অপ্রিয় আশালতা পর্ব ১০

অপ্রিয় আশালতা পর্ব ১০
আফিয়া অন্ত্রীশা

-সংসার ত*চ*ন*চ হয়ে গেল মানে! (সাজেদা বেগম)
মেয়ের কথা শুনে রীতিমতো তার চোখ ছানাবড়া হয়ে গিয়েছে। কা*ন্নারত অবস্থাতেই সাদের ছোট বোন তার কাধের ভ্যানিটি ব্যাগ হতে কিছু কাগজ বের করে সাজেদা বেগমের হাতে দেয়। সাজেদা বেগম সন্দিহান চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলেন, “কি এটা?” সাদ এক টানে সাজেদা বেগমের হাত হতে কাগজগুলো নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখতে শুর করে। মুহূর্তের মাঝে সাদের চোখ চ*ড়*কগাছ হয়ে যায়।

-ডিভোর্স পেপার! কাহিনী কি ছবি? ভ্রু কুচকে ছোট বোন ছবির উদ্দেশ্যে কথাটা বলে ওঠে সাদ।
-বাচ্চা হয় না কেন দিন রাত শুধু খো*টা দিতে থাকতো। ডাক্তার বলেছে যে একটু প্রবলেম আছে কিন্তু সমস্যা নেই বাচ্চা হবে। কিন্তু আমার শাশুড়ী আর ননদ মিলে সকলের কাছে রটিয়ে দিয়েছে আমি নাকি ব*ন্ধ্যা।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আমি কখনো নাকি মা হতে পারব না। আমার ফোনটা পর্যন্ত আট*কে রেখেছিল যেন বাড়িতে কল দিতে না পারি। ওরা পরিবারের সকলে মিলে সালিশ বসিয়ে রেহানের সাথে আমার ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নেয়। তার চেয়েও বড় কথা কি জানো? রেহান নাকি বুঝে গিয়েছিল আমি মা হতে পারব না।

তাই সে অন্য একটা মেয়েকে দুই মাস আগেই গোপনে বিয়ে করে নিয়েছে। আর তা একমাত্র আমার শাশুড়ির আদেশেই হয়েছিল। আজকে আমাকে দিয়ে জোরপূর্বক ডিভোর্স পেপারে স্বাক্ষর করিয়ে ঘা*ড় ধা*ক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে।

ফো*পা*তে ফো*পা*তে কথাগুলো বলে ওঠে ছবি। আদরের ছোট বোনের কথা শুনে ফু*সে ওঠে সাদ।
-আমি আজই ওদের নামে কে*স করব। এতো সাহস হয় কিভাবে? আমার বোনকে ঘা*ড় ধা*ক্কা দিয়ে বের করে দেয়ার দুঃসাহস হয় কিভাবে ওদের? (সাদ)

-হায় হায় আমার এতটুকু মেয়েটার সাথে এসব কি হয়ে গেল! কিভাবে মানুষ এত নি*ষ্ঠু*র হয়? এরা কি মানুষ আদৌ? আহা*জারি করতে করতে বলে ওঠে সাজেদা বেগম।
সাজেদা বেগমের কথা শুনে তাচ্ছি*ল্যের হাসি দিয়ে শাড়ির আচল দিয়ে আলগোছে কপালের ঘাম মুছে নেয় সাদের বড় ভাবি।

-তা আম্মা নিজের মেয়ের সংসার ভা*ঙ্গা*টা অতি ক*ষ্টের হলে অন্যের মেয়েরটা কি? যেই কাজটা আপনার মেয়ের সাথে হয়েছে বলে তাদের অ*মানুষ বলে আখ্যায়িত করছেন। খেয়াল করেছেন কি? ইনডিরেক্টলি কিন্তু কথাটা নিজেদেরকেও উদ্দেশ্য করে বলে ফেলেছেন! পাপ বাপকেও ছাড়ে না আম্মা।

কথাগুলো বলেই ড্রইংরুম থেকে সোজা নিজের ঘরে চলে যায় সাদের বড় ভাবি। সাজেদা বেগম ভ্যাবা*চেকা খেয়ে তাকিয়ে থাকে তার যাওয়ার পথে। আচমকা সাজেদা বেগমের মনের মাঝে ভিষণ ভ*য় এসে হা*না দেয়। তাদের পাপের ফলগুলো কি তবে ফলতে শুরু করেছে! আলগোছে মেয়েকে বুকে টেনে নে সাজেদা বেগম।

-আম্মা বড় ভাবি এগুলো কি বলল? ফু*সতে ফু*সতে বলে ওঠে সাদ।
-ওতো মাথায় নিস না সাদ। আগে তোর বোনের কথা ভাব। তোর ভাই আসলে ফয়সালা করতে হবে এই বিষয়ের। ওদেরকে ছেড়ে কথা বলা যাবেনা একদম।
এতক্ষণ সবই চুপচাপ দেখছিল লিনা। এদের এতো হায়-হুতাশ দেখে তার দম ফে*টে হাসি আসছে। আস্তে করে চে*পে যায় সে।

দেখতে দেখতে সেই কাঙ্ক্ষিত সময় চলে আসে। হাফসা বেগম রান্নাঘরে রাতের রান্না করছেন। আর আশালতা শোয়ার ঘরে বিছানায় বালিশে হেলান দিয়ে বসে আছে। এই কয় মাসে লাইজু বেগম ফোন দিয়ে খোজ খবর নিলেও আর বিয়ের কথা কখনো তোলেন নি। আচমকা মেয়ের আর্ত*নাদ শুনে রান্নাঘর হতে ছুটে শোয়ার ঘরে আসেন হাফসা বেগম।

-আশা কি হইছে মা? (হাফসা বেগম)
য*ন্ত্র*ণায় এপাশ-ওপাশ করতে করতে আশালতা বলে ওঠে,
-মা পেটে অনেক ব্যথা করছে। মা ম*রে যাচ্ছি য*ন্ত্র*ণায়।

ডেলিভারি ডেট এখনো গুনে গুনে তিন দিন পরে। হাফসা বেগম বুঝে ফেলেন এই য*ন্ত্র*ণা ব্য*থা সন্তান প্র*সবের সঠিক সময়ের জানান দিচ্ছে। হাফসা বেগম দ্রুত ছুটে গিয়ে নিলুফাকে কল দেন। ত্রিশ মিনিটের মধ্যেই আশালতাকে নিয়ে হসপিটালে পৌছে যায় হাফসা বেগম ,নিলুফা ও জুলহাস।

পথেই ডাঃ রুমকিকে কল দিয়ে সব খুলে বলেছে হাফসা বেগম।
দুজন নার্স এসে আশালতাকে ধরে নিয়ে একটা কেবিনে চলে যায়। এক ঘন্টা পরে বিশটা হা*ড় ভা*ঙ্গার সমান য*ন্ত্রণা সহ্য করে আশালতা জন্ম দেয় এক ফুটফুটে ছেলে সন্তান। এই য*ন্ত্র*ণা এই প্র*স*ব ব্য*থা যে পৃথিবীর ক*ষ্টকর ব্য*থাগুলোর মধ্যে একটা।

একজন নার্স এসে আশালতার ছেলেকে হাফসা বেগমের কোলে দিয়ে যায়।
-আশা কেমন আছে? (হাফসা বেগম)
-ভালো আছে আন্টি। নরমালে ডেলিভারি সক্ষম হয়েছে। একটু পরেই আশাকে একটা কেবিনে শিফট করা হবে। বলতে বলতে ডাঃ রুমকি হাফসা বেগমের দিকে এগিয়ে আসে।

হাফসা বেগম সস্তির নিশ্বাস নেন। ছলছল চোখে আশালতার ছেলের নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকান। একদম আশালতার মতো মায়াবি চেহারা পেয়েছে। কপালে চুমু এঁকে দিয়ে হাফসা বেগম বলে ওঠেন,
-তোমার মায়ের বেঁচে থাকার একমাত্র অনুপ্রেরণা তু্মি। দেখে রেখো আমার মেয়েটাকে।

ক্ষানিক বাদেই আশালতাকে একটা কেবিনে শিফট করা হয়। জ্ঞান ও ফিরেছে এর মাঝে। শরীর বেশ দূর্বল থাকায় একটা স্যালাইনও দেওয়া হয়েছে। ধীর কন্ঠে আশালতা তার মাকে ডেকে বলে ওঠে,
-মা ফোন টা একটু দেবে?

হাফসা বেগম চুপচাপ ফোনটা আশালতার দিকে এগিয়ে দেন। আশালতা তার বড় ভাই আশরাফ মোল্লার নাম্বার ডায়াল করে কল দিয়ে ফোনটা কানের কাছে নেয়। রিং হওয়ার ক্ষানিক বাদেই অপর পাশ হতে কেউ একজন সালাম দিয়ে ওঠে। আশালতা সালামের জবাব দিয়ে বলে ওঠে,

-ভাইজান কেমন আছো?
এত মাস পরে বোনের কন্ঠ শুনে চমকে ওঠে আশরাফ মোল্লা।
-আশা? বোন তুই কোথায় এখন? এতো মাস কোথায় ছিলি? কত চিন্তায় ফেলে রেখেছিস জানিস? মা কেমন আছে? কা*দো কা*দো হয়ে বলে ওঠেন আশরাফ মোল্লা।

-মা ভালো আছে। ভাইজান আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমি বলতে পারব না আমি কোথায় আছি। আর জানতে চেয়েওনা। তুমি মামা হয়েছো ভাইজান। তোমার সেই ছোট বোনটা আজ এক ছেলের মা হয়ে গেছে। দোয়া করো আমার ছেলেটার জন্য। (আশালতা)

-আলহামদুলিল্লাহ। আমার মামাটাকে কবে দেখতে পাব আশা? বল না বোন কোথায় আছিস? তোর ভাবি ব্ল্যা*ড ক্যা*ন্সা*রে আক্রান্ত তোকে আর মাকে দেখার জন্য ছটফট করে সারাদিন। একটাবার একটু ক্ষমা চেয়ে নিতে চায়। একবার একটু তোর ভাবিকে ক্ষমা চেয়ে নেয়ার সুযোগ দে বোন। (আশরাফ মোল্লা)

আশালতা আর কিছু না বলেই কল কেটে দিয়ে নাম্বার ব্লক করে দিয়ে ফোন বন্ধ করে দেয়। চোখ বেয়ে টুপটুপ করে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে আশার। হাফসা বেগম দৌড়ে এসে মেয়ের চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে ওঠেন,
-এই মেয়ে একদম কাদবিনা। বিশ্রাম নে চুপচাপ।
-মা ভাবির ব্ল্যা*ড ক্যা*ন্সার ধরা পড়েছে। (আশালতা)
আশালতার মুখে এহেন কথা শুনে চমকে উঠে পাশে চেয়ারে ধপ করে বসে পড়েন হাফসা বেগম।

পরেরদিনই হসপিটাল থেকে বাসায় ফেরে আশালতারা। কিছুক্ষণ বাদে বাদে গলির বাসিন্দারা এসে আশালতা আর তার ছেলেকে দেখে যাচ্ছে। কেউ কেউ সামর্থ অনুযায়ী বাচ্চাকে হাদিয়া স্বরূপ টুকটাক টাকা আর কিছু জিনিসও দিয়ে গেছেন। মাটির ব্যাংকটাতে জমিয়ে রাখা টাকা থেকে কিছু টাকা বের করে আশা জুলহাসের কাছে দিয়ে দেয় মিষ্টি কেনার জন্য। হাফসা বেগম পুরো গলির সকল বাড়িতে গিয়ে মিষ্টি দিয়ে আসেন আর নাতির জন্য দোয়া করতে বলে আসেন।
এর মাঝে সন্ধ্যায় লাইজু খানম এসে আশালতা আর তার ছেলেকে দেখে যান।

নিশ্চুপ হয়ে একনাগাড়ে নিজের ছেলের দিকে তাকিয়ে আছে আশালতা। এই ছেলেটাই যে আগামী দিনে বেঁচে থাকার একমাত্র পন্থা তার। হায়াত যতদিন আছে ততোদিন ল*ড়াই করে বেচে থাকার একমাত্র অনুপ্রেরণাই যে তার এই ছোট্ট ছেলেটা। পারবে কি সে ছেলের উজ্জ্বল ভবিষ্যত নিশ্চিত করতে? ছেলেকে মানুষের মতো মানুষ করতে? ভাবতে ভাবতে ছোট্ট ছেলেটাকে বুকের মাঝে মিশিয়ে নেয় আশালতা।

-মা দেখো বাবুর নাকটা একদম সাদের মতো হয়েছে না? (আশালতা)
হাফসা বেগম মুখে কিছু না বলেই উপর নিচে মাথা নাড়িয়ে “হ্যা” সূচক ইঙ্গিত দেন।

অপ্রিয় আশালতা পর্ব ৯

-মা কোনোদিন যদি সাদ ওর কথা জানতে পেরে বাবার অধিকার দেখাতে আসে? আমার ছেলেটাকে আমার কাছ থেকে যদি কেড়ে নিতে আসে? মা আমিতো কখনোই পারব না আমার না*ড়ি ছে*রা ধনকে ছাড়া বাঁচতে! (আশালতা)
মেয়ের মুখে এমন কথা শুনে ভেতরে ভেতরে কেঁপে ওঠেন হাফসা বেগম।

অপ্রিয় আশালতা পর্ব ১১