অপ্রিয় আশালতা পর্ব ৫

অপ্রিয় আশালতা পর্ব ৫
আফিয়া অন্ত্রীশা

-সাদ বাবা আবার চলে যাচ্ছিস কবে? (সাজেদা বেগম)
-মা আমি আর যাচ্ছি না। এখন থেকে দেশেই থাকছি আমি। (সাদ)
-মানে? (সাজেদা বেগম)
-মানে আমি সারাজীবনের জন্যই দেশে চলে এসেছি। আর যাচ্ছিনা আমি ওখানে। আমার এখানে যে ব্যবসাটা আছে সেইটাই এখন থেকে দেখাশুনা করব। (সাদ)

-তোর এখানে আবার ব্যবসা হলো কবে ভাই? (সাদের ছোট বোন)
-ওই দেশে থাকতেই আমি কিছু টাকা আমার বন্ধু রিফাতকে দিয়ে একটা ব্যবসা চালু করেছিলাম। বেশ ভালোই চলছে। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি দেশে থেকেই ব্যবসা দেখাশুনা করব। তাছাড়া মাস শেষে যে লাখ টাকা পাঠিয়েছি তোদের তা কি শুধু আমার বেতনের টাকা থেকেই নাকি? অর্ধেকের বেশিই আমার ব্যবসার ছিল। (সাদ)

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-না সাদ তুমি একদম এটা ঠিক করোনি। ব্যবসা যে সবসময় ভালো চলবে তা তুমি শিওর কিভাবে হচ্ছো? (লিনা)
-কেন লিনা তুমি খুশি না সাদ দেশে থাকলে? টাকাই সব নাকি? ছেলেটা চোখের সামনে থাকবে এটাই তো কত! (সাজেদা বেগম)
সাজেদা বেগমের কথা শুনে লিনা মিনমিন করে বলে ওঠে,

-হুহ! আপনার কাছে আবার টাকা কোনো কিছু না!
ভ্রু কুচকে সাজেদা বেগম বলে ওঠেন,
-কিছু বললে বউমা?
মে*কি হাসি দেয় লিনা।
-না মা কিছু বলিনি। (লিনা)
সাজেদা বেগম সন্দেহপ্রবণ দৃষ্টিতে লিনার দিকে তাকিয়ে থাকে।

রাতে শরীরটা বেশ খা*রা*প হয়ে যায় আশালতার। সন্ধ্যার দিকে সাত আটবার ব*মিও হয়েছিল আশালতার। হাফসা বেগম আর নিলুফা মিলে মাথায় পানি ঢালতে আরম্ভ করে। এই রাতে কিভাবে আশালতাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে তারা? ঘরে কোনো পুরুষ লোক নেই। আর এই অন্ধকারাচ্ছন্ন গলিতে কোনো ডাক্তারও আসতে চায়না। অনেক ক*ষ্টে*শি*ষ্টে ঘুমিয়ে যায় আশালতা।

রাত দুটোর দিকে পুরুষ কন্ঠের চেঁ*চা*মে*চি কানে এসে বা*জ*তে*ই ঘুম ভে*ঙ্গে যায় আশার। দরজা ভিড়িয়ে দিয়ে রুমের বাইরে এসে দাড়াতেই নিলুফার রুম থেকে নিলুফার এবং তার স্বামীর কথোপকথন ভেসে আসে।
-সারাদিন এতো ক*ষ্ট করে দুই পয়সা রোজগার করি কি পররে খাওয়ানোর জন্য। তোমার বান্ধবীর কি বিবেক নাই। দুইটা মানুষ ক*ষ্ট কইরা আয় রোজগার কইরা কোনো মতে সংসার চালাই। তার মধ্যে সে কিভাবে আইসা ঘা*ড়ে ওঠে?

-জুলহাস তুমি থামবা? কে ঘাড়ে উঠে বসেছে আশা? ওই মেয়েটার জন্য আজকে আমি বেঁচে আছি। আর সে-ই যখন এত বি*প*দে আছে তখন আমি তার পাশে দাড়াবো না? ও একটা কাজ পেলেই নিজে বাসা নিয়ে থাকবে। তুমি দয়া করে তোমার মুখটা ব*ন্ধ রাখো। মানুষের পাশে দাড়াতে শেখো। মানবিক হও জুলহাস। (নিলুফা)

নিলুফাদের রুম থেকে কেউ বের হচ্ছে টের পেয়েই রুমে ঢুকে পড়ে আশালতা। সন্তপর্ণে মায়ের পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ে আশালতা। বু*ক ফেটে কা*ন্না আসছে তার। হাত দিয়ে মুখ চে*পে ধরে কা*ন্না করে ওঠে মুহূর্তের মাঝেই।
-কাঁ*ন*দি*স না মা। দেখ নিলুফা কাজ ঠিক করে দিতে পারে কিনা। (হাফসা বেগম)

-মা জুলহাস ভাই তো ঠিক বলছে। কিন্তু আমারতো বিবেকবোধ আছে মা। আমারও তো ইচ্ছা করেনা কারো ঘা*ড়ে জুড়ে বসতে। কিন্তু উপায় যে খুজে পাইনা আমি। (আশালতা)
মেয়েকে বুকে টেনে নেন হাফসা বেগম। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে ওঠেন,
-এখন একটু ঘুমা মা। তখন তোর কি অবস্থাটাই না হয়েছিল।

আলু ভ*র্তা দিয়ে ভাত মা*খা*তে মা*খা*তে আশালতা বলে ওঠে,
-নিলু তোদের মালিকের সাথে কি কথা বলেছিলি?
-হুম বলছিলাম তো। মালিক বলছে তোকে আজকে সাথে নিয়ে যেতে। কিন্তু তোর শরীরের যে অবস্থা! (নিলুফা)
-আরে আমি একদম ঠিক আছি নিলু। আমাকে প্লিজ নিয়ে চল। আমার কাজটার যে খুব দরকার। (আশালতা)

-আচ্ছা নিয়ে যাব। কিন্তু ওখান থেকে আমার সাথে আজকে তোকে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। তুই এখন প্রেগনেন্ট। তোর ডাক্তার দেখানোটা খুব জরুরি নিলু। (নিলুফা)
-নারে নিলু তুই অনেক করছিস আমার জন্য। ডাক্তার দেখানোর মতো অত টাকাও আমার কাছে নেই। (আশালতা)
-তুই টাকা নিয়ে চিন্তা করছিস? আমি আছিতো। (নিলুফা)

-না ভাই আমি দেখাবোনা ডাক্তার প্লিজ। আমাকে একটু তোদের ফ্যাক্টরিতে নিয়ে চল নিলু। (আশা)
-ভাই ক্ষ্যা*মা দে। তুই প্রথম বেতন পেয়েই আমাকে পরিশোধ করে দিস টাকা। এবার তো রাজি হ আশা। (নিলুফা)
কিছুক্ষণ চিন্তা-ভাবনা করে তারপর আশালতা জবাব দেয়,

-আচ্ছা।
আশালতার মাথায় এখন একটা কথাই ঘু*র*পা*ক খাচ্ছে। তাকে যে একটা কাজ খুজে নিয়ে একটা বাসা ভাড়া নিতেই হবে।

হাসি-খুশি মুখ নিয়ে নিলুফার সাথে সিএনজিতে বসে আছে আশালতা। অনেক কষ্টে শেষমেষ একটা কাজ যোগাড় করে দিতে সক্ষম হয়েছে নিলুফা। এখন ডাক্তারের চেম্বারের দিকেই রওনা হয়েছে তারা।
-নিলু আমাকে একটা বাসা খুজে দিতে পারবি তোদের আশেপাশে। (আশালতা)
-কেন আশা? আমাদের সাথে থাকতে স*ম*স্যা? আর কিছুদিন অন্তত থাক। (নিলুফা)
-না নিলু। অনেক করেছিস আমার জন্য। লাস্ট এই সাহায্যটুকু করে দে ভাই। (আশালতা)

-আচ্ছা শোন আমরা যে বাড়িতে ভাড়া থাকি ওটা ফ্যাক্টরির আন্ডারেই। ফ্যাক্টরির কর্মচারীরা যদি আমাদের গলির যেকোনো বাড়িতেই থাকতে চায় তবে তাদের অর্ধেক ভাড়া দিতে হয় পুরোটা দেওয়ার লাগেনা। আমি আজকেই মালিককে কল দিয়ে একটা ছোটখাটো একরুমের বাসা ঠিক করে দেব। তাতে আমাদের চেয়েও তোর ভাড়া একটু কম পড়বেনে। আর খাট,আলনা আর টুকটাক জিনিসপত্র নিয়ে ভাবতে হবেনা। সবই থাকে বাসাতে। কর্মচারীদের জন্য এটুকু সুবিধা করে দিয়েছে ফ্যাক্টরির মালিক। কিন্তু তুই এই অবস্থায় কি পারবি কাজ করতে আশা? (নিলুফা)

নিলুফাকে দুই বাহুতে জড়িয়ে ধরে আশা বলে ওঠে,
-সেলাই মেশিনের কাজই তো। খুব স*ম*স্যা হবেনা ভাই। তোকে যে কি বলে ধন্যবাদ দেব আমি!
-হয়েছে এখন চুপচাপ করে বসেন আপনি। (নিলুফা)
নিলুফা বুঝতে পারে গতকাল রাতে জুলহাসের বলা সব কথাই হয়তো শুনে ফেলেছে আশালতা। তাই তো অ*সু*স্থ শরীর নিয়েও জোর করে এসেছে কাজ খোজার জন্য। মনে মনে অনুতপ্ততা বোধ করে নিলুফা।

কেটে গেছে পনেরোটা দিন। জমিয়ে রাখা টাকা গুলো দিয়েই টেনেটুনে দিন চালাচ্ছে আশালতা। মাস শেষ হতে এখনো পনেরো দিন বাকি। সকালে ফ্যাক্টরিতে চলে যায় আর ফিরতে সন্ধ্যা হয় তার।
রাত হলে বু*ক*টা পু*ড়ে ছা*র*খা*র হয়ে যায় আশালতার।

আগে রোজ রাতে সাদ তাকে কল দিয়ে সারারাত কথা বলতো। কিন্তু এক নিমিষেই সব যে শেষ হয়ে যাবে তা কল্পনাও করেনি আশালতা। ইন্টার পাশ করেও আর অনার্সে ভর্তি হতে পারেনি শাশুড়ির ভয়ে। নয়ত এতটাও ক*রু*ণ অবস্থায় পড়তো না সে। সামান্য অর্থে কিভাবে মাস পার করবে তা ভেবে রোজ রাতে চিন্তায় চিন্তায় নিজের চুল টে*নেও ছি*ড়*তে হতো না। অর্থের অভাব মানুষকে ঠিক কতটা অসহায় বোধ করায় তা যে এই পরিস্থিতিতে পড়ে সেই একমাত্র উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়। তবুও আশালতা দিন-রাত অসুস্থ শরীর নিয়ে পরিশ্রম করে যাচ্ছে একটা সুন্দর দিনের আশায়।

-কিরে মা তুই এখনো ঘুমাইস নি? কত রাত হয়ে গেছে জানিস? কালকে সকালে আবার তোর ফ্যাক্টরিতে যেতে হবে। (হাফসা বেগম)
শান্ত কন্ঠে আশালতা লতা বলে ওঠে,
-মা রাত ১২টা বাজে। আজকে আমার জন্মদিন। ওই মানুষটার মুখ থেকে শুভেচ্ছা বার্তা শুনতে পারলাম না এবার।
মেয়ের নিরব হা*হা*কা*র শুনে বু*ক*টা পু*ড়ে ওঠে হাফসা বেগমের। নিজেকে সামলে নিয়ে বেশ ধ*ম*কের সুরেই বলে ওঠেন,

-চুপচাপ ঘুমাতো তুই।
রুম থেকে বের হয়ে যান হাফসা বেগম।

-এত রাতে কার সাথে কথা বলছো লিনা?
সাদের গলা টের পেতেই কে*পে ওঠে লিনা। ঠা*স করে হাত থেকে ফোনটা ছি*ট*কে মেঝেতে পড়ে যায়। সাদ ফোনটা উঠানোর জন্য মেঝের দিকে ঝুকতে নিলেই লিনা তাড়াহুড়ো করে মেঝে থেকে ফোনটা উঠিয়ে নেয়।

-আ…আমার একটা ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলছিলাম সাদ। তু…তুমি এত রাতে বারান্দায় কি করো? ঘুমাও নি? (লিনা)
-ঘুমিয়েছিলাম তো। হঠাৎ ঘুম ভে*ঙ্গে যাওয়ার পরে দেখি তুমি বিছানায় নেই। বারান্দা থেকে তোমার কন্ঠস্বর ভেসে আসছিল। এসে দেখি তুমি বারান্দায়। তা কা*প*ছো কেন তুমি? (সাদ)
-আরে কই কা*প*ছি? ঘুমাতে আসো। আমি গেলাম।

অপ্রিয় আশালতা পর্ব ৪

বলেই রুমে চলে যায় লিনা। সাদ ঠায় লিনার গ*ম*ন পথের দিকে চেয়ে থাকে। লিনার হাবভাব মোটেও তার সুবিধার মনে হচ্ছেনা। আচমকা তার মনে পড়ে আজতো আশার জন্মদিন! প্রতিবার ভাবিকে দিয়ে উপহার কিনিয়ে আশাকে সারপ্রাইজ দিতো সে। এবার তো আর উইসটাও করা হলোনা। এত মাস পরে এসে সাদের মনে প্রশ্ন জাগে, “কেমন আছে মেয়েটা?”

অপ্রিয় আশালতা পর্ব ৬