় মাংশ এক করে ফেলেন। ঢোক গিললো মিঠু। বাবা ধারালো নজর নিক্ষেপ করলেন। অত্যন্ত গম্ভীর গলায় শুধালেন,

-“তোর পড়ালেখার কী হয়েছে?”
মিঠু ভয়ে জবাব দিতে পারলোনা। কী বলবে সে? ’আমি সারাদিন আড্ডাবাজি করে পড়ালেখা লাটে উঠিয়েছি’।
এটা বলবে? বাবা আবারও একই প্রশ্ন করলেন।
এবারও নিঃশ্চুপ মিঠু।

আচমকা তার বাঁ গাল জ্বলে উঠলো। কানা তালা লেগে গেল। সজোরে শব্দ শুনে তরী বাবা ভাই দুজনের দিকেই তাকালো। চোখদুটো জ্বলে উঠলো তার। ব্যথাতুর চোখে মিঠুর দিকে তাকালো। একটু আগের ক্ষো*ভ পানি হয়ে গেল। বাবা কষে থাপ্পড় মা*র*লে*ন মিঠুর গালে। বাজখাঁই গলায় বললেন,
-“পড়াশোনা না করলে কাল থেকে তোর খাওয়াদাওয়া, টাকা সব বন্ধ। কী পেয়েছিস তুই? টাকা কি গাছে ধরে? গাছ থেকে ছিঁড়লাম আর তোদের পেছনে খরচ করলাম!”

বাবা আর দাঁড়ালেন না, চলে গেলেন। ইকুয়েশন গোল্লায় যাক। তরী তড়িঘড়ি করে উঠে এলো। মিঠুর গালে হাত বুলিয়ে ব্যথাতুর কন্ঠে বলল,
-“ইশ! খুব বেশি লেগেছে, না?”
মিঠু তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। কথা বললোনা। তরী ফোন বাড়িয়ে বলল,
-“নে ধর।”
বে*হা*য়া মিঠুর সকল রা*গ, ব্যথা, ভয় ফিকে হয়ে গেলো। সব ভুলে এক থাবায় ফোন নিয়ে নিলো। যেতে যেতেই বিদ্রুপ করে বলে গেল,

-“সব দরদ শুধু মেয়েদের জন্য। আর আমিতো বানের জলে ভেসে এসেছি। তাই আমার জন্য দরদ নেই। এসব আলগা দরদ দেখলে ইচ্ছে করে কোথাও গিয়ে ঘাপটি মে*রে বসে থাকি।”
নিঃশব্দে হাসলো তরী। এই ভাইটা তাকে সামনা সামনি যতটা হিং*সে করে, আড়ালে তারচেয়েও বেশি ভালোবাসে। সে অনেকটা বেপরোয়া থাকতে চায়। নিজের মর্জিমাফিক সবকিছু না হলে অশান্ত হয়ে পড়ে। তার রা*গ, অভিমান ক্ষণিকের জন্য।

এখন আর পড়ায় মন বসবেনা। বই গুছিয়ে উঠে পড়লো তরী। বৈঠকখানায় গিয়ে দেখলো অরু আগে আগেই বাবার কোল দখল করে নিয়েছে। ছোটো ছোটো হাত দুটো বাবার গলা পেঁচিয়ে সারা মুখে অগণিত চুমু খাচ্ছে। যেন বহুবছর পর বাবাকে দেখলো। অথচ সকালেই বাবা বেরিয়েছেন।
মিঠু দরজা ধরে বেরিয়ে যাচ্ছে দেখে পেছন থেকে ডেকে উঠলো তরী,

-“কোথায় যাচ্ছিস?”
-“সন্ধ্যা থেকে রামির জ্বর। তার কাছেই যাচ্ছি।”
তরী চিন্তিত স্বরে বলল,
-“কী বলিস! চল আমিও যাবো।”
অরু বাবার কোল থেকে নেমে পড়লো। বায়না ধরলো সেও যাবে। অতঃপর তিন ভাই-বোন তিনতলায় নামলো।
আয়েশা আন্টি বসে বসে জলপট্টি দিচ্ছেন রামির কপালে। পাশেই কপালে ভাঁজ ফেলে ঔষধ চেইক করছে মাহমুদ। তরীদের দেখে দাঁড়িয়ে পড়লো। রামির পাশে বসার জায়গা করে দূরে দাঁড়ালো। চঞ্চল স্বভাবের ছেলেটাকে একনজর দেখলো তরী। কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে তার চেহারায় মলিনতার ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। চোখদুটো খাদে নেমে আছে। নরম হাতে রামির কপালে, গালে হাত রেখে জ্বর দেখলো। চিন্তিত গলায় বলল,

-“ওর তো অনেক জ্বর।
কিছু খেয়েছে?”
আয়েশা সুলতানা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
-“কিছুই খেতে চাচ্ছেনা। মাত্রই স্যুপ বানিয়ে আনলাম। না খেলে ঔষধ খাবে কিভাবে?”
-“আপনাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে আন্টি। আপনি কিছুক্ষণ আরাম করুন। আমি খাইয়ে দিচ্ছি।”
বাঁধা দিলেন আয়েশা সুলতানা।
-“তুমি বসো তো। আমি খাওয়াতে পারবো।”

তরী জোরপূর্বক স্যুপ হাতে নিলো। অল্প অল্প ফুঁ দিয়ে রামির সামনে ধরলো। সে গিলতে গিয়ে চোখমুখ কুঁচকে নিচ্ছে।
স্যুপ শেষ করে ঔষধ চাইলো। মাহমুদ সামনে ঔষধের বাক্স রাখলো। তরীর পেছনে দাঁড়িয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছে কোনটা কোনটা খাওয়াতে হবে। জমে রইলো তরী। ঘাড় নাড়ানোর সাহস পেলোনা। অথচ মাহমুদ স্বাভাবিক দূরত্বে দাঁড়িয়েছে। তরীর মনে হলো তার একেবারে পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে। সে নড়াচড়া করলেই কিছু একটা ঘটে যাবে। রামিকে ঔষধ দিয়ে আর দাঁড়ালোনা। দ্রুত বাসায় চলে এলো।

দুপুরে তেজী সূর্য তার উত্তাপ ছড়াতে ব্যস্ত। ঘামে জড়োসড়ো শরীর। লাইব্রেরির থেকে কিছু একাডেমিক বই নিয়ে বের হলো তরী। এই ছোট-খাটো লাইব্রেরি বাবার পরিচিত। বাবার কথা বলে বইপত্র নিয়ে যায় তরী। তিনি সময় করে বিল পরিশোধ করেন। লাইব্রেরিটা মাহমুদের কলেজের রাস্তায়।
রিকশা করে বাসায় ফিরছিলো মাহমুদ। পথিমধ্যে তরীর মতো কাউকে দেখে রিকশা থেকে নেমে পড়লো। একটু কাছে এসেই নিশ্চিত হলো এটা তরী। হাতে কয়েকটা বই, কাঁধে ব্যাগ। লম্বা কদমে এগিয়ে এলো সে।

-“তরী!”
চমকে পেছনে তাকালো তরী। মাহমুদ দাঁড়িয়ে আছে। জিজ্ঞেস করলো,
-“বই কিনতে এসেছেন?”
-“জি।”
ছোট করে উত্তর দিলো তরী।
মাহমুদ বলল,
-“চলুন আপনাকে রিকশা ডেকে দিই।”

মাহমুদ নিশ্চয়ই নিজের চড়া রিকশায় তাকে যেতে বলে নিজে রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে থাকবে! কী দরকার? তরী বলল,
-“অল্প একটু পথ বাকি। এখান থেকে তো বাসা কাছেই। আমি যেতে পারবো।”
সামনে এগিয়ে গেলো তরী।
মাহমুদ দ্বিরুক্তি করলোনা। তরীকে এভাবে রাস্তায় ফেলে সে রিকশা নিয়ে চলে যাবে এটা সমীচীন দেখায় না। রিকশার ভাড়া মিটিয়ে তরীর পাশাপাশি কদম ফেললো।

অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব ৪

-“বইগুলো আমার হাতে দিন, তরী।”
-“আমি নিতে পারবো।”
মাহমুদ বইগুলো জোরপূর্বক টে*নে নিলো। হাঁটতে হাঁটতেই নিঃসংকোচে নরম স্বরে বলল,
-”এই ভারী বই নিতে কষ্ট হবে আপনার।”

অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব ৬