অপ্রিয় আশালতা পর্ব ৪

অপ্রিয় আশালতা পর্ব ৪
আফিয়া অন্ত্রীশা

সকাল হতেই আশরাফ মোল্লা তার মা-বোনকে সারাবাড়ির কোথাও খুজে না পেয়ে বেশ দুশ্চিন্তায় পড়ে যান। দুই ভাই মিলে পুনরায় আবার খোজাখুজি শুরু করে দেয়। কিছুক্ষণ বাদে নিপা তার শাশুড়ির ঘর থেকে একখানা চিঠি এনে আশরাফের হাতে তুলে দেয়। হাতের লেখা দেখে একদম বুঝতে অ*ক্ষ*ম হননি যে এটা আশালতারই লেখা চিঠি। তড়িঘড়ি করে চিঠি পড়তে আরম্ভ করেন আশরাফ মোল্লা।

“বড় ভাইজান তোমরা চিন্তা করো না। আমি আর মা একটু দূরেই হারিয়ে গেলাম ইচ্ছাপূর্বক। যেখানে থাকব ভালোই থাকব। খোজার চেষ্টা করোনা। আমার সন্তানের ভবিষ্যৎ গড়তে হলে আমাকে দূরে আসতেই হতো। বাড়িতে থাকলে হয়ত কখনোই পারব না। আশেপাশের মানুষ আমাকে শেষ করে দেবে একদম।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

জীবন্ত লা*শ হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে জীবনকে নতুন রূপ দেয়া হয়ত অধিক শ্রেয়। আশা করি তুমি রা*গ হবেনা। ফিরে আসব হয়ত কোনো একদিন এক নতুন আমি হয়ে। তুমি হয়তো আমার ওপর খুব ক*ষ্ট পেয়েছো। কেন আমি সাদ এবং সাদের পরিবারের বিরুদ্ধে আইনী পদক্ষেপ নিতে দিলাম না!

আমার ক্ষ*তি করে মানুষ যত সুখী হতে পারুক হোক ভাইজান। আমি দোয়া করি যেন তারা অনেক ভালো থাকে। আমার সন্তানকে ওদের মুখোমুখি আমি হতেই দিতে চাইনা কখনো। ওদেরকে কখনো জানতে দিওনা যে আমার গ*র্ভে সাদের সন্তান রয়েছে।

আমি কারো সুখের পথে বা*ধা হতে চাইনা ভাইজান। আল্লাহ তো সব দেখছেন তাইনা? যেখানে আমার স্বামীই ঠিক নেই সেখানে অন্যকে জ*ব্দ করে আমি ঠিক কতটুকুই সুখী হবো? আমাকে ক্ষমা করে দিও ভাইজান। আমার সন্তানের জন্য দোয়া করো। ছোট ভাইজান যেন রাগ না হয় দেখো। ভাবিদেরকে বলো আমাদের জন্য দোয়া করতে আর আমাকে যেন ক্ষমা করে দেয় তারা। “
ইতি
তোমাদের আশালতা ।

ধপ করে মেঝেতে বসে পড়েন আশরাফ মোল্লা। মারজানা দ্রুত গিয়ে তাকে ধরতে নিলেই আশরাফ মোল্লা ছ্যা*ত করে ওঠেন।
-একদম নাটক করতে আসবানা তুমি। এবার কি শান্তি হয়েছে তোমার? আমার বোনটা তোমার কি এমন ক্ষ*তি করতেছিল? একটু স*হ্য করা গেল না ওই বেচারিকে? মানসিক অ*শা*ন্তিতে শেষ হয়ে যাচ্ছিল মেয়েটা। একটু ভরসা দিলে কি এমন হতো?

-এখন সব দো*ষ আমারে দিতেছো? আমি কি করছি? আমি বের কইরা দিছি ওরে? বাহ বেশ ভালোই তো। গেল নিজের ইচ্ছায় ফাঁ*সা*ই*য়া দিয়ে গেল আমারে? (মারজানা)
-একদম চুপ করো তুমি। আমার বৃ*দ্ধ মা পর্যন্ত চলে গেল। হই আমি একজন প্রাইমারি স্কুল শিক্ষক। কিন্তু এটুকু সামর্থ্য তো ছিল আমার যা দ্বারা আমার মা বোনরে দেখতে পারব। (আশরাফ মোল্লা)

-ভাইজান তুমি শান্ত হও। ভাবির ওপর রা*গ ঝা*ই*ড়ো না। ভাবি তুমি ভেতরে যাও তো। (হাশেম মোল্লা)
-ভাই তুই আর আমাকে থামতে বলিস না। এই মহিলার উদ্দেশ্যই শুধু অ*শা*ন্তি করা। কি পরিমাণ চুপ যে আমি থাকি। সে কি ভাবে আমি কি কিছু লক্ষ্য করিনা?

সবই দেখি আমি, জানি আমি। আমার বোনটা আঠের পার করে পারল না সেই এমনি ও গিয়ে আসেপাশের খালা-চাচীদের উ*স্কা*য়ে দিয়ে আসছে আব্বা আম্মার কান ভা*রী করার জন্য আশার বিয়ে নিয়ে। যাক ও তো এখন শান্তি পাইছে। তাতেই হবে। এই বাড়ির মধ্যে যেন কোনো বা*জে মানসিকতার মানুষ প্রবেশ না করে। ওদের জন্য আমার বোনটা আরও বেশি ভেঙ্গে পড়ছে। কেন যে আমি আগে বুঝিনাই। কেন আমি আগে কঠোর হলাম না? (আশরাফ)

উপস্থিত সকলে নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কারো মুখেই কথা বলার ক্ষমতাটুকু নেই।
বাসের জানালার বাহির থেকে আসা হাওয়ার তীব্র গতির ফলে চোখে মেলতে বারবার ব্যর্থ হচ্ছে আশালতা। পাশের সিটে তার কাধে হেলান দিয়েই হাফসা বেগম ঘুমিয়ে আসছে। ছলছল চোখে মায়ের ঘুমন্ত নিষ্পাপ চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকে আশালতা। মাকে নিয়ে বেরিয়ে এসেছে তো ঠিকই। কিন্তু মাকে নিয়ে সে থাকবে কোথায়? কিছু সোনার অলংকার বেচে যতটুকু টাকা সে পেয়েছে তাতে টেনেটুনে কিছুদিন হয়তো চলবে। কিন্তু তারপরে কি করবে? মাথা ঝি*ম ধরে আসে আশালতার।

হাফসা বেগমের ঘুম ভা*ঙ্গ*তেই আশা তার দিকে পাউরুটি আর কলা এগিয়ে দেয় সকালের নাস্তার জন্য।
-তুই খেয়েছিস মা? (হাফসা বেগম)
আশালতার মুখখানা ফ্যা*কা*শে হয়ে আসে। মাকে সে কিভাবে বলবে যত কম খরচ সে করে পারবে ততোই টাকার সাশ্রয় হবে। হাফসা বেগমকে সে ভরাপেটে রাখতে পারবে।

-হ্যা মা খেয়েছি তো। তুমি তো ঘুম ছিলে। (আশালতা)
মেয়ের হাবভাব দেখেই হাফসা বেগম বুঝে যান যে সে মি*থ্যা বলছে। পাউরুটি আর কলাটি মাঝ বরাবর ছি*ড়ে একভাগ নিজে খান আর আরেক ভাগ জোর করে আশালতাকে খাইয়ে দেন।

খাবার টেবিলে বসে রুটি চি*বো*তে চি*বো*তে সাদ তার মায়ের উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,
-মা আশা কি ডিভোর্স পেপারে সাইন করেছে? পেপার কই? আমার সাইনটা বাকি আছে তো।

ছেলের কথা শুনে চ*ম*কে ওঠেন সাজেদা বেগম। ক*ড়া চোখে লিনার দিকে তাকিয়ে ইঙ্গিত দেন সাদকে আশার ব্যাপারে কিছুই না বলতে। চা*লা*ক সাজেদা বেগম চে*পে যান। একে তো প্রেগনেন্ট অবস্থাতেই আশালতার থেকে তিনি ডিভোর্স পেপারে সাইন করিয়ে নিয়েছেন। এখনই যদি ছেলেকে দিয়ে সাইন করিয়ে নেন তবে আশার পরিবার যখন তাদের বিরুদ্ধে আইনী পদক্ষেপ নেবে তখন তো পুরো পরিবার ধরে ফেঁ*সে যাবে।

যেভাবেই হোক ছেলের থেকে ঘুরিয়ে পেচিয়ে চলবেন যতদিন না আশা সন্তান প্রসব না করে। কিছুতেই সে এখন ছেলের হাতে ডিভোর্স পেপার তুলে দেবেন না বলে সিদ্ধান্ত নেন।

-ন…না সেদিন গিয়ে তো সাইন করাতেই পারলাম না। ওর বাড়ির লোক একটু সময় দিতে বলেছে। আশাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে সাইন নিয়ে তারপর পেপার পাঠিয়ে দেবে। তুই এত চিন্তা করিস না তো। আমি দেখব সব। আর আমিতো আশার থেকে তোর আর লিনার বিয়েতে ওর কোনো আপত্তি নেই সেইটা একটা কাগজে লিখে সাইন করিয়ে এনেছি। বলেছি ওর নামে যে ব্যাংক একাউন্ট সেইটা ক্লোজ করার জন্য সাইন লাগবে। বুঝতেই পারেনি আশা। এখন বাদ দে তো। তোরা নাকি আগামী সপ্তাহে সাজেক যাবি? সেই প্রস্তুতি নে এখন। (সাজেদা বেগম)

-ওহ মা তোমার বুদ্ধির প্রশংসা করতেই হয় দেখছি। (সাদ)
-ভালো কথা সাদ। তুমি চলে যাওয়ার আগে আমাকে একটা ব্যাংক একাউন্ট খুলে দিয়ে যেও তো। আর আমাকে এককালীন কয়েক লাখ টাকাও দিয়ে যেও একাউন্টে। (লিনা)
-আচ্ছা দেবো সমস্যা নেই। (সাদ)

লিনার কথায় চক্ষু চ*ড়*ক গাছ হয়ে যায় সাজেদা বেগমের। এই মেয়ে যে তার চেয়েও কয়েকগুণ বেশি উপরে।
রান্নাঘরে রুটি ছে*ক*তে ছে*ক*তে সাজেদা বেগমদের সকল কথা শোনে সাদের বড় ভাবি। ঘৃ*ণায় গা গুলিয়ে আসে তার। এই কাদের মাঝে সে বসবাস করছে? সে আর কতদিন এর মাঝে টিকতে পারবে তা ভেবে পায়না। এদের পরিণাম যে কি হবে ভবিষ্যতে তা ভাবতেই শি*উ*রে ওঠে সাদের বড় ভাবি।

দুপুর দেড়টার দিকে এসে বাস ঢাকা পৌছায়। বাস থেকে মাকে নিয়ে নেমেই আশালতা কল দেয় তার এক স্কুলের বান্ধবীকে। বাসে বসে যখন দুশ্চিন্তায় মত্ত আশালতা। সেই মুহূর্তেই স্কুলের এক বান্ধবীর কথা মনে পড়ে। আশালতা কখনো ঢাকা এলে যেন তাকে একটাবার জানায় আশা বারবার অনুরোধ করেছিল। বান্ধবীকে কল দিয়ে সব জানায় আশালতা। সেই বান্ধবীই তাকে আশ্বাস দেয় আশার থাকার থাকার ব্যবস্থা করবে সে।

বাস থেকে নেমে কল দেয়ার মিনিট দশেক পরেই আশালতার বান্ধবী এসে হাজির হয়।
-কেমন আছেন চাচী? চিনতে পারছেন আমাকে? (নিলুফা)
-ভালো আছি মা। তুমি কেমন আছো? আর তুমি তো নিলুফা তোমাকে চিনব না কেন? (হাফসা বেগম)
-ভালো আছি চাচী। যাক তাইলে মনে আছে আমাকে। আপনি আর আশা যদি সেদিন আমাকে সাহায্য না করতেন তাইলে হয়তো আমি আর বেঁচে থাকতাম না। মামির হাতে মা*ই*র খেতে খেতেই ম*রে যেতাম। চলেন বাসায় নিয়ে যাই আপনাদের নিয়ে। আশা চাচীরে ধরে রাস্তা পার কর আয়। (নিলুফা)

আশালতার মনে এক নতুন জীবন পাওয়ার উদ্দীপনা কাজ করতে থাকে।
আশালতাদের নিয়ে এক অ*ন্ধ*কা*রাচ্ছন্ত গলিতে প্রবেশ করে নিলুফা। কয়েকটা টিনসেটের বাড়ি পার করেই একটা ছোটখাটো টিনসেটের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায় তারা। নিলুফা ব্যাগ থেকে চাবি বের করে তা*লা খুলে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে।

-এই বাড়িতে ভাড়া থাকি আমি আর আমার স্বামী। দুইটা রুম আছে। তোরা একটাতে থাকিস আশা। আমি রান্না করে রাখছি। চাচীরে নিয়ে খাইস। আমি একটু পরেই ফ্যাক্টরিতে চলে যাব। সন্ধ্যা হবে আসতে। তোর দুলাভাই আসতে আসতে রাত হবে। সিএনজি চালায় সে। কোনোমতে টেনেটুনে সংসার চলে যায় আমাদের। (নিলুফা)
নিলুফার হাত নিজের দুহাতের মাঝে আগলে নেয় আশালতা।

-তোকে যে কি বলে ধন্যবাদ দেব নিলু। আমি আসলেই কৃতজ্ঞ। একটা কথা বলতে বিবেকে বাধছে তবে না বলেও পারছিনা। আমাকে একটা কাজের ব্যবস্থা করে দিবি তুই যে ফ্যাক্টরিতে কাজ করিস? (আশালতা)
-ল*জ্জা দিস না আশা। তোরা আমার জন্য যা করেছিস আমি সারাজীবন বসে তার ঋণ পরিশোধ করতে পারব না। আমি আজকেই মালিকের সাথে গিয়ে কথা বলব। তোরা খেয়ে নিস। আমি গেলাম ফ্যাক্টরিতে। ভেতর দিয়ে দরজা আ*ট*কে দে। (নিলুফা)

নিলুফা চলে যেতেই দরজা আটকে দেয় আশালতা। হাত-মুখ ধুয়ে মাকে নিয়ে খেয়ে-দেয়ে একটু ঘুমিয়ে নেয় সে। কতরাত যে ঘুমায় না সে। এখন যদি শরীর দূ*র্ব*ল হয়ে যায় তবে আয়রোজগার করা ক*ঠি*ন হয়ে পড়বে। আর নিলুফার ওপর নির্ভর হতে তার বিবেকে বাধে।

ফোন থেকে খুলে রাখা সিমটা ভে*ঙ্গে দুই টুকরো করে ফেলে আশালতা। তার কাছে থাকা অতিরিক্ত সিমটাই ব্যবহার করবে সে,যেই নাম্বারটা নিলুফা ব্যতীত কারো কাছেই নেই।
এদিকে আশালতার দুইভাই আর ছোট ভাবি আত্মীয়দের মধ্যে এমন কেউ নেই যে তাদের কাছে ফোন দিয়ে আশালতার খোজ নেয়নি।

অপ্রিয় আশালতা পর্ব ৩

কিন্তু আশালতাকে তারা কোথাও খুজে পায়নি। ফোন নাম্বারে কল দিলেও বন্ধ বলছে। আশালতা আর মাকে কোথাও খুজে না পেয়ে হতাশ হয়ে পড়ে সবাই। তাদের মনে একটা কথাই বার বার বা*ড়ি খাচ্ছে। আশালতা কি কাজটা ঠিক করেছে? হয়তো ঠিক করেনি আবার করেছে।

অপ্রিয় আশালতা পর্ব ৫