অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব ৭

অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব ৭
জিন্নাত চৌধুরী হাবিবা

দুরুদুরু বুক কাঁপছে তরীর, হাত কাঁপছে। এখনো তার চোখেমুখে বিষ্ময় খেলে যাচ্ছে। অল্প অল্প শরীর ঘামছে।
হুট করে করেই রিকোয়েস্ট এলো আর সে একসেপ্ট ও করে নিলো। মাহমুদের মেসেজের জবাব দেবে কি দেবেনা দ্বিধাদ্বন্দে কেটে গেল অনেকটা সময়। পরক্ষণে ঠিক করলো জবাব দেবে। হয়তো মাকে অনেকক্ষণ ধরেই খুঁজে যাচ্ছে লোকটি।
তরী ফোনের কি-বোর্ডে কাঁপা কাঁপা হাত চালালো।

❝জি, আন্টি আমাদের ঘরে।❞
ছোট্ট জবাব দিয়ে শ্বাস ছাড়লো তরী। টুংটাং করে আবার মেসেজ ভেসে এলো।
❝কষ্ট করে মাকে একটু পাঠিয়ে দিন।❞
আয়েশা আন্টিকে ডাকতে গিয়েও থেমে গেল তরী। কি বলে আন্টিকে পাঠাবে? উনার ছেলের কথা বললে যদি উল্টোপাল্টা মানে বের করেন, তীক্ষ্ণ চোখে তাকান? তবে তরী লজ্জায় ম*রে*ট*রে যেতে পারে। তার মনে তো এসব কিছুই নেই। সে আবারও মাহমুদের আইডি ঘেঁটে মেসেজ করলো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

❝আন্টিকে কি বলে পাঠাবো? যদি জিজ্ঞেস করেন আপনি উনাকে ডেকেছেন, তা আমি কিভাবে জেনেছি?
তখন কী বলবো?❞
নিরবে কে*টে গেল কিছু মুহুর্ত। অনেকটা সময় পর মাহমুদের আইডি স্ক্রিনে আবাটও ভেসে উঠলো। সাথে টুং করে ছোট্ট একটি আওয়াজ হলো,
❝দরজা খুলুন তরী।❞

পরপরই দরজায় বেল বাজলো। ভড়কে গেল তরী। তার মাঝে উঠে দরজা খুলে দেওয়ার কোন লক্ষণ নেই। সে একটা ঘোরের মাঝে পড়ে রইলো। মায়ের আলাপ-আলোচনায় ব্যাঘাত ঘটায় বিরক্ত হলেন তিনি। তরীকে বললেন,
-“যা তো, দরজাটা খুলে দিয়ে আয়। তোর বাবা বা মিঠু হতে পারে!”
তরী মাকে বলতে চাইলো,
“আমার বাবা-ভাই কেউ নয় মা। দরজায় আমার জন্য একরাশ লজ্জা দাঁড়িয়ে আছে।”

বলতে না পেরে মায়ের তাড়ায় ধীর পায়ে দরজার দিকে এগোলো তরী। দরজা খুলে দাঁড়াতেই মুখের উপর লম্বা চওড়া একটা মানুষ ঝুঁকে থাকতে দেখে ভয় পেয়ে কয়েক কদম পিছিয়ে গেল তরী। একবার পেছনে তাকিয়ে মা আর আন্টির দৃষ্টির অবস্থা বুঝে নিলো। সরাসরি মাহমুদের চোখে তাকাতে পারলোনা। তার এলোমেলো দৃষ্টি আশেপাশে গিয়ে ঠেকছে। মাহমুদ ভীষণ শীতল কন্ঠে শুধালো,

-“দরজা খুলতে এত দেরি হলো কেন, তরী? অপেক্ষায় ছিলাম তো।”
তরীর শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেল। শিরশির করে উঠলো প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। সে তো খুব একটা দেরি করেনি। দু-মিনিটের দেরিতে নিশ্চয়ই লোকটি অপেক্ষা করতে করতে শুকিয়ে যায়নি! ফ্যালফ্যাল করে তাকালো তরী। তার দৃষ্টিতে স্পষ্ট দ্বিধা। মাহমুদ আরেকটু ঝুঁকলো, ঘাড় নিচু করে ক্ষীণ দূরত্ব মিটিয়ে গাঢ় স্বরে বলল,
-“ লুকিয়ে দেখছেন কেন, তরী? ভেতরে ঢুকতে দেবেন না?”

তরী থতমত খেয়ে দ্রুত দরজা ছেড়ে সরে দাঁড়ালো। স্পষ্ট লজ্জার আভা তার গালে ফোটে উঠেছে। ভয়া*বহ লজ্জায় ক্রমাগত গাল দুটো একটু একটু করে ফুলছে। ভেঙে ভেঙে জবাব দিলো তরী,
-“আ..আসুন।”
মাহমুদ হাসলো, খুবই অল্প। তরী বুঝে ওঠার আগেই ভেতরে প্রবেশ করলো।
গম্ভীর পুরুষালি কন্ঠে ডাকলো,
-“মা।”
আয়েশা সুলতানা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন। জিজ্ঞেস করলেন,

-“কখন ফিরেছিস?”
-“একঘন্টা আগেই।”
-“আসছি ভাবি।”
বলে উঠে পড়লেন আয়েশা সুলতানা। তরীর মা বললেন,
-“বসুন ভাবি।
বাবা বসো। চা খেয়ে তারপর যেও।”
মাহমুদ চমৎকারভাবে হাসলো। ভদ্রতা করেই বলল,
-“আমি চা খেয়েছি আন্টি। তাড়াহুড়োর দরকার নেই।”
-“আরে বসো তো বাবা।”
আয়েশা সুলতানাও বললেন,

-“আচ্ছা একটু পরে যাস। এখন একটু বস।”
বৈঠকাখানার সোফায় আরাম করেই বসলো মাহমুুদ।
অরু তাকে দেখে লুকিয়ে পড়লো সোফার পেছনে। মাহমুদ মিটিমিটি হেসে ফোন কানে তুললো। মিছেমিছি কারো সাথে কথা বলার ভঙ্গিতে বলল,
-“হ্যালো, বুড়োলোক। আপনি কবে আসবেন? অরু কিন্তু আমার সামনেই আছে। সোফার পেছনে ঘাপটি মে*রে লুকিয়ে আছে। ও আচ্ছা আপনি তাহলে পথেই আছেন? তাড়াতাড়ি চলে আসুন। আমরা অরুকে আপনার সাথে আজই বিদায় করে দেবো।”

অরু ভয় ভয় চোখে তাকিয়ে ছিল। এবার আর রিস্ক নিলোনা। এক দৌঁড়ে রামির ঘরে গিয়ে দরজা আটকে দিলো। সে বুড়োলোকের সাথে কিছুতেই যাবেনা।
মাহমুদ মুখ চেপে শরীর দুলিয়ে হাসলো। কোন শব্দ হলোনা। আয়েশা সুলতানা সবটা না জানলেও এই মুহূর্তের ঘটনায় তিনিও হাসিতে যোগ দিলেন।
তরী মায়ের সাথে রান্নাঘরে চলে গেল। চায়ের কথা বললেও হাতে হাতে কিছু নাস্তা নিয়ে তরীকে পাঠালেন মা। তিনি চা নিয়ে আসছেন।
তরী টি-টেবিলের উপর নাস্তা রেখে নরম স্বরে বলল,

-“নিন।”
মাহমুদ বিব্রত তরীকে খুব মনযোগ দিয়ে দেখলো। তরী যখন লজ্জা পায়, তখন তাকে ভীষণ স্নিগ্ধ দেখায়। মাহমুদ মুগ্ধ হয়। কতভাবে যে লজ্জা পাওয়া যায় তা মেয়েদের তরীর কাছ থেকে শেখা উচিত। কারণে-অকারণে, হুটহাট লজ্জা পাওয়া মেয়েটাকে কোন কারণ ছাড়াই মাহমুদের চোখে বিশেষ কেউ মনে হয়। সে নাস্তা নিলোনা। তরীর মা চা নিয়ে আসতেই এক কাপ চা হাতে নিলো। ছোট্ট ছোট্ট চুমুক বসিয়ে চোখ বুলিয়ে নিলো সামনে থাকা ঘরের প্রতিটি কোণে। সকল আসবাবপত্রের সাথে সাথে তরীও ছিলো তার দৃষ্টির শিকার। ওই ধারালো নজর থেকে রক্ষা পেলোনা তরী। কৌশলে কয়েকবার জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটিকেও দেখে নিলো মাহমুদ। চা শেষ হতেই কাল বিলম্ব না করে মা – ছেলে ফিরে এলেন ঘরে।

গ্রীষ্মের দুপুরে খা খা করা রোদ্দুর। সূর্যের তাপে মগজ গলে পড়ার উপক্রম। তরতর করে ঘামছে শরীর। প্রচন্ড পানি পিপাসায় কাতর রোজাদার ব্যক্তিরা। আকাশ ফেটে এক ফসলা বৃষ্টির আশায় চাতক পাখির মতো চেয়ে আছে তারা। ওড়না দিয়ে মুখের ঘাম মুছে নিলো তরী। অন্যদিনের তুলনায় আজ একটু বেশিই কষ্ট হচ্ছে। ভীষণ অস্থির অস্থির লাগছে। ক্লাসের ঝামেলায় বাড়ি থেকে বের হতে হয়েছে। স্টপেজ আসতেই বাস থেকে নেমে পড়লো। এতক্ষণ মোটামুটি ঠিক থাকলেও এবার শরীর মৃদু মৃদু কাঁপছে। দাঁড়িয়ে থাকতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।

মাহমুদ কলেজ ডিউটি শেষ করে রিকশা নিলো। গাড়িতে চড়ার সময় আশপাশ পর্যবেক্ষণ করা তার অভ্যাস। চোখ পড়লো বাস স্টপেজ এর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা তরীর উপর। চোখমুখ শুকিয়ে আছে। অনেকটাই অসুস্থ দেখাচ্ছে তাকে। মনে হচ্ছে এক্ষুনি বুঝি ঢলে পড়বে। মাহমুদ রিকশা নিয়ে থামলো স্টপেজ এর সামনে। নেমে গিয়ে ব্যস্ত পায়ে তরীর সান্নিধ্যে এলো। নরম স্বরে ডাকলো,

-“তরী।”
তরী ঝাপসা ঝাপসা চোখে তাকালো। মাথা ঘুরছে তার।
মাহমুদ এগিয়ে এসে এই প্রথমবার তরীর হাত আঁকড়ে ধরলো। অনুমতি বিহীন শক্ত হাতের মুঠোয় নিয়ে নিলো তরীর নরম হাত। তরী বাঁধা দিলোনা। দুর্বল শরীরে জড়তা আজ জায়গা পেলো না। অল্প সময়ের জন্য লুকিয়ে পড়লো ভুরি ভুরি লজ্জা। বাধ্য মেয়ের মতো মাহমুদের সাথে রিকশায় উঠলো সে। মাহমুদ চিন্তিত স্বরে বলল,

-“বেশি খা*রা*প লাগছে, তরী?”
তরী জবাব দিলোনা। চোখ বুজে রিকশার হুড আঁকড়ে বসে রইলো।
মাহমুদ রিকশা ছেড়ে হুট করেই নেমে পড়লো। পাশের দোকান থেকে এক বোতল ঠান্ডা পানি কিনে নিলো। দোকানি লোকটি বাঁকা চোখে তাকালেন। রমজান মাসে কিছু কিনতে দেখলেই মানুষ ভাবে লোকটি বুঝি রোজা রাখেনি! মাহমুদ অবশ্য দোকানি লোকটির দৃষ্টিকে পাত্তা দেয়নি। টাকা পরিশোধ করে রিকশায় উঠলো।

-“তরী।”
চোখ খুলে তাকালো তরী। মাহমুদ ঠান্ডা পানির বোতল এগিয়ে বলল,
-“ঠান্ডা পানি এনেছি আপনার জন্য।”
মাহমুদ নিজেও ঘেমে জবুথবু অবস্থা। শার্টের টপ বোতাম দুটো খুলে দিলো। চেহারা লাল হয়ে আছে তার।
তরী আতঙ্কিত স্বরে বলল,
-“আমি রোজা ভাঙবো না।”
গভীর শ্বাস ছাড়লো মাহমুদ।
-“আচ্ছা, মাথায় একটু পানি দিন। ভালো লাগবে।”

বোতলের মুখ খুলে তরীর হাতে ধরিয়ে দিলো মাহমুদ। তরী ওড়না সরিয়ে মাথার তালুতে সামান্য পানি দিলো। এখন একটু ঝরঝরে লাগছে। রোজার সময় অতিরিক্ত গরম পড়লেই তরীর এমন দুর্বল দুর্বল লাগে। এটা নতুন নয়। কিন্তু মাহমুদের জন্য নতুন।
-“বসতে কষ্ট হচ্ছে তরী? আমি হাত ধরে বসবো?”

ক্লান্তির মাঝেও তরী একটুখানি হাসলো যেন! কেমন অকপটে আপজনের মতো ট্রিট করছে তাকে। এই প্রথম তার মনে হলো লোকটির স্বাভাবিক কথায়ও ছন্দ আছে। মানুষকে বা*জে*ভা*বে আকৃষ্ট করার ক্ষমতা আছে। সে মানুষটি তরী নিজেই। তরী দু’দিকে মাথা দুলিয়ে ছোট্ট করে জবাব দিলো,
-“এখন অনেকটা ঠিক লাগছে।”

মাহমুদ স্বস্তির শ্বাস নিলো। দূর দূর সম্পর্ক হওয়ায় সবকিছুতেই অনুমতি নিতে হচ্ছে। পাছে তরী তাকে ম*ন্দ*লো*ক ভেবে বসে।
রিকশা থেকে নেমে তরীকে চারতলা পর্যন্ত এগিয়ে দিলো মাহমুদ। তরী দরজায় বেল দেওয়ার আগেই মাহমুদ বলল,
-“শরীরের যত্ন নেবেন, তরী।”
পরপরই সিঁড়ি বেয়ে তিনতলায় নেমে গেলো। তার কথা খানায়ও ভীষণ যত্ন গোপন করা। তরী ততক্ষণ তাকিয়ে রইলো, যতক্ষণ মাহমুদের চিহ্ন নিশ্চিহ্ন না হয়েছে।

তারাবি নামাজ শেষ করে মাহমুদ, রামি দুই-ভাই বাসায় ফিরলো তরীর বাবা আর ভাইয়ের সাথে। রামি, মিঠু দিজনেই দুষ্টুমি করতে করতেই বাড়ি ফিরেছে। মাহমুদ তরীর বাবার সাথেই খুটিনাটি আলাপ চালাতে চালাতেই ফিরলো। আয়েশা সুলতানা ছেলেদের দেখে বললেন,
-“বসে পড়, খাবার দিচ্ছি আমি।”

তিনজনে খেতে খেতে আয়েশা সুলতানা কথা তুললেন মাহমুদের উদ্দেশ্য।
-“চাকরি-বাকরি করছিস। সংসারে ঝুটঝামেলা নেই। এবার মেয়ে দেখি তোর জন্য?”
জবাবের আশায় তাকিয়ে রইলেন আয়েশা সুলতানা।
মাহমুদ খাওয়া থামালোনা। ধীরে সুস্থে মুখের খাবার গিলে নিলো। শান্ত স্বরেই মাকে জবাব দিলে,
-“এখন নয়, মা।”
-“এখন নয় তো কখন? তুই কি বিয়ে-সাদী করবি না?”
মাহমুদ নির্বিকার ভঙ্গিতে জবাব দিলো,
-“করবো।”
আয়েশা সুলতানা উৎসুক হয়ে বললেন,

-“তাহলে মেয়ে দেখি? তোর মুন্নি খালা আছে না? তিনি বেশ যাচাই-বাছাই করে দুজনকে দেখেছেন তোর জন্য। সুন্দরী, শিক্ষিত। তুই বললেই আমরা দেখতে যাব।”
-“এখন বিয়ে করবো না, মা।”
রামি এতক্ষণ চুপচাপ খাবার গিললেও এবার বলল,
-“মা ভাইয়া তো বিয়ে করবেনা। তাহলে আমাকে বিয়ে করিয়ে দাও। আমার একটা মেয়েকে খুব পছন্দ। বাড়ির বউ হিসেবে এমন লজ্জাবতী, নম্র-ভদ্র মেয়ে পারফেক্ট।”
মাহমুদ কোন প্রতিক্রিয়া দেখালোনা। রামিটা যে ভারি দুষ্টু, তাকে চোখ রাঙিয়েও লাভ নেই।
আয়েশা সুলতানা জিজ্ঞেস করলেন,

অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব ৬

-“তা কে এই নম্র- ভদ্র, লজ্জাবতী মেয়ে, হুম?”
রামি ফট করেই বলে দিলো,
-“তরী আপু। তার সাথে আমাকে বিয়ে দিয়ে দাও। আমাকে গাধা থেকে মানুষ করার দায়িত্ব সে নিয়ে নেবে।”
আয়েশা সুলতানা না হেসে পারলেন না। রামিও হেসে বলল,
-“তাড়াতাড়ি বিয়ে দিও কিন্তু।”
মাহমুদ সেই কখন থেকেই রামির উপর শান্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আছে।

অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব ৮