অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব ৫

অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব ৫
ইফা আমহৃদ

” জোনাকি, কে মে’রেছে তোমায়? গালে এটা কিসের দাগ। দেখে তো মনে হচ্ছে আঙুলের দাগ। শরীরটাও তো বেশ গরম। জ্বর হয়েছে নাকি?”
রৌধিকের অতি স্বাভাবিক কন্ঠ। নিজের হাত কখনো গালে কখনো কপালে ছুঁয়ে দিচ্ছে। কি প্রত্যুত্তর দিবো খুঁজে পেলাম না। নিজের প্রশ্নের জবাব না পেয়ে রৌধিক হিংস্র হয়ে উঠলো। টেবিলের উপর রাখা শপিং ব্যাগ গুলো ছুঁড়ে ফেলল নিচে। এগুলো হয়তো আমার জন্য কিনে এনেছে। মাথা চেপে চেঁচিয়ে বলল,

“কি বলছি কানে যাচ্ছে না, আশ্চর্য। ঠিক আছে আমিই দেখছি।”
এবারও মাথা নিচু করে রইলাম আমি। রৌধিক একটা ব্যাগ তুলে এগিয়ে এলো আমার দিকে। ভয়ে ব্লাঙ্কেট মুড়ি দিলাম। রৌধিক মুখে কিছু বললেন না। ফেলে দিল ব্যাগ টা। হুট করে ব্লাঙ্কেট সমেত কোলে তুলে নিলো আমায়। দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলো। ড্রয়িং রুমে বসে ছিলো সকলে। সেখানে এনে দাঁড় করিয়ে দিল আমায়। আমি সামনে না তাকিয়েও বুঝতে পারছি, সবাই অবাক হয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের মাঝখানে ঐ মেয়েটাও বসে আছে। রৌধিকের পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। রৌধিক হাত ধরে সামনে নিয়ে এলো। দাঁতে দাঁত মিশিয়ে টেনে টেনে বললেন,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

” কে? কে মে’রেছে ওকে?”
সবাই কিংকতব্যবিমূঢ় হলেন। আদ্রিক আঙ্কেল কিয়ৎক্ষণ আমার দিকে চেয়ে থেকে বললেন,” মানে? মা’রবে মানে কী? কে মা’রবে ওকে?”
“আমিও তো সেটাই জানতে চাইছি?” একরোখা জবাব দিলো রৌধিক।
আদ্রিক আঙ্কেল আমার দিকে তাকালেন। সন্দিহান কন্ঠে বললেন,
“জোনাকি কে মে’রেছে তোমায়?”

রৌধিক যা রেগে আছে, ঐ মেয়েটাকে দেখিয়ে দিলে তাকে প্রচুর বকবে। তাই মাথা নিচু করে রইলাম। কিন্তু সবাই আমার দিকে হতাশাগ্ৰস্থ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। তাই মিনমিনিয়ে বললাম,
“কেউ মা’রে নি, এলার্জি প্রবলেম..

“চুপ। একদম চুপ। চড়িয়ে তোমার অন্যটাও লাল করে দিবো, স্টু’পিড। এখন তোমার কাছ থেকে আমাকে শুনতে হবে, কোনটা এলার্জি আর কোনটা আঙুলের ছাপ? সত্যি কথা না বললে চুপ করে থাকবে, কিন্তু মুখ থেকে যাতে কোনো আওয়াজ না বের হয়! বুঝতে পেরেছ তুমি? তাহলে আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না।”

আমার গাল থেকে চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে সবাইকে দেখালো। এখনো স্পষ্ট আঙুলের ছাপ দেখা যাচ্ছে। সবাই একে অপরের দিক জিজ্ঞাসা সূলভ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। সবাই ইশারায় নাসূচক জানালো। তখন সবাই ঐ মেয়েটির দিকে চাইল। মেয়েটি মাথা নিচু করে আছে। আদ্রিক আঙ্কেল ডাক দিলেন,

” ইয়ানাত!”
এতোক্ষণে বুঝতে পারলাম মেয়েটির নাম ইয়ানাত। সে নত স্বরে বলল,”আসলে ও আমাকে ধাক্কা মেরেছিল।”
“তাই বলে তুমি ওর গায়ে হাত তুলবে।”
“আঙ্কেল ও ইচ্ছে করে আমাকে ধাক্কা দিয়েছিল। তাই। আমি বুঝতে পারি নি, এতোটা জোরে লাগবে।”

“দেখে তো মনে হচ্ছে না, আস্তে মে’রেছো। মনে হচ্ছে মনের ভেতরের ক্ষোভ থেকে মে’রেছো। জোনাকি লেখাপড়া করা একটা মেয়ে। ও তোমার মতো এতোটা অস’ভ্য মেয়ে নয় যে, তোমাকে ধাক্কা দিবে। [আমাকে উদ্দেশ্য করে] যখন তোমাকে মেরেছে, তখন তুমিও কয়েকটা মেরে দিতে। তাহলে নেক্সট টাইম মারার সাহস হতো না।
বাবা, তোমার বন্ধুর মেয়ের বিহেবিয়ার যদি চেঞ্জ করতে না পারে, তাহলে আমাদের বাড়িতে আসতে বারণ করে দাও।” রৌধিকের তেড়া উত্তর।

ইয়ানাতের গম্ভীর মুখ। স্বাভাবিক স্বরে বলল,”আঙ্কেল আমি আসছি।” ইয়ানাত বেরিয়ে গেল।
রৌধিক সার্ভেন্ট কে দুজনের জন্য খাবার আর আইসব্যাগ নিয়ে আসতে বলল। আইসব্যাগ আনতে দেরী হচ্ছে দেখে আবার চেঁচিয়ে উঠলো। আইসব্যাগ দিয়ে গালে ঘসে দিল। পুনরায় আমাকে কোলে তুলে নিল। রুমে এনে বেডের উপর বসিয়ে দিল। জামা কাপড় গুলো তুলে স্বযত্নে কাবার্ডে গুছিয়ে রাখল। ব্যাগ গুলো ভাঁজ করতে করতে বললেন,”আজকে আর জামা কাপড় চেঞ্জ করতে হবে না। একদম কালকে।”

ইতিমধ্যে খাবার দিয়ে গেছে। রৌধিক খাবার খাচ্ছে। আমি রৌধিকের দিকে চেয়ে আছি। মানুষটা একদম ভিন্ন রকমের। সেদিন আমার সাথে কেমন ব্যবহার করলো, আর আজ। আজকে আমার জন্য বাড়ি মাথায় তুলেছে। অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি আমি আর তিনি বিদেশি মানুষ। কতো বছর বিদেশে ছিলেন। আমি কী আদোও তার যোগ্য। ভাবতে ভাবতে অজান্তেই বলে ফেললাম,

” আমি আপনার যোগ্য নই, তাই না?”
“মানে..
নিজের ভেতরে ফিরলাম আমি। কী বলতে কী বলে ফেলেছি। মৃদু স্বরে বললাম,” ক- কিছু না?”
“জোনাকি, কে বলছে এইসব?”
“কেউ বলেনি। আমি নিজেই বলছি।”

“আমি জানতে চাইছি, কে? কে বলেছে? কানে যাচ্ছে না আমার কথা। আর কি বলছে? ” চেঁচিয়ে বললেন সে।
কাঁপতে কাঁপতে বললাম,”ব বলেছে, আমাকে রাস্তা থেকে তুলে এনেছে। এখন এই ধরনের জামা কাপড় প-পড়েছি। পরে তাও থাকবে না।”

ধমকে বললেন তিনি,
“ই’ডিয়েট, একটা। আমার সাথে কথা বলার সময় তো মুখ থেকে খই ফোটে। তখন কেন মুখে খই ফোটে নি? আমি যখন জিজ্ঞাসা করেছি, তখনও তো বলতে পারতে? আশ্চর্য মেয়ে।”
” ভয় করছিলো ত?”
“আমার সামনে ইয়ানাত তোমাকে খেয়ে ফেলতো?”

“আমার তো আপনাকে ভয় করছিলো।”
রৌধিক একগাল হাসলো। বাম গালে গর্তের সৃষ্টি হলো। অপূর্ব লাগছিল তাকে। হারিয়ে গেলাম তার রুপের মাঝে। তুরি বাজালো। ধ্যান ভাঙল আমার। বাম হাতে নিজের সাথে দৃঢ় করে মুড়িয়ে নিলেন। ভ্রু নাচিয়ে বলল,”
“আই নো, আ’ম এ প্রিটি বয়। সো দেয়ার ইজ নাথিং টু লুক এট মি! বুঝেছ?”
বলেই নাক ধরে টেনে দিলেন।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে এসেছে। সকালে বাড়ি থেকে বের হয়েছি‌। ঘুম থেকে উঠার পরে রৌধিকের দেখা পাই নি। আমি উঠার আগেই সে কোথাও একটা চলে গেছে। সময় ছিল ১০ টা ৯ মিনিট। সরাসরি হসপিটালে গিয়েছিলাম বাবাকে দেখতে। কড়া মেডিসিন আর স্যালাইনের কারণে ঘুমাচ্ছে সে। জয়া স্কুলে গেছে। এতোক্ষণ বসে ছিলাম সেখানে। বাবার ঘুম ভাঙে নি। জয়াও আসেনি। তাই বেরিয়ে পড়েছি। ডাক্তার বলেছে আরো কয়েকদিন লাগবে। তারপরে বাবাকে হসপিটাল থেকে রিলিজ করবে। আদ্রিক আঙ্কেল হসপিটালের বিল মিটিয়ে দিয়েছিল। এখানেও পাবে,

বেশ ক্ষুধার্ত আমি। ইদানিং খাবারে অনিয়ম করলে বমি বমি পায়। অসুস্থ লাগে। কাঁধ থেকে ব্যাগ বের করে টাকার পরিমাণ গুনে নিলাম। ব্যাগের ভেতরে আর মাত্র বিশ টাকা পড়ে আছে। দশ টাকার কচকচে দুটো নোট। অথচ এখান থেকে রৌধিকদের বাড়িতে যেতেই ত্রিশ টাকা খরচ হয়। একবার ভেবেছি রৌধিকদের বাড়িতে পৌঁছানোর আগে গাড়ি থেকে নেমে বাকি পথটা হেঁটে যাবো। কিন্তু ক্ষুধায় সহ্য হচ্ছে না।

কিছুটা পথ পেরুতেই শরীরটা আরো ক্লান্ত ঠেকলো। মাথাও ধরেছে। বমি বমি ঠেকছে শরীর টা। বিপরীত পাশে টং দোকান নজরে গেল আমার। ধীরে ধীরে রাস্তা পেরুলাম। এক কাপ চা দিতে বললাম। ড্রাম থেকে এক গ্লাস পানি তুলে চোখ মুখে ছিটিয়ে দিলাম। মাথায়ও পানি দিলাম। অতঃপর আঁচল দিয়ে মুছে নিলাম।

চা আর বিস্কিট নিয়ে টুলের উপর বসলাম। আরেকটু জিড়িয়ে হাঁটা ধরবো। বিস্কিট ভিজিয়ে ভিজিয়ে খেলাম। শেষ অংশ টা মুখে তোলার আগেই গলে পড়লো নিচে। চায়ের কাপ মুখের দেওয়ার আগেই ধাক্কা দিলো কেউ। অধরে গরম ছ্যাকা লাগলো। দ্রুত কাপ সরিয়ে পাশে তাকিয়ে কিছু বলার উদ্যোগ নিলাম। পাশ তাকাতেই আমার সব বুলি উবে গেল। হাত ফসকে চায়ের কাপ পড়ে যেতে নিলেই ধরে ফেললো শুভ।
বাবা এই শুভ সাথেই আমার বিয়ে ঠিক করেছিল। শুভ বাবার বাল্যবন্ধু।
সন্তর্পণে কাপ টা পাশে রেখে বলল,

-” তুমি দিন দিন কেমন কেয়ার ল্যাস হয়ে যাচ্ছো জোনাকি! একটু হলেই তো কাপ টা নিচে পড়ে যেত।
মামা, দুই কাপ চা। কড়া লিকার। দুধ ছাড়া।”
বলেই উঠে দাঁড়ালো। পাশে রাখা কাপটা এগিয়ে দিলো।

এক হাঁটু ভাঁজ করে টুলের উপর বসলো। আমার দিকে মুখ করে। আমার হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নিল। অন্যহাত পকেটে ঢুকিয়ে রুমাল বের করলো। আমার ভেজা চুলগুলো স্বযত্নে মুছিয়ে দিলো। ভেজা রুমাল টা বাইরে ফেলে নিগলে নিল। অতঃপর পকেটে রেখে দিলো। আদুরে গলায় বলল,

-” কি হয়েছে তোমার জোনাকি পোকা। আমি ব্যস্ত ছিলাম। তাই তোমার ফোন রিসিভ করতে পারিনি। তাই বলে তুমি নিজের ফোন বন্ধ করে রাখবে। আমি জানতাম না, আঙ্কেল অসুস্থ। যখন জানতে পারি, তোমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করি। তাহলে..

অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব ৪

তুমি যদি বলো, তাহলে আমি কাজ ছেড়ে সর্বক্ষণ আমার জোনাকির পাশে বসে থাকবো।”
তবুও আমি কোনো কথা বললাম না। প্রত্যুত্তরে কি বলবো, ভাষা নেই। চায়ের কাপ আমার হাতে দিয়ে নিজে চুমুক দিলো কাপে। কাঁপা হাতে চুমুক দেওয়ার আগেইঝড়ের গতিতে হাজির হলো কেউ। হাত থেকে কাপ নিয়ে তুমুল শব্দে নিচে ফেলে দিলো। তাকালাম আমি। রৌধিক রক্তচক্ষু করে আমার পানে চেয়ে আছে। এখানে কিভাবে এলো সে?

অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব ৬