অপ্রিয় আশালতা পর্ব ৬

অপ্রিয় আশালতা পর্ব ৬
আফিয়া অন্ত্রীশা

সারারাত আর ঘুম হয়না আশালতার। বিছানায় এপাশ-ওপাশ করতে করতেই ফজরের আজান দিয়ে দেয়। ব্যাপারটা বুঝতে পেরেও হাফসা বেগম নিশ্চুপ হয়ে থাকেন।
হাফসা বেগমকে ডেকে উঠিয়ে একসাথে নামাজ আদায় করে রান্নাঘরের দিকে চলে যায় আশালতা। হাড়িতে ভাত চ*ড়ি*য়ে দিয়ে মেঝেতে বটি পেতে বসতে নিতেই হাফসা বেগম দৌড়ে আসেন।

-তোকে না বলেছি এসব কাজ তুই করবিনা? এই সময়টায় কতটা সা*ব*ধা*নে থাকতে হয় তুই বুঝিস? প্রথমবার মা হতে যাচ্ছিস। সারাটাদিন কি পরিমাণ পরিশ্রম করিস এই শরীর নিয়ে? ব*মি তো লাগাতার হতেই থাকে। কেন এত ক*ষ্ট সহ্য করিস মা? আমার হাত-পা তো এখনো টিকে আছে তাইনা? তুই আজকের পর থেকে না রান্নাঘরে ঢুকবি আর না কাপড়-চোপড় কা*চ*বি। (হাফসা বেগম)

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-মা? এমন কোনো কাজ তো করিনা আমি। আর ফ্যাক্টরিতেও সারাদিন বসে বসেই কাজ করি। তুমিতো দুপুরে আর রাতে রান্না করোই। একবেলা আমি করলে কি হবে? তুমি এমনিই অসুস্থ। (আশালতা)
-সব বুঝলাম। কিন্তু এই কা*টা*কা*টির ধারে কাছে তুই থাকতে পারবিনা। বসে থেকে বা দাঁড়িয়ে থেকে যতটুকু করা যায় তাই করবি। এখন রুমে গিয়ে সব গুছিয়ে নে আমি আলু ,পেয়াজ আর মরিচগুলো কেটে ভেজে নিচ্ছি। (হাফসা বেগম)

-মা কিসের যেন পরিবর্তন লক্ষ্য করছি! (আশালতা)
হাফসা বেগম ফিক করে হেসে দিয়ে বলে ওঠেন,
-মেয়ের সাথে শহরে থাকি এখন। তা একটু আধটু শুদ্ধ ভাষায় যদি কথা না বলি তাহলে কি চলে?
-একটু আধটু না মা। তুমি তো পুরোপুরি অভ্যাস করে ফেলেছো।

দুজনেই এবার একসাথে তাল মিলিয়ে হেসে ওঠে। হাফসা বেগম থেমে গিয়ে গভীরভাবে মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকেন। কত মাস পর আজ তার মেয়ে মন খুলে হাসছে।
রুমে এসে কাঠের জানালাটা খুলে দিতেই উত্তরের হিম ধরা হাওয়া এসে ছুয়ে দেয় আশালতাকে। এই হাওয়াই জানান দিচ্ছে শীতকাল আসতে চলেছে। ভাগ্যিস বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময়ই ব্যাগে শীতের কাপড় নিয়ে এসেছিল!

-কিগো আশরাফের বউ শুনলাম আশা আর হাফসা নাকি বাড়ি ছাইড়া চইলা গেছে কোহানে?
পেছনের বাড়ির আসাদের মায়ের কথা কর্ণগোচর হতেই চুলায় নতুন একটা কাঠ ঠে*লে দিয়ে মারজানা বলতে আরম্ভ করে,
-হয় কাজল চাচী ঠিকই শুনছো। বাড়ি ছাইড়া গেছে একমাসের বেশি হইছে। তুমিতো মাইয়ার শশুড়বাড়ি ছিলা এতদিন তাই কিছু জানতে পারো নাই।

-তুই তো এখন তাইলে খুশি। একলা একলা সব খাবি। আরামে থাকবি একদম। (কাজল বেগম)
-আর আরাম! গেছে তো গেছে। আমারে ভালো মতন ফা*সা*ই*য়া দিয়া গেছে। আশরাফ উঠতে বসতে কথা শুনায় আমারে। থাকতেও অশান্তি দিছে আর এহন চইলা গিয়াও অশান্তিরে ঘরের খুঁ*টি*র সাথে বা*ই*ন্ধা দিয়া গেছে চাচী। (মারজানা)

-আরে ছেমরি স*হ্য কর কিছুদিন। ব্যাটা মানুষ! কয়দিন চি*ল্লা*বে তারপরে আবার ঠিক হইয়া যাবে দেখিস। তারপর তো তোর শান্তি আর শান্তি। (কাজল বেগম)
-শান্তি পাবে নাকি অশান্তি পাবে তা পরে দেখতেছি। আপনারে জানি আর কোনোদিন আমাদের বাড়ির মধ্যে না দেখি চাচী। আমি কালকেই আপনার ছেলে আসাদকে সব জানাচ্ছি। নারী হয়ে আরেক নারীর ক*ষ্ট বোঝেন না। একে অপরকে উ*স্কা*উ*স্কিই কি আপনাদের প্রধান কাজ নাকি চাচী? সন্ধ্যা হইছে বাড়িতে যান আপনি।

রান্নাঘরে বাজারের ব্যাগ নিয়ে প্রবেশ করে কথাগুলো বলে ওঠেন আশরাফ মোল্লা। এতক্ষণ রান্নাঘরের বাইরে থেকে সব কথাগুলো শুনছিলো সে। কাজল বেগম মুখ ঝা*ম*টা দিয়ে বেরিয়ে যেতেই আশরাফ মোল্লা মারজানার উদ্দেশ্যে বা*জ*খা*ই কন্ঠে বলতে আরম্ভ করেন,

-আগামীকাল সকালেই তুমি তোমার বাপের বাড়ি যাচ্ছো। আমি তোমার ভাইকে ফোন দিয়ে বলে দিচ্ছি। পনেরোটা দিন বাপের বাড়ি গিয়ে থেকে বুঝে আসো আশেপাশের মানুষের নোং*রা বুলি ঠিক কতটা য*ন্ত্র*ণার সৃষ্টি করে মনে। আমি তোমার সাথে যোগাযোগও করব না। আশেপাশের মানুষ ঠিকই বুঝে নেবে স্বামীর বাড়ি থেকে বি*তা*ড়ি*ত হয়ে বাপেরবাড়ি উঠেছো। তখন তুমি ঠিক বুঝবে একটা মেয়ের জন্য অমন পরিস্থিতি ঠিক কতটা ভ*য়া*ব*হ। আমার বোনটা তোমাদের দ্বারা ঠিক কতটা কষ্ট পেয়েছে তা তুমিও হা*রে হা*রে টের পাবে মারজানা।

মারজানার মাথায় আকাশ ভে*ঙ্গে পড়ে। চোখ উপচে নো*না জল গাল বেয়ে টুপটুপ করে মেঝেতে পড়তে আরম্ভ করে।
-আশরাফ এমন নি*ষ্ঠু*র হইও না তুমি। মানুষ কি বলবে তুমি বুঝতেছো? ও আশরাফ তুমি আমারে ভুল বুঝতেছো। (মারজানা)

-আমার যা বলার আমি বলে দিয়েছি। ঠিক পনেরো দিন পরে আমি তোমাকে আনতে যাব। আশা করি পনেরো দিনই তোমার জন্য যথেষ্ট হবে।
বলেই হনহন করে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে আশরাফ। মাথায় হাত দিয়ে রান্নাঘরের মেঝেতে বসে পড়ে মারজানা। বেশি সুখের আশা করে কি উলটো কপালে দুঃ*খ ডেকে নিয়ে এলো সে?

প্রথম মাসের বেতন হাতে পেতেই খুশিতে চোখ ছলছল করে ওঠে আশালতার। কাছে থাকা সব টাকা শেষ হয়ে যাওয়ায় মায়ের ঔষুধ পর্যন্ত কিনতে পারছিল না সে। প্রতিদিন রাতে বুকের ব্যথায় মায়ের নিরব আ*র্ত*না*দ টের পেয়ে অশ্রু বিসর্জন দিতো আশালতা। মায়ের ঔষুধ কেনার মতো সামর্থ্যও যে ছিল না তার এই ক’দিন। ঠিক কিভাবে সে দিনগুলো পার করেছে তা সে আর আল্লাহ ব্যতিত কেউ জানেনা।

প্রতিটা রাতে আশালতার চোখের অশ্রুর প্রমাণ বহণ করে তার মাথার নিচের শক্ত বালিশটা। সন্ধ্যায় কাজ শেষ করে ফ্যাক্টরি থেকে বের হয়ে ফারমেসি থেকে মায়ের জন্য ও তার জন্য দরকারি ঔষুধ গুলো কিনে নিয়ে রাস্তার পাশের ভ্যান থেকে টুকটাক শাক-সবজি কিনে নিয়ে বাসায় ফেরে আশালতা।

প্রতিদিনের মতো হাফসা বেগম একগ্লাস পানি নিয়ে দরজার পানে দাঁড়িয়ে আছেন। মেয়ে আসতেই ব্যাগগুলো হাত থেকে নিয়ে মেঝেতে রেখে গ্লাসটা তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে টেনে শোয়ারঘরে নিয়ে যান। বিছানায় বসিয়ে দিয়ে মিনিট দুয়েক মেয়ের ক্লা*ন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন হাফসা বেগম। হঠাৎ চোখ যায় আশালতার আঙুলের ক্ষ*তের দিকে। বু*কটা ধক করে ওঠে হাফসা বেগমের। আশালতার হাত থেকে গ্লাসটা পাশে রেখেই হাতটা টেনে নিয়ে আঙ্গুলের ক্ষ*ততে হাত বুলাতে শুরু করেন।

-কিভাবে হলো এটা? কিছু লাগাস নি? (হাফসা বেগম)
-সেলাই মেশিনের কাজ করি মা। এটুকু ক্ষ*ত কিছুই না। বে*খেয়ালিতে সুই গে*থে গিয়েছিল আঙ্গুলে। সামান্য ক্ষ*ত,এ তো এমনিই ঠিক হয়ে যাবে। (আশালতা)
-সামান্য ক্ষ*ত? এপাশ থেকে গে*থে ওপাশ হতে বের হয়ে গেছে মেয়ে। তুই বোরখা খুলে নে। আমি মলম নিয়ে আসি।
মেয়ের হাতে মলম লাগিয়ে দিয়ে হাতের তালুতে সন্তপর্ণে চুমু খান হাফসা বেগম। কোমল হাত জোড়া ধীরে ধীরে লোহার ন্যায় রূপ নিচ্ছে। মেয়ের এত ক*ষ্ট কোনো মায়েরই স*হ্য হবার নয়।

-মা লিনা আগের মতো নেই। আগের মতো আমাকে ভালোও বাসেনা মা। দিন দিন কেমন যেন অচেনা মনে হয় ওকে। (সাদ)
-কি বলো সাদ? যার জন্য নিজের তিন বছরের সংসার ত্যাগ করে দিলে। তোমার সেই এত ভালোবাসার মানুষ এখন তোমাকে আগের মতো ভালোও বাসেনা? নাহ এটা তো একদম মানা যায়না! (সাদের বড় ভাবি)

বড় ভাবি যে ঠে*স দিয়েই কথাটা বলেছে তা বুঝতে বাকি নেই সাদের। ভাবির কথায় আর উলটো জবাব দেয়না সাদ। সে জানে তার ভাবি ঠিক কতটা বি*চ*ক্ষ*ণ।
-আরে বাবা তুই খামখা উলটো ভাবছিস। তেমন কিছুইনা। তুই ওকে আরও সময় দে। হয়তো কিছু নিয়ে দুশ্চিন্তা করছে। ওর সাথে কথা বল ব্যাপারটা নিয়ে। (সাজেদা বেগম)

মায়ের কথা বেশ যুক্তিযুক্ত তা বুঝতে পারে সাদ। এখন থেকে লিনাকে বেশি বেশি সময় দেবে ভেবে নেয় সাদ। আসলেই ইদানীং সে লিনাকে ব্যবসার কাজে বিজি থাকার জন্য সময় দিতে পারছেনা।

-তা বউমা কই সাদ? (সাজেদা বেগম)
-কি একটা কাজে যেন বাইরে গেছে মা। (সাদ)
ছেলের কথায় যে ভুল নেই তা সাজেদা বেগম ঠিকই বুঝেছেন। কিন্তু সে চান না তার ছেলে অযথা কথা চিন্তা করে মন খারাপ করুক,দুশ্চিন্তা করুক। তাই ব্যাপারটি ঘুরিয়ে অন্যভাবে বুঝিয়ে দেন ছেলেকে।

আজকাল বেশ পরিবর্তন এসেছে আশালতার মাঝে। এই পরিবর্তন যে মাতৃত্বের চিহ্ন বহন করছে। এই সময়টায় মেয়েদের অন্যরকম সুন্দর লাগে।

অপ্রিয় আশালতা পর্ব ৫

বেশি পরিশ্রমের ফলে প্রতিদিনই অ*সু*স্থ হয়ে পড়ে আশালতা। পায়ে পানি এসে পা ফু*লে টই*টুম্বুর হয়। হাটতে চলতেও বেশ অসুবিধা হয় তার। হাফসা বেগম প্রায়ই মেয়েকে জোর দেন আল্ট্রানোগ্রাফি করতে। আজ শুক্রবার হওয়ায় বিকালেই মাকে নিয়ে ডাক্তারের চেম্বারে যায় আশালতা।

অপ্রিয় আশালতা পর্ব ৭