অপ্রিয় আশালতা পর্ব ১১

অপ্রিয় আশালতা পর্ব ১১
আফিয়া অন্ত্রীশা

-তোর ছেলেকে তোর থেকে কেউ কে*ড়ে নিতে পারবেনা দেখিস। একদম দুশ্চিন্তা করিস না তো। (হাফসা বেগম)
মায়ের কথা শুনে নিয়ে ঘুমন্ত ছেলের মুখের দিকে দৃষ্টি স্থাপন করে আশালতা। বুকটা প্রশান্তিতে ছেয়ে যায় তার। আস্তে করে ছেলের পাশের বালিশটায় শুয়ে পড়ে সে। পিটপিট করে আশালতা তার মায়ের উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,

-মা বাবুর জন্য কি নাম রাখবা?
হাফসা বেগম কিছুক্ষণের জন্য গভীর চিন্তায় ডু*ব দেন।
-উম…ভাবতে হবে দাড়া। তোর নামের সাথে মিলিয়ে রাখতে হবে। (হাফসা বেগম)
আশালতা মুচকি হেসে ওঠে মায়ের কান্ড দেখে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

এদিকে আশরাফ মোল্লা আর শত চেষ্টা করেও আশালতার ফোনে কল ঢোকাতে পারেননি। বাজারে গিয়ে মিষ্টি কিনে নিয়ে এসে আশেপাশের সকলের বাড়িতে দিয়ে এসেছেন হাসি-মুখে। মারজানা বারবার করে আশরাফ মোল্লাকে বলছিল মিষ্টি কিনে এনে সকলের বাড়িতে দিয়ে আসতে। আশরাফ মোল্লা স্ত্রীর এহেন পরিবর্তনে এখন বেশ খুশি। কিন্তু স্ত্রীকে হারানোর ভ*য় প্রতিনিয়ত মনের মাঝে পুষে নিয়ে চলছেন তিনি।

এরমাঝেই এলাকা থেকে আশালতার শাশুড়ির কাছে খবর পৌছে গেছে আশালতা ছেলে সন্তান জন্ম দিয়েছে। লিনা তার শাশুড়ির মুখে কথাটা শুনেই তাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে ডিভোর্স পেপারটা হাতে নিয়ে নেয়। সাজেদা বেগম মেয়েকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকায় অতশত না ভেবেই লিনার কাছে ডিভোর্স পেপারটা দিয়ে দেন।

সাজেদা বেগম মেয়েকে এই কয়েক মাস বসে বুঝিয়ে একটুও রাজি করাতে পারেননি রেহানের পরিবারের বিরুদ্ধে আইনী পদক্ষেপ নিতে। ছবি প্রত্যেকবার একই কথাই জপ করতে আরম্ভ করে, “পাপ বাপকেও ছাড়ে না। আমরা অ*ন্যায় করেছি আশার সাথে মা। রেহানের পরিবারের যদি শা*স্তি প্রাপ্য হয়ে থাকে তবে মা একই অ*ন্যায় তো আমরাও করেছি। আমাদেরও তবে শা*স্তি হবে,হওয়া চাই।“ কথাগুলো বলার পর পরই অস্থিরতায় ছ*ট*ফ*ট করতে আরম্ভ করে ছবি। সাজেদা বেগম ভেতরে ভেতরে শি*উ*রে ওঠেন।

বিছানায় বসে কিছু কাগজপত্র ঘা*টা*ঘা*টি করছে সাদ। লিনা সন্তপর্ণে গিয়ে সাদের সামনে বসে পড়ে। কাগজপত্র দেখতে দেখতে আড়চোখে লিনার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
-কি ব্যাপার ম্যাডাম? এতক্ষণে যে আমার কথা আপনার মনে এলো?
হাসি হাসি মুখ করে সাদের দিকে তাকিয়ে লিনা বলে ওঠে,
-কাঙ্ক্ষিত সময় এসে গেছে সাদ। আশাদের বাড়ি থেকে ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে দিয়েছে।

সাদের দিকে ডিভোর্স পেপারটা এগিয়ে দেয় লিনা। ডিভোর্স পেপারটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ নিশ্চুপ হয়ে মেঝের দিকে তাকিয়ে থাকে সাদ। “কি হলো সাইন করবানা?” লিনার কথায় হুশ ফেরে সাদের। আস্তে করে লিনার উদ্দেশ্যে বলে ওঠে, ‘হু? হ্যা করব তো!” মৃদু হাসে লিনা। সাদের মস্তিষ্কে একটা কথা বাড়ি খেতে শুরু করে, আর কিছু মুহূর্তের মাঝেই আশার সাথে গড়ে তোলা তার তিনটে বছরের সংসার একদম ধূলি*স্যাৎ হয়ে যাবে।

-কি হলো সাদ? মায়া লাগছে? আরেহ তোমার মতো নাম্বার ওয়ান বিশ্বাসঘা*তকের মনেও যদি এখন মায়া কাজ করে তবে ব্যাপারটা হাস্যকর হয়ে যায় না জান? (লিনা)
লিনার কথায় রীতিমতো অবাক হয়ে গিয়ে সাদ বলে ওঠে,

-মানে? কি বলতে চাইছো তুমি?
-জোক্স আ পার্ট জান! আমি মজা করে বলেছি। (লিনা)
সাদ ঠোট গোল করে বলে ওঠে, “ওহ!”
সাদ ডিভোর্স পেপারে সাইন করে পেপারগুলো একটা ফাইলের মধ্যে রেখে পুনরায় লিনার কাছে দেয় আলমারিতে উঠিয়ে রাখার জন্য। লিনা ডিভোর্স পেপারের মাঝে থেকে একটা পেপার বের করে ওড়নার মাঝে লুকিয়ে নিয়ে ডিভোর্স পেপারের ফাইলটা আলমারিতে রেখে দেয়।

ইদানীং বেশ দুশ্চিন্তায় ভুগছে আশালতা। গর্ভকালীন সময়ের ছুটি তো তাকে দেয়া হয়েছে এবং প্রতি মাসের বেতনটাও তাকে বাসায় এসে পৌছে দিয়ে যায়। এই সুবিধাটি ফ্যাক্টরির সকল মেয়ের জন্যই রয়েছে। কিন্তু আশালতার মন চায় না ফ্যাক্টরিতে ফিরে কাজ করার। কিন্তু আয়ের উৎস সে কোথায় পাবে? এতোই কি সহজ টাকা উপার্জন করা?

নিজের শিক্ষাগত যোগ্যতার ওপর নির্ভর করে আশা সিদ্ধান্ত নেয় সে প্রাথমিক পর্যায়ের ছোট বাচ্চাদের পড়ানো শুরু করবে। বিষয়টা নিলুফাকে জানাতেই সে জানায় গলির সকল বাসিন্দার সাথেই আলাপ করবে বাচ্চাদের পড়ানোর বিষয় নিয়ে। আশালতা মাসের বেতন হতে বাচিয়ে রাখা টাকাগুলো জমিয়ে একটা সেলাই মেশিন কিনে আনে।

গলির বাসিন্দারা টুকটাক জামা-কাপড় বানাতে হলেই আশালতার কাছে ছুটে আসে। মেয়েদের যে হাতের কাজ শেখাটা ঠিক কতটা জরুরি আজ সে বুঝতে পারছে। মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হতেই আশালতা তার বাবার আদেশে হাতের কাজ ও সেলাই মেশিনের কাজের কোর্স করেছিল। এই দক্ষটাই যে বর্তমানে তার মূল অস্ত্র হয়ে দাঁড়াবে তা সে কখনো কল্পনাও করেনি। বাবাকে সে মনে মনে লক্ষাধিক বার ধন্যবাদ জানায়।

ঢাকা শহরে আসার পরে নিলুফা যার বাসায় কাজ করতো সেই মালিককে অনেক অনুরোধ রাজি করায় দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়া তার মেয়েকে আশালতাকে দিয়ে পড়ানোর জন্য। প্রথমে রাজি না হলেও পরবর্তীতে আশালতার করুণ পরিস্থিতি ও উচ্চ মাধ্যমিকের ফলাফল শুনে খুশি হয়ে অনুমতি দিয়ে দেয়। মালিক নিজে থেকেই পাঁচ হাজার টাকা বেতন হিসেবে ঠিক করে। নিলুফা খুশিতে গদগদ হয়ে সঙ্গে সঙ্গে আশালতাকে খবরটা জানিয়ে দেয়। খুশিতে আশালতার চোখ ছলছল করে ওঠে।

-তা পোলার বাপের নাম কি আশা?
পাশের বাসার এক বৃদ্ধ মহিলার প্রশ্নে মুখটা একটুখানি হয়ে যায় আশালতার।
-জ্বী খালাম্মা সাদ। (আশালতা)
-ম্যালা বড়লোক?
-ধরেন তাই! (আশালতা)

-ওহ আচ্ছা এতক্ষণে বুঝলাম! ব্যাডা মানুষ তো! টাকা পয়সা বেশি হইলে চোখ এদিক-ওদিক হইয়া যায়। বেচারা পোলাডা এট্টু বাপ কইয়াও ডাকতে পারবেনা কাউরে।
এহেন কথায় আশালতার বুকের মাঝে ধক করে ওঠে। তার ছেলেটা কাউকে বাবা ডাকার সুযোগটুকু পাবেনা কখনো?

-খালাম্মা ওর বাপ লাগবেনা। আমিই ওর বাপ,আমিই ওর মা। আর টাকা হলেই পুরুষ মানুষ খারাপ হয় এমনটা না। আর সব পুরুষও যে খারাপ এমনও না। কিছু কা*পুরুষের জন্যই পুরো পুরুষ জাতির ব*দনাম করি আমরা। কিন্তু এটা ঠিক না। সবাই সমান না। আর সবার পরিবারও তাদের সন্তানদেরকে সঠিক শিক্ষা দিতে সক্ষম হয়না খালাম্মা। (আশালতা)

-তা ভুল বলিস নাই আশা। আমার স্বামীও ছিল একজন সুপুরুষ। আহ লোকটা আমারে ছাইড়া চইলা গেল আর আমি একলাই পইড়া রইছি।
মহিলাটির কথাগুলো শুনে নিরবে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে আশালতা।

ভোর সাড়ে ছয়টা নাগাদ দরজায় কড়ানাড়া পড়তেই ঘুম ভে*ঙ্গে যায় আশালতার। গায়ের ওপর থেকে কম্বলটা সরাতেই শীতে মৃদু কেঁপে ওঠে সে। নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়ে পাশে শুয়ে থাকা ছোট্ট ছেলেকে ভালো করে কম্বল দিয়ে ঢেকে দিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেয় আশালতা। দরজা খুলতেই মাফলার, টুপি পড়া ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চাদের ব্যাগ ঘাড়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মুচকি হেসে ওঠে আশালতা।

-বাব্বাহ আপনারা এতো সকালে উঠে চলে এসেছেন পড়ার জন্য? (আশালতা)
উপর-নিচ মাথা নাড়ায় বাচ্চাগুলো। আশালতা সাদরে তাদের আহ্বান জানায় ভেতরে প্রবেশ করার জন্য।

এতক্ষণে হাফসা বেগম উঠে রান্নাঘরে চলে গিয়েছেন। আশালতা শোয়ার ঘরে এসে ছেলেকে বিছানায় একপাশ করে শুইয়ে দিয়ে বাচ্চাগুলোকে বসতে দেয়। শীতে এখনো থরথর করে কাপছে আশালতা। বাচ্চাগুলোকে ঘন্টা দুই পড়িয়ে ছুটি দিয়ে দেয় সে।

ঘড়ির কাটা দুপুর ১২টা ছুই ছুই। শীতকাল হলেও এই দুপুরের সময়টায় সূয্যি মামা প্রখরভাবে তার তাপ দেয়। আশালতা তীব্র রোদ মাথায় বয়ে নিয়ে হেঁটে চলেছে নিলুফার সেই মালিকের বাসার উদ্দেশ্যে। আজ দুদিন হয়েছে বাচ্চাটাকে পড়াচ্ছে সে। আশালতা গতকালের কথা ভেবে বেশ অবাক হচ্ছে।

গতকাল যখন বাচ্চাটিকে সে পড়াতে গিয়েছিল বাচ্চার মা তাকে প্রিজে করে কিছু বিস্কুট দিয়েছিল খাওয়ার জন্য। কিন্তু আশালতার তো বিস্কুট গলা হতে নামবেনা। কারণ সে কিছুতেই তার মাকে রেখে এক দানা খাবারও মুখে দিতে পারবেনা। তার মা যেখানেই যেতো কখনো তাদের ভাই-বোনকে রেখে কিছু খেতো না।

এমনকি এখনো খায়না। মাকে দেখে ব্যাপারটা নিজের মধ্যেও আয়ত্ত করেছে আশালতা। আশালতাকে এক পিস বিস্কুটও স্পর্শ করতে না দেখে ফেরার পথে দুই প্যাকেট বিস্কুট আশালতার হাতের মধ্যে গুজে দিয়েছিল বাচ্চাটির মা। ভাবনার মাঝেই আশালতা হো*চ*ট খেয়ে দুই কদম দূরে হু*ম*ড়ি খেয়ে পড়ে।

অপ্রিয় আশালতা পর্ব ১০

বি*র*ক্তি ভরা দৃষ্টিতে জুতার দিকে তাকাতেই দেখে জুতার ফিতা ছি*ড়ে দু’ভাগ হয়ে গেছে। হঠাৎ কেউ একজন তার পুরুষালি হাত আশালতার দিকে বাড়িয়ে দেয়। বসা অবস্থাতেই মুখ তুলে সামনে তাকাতেই থমকে যায় আশালতা। কাব্য ঘ*র্মা*ক্ত চেহারায় তার দিকে হাত বাড়িয়ে স*টান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

অপ্রিয় আশালতা পর্ব ১২