চৈত্রিকা পর্ব ১০

চৈত্রিকা পর্ব ১০
বোরহানা আক্তার রেশমী

চৈত্র মাসের ভ্যাপসা গরম। রোদের উত্তাপে বাহিরে থাকা মুশকিল। বাড়ির মধ্যেও সমানে ফ্যান চলছে। এই গরমের মধ্যেই অর্থি বইখাতা নিয়ে পড়ার ঘরে এসেছে। নিবিড় আজ পড়াতে আসবে। অর্থি গরমে, বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে আছে। এর মধ্যেও কেনো নিবিড়ের পড়াতে হবে? একদিন ছুটি দিলে কি হয়! তার চিন্তা ভাবনার মাঝেই নিবিড় দরজা ঠেলে ভেতরে আসে। অর্থি চোখ মুখ কুঁচকে বলে,

‘আপনার কি হুশ জ্ঞান নেই মাষ্টারমশাই? এই গরমের মধ্যে কেউ পড়ে?’
একেই তো গরমে অবস্থা খারাপ তারওপর এতো দুর হেঁটে এসে আবার অর্থির এহেন কথা শুনে আপনা আপনিই ভ্রু কুঁচকে যায় নিবিড়ের। কোনো রকমে ফ্যানের নিচে বসে আগে জিরিয়ে নেয়। দৃষ্টি তখনো অর্থির মুখের দিকে। অর্থি নিজেও ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে নিবিড়ের দিকে। গরমে শ্যাম বর্ণ মুখটা লাল হয়ে আছে। গালের খোঁচা খোঁচা দাড়ির সাথে ঘাম চিক চিক করছে। কপালে পড়া চুলগুলো নিবিড় বার বার ঠেলে সরিয়ে দিচ্ছে। অর্থি হা করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘আপনার কি অনেক বেশি গরম লাগছে মাষ্টারমশাই?’
নিবিড়ের আর ধৈর্যে কুলালো না। দাঁতে দাঁত চেপে অর্থির দিকে খানিকটা এগিয়ে এসে বললো, ‘নাহ! আমার একটুও গরম লাগছে না। আমার অনেক ঠান্ডা লাগছে। ইচ্ছে করছে লেপ, কাথা মুড়ি দিয়ে ঘুমাই।’
বোকা অর্থি নিবিড়ের রাগ তো বুঝলোই না উল্টো তার রাগ দ্বিগুণ বাড়িয়ে ছোট ছোট স্বরে বললো, ‘তাহলে কি আমি ফ্যান অফ করে দিবো মাষ্টারমশাই? আম্মাজান কে বলবো লেপ, কাথা এনে দিতে?’

গরমকালে এমনিই কিছু মানুষের মেজাজ সপ্তম আসমানে থাকে। সেসব মানুষের মধ্যেই নিবিড় পড়ে। বিরক্তি আর রাগে ধমক লাগিয়ে দেয় অর্থিকে। এতো বোকা কেউ হয়? মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে মেয়েটাকে মাথায় তুলে আ’ছাড় মা’রতে নেহাৎই সে ভদ্র ছেলে নয়তো কবে যে মে’রে বসতো তার ঠিক ঠিকানা নেই। নিবিড়ের ধমকে অর্থি ভয় পেয়ে যায়৷ চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে কিছু বলতে নিলে নিবিড় চোখ গরম করে তাকায়। ভয়ে আর কিছু না বলে চুপচাপ নিজের খাতায় মন দেয়৷ বার কয়েক ঢোক গিলে অঙ্ক বই নিয়ে বসে অঙ্ক করতে নেয়। কিন্তু নিবিড়ের চোখ গরম আর ধমকে তার মাথার মধ্যে সব অঙ্কেরা জট পেকে যায়। পিটপিট করে বইয়ের দিকে আর খাতার দিকে তাকিয়ে থেকে মাথা চুলকাতে শুরু করে। নিবিড় ততক্ষণে ঠান্ডা হাওয়া গায়ে লাগিয়ে শান্ত হয়ে গেছে। অর্থির অযথা বসে থাকা দেখে গম্ভীর স্বরে বলে,

‘এই মেয়ে! বসে বসে মাথা চুলকাও কেন? তোমাকে মাথা চুলকানোর কাজ দিয়েছি নাকি অঙ্ক কষতে বলেছি?’
অর্থি জবাব দেয় না। কলম মুখে পুড়ে নিজ মনে অঙ্কের দিকে চেয়ে রইলো। অঙ্কটা তার বেশ চেনা চেনা মনে হচ্ছে। অর্থির এমন এক ধ্যানে অঙ্কের দিকে চেয়ে থাকা দেখে ভ্রু কুঁচকে নেয় নিবিড়। নিজেও কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে,
‘অঙ্ক না করে বসে বসে অঙ্কের চেহারা কেনো দেখছো? কি সমস্যা?’
অর্থি বেশ উত্তেজিত স্বরে বললো, ‘মাষ্টারমশাই! এই অঙ্ককে বেশ চেনা চেনা মনে হচ্ছে! আগেও কোথাও দেখেছি মনে হয়!’

নিবিড়ের গা জ্বা’লা করে উঠলো। ইচ্ছে করলো কয়েক ঘা বসিয়ে দিতে। নিজের রাগ দমন করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো। শেষে গিয়ে চোয়াল শক্ত করে বললো,
‘তোমার মতো গা’ধা, গ’র্দভ, মাথামোটা, ইডিয়েট মেয়ে আমি এজন্মে একটাও দেখিনি৷ গত এক সপ্তাহ থেকে আমি তোমাকে এই বিষয়ের অঙ্ক করাচ্ছি। এটা অন্তত পক্ষে ১০ বার করিয়েছি আর এখন এসে তুমি বলছো এই অঙ্ক তোমার চেনা চেনা মনে হচ্ছে! তোমাকে কি করা উচিত?’

অর্থি মাথা নিচু করে নেয়। নিবিড় রেগে গেছে বুঝে সে আর একটা টু শব্দও করে না। তবে মন আনচান করছিলো এটুকু বলতে, ‘আপনার জন্যই তো গুলিয়ে ফেলেছি। আপনি আমাকে ধমক না দিলে কি ভুলে যেতাম!’ কিন্তু বলার মতো সাহস না থাকায় চুপচাপ খাতার পৃষ্ঠা উল্টিয়ে আগের অঙ্ক দেখে নেয়। তারপর নিজ মনে অঙ্ক করতে থাকে। নিবিড় হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। প্রায় ১ টা মাস হতে চললো অথচ এই মেয়েকে একটা অঙ্কও ঠিক ভাবে শেষ করাতে পারলো না। এভাবে কতদিন চলবে? নাহ! এবার একটা কিছু করতেই হবে। অনেক ভেবে চিন্তে একটা সিদ্ধান্তে এসে পৌছোয়। গলা পরিষ্কার করে বেশ গম্ভীর স্বরে অর্থিকে উদ্দেশ্য করে বলে,

‘এ মাস শেষ হলে আমি আর তোমাকে পড়াবো না অর্থি। আমি তোমার আব্বাজানকে বলে দিবো!’
হাত থেমে যায় অর্থির। চোখ ছোট ছোট করে তাকায় নিবিড়ের দিকে৷ অজানা কারণেই বেশ খারাপ লাগে। মাষ্টারমশাই সত্যিই আর তাকে পড়াবে না? কেনো? সে কি এতোটাই খারাপ ছাত্রী! নাহ তো। অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বিড়বিড় করে বলে,
‘আমি কি খারাপ ছাত্রী নাকি? নাহ তো। আমি অনেক ভালো ছাত্রী। শুধু একটু পড়ি নাহ তাই বলে মাষ্টারমশাই আমাকে পড়ানোই বাদ দিবে? আমার না হয় একটু পড়তেই ইচ্ছে করে না তাই বলে উনি এমন করবে?’

জমিদার বাড়ির বিশাল দীঘির সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছে চৈত্রিকা। রোদ কমে গেছে। সূর্যও ডোবা ডোবা ভাব। গোধুলী লগ্নের হালকা আলো এসে ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশ। চৈত্রিকা কিছুক্ষণ মুগ্ধ দৃষ্টিতে সবটা দেখে দীঘির দিকে এগিয়ে যায়। শান বাঁধানো সিড়িতে বসে পা ডুবিয়ে দেয় দীঘির জলে। স্বচ্ছ পানিতে স্পষ্ট ফুটে ওঠে তার প্রতিবিম্ব। নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে কিছু ভাবতে থাকে। ঠিক সে সময়ই ভেসে আসে এক পুরুষালী কন্ঠ। ঘাড় বাকিয়ে পিছু তাকাতেই চোখে পড়ে পিয়াসকে। চৈত্রিকা মনে মনে হাসে। তবে মুখভঙ্গির একটুও পরিবর্তন করে না। নিজের মতো উঠে দাঁড়িয়ে পিয়াসের মুখোমুখি হয়। পিয়াস দু পা এগিয়ে আসে। বেশ শান্ত স্বরে বলে,

‘এই অবলোয় এখানে কি করছেন বড় ভাবী? সাঝের সময় মেয়ে বউদের বাহিরে থাকতে নেই। অন্তত আমাদের জমিদার বাড়ির বউদের তো আরো আগেই না।’
‘কেনো মেজো ভাই? সাঝের সময় বাহিরে থাকতে সমস্যা কোথায়?’
পিয়াস অদ্ভুত ভাবে হাসে। নিজের শার্টের হাতা গোটাতে গোটাতে বলে, ‘সে তো অনেক সমস্যা আছে। এসব ছাড়ুন। আপনার কি অবস্থা? বিয়ে তো করলেন! বড় ভাইজানের ব্যাপারে সব জানেন তো?’
চৈত্রিকা ভ্রু কুঁচকে তাকায়। হাত বগলদাবা করে বলে, ‘কি জানবো?’

পিয়াস উত্তর দেয় না। শুধু হাসে। তারপর পেছনে ঘুরে চলে যেতে যেতে বলে, ‘মহুয়া ভাবীজানের মৃ’ত্যু কিন্তু এই দীঘির পানিতেই হয়েছে।’
চমকে ওঠে চৈত্রিকা। সে আগেই জানতো এ দীঘির জলেই মহুয়ার মৃ’ত দেহ উদ্ধার হয়েছিলো কিন্তু পিয়াসের বলার মাঝে অন্য কিছু ছিলো। কি ছিলো? সাবধান বাণী নাকি আসন্ন বিপদের আভাস!

কাল সকালের দিক থেকেই মনটা বিষণ্ন ছিলো অর্পিতার। চিত্রর মুখে অন্য কাউকে ভালোবাসার কথা শুনে তার যেনো হৃদপিণ্ডই কিছুক্ষণের জন্য থেমে গেছিলো। যার জন্য পুরো ৪ টা বছর সে অপেক্ষা করলো! যার ভালোবাসা পাওয়ার তৃষ্ণায় সে প্রতিটা মুহুর্ত ছটফট করলো সেই মানুষটাই কি সুন্দর এক লাইনে বললো, ‘আমি অন্য কাউকে ভালোবাসি।’ সুন্দর না? আসলেই তো সুন্দর।

ঘরের এক কোণের মেঝেতে বসে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে আনমনে অনেক কিছুই ভাবছিলো অর্পিতা। কালকের ঘটনাগুলো মনে পড়লেই নিজের প্রতি নিজের তাচ্ছিল্যতা বেড়ে চলেছে। সে এই মানুষটাকে ভালোবাসে! যে তার ভালোবাসার মূল্যই দেয় না। নিজের ওপর নিজের আকাশ সমান রাগ হলো। কেনো তার ভেতরের আবেগ, মোহ কাটে না? কেনো বার বার এই পুরুষটার মায়াতে আষ্টেপৃষ্টে যায় সে? রাগের সাথে সাথে ভীষণ কান্নাও পেলো। ভাঙা ভাঙা স্বরে আওড়ালো,

‘তোর জন্য বড্ড মায়া হচ্ছে রে অর্পিতা। তুই যে কেনো এতো বোকা! কেনো ভালোবাসার মতো ভুল করে তিলে তিলে ম’র’ছিস? কি দরকার ছিলো? এখন শান্তি পাচ্ছিস! তোর কপালে ওই এক টুকরো সুক্ষ্ম সুখই নেই। যা তুই চিত্র ভাইয়ের থেকে চাস!’
ক্ষণেই হেঁসে উঠে। রাগ, কান্না, হাসি সব যেনো একসাথে এলো। নিজেকে পাগল মনে হলো তার। অনুভূতি শূণ্যের মতো চেয়ে রইলো জানালায়। সে সময় খট করে দরজা খুলে যায়। সেদিকে একটুও ভ্রুক্ষেপ করে না অর্পিতা। অর্থি ঘর অন্ধকার দেখে বেশ ভয়ে ভয়ে ডাকে,

‘ওহ আপু! কোথায় তুমি? তোমার ঘরের আলো কই? ওহ ভাবীজান আপুরে তো দেখতে পাই না!’
অর্পিতা ফট করেই জানালা থেকে চোখ সরালো। অর্থি ভাবীজান ডাকলো! চৈত্রিকা এসেছে? তার ভাবনার মাঝেই চৈত্রিকার নরম স্বরে ভেসে আসা বাক্য কানে আসে,
‘ভয় পেও না অর্থি। দাঁড়াও! আমি লাইট জ্বালিয়ে দিচ্ছি। সুইচ কোন দিকে জানো তুমি?’

অর্থি বলে দেয় কোনদিকে সুইচ বোর্ড। চৈত্রিকা সে অনুযায়ী হাতড়ে হাতড়ে সুইচ অন করে। ততক্ষণ পর্যন্ত অর্থি হাত চেপে ধরে থাকে। লাইটের আলো চোখে পড়তেই অর্পিতা চোখ মুখ কুঁচকে নেয়। আর অর্পিতাকে ওভাবে বসে থাকতে দেখে আঁতকে ওঠে অর্থি। ছুটে এসে অর্পিতার পাশে বসে বলে,
‘আপু! তুমি এখানে বসে আছো কেন? কি হয়ছে আপু? তোমার চোখ মুখ এমন কেন?’

চৈত্রিকাও ততক্ষণে এগিয়ে এসেছে। হাটু মুড়িয়ে বসে অর্পিতার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। বুঝতে পারে কোনো কারণে অর্পিতা মন থেকে ভেঙে পড়েছে আর এজন্যই তার এমন বি’ধ্বস্ত রুপ। অর্থির প্রশ্নের উত্তর দেয় না অর্পিতা। চুপচাপ নিজ জায়গায় ওভাবেই বসে থাকে। চৈত্রিকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
‘আপু উঠুন! এখানে বসে আছেন কেনো?’

অর্পিতা কোনো কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ নিজ জায়গা থেকে উঠে। তারপর ঢুলতে ঢুলতে বিছানায় খাটের সাথে হেলান দিয়ে বসে। অন্যদিকে তাকিয়ে বলে,
‘লাইট অফ করে তোমরা যাও। আমি ঘুমাবো!’
অর্থি কিছু বলতে নিলে হাত আটকে থামিয়ে দেয় চৈত্রিকা। চোখের ঈশারায় চুপ করে থাকতে বলে। এরপর নিজে আস্তে করে বলে, ‘লাইট টা জ্বালানোই থাকুক আপু। আপনি এভাবেই ঘুমান।’

অর্পিতা কিছু বলে না। অর্থির হাত ধরে ঘর থেকে বের হয় চৈত্রিকা। অর্থি অবুঝ স্বরে শুধায়,
‘ভাবীজান আপুর কি হয়ছে? আপু এমন করলো কেনো? একা রেখে আসলেন কেনো? আপু কি সত্যিই ঘুমাবে?’
‘মনে হয় আপুর মন খারাপ। তাই উনি এখন একা থাকতে চাচ্ছে। আমরা না হয় পরে উনার সাথে গল্প গুজব করবো! এখন তুমি গিয়ে পড়তে বসো। আমিও ঘরে যাই!’

অর্থি মাথা নাড়ায়। মনে পড়ে যায় নিবিড় তাকে পড়াবে না বলেছে। মনটা খারাপ হয়ে যায়। চৈত্রিকার সাথে পা মিলিয়ে নিজের ঘরের উদ্দেশ্যে হাঁটা লাগায়। মনে মনে বেশ শক্ত পোক্ত প্রতিজ্ঞা করে। এবার থেকে সে একটুও ফাঁকিবাজি করবে না। অনেক ভালো করে পড়বে আর মাষ্টারমশাইকেও দেখিয়ে দেবে সেও যে পড়ালেখা করতে জানে! হুহ।

চৈত্রিকা অর্পিতার বিষয়টা ভাবতে ভাবতেই নিজেদের ঘরে আসে। প্রহর ততক্ষণে শুয়ে পড়েছে। এতো তাড়াতাড়ি প্রহরকে শুয়ে পড়তে দেখে ভ্রু কুঁচকে যায় চৈত্রিকার। বিয়ের শুধুমাত্র ২ রাত হয়েছে এবাাড়িতে। আর এই দুই রাতেই চৈত্রিকাকে কিছুটা হলেও ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে থাকতে হয়েছে। প্রহর পুরোপুরি কাছে না আসলেও বেশ অনেকটাই কাছে আসে। ততটা সময় চৈত্রিকার আল্লাহকে স্মরণ করতে করতেই সময় কেটে যায়। আজ আগে আগেই শুয়ে পড়েছে! কিছুটা সন্দেহ হলেও স্বস্তির শ্বাস ফেলে।

আজ আর তাকে ভয় পেতে হবে না। চুপচাপ নিজে কিছুক্ষণ ব্যালকনিতে ঘুরে ফিরে এসে শুয়ে পড়ে। প্রহরের চেয়ে বেশ খানিকটা দুরত্ব রাখে। অনেকটা রাত পেরিয়ে যাাওয়ার পরও ঘুম আসে না। এপাশ ওপাশ করতে করতেই সময় কাটে অনেকক্ষণ। হুট করেই গরম, উত্তপ্ত কিছু এসে ঠেকে চৈত্রিকার পেটের ওপর। চৈত্রিকা চমকে উঠে সরে যায়। খেয়াল করে প্রহর গোঙাচ্ছে আর বিড়বিড় করে কিছু বলছে। হঠাৎ প্রহরের এমন অবস্থায় বেশ ঘাবড়ে যায় চৈত্রিকা। কাঁপা কাঁপা হাতে প্রহরের হাত ছুঁয়ে দেখে গা পু’ড়ে যাচ্ছে রীতিমতো। চমকে হাত সরিয়ে কান টা এগোয় প্রহরের দিকে। ভাঙা ভাঙা ভাবে কিছু বাক্য এসে কানে বা’রি খায়,

‘তুমি প্র’তারক! তোমরা প্র’তারক! আমি তোমাকে যেভাবে ভালোবেসেছি তুমি বাসোনি মহুয়া। তুমি বাসোনি।’
জ্বরের ঘোরে কথাগুলো বার বার আওড়াচ্ছে প্রহর। চৈত্রিকা সরে এসে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো মুখের দিকে। মহুয়া প্রহরকে ঠ’কিয়েছে! ভালোবাসেনি! কই? সে তো শুনেছিলো মহুয়া আর প্রহর একে অপরকে ভীষণ ভাবে ভালোবাসে! তবে কি এই দেখার মাঝেও আরো দেখা আছে? চারপাশে চোখ বুলায় চৈত্রিকা। বিড়বিড় করে বলে,
‘এই জমিদার বাড়ির ইট, পাথরেও যেনো র’হস্যের গন্ধ। শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবো!’

রাত যত গভীর হচ্ছে ততই প্রহরের জ্বর বাড়ছে। গায়ের উত্তাপ বাড়ছে ক্ষণে ক্ষণে। চৈত্রিকা কি করবে ভেবে পেলো না। ইচ্ছে করলো না প্রহরের সেবা করতে আবার এভাবে কতক্ষণ তাও ভেবে পেলো না। এক মন যেনো বুলি আওড়াচ্ছে, ‘প্রহর তো তোমার স্বামী তবে ওর সেবা করতে দ্বিধা কোথায়? মানলাম তুমি প্র’তিশোধের জন্য এসেছো তাই বলে কি মানুষ হয়ে মনুষ্যত্বও ত্যাগ করলে!’

চৈত্রিকা পর্ব ৯

পরক্ষণেই যেনো বিবেক যুদ্ধ ঘোষণা করছে মনের বিরুদ্ধে। ভীষণ কড়া ভাবে তাকে শাসিয়ে বলছে, ‘তুমি এসেছোই ওদের মা’রতে তবে এখন ম’রুক না হয় বাঁচুক তাতে তোমার কি?’
মন মস্তিষ্কের বিরোধিতায় চৈত্রিকা বোকার মতো বসে বসে তাকিয়ে রইলো প্রহরের দিকে। কি করবে আর কি করবে না তা মাথাতেই আসলো না!

চৈত্রিকা পর্ব ১১