অপ্রিয় আশালতা পর্ব ৮

অপ্রিয় আশালতা পর্ব ৮
আফিয়া অন্ত্রীশা

আশালতার বাসার পথের চি*পা গলিটাতে দিন আর রাতের মাঝে কোনো তফাৎ পরিলক্ষিত হয়না। রাতের বেলাতেও যেমন ঘুটঘুটে অন্ধকার তেমনি দিনের বেলাতেও সূর্যি মামার আলো গাছগাছালির কোনো ফা*ক-ফো*ক*র থেকেও এসে এই গলিতে পৌছায়না। লাইজু খানম এক হাতে আশালতাকে আগলে নিয়ে হাফসা বেগমের নির্দেশনা মোতাবেক বাসার পথে এগিয়ে চলছেন। মিনিট দুয়েক পরেই কাঙ্ক্ষিত স্থানে পৌছানোর পরেই আশালতাকে হাফসা বেগমের হাতে তুলে দিয়ে লাইজু খানম বলে ওঠেন,

-আজ আমি আসছি তবে। আপা আশার দিকে লক্ষ্য রাখবেন। আগামীকাল থেকে যেন আশা ফ্যাক্টরিতে না যায়। ছয় মাস পর্যন্ত কিন্তু ওর ফ্যাক্টরিতে যাওয়া মানা বলে দিলাম। গর্ভকালীন ছুটি এটা। আগামী ছয় মাসের স্যালারি আমাদের স্পেশাল স্টাফ এসে পৌছে দিয়ে যাবে একদম চিন্তার কোনো কারণ নেই। (লাইজু খানম)
হাফসা বেগম কৃতজ্ঞতার চোখে লাইজু বেগমের দিকে তাকিয়ে একটা মুচকি দিয়ে বলে ওঠেন,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-তা আপনাকে এখন তো কোথাও যেতে দিচ্ছিনা আপা।
-না আপা আমাকে ফিরতেই হবে এখন। আমার ছেলেটা অফিস থেকে ফিরেই আমাকে খুজে না পেলে পা*গ*ল হয়ে যাবে।
বলেই উলটো দিকে ঘুরে হাটা দিতে নিতেই আশালতা ঘপ করে লাইজু খানমের ডান হাত আক*ড়ে ধরে। ধীর কন্ঠে বলে ওঠে,

-আমার অনুরোধটুকু রাখুন। আমাদের সাথে আজকে রাতের খাবার খেয়ে তারপর যাবেন। বিকাল তো হয়েই গেছে। আরও কিছুটা সময় আমাদের সাথে কাটিয়ে যান।
আশালতার মায়াভরা মুখের দিকে তাকিয়ে আর না করতে পারেননা লাইজু খানম। হাসি মুখে দু;বাহুতে আগলে নেন আশালতাকে। ড্রাইভারকে কল দিয়ে ফিরে যেতে বলেন।

-মা ব্যাগ থেকে মুরগিটা বের করে রান্না করো। (আশালতা)
-আমি রান্না করি? (লাইজু খানম)
-এম্মাহ! আপা আপনি কেন কষ্ট করবেন? একদম না। আমি ত্রিশ মিনিটের ভেতরে রান্না শেষ করে আসছি আপনি আশার সাথে বসে গল্প করুন। (হাফসা বেগম)

-প্লিজ আপা আমি রান্না করি? আপনি একটু হাফসাকে ফল কে*টে দিন। (লাইজু খানম)
লাইজু খানমকে আর জোর করেও রান্না করা থেকে আটকাতে পারেনা হাফসা বেগম। ব্য*র্থ হয়ে কিছু ফল কে*টে নিয়ে শোয়ার ঘরে চলে যান।

গো*স্তের ঝোলের সুগন্ধে সারা বাসার আনাচে-কানাচেও মৌ মৌ করছে। আশালতা ধীর পায়ে হেটে রান্নাঘরের দিকে যায়। হাফসা বেগম ও লাইজু খানমকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করছেন দেখে সেদিকে হাসি মুখে এগিয়ে যায় আশালতা।
-আশা তুমি খালি পায়ে কেন ঘুরছো? এমনিতেই ঠান্ডা পড়েছে বেশ। এখন যদি স*র্দি-জ্ব*র বাধিয়ে বসো তবে তো ঝামেলা হয়ে যাবে। বলেই নিজের পায়ের থেকে জুতা জোড়া খুলে আশার পায়ের দিকে এগিয়ে দেন লাইজু খানম।

-না আন্টি আপনি পায়ে দিন। আমি ঘর থেকে আরেক জোড়া নিয়ে আসছি। (আশালতা)
-এই মেয়ে চুপচাপ পায়ে দিয়ে এই টুলে বসো তো।
কথাগুলো বলে দুই পিস গোস্ত একটা প্রিজে উঠিয়ে আশালতার দিকে এগিয়ে দেন লাইজু বেগম।

লাইজু খানমের ব্যবহারে অবাকের ওপর অবাক হতেই আছে আশালতা। চারপাশের সকলেই যখন নিজেদের বিষাক্ত রূপ দেখিয়ে দিলো তারপর আর কাউকেই বিশ্বাসযোগ্য আর ভালো বলে উপাধি দেয়া সহজ হবে বলে মনে হতো না আশালতার। কিন্তু এমন দু একজন হুট করে এসেই যে তাকে এভাবে চমকে দেবে তাও সে কল্পনা করেনি। চোখ উপচে পানি এসে যায় আশালতার।

মুর*গির গোস্তের ঝোল দিয়ে ভাত মেখে এক লোকমা মুখে দিয়েই লাইজু বেগমকে উদ্দেশ্য করে আশালতা বলে ওঠে,
-আন্টি আপনার হাতে আসলেই অদ্ভুত জাদু আছে। আমার তো মনে হচ্ছে আমি সব খেয়ে নিতে পারব একদম।
আশালতার কথা শুনে ফিক করে হেসে ফেলেন লাইজু খানম।

-তুমি যে সব খেতে পারবে তা তো আমি বিশ্বাস করতে পারছিনা আশা। প্লেটে যে কয়টা ভাত নিয়েছো তুমি! ওর চেয়ে তো একটা পাচ বছরের বাচ্চাও অনেক খায়। খেতে হবে এখন বেশি বেশি বুঝেছো? পুষ্টির অনেক ঘাটতি তোমার। (লাইজু খানম)
লাইজু খানমের কথা শুনে বোকার মতো হেসে ওঠে আশালতা।

-আসলে আন্টি! হয়েছে কি! (আশালতা)
-হয়েছে ফা*জি*ল মেয়ে থামো এখন। খাও চুপচাপ। (লাইজু খানম)
এরমাঝেই লাইজু খানমের ফোনে একটা কল আসতেই সঙ্গে সঙ্গে রিসিভ করে ফেলেন।
-হ্যালো আব্বা!
অপর পাশ হতে একটা গম্ভির কন্ঠ ভেসে আসে,

-আম্মু কোথায় তুমি? রাত হয়ে গেছে কত দেখেছো?
-আব্বা আমি তোমার একটা আন্টির বাসায় এসেছি। একটু পরেই ফিরছি। তুমি কখন ফিরেছো কাব্য? (লাইজু খানম)
-আমি এইমাত্রই ফিরেছি। (কাব্য)
-শিরিন একটু পরেই কফি নিয়ে যাবে তোমার রুমে। তুমি কফি খেতে থাকো আমি চলে আসছি তাড়াতাড়ি। বলেই কল কেটে দেন লাইজু খানম।

লাইজু খানম চলে গেছেন ঘন্টা দুই হয়েছে। আশালতা আর তার মা বেশ অবাক হয়েছে লাইজু খানমের এত বন্ধুসুলভ আচরণ দেখে। এত বড় একজন ব্যবসায়ীর স্ত্রী হয়েও মনের মাঝে বিন্দু পরিমাণ অহং*কার পর্যন্ত নেই!

-আশা এখন তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়। তোর চোখের দিকে তাকাতে গেলে আমার বু*কটা ফেটে যায়। কি অবস্থা হয়েছে তোর দেখেছিস? সারাদিন এত পরিশ্রম করে রাতেও একটু ঘুমাইস না। এপাশ-ওপাশ করেই রাত পার করে দিস। আজ থেকে একটু ঘুমা অন্তত। কাল থেকে তো ফ্যাক্টরিতেও যেতে হবেনা তোর। (হাফসা বেগম)
হাফসা বেগমের কথায় স্বায় দিয়ে তার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে আশালতা।

-আসব আব্বা? (লাইজু খানম)
বিছানায় শোয়া থেকে উঠে বসে মায়ের দিকে হাসি হাসি মুখ করে তাকিয়ে কাব্য বলে ওঠে,
-তোমাকে না বলেছি এত ফরমালিটি না দেখাতে? ভেতরে আসো আম্মু।
-এই নে তোর কফি। (লাইজু বেগম)

মায়ের হাত থেকে সন্তপর্ণে কফির মগটা নেয় কাব্য। হালকা ফু দিয়ে তাতে একটা চু*মুক দিয়ে পুনরায় মায়ের দিকে দৃষ্টি স্থাপন করে।
-একটা কথা বলি তোকে? (লাইজু বেগম)
-আমিতো জানি তুমি কি বলবা। তোমাকে আর কতবার বলব যে তুমি যাকে পছন্দ করবে তাকেই আমি বিয়ে করব। তাকেই ভালোবেসে আগলে নেব। আজ পর্যন্ত তোমার অপছন্দের কোনো কাজ করেছি আমি বলো? তোমার পছন্দের ওপরই আমার ছোট বেলা থেকে দৃঢ় বিশ্বাস আম্মু। (কাব্য)

ছেলের কথা শুনে গর্বে বু*কটা ভরে যায় লাইজু বেগমের।
-মেয়েটার নাম আশালতা। আগে একটা বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু ভাগ্যক্রমে একটা অ*মা*নুষ জুটেছিল স্বামী হিসেবে। প্রাক্তনকে বিয়ে করে নিয়েছে সেই ছেলে। সুযোগ পেয়ে শশুড়বাড়ির লোকেরা বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিল। আমি অবাক হয়েছি মেয়েটা কেন আইনী পদক্ষেপ নিলো না। জানিস মেয়েটা প্রেগনেন্ট। কি যে মায়াভরা মুখটা।

সারাক্ষণ চেয়ে থাকতে মন চায় আমার। যতক্ষণ আজ আমার সামনে ছিল আমি শুধু ওকেই দেখে গেছি। আমি চাই তুই ওকে ভালোবাসা দিয়ে আগের সব কষ্ট একদম ফু দিয়ে উড়িয়ে দিবি। একজন যোগ্য স্বামী হয়ে দেখাবি। ওর সামনে প্রমাণ করে দিবি কিছু কা*পুরুষেরাই স্বামী শব্দটাকে বিষাক্ত করে তোলে নারীদের সম্মুখে। পারবি আমার কথাটুকু রাখতে? সমাজের সমালোচনাকে ঠে*লে সরিয়ে দিয়ে পারবি মেয়েটাকে ভালোবাসা দিয়ে আগলে নিতে? (লাইজু খানম)
মায়ের কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে কাব্য। কিছুক্ষণ পরে মুখে হাসি ফুটিতে তুলে বলে ওঠে,

-আমার মায়ের পছন্দ হয়েছে মানে মেয়ে কোটি তে একটা হবে আমি নিশ্চিত। হোক সে ডিভোর্সি। আমি তাকেই ভালোবেসে আগলে নেব মা। কথা দিলাম তোমাকে। আর বাচ্চার ক্ষেত্রেও আমি কোনো প্রকার ঘাটতি রাখব না। নিজের সন্তান হিসেবেই আগলে নেব কথা দিলাম। একজন যোগ্য স্বামী হয়ে দেখাবো। (কাব্য)
কাব্যের কথা শুনেই লাইজু খানমের মুখে হাসি ফুটে ওঠে। ছেলের কপালে গাঢ় একটা চুমু এঁকে দেন।

-আমি তো ভাবছি সে কতটা লাকি যে এমন একটা শাশুড়ি পাবে! আব্বুকে বলেছো এই বিষয়ে? (কাব্য)
-হ্যা বলেছি তো । সে বলেছে তুই যেটা বলবি সেটাই হবে। আমি এখনই তোর আব্বুকে গিয়ে বলছি সব। আমরা কিন্তু পরশুই আশাদের বাসায় যাচ্ছি কাব্য। সময় বের করে রাখবি একদম হেয়ালি করবিনা। বলেই রুম থেকে দ্রুত বের হয়ে যান লাইজু খানম।
কাব্য মায়ের যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়িয়ে মুচকি হেসে ওঠে।

দুদিন বাদেই লাইজু খানম ও কাব্য এসে হাজির হয়ে আশালতাদের বাসার সামনে।দরজায় কড়ানাড়া পড়তেই ছুটে আসেন হাফসা বেগম। দরজা খুলে দিতেই লাইজু খানম ও তার পাশে একজন সুদর্শন পুরুষকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চমকে ওঠেন।

অপ্রিয় আশালতা পর্ব ৭

-কে এসেছে মা? বলতে বলতে দরজার দিকে এগিয়ে আসে আশালতা।

অপ্রিয় আশালতা পর্ব ৯