অপ্রিয় আশালতা পর্ব ৭

অপ্রিয় আশালতা পর্ব ৭
আফিয়া অন্ত্রীশা

আল্ট্রাসনোগ্রাফির রিপোর্ট দেখে ডাক্তার নিশ্চিত করেন বাচ্চা একদম ঠিকঠাক আছে। তবে আশালতার শরীরের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে বেশ আকারে ধমকও দেন ডাক্তার। গর্ভকালীন অবস্থায় কিভাবে চলতে হবে।কি খেতে হবে সবকিছুর একটা রুটিন করে দিয়ে সেই অনুপাতে চলতে বলেন।

-টাকার চিন্তা করে নিজের দিকে অবহেলা করোনা আশা। তুমি আমার ছোট বোনের মতো তাই তুমি করেই বললাম। (ডাঃ রুমকি)
ডাক্তারের কথা শুনে চোখ বড় বড় হয়ে যায় আশালতার।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-অবাক হতে হবেনা। কখন একজন নারী গর্ভকালীন সময়ে নিজের সাস্থ্য নিয়ে অ*গ্রা*হ্য করে তা আমি বুঝি। আমিও একজন নারী আর একজন মাও। আমি তোমার চোখের চাহনী দেখেই মনের ভেতরে কি চলছে বুঝে গেছি আশা। রুটিনটা আমি তোমার সামর্থ্যের মধ্যেই করে দিয়েছি আশা। প্লিজ ওটা অনুসরণ করে চলো। (ডাঃ রুমকি)

হাসি মুখে মাথা নাড়িয়ে ‘হ্যা’ সূচক ইঙ্গিত দেয় আশালতা। ব্যাগ থেকে ফি বের করে ডাঃ রুমকির দিকে এগিয়ে দিতে নিলেই তা নিতে বাধা সাজে সে।

-তোমাকে ছোট বোন ডেকেছি আশা। এটা আমি নিতে পারব না। জানো আমার বড় বুবু তার বাচ্চা জন্ম দিতে গিয়েই মা*রা গিয়েছিল। অনেক টাকা খরচ হবে বিধায় ওর শশুড় বাড়ির লোক ওকে হসপিটালেও নেয়নি। গর্ভকালীন সময়ে পুষ্টিকর কিছু খাওয়ায়ও নি। ওকে দিয়ে সব ভারী কাজগুলো করাতো। প্রতিটা দিন গা*য়ে হাত তুলতো। আমার বুবুটাকে বা*চা*তে পারিনি আমরা।

সবকিছু জানতে যে খুব দেরি হয়ে গিয়েছিল। দো*ষীরা ঠিকই এখন সাজা ভোগ করছে কিন্তু আমার বুবুকে তো ফিরে পেলাম না। প্রতিজ্ঞা করেছিলাম আমি ডাক্তার হবোই। আমি চাইনা আমার বুবুর মতো কেউ ক*ষ্ট পাক। আমার কোনো বোন নেই এখন। তোমাকে বোন ডেকেছি। আমি পারব না তোমার থেকে টাকা নিতে। আরও একটা কথা আমি চাই তোমার সন্তান এই হসপিটালেই জন্ম নিক আর তা আমার তত্ত্বাবধানেই। সব দায়িত্ব আমার। নাম্বারটা দিয়ে যেও তোমার। (ডাঃ রুমকি)

আশালতা অবাক চোখে ডাঃ রুমকির দিকে দিকে ভাবতে থাকে ,” জীবনের খা*রা*প সময়েও তাহলে এমন দুই একজন অদ্ভুত মানুষের আগমনও ঘটে বটে!”
-আল্লাহর কাছে তোমার জন্য অনেক অনেক দোয়া করব মা। তোমার মতো ডাক্তার যেন ঘরে ঘরে জন্মে। না জানি কোন মায়ের সন্তান তুমি। তোমার মাকে আমার সালাম পৌছে দিও মা। (হাফসা বেগম)

-কিযে বলেন না মা। আমার মা গত হয়েছে সাত বছর হয়ে গেছে। তা ছাড়া আপনিও তো আমার মায়েরই মতো । মা ডেকে ফেললাম তাতে কিছু মনে করবেন না। (ডাঃ রুমকি)

ডাঃ রুমকির মুখে ‘মা’ ডাক শুনে মনে প্রশান্তি ছেয়ে যায় হাফসা বেগমের। এক টানে রুমকিকে বু*কে টেনে নেন তিনি।
-যত ইচ্ছা মা ডাকো তুমি। আজ থেকে আমার আরেকটা মেয়ে হলো। তুমি। বুঝেছো? অবসর পেলেই ছুটে এই মায়ের কাছে আসবা। আমার বাসায় আমার এই বড় মেয়েটার আসার অপেক্ষায় থাকব আমি সবসময়। আজকে আসি তবে। কথাগুলো বলেই ডাঃ রুমকির কপালে আলতো ভাবে চুমু খান হাফসা বেগম।

সন্ধ্যার একটু পরপরই প্রয়োজনীয় ঔষুধ ও কিছু ফলমূল কিনে নিয়ে বাসায় ফেরে আশালতা ও হাফসা বেগম।
রাতে শুয়ে শুয়ে আশা তার মাকে আহ্লাদি সুরে জিজ্ঞাসা করে ওঠে,
-মা তোমার কি মনে হয়? আমার ছেলে হবে নাকি মেয়ে হবে?
-আহ এটা বলিস না মা। ছেলে হোক বা মেয়ে হোক। আল্লাহর কাছে এটাই প্রার্থনা করবি সবসময়,যে আসবে সে যেন সুস্থভাবেই আসে তোর কোলে। (হাফসা বেগম)

ঠোট চেপে আশালতা জবাব দেয়, “হুম।“ অতঃপর ক্ষানিক বাদে মায়ের বু*কে মাথা রেখে ঘুমিয়ে যায় সে।
এভাবেই কেটে গেছে আরও কতগুলো মাস। এখন নিজের ভেতরে আর একজনের অস্তিত্ব বেশ ভালো ভাবেই উপলব্ধি করতে পারে আশালতা। সাড়ে সাত মাস চলছে এখন। আজ আল্ট্রাসনোগ্রাফির রিপোর্ট থেকে জানা গেছে ছেলে সন্তান জন্ম দিতে চলেছে সে। হাফসা বেগম মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বাম গালে চুমু খান।

ইদানীং হাফসা বেগম বসে বসে তার পুরানো শাড়িগুলো দিয়ে ছোট ছোট কাঁথা সেলাইয়ে মনযোগ দিয়েছেন। নানা রকম ফোড় দিয়ে কাথায় হরেক রকম ডিজাইন তোলেন মনের সকল মাধুরী মিশিয়ে। আশালতা প্রতিদিন কাঁথাগুলো বুকের মধ্যে জড়িয়ে নিয়ে বসে থাকে ঘন্টার পর ঘন্টা। হাফসা বেগম দূরে বসে মেয়ের পা*গ*লা*মী দেখে মুচকি হাসেন। আশালতা এখন শুধু দিনই গুনে যায় ,কবে সে তার ছোট্ট ছেলেটাকে কোলে নিয়ে আদর করবে।

আজ প্রায় ছয়টা মাস হয়েছে বাড়ি ছেড়েছে আশালতা আর হাফসা বেগম। ঘরের দাওয়ায় উদাস মনে বসে আছেন আশরাফ মোল্লা। চোখের নিচে কা*লি পড়ে গেছে। আজও একটু খোজ পাননি প্রিয় বোন আর মায়ের। মারজানা আজ আড়াইটা মাস যাবৎ কঠিন ম*র*ণ ব্যা*ধিতে আক্রান্ত হয়ে বিছানা শয্যা হয়ে আছে।

ব্ল্যা*ড ক্যা*ন্সা*রে আক্রান্ত সে। সারাটা দিন বিছানায় শুয়ে আহাজারি করতে থাকে একটাবার হাফসা বেগম ও আশালতার নিকট ক্ষমা চেয়ে নেওয়ার জন্য। এই অনুতপ্ততা কিন্তু ব্ল্যা*ড ক্যা*ন্সা*রে আক্রান্ত হওয়ার পর সৃষ্টি হয়নি। আশালতার মতো ঠিক একই পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে আসার পরেই সে নিজের ভু*লটা উপলব্ধি করতে পেরেছে।

একা হাতে ঘর সামলানো, মারজানাকে দেখাশুনা করা ,মা আর বোনের জন্য শো*ক সব মিলিয়ে আশরাফ মোল্লার রাতের ঘুম এখন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। ছেলেটাকে তো সেই ছোট বেলাতেই মাদরাসার বোর্ডিং এ রেখেছেন। তাই ছেলেকে নিয়ে একদম দুশ্চিন্তা নেই তার। মাঝে মাঝে এসেই ছেলে মারজানাকে দেখে যায়। মাকে যে হারাতে হবে তা ছেলেও এখন বুঝে গেছে। আড়ালে চোখের পানি ঝরিয়ে আবার নিজের গন্তব্যে ফিরে যায় সে।

-এই মেয়ে তুমি ঠিক কি উদ্দেশ্য নিয়ে এই বাড়িতে ঠাই গে*ড়ে*ছো বলো তো? আমি কিন্তু তোমার উদ্দেশ্য কিছুটা হলেও বুঝে নিয়েছি। (সাদের বড় ভাবি)

-বুঝেই যদি থাকেন তবে আপনি আসলেই বুদ্ধিমতি ভাবি। আপনাকে তো বড়সড় প্রাইজ দেওয়া উচিত। এত ধৈর্য্য নিয়ে কিভাবে এদের মাঝে টিকে আছেন? আমিতো আছি আর কিছুদিন মাত্র। একদম ভ*ষ্ম করে দিয়ে যাব এদেরকে। বিয়ের আগে একটা বার আমাকে এই অ*মানুষটা বলেনি যে সে বিয়ে করেছিল আশালতা নামের মেয়েটিকে। বিয়ের দিন রাতে বলেছিল সব।

কি ভেবেছেন আমি ইচ্ছা করেই আশালতার সংসারে ভাগ বসিয়েছি? নাহ। আমি ভালো না তা আমি জানি কিন্তু অ*মানুষও নই যে একটা মেয়ের ঘর ভে*ঙ্গে সেখানে ঠাই নেব। আপনাকে একটা কথা বলে রাখি,আশালতার গর্ভে সাদের সন্তান রয়েছে। আর সাজেদা বেগম সবই জানে। আপনি কখনোই এই কথাটি সাদকে বলবেন না।

আমি চাইনা আশালতা এই অ*মানুষের সংসারে আবার ফিরে আসুক। নিজের মতো করে বাঁচুক এটাই চাই আমি। কখনো সামনাসামনি পেলে একটাবার জড়িয়ে ধরব মেয়েটাকে। এদেরকে তো আমি একদম পথে বসিয়ে দিয়ে যাব। আপনি আপনার স্বামীকে নিয়ে এখান থেকে সরে যান ভাবি। আপনার ভালোর জন্যই বলছি।

কথাগুলো বলে হনহন করে ডাইনিং রুম থেকে পানি ভর্তি জগটা নিয়ে নিজের রুমে চলে যায় লিনা। সাদের বড় ভাবি হা করে লিনার যাওয়ার দিকে চেয়ে থাকেন। আসলে বাহির থেকে দেখে কাউকেই চেনা যায়না। কার মনে আসলে কি চলে তা আসলেই আমাদের ধারণার বাইরে। এতোদিন সে কতশত গা*লি দিয়ে এসেছে মেয়েটাকে।

শার্টগুলো সেলাই করা শেষ করে বোতামগুলো লাগাতে বসতেই আশালতা লক্ষ্য করে বক্সে একটাও বোতাম নেই। শার্টগুলো মেঝেতে নামিয়ে রেখে চেয়ার থেকে উঠে দাড়াতেই আচমকা পেটে ব্যথা ওঠে আশালতার। সমান তালে মাথাও ভো ভো করে ঘুরছে। গগণ বিদারী এক চি*ৎ*কা*র দিয়ে আস্তে আস্তে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে আশালতা।

উপস্থিত আশেপাশের সকলে দৌড়ে আশে আশালতার কাছে। এর মাঝে ফ্যাক্টরির মালিকের স্ত্রী লাইজু খানমও সবেমাত্র ফ্যাক্টরিতে প্রবেশ করে দেখেন একপাশে প্রচুর ভীড় জমেছে। ভ্রু কুচকে সেদিকে এগিয়ে গিয়েই দেখেন মেঝেতে এক গর্ভবতী রমনী জ্ঞান হারিয়ে পড়ে রয়েছে।

এমন দৃশ্য দেখে তিনি ব্যতিব্যস্ত হয়ে কিছু স্টাফকে দিয়ে আশালতাকে উঠিয়ে দ্রুত নিজের গাড়িতে নিয়ে যান হসপিটালে যাওয়ার জন্য। এদিক থেকে নিলুফা হাফসা বেগমকে কল দিয়ে সবকিছু জানাতেই তিনি হা*উ*মা*উ করে কেঁ*দে ওঠেন। পাশের বাসার এক মহিলাকে নিয়েই ফোনে যেই হসপিটালের ঠিকানা নিলুফা দিয়েছিল সেখানে রওনা হন।

-ইনি কি নিজের শরীরের দিকে একদম কোনো খেয়াল রাখেন? এনার অবস্থা তো খুব খা*রা*প। এখন যে পরিস্থিতি যদি ঠিকঠাকভাবে নিজের খেয়াল না রাখেন তবে এনার এবং বাচ্চার দুজনেরই জীবনের ঝুঁ*কি রয়েছে। এনার অভিভাবক কে আছেন? প্লিজ খেয়াল রাখবেন। এখন কোনো প্রকার বাড়তি কাজ সে করতে পারবেনা। টুকটাক হাটাচলা ছাড়া যেন বিছানা থেকে একদম না নামে । অভিভাবক যে আছেন এই ফাইলটি নিয়ে ডাক্তারের চেম্বারে যান।

একজন নার্স কথাগুলো বলেই ফাইলটা বেড সাইড টেবিলের ওপর রাখেন। লাইজু খানম ফাইলটা হাতে নিয়ে হাফসা বেগমকে সাথে করে নিয়ে ডাক্তারের চেম্বারে প্রবেশ করেন।

একটু আগেই জ্ঞান ফিরেছে আশালতার। স্যালাইনও মাত্র শেষ হয়েছে। ক্ষানিক বাদের বাসায় যেতে পারবে বলে দিয়েছে ডাক্তার। লাইজু বেগম নিজে থেকেই আবদার করেন তিনি হাফসা বেগমকে এবং আশালতাকে বাসায় পৌছে দেবেন।
গাড়ি ছুটে চলেছে আশালতার বাসার উদ্দেশ্যে।

সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুজে রয়েছে আশালতা। লাইজু বেগম বেশ আগ্রহ নিয়েই আশালতার দিকে চেয়ে রয়েছেন। কিয়ৎক্ষণ আগেই তিনি হাফসা বেগমের থেকে আশালতার অতীতের সকল ঘটনা জেনেছেন। আশালতার জন্য এই মুহূর্তে বেশ ক*ষ্ট অনুভব করছেন লাইজু খানম।

অপ্রিয় আশালতা পর্ব ৬

এই সময়টায় একজন মেয়ের স্বামীর থেকে ঠিক কতটা যত্নের প্রয়োজন হয় আর সেই সময়টাতেই এই মেয়েটা সেই যত্ন হতে বঞ্চিত! মানুষ কিনা গায়ের রঙ দেখে সৌন্দর্য বিচার করে? অথচ আশালতার মাঝে তিনি এক অপরূপ সৌন্দর্য খুজে পাচ্ছেন। কি অদ্ভুত!

অপ্রিয় আশালতা পর্ব ৮