অর্ধাঙ্গিনী পর্ব ৯

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব ৯
Mousumi Akter

রাস্তার পাশে কতগুলো অনাথ বাচ্চাদের খাবার দিচ্ছে মেরি আর পুষ্প।মেরির চোখ দিয়ে অনবরত পানি ঝরছে সে ওড়নার মুড়ো দিয়ে পানি মুছছে।ক্রমাগত চোখের পানি পড়েই যাচ্ছে।পুষ্প প্রতিবছর এই দিনটায় ভীষণ অবাক হয়ে নিজের মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে।সারাবছর তার মায়ের চোখে সে পানি দেখেনা।

তারা বাবার এত অত্যাচার সহ্য করে তবুও এইভাবে কাদেনা।পৃথিবীর সকল বাঁধা অতিক্রম করে এই দিনে মেরি বেরিয়ে আসে।সারা বছর যে টাকা জমায় সেই টাকায় শহরের সমস্ত এতিম,অনাথ অসহায় বাচ্চাদের দামী দামী খাবার সহ দামী দামী পোশাক কিনে দেয়।পরিবারের কেউ জানেনা কেন এই তারিখে মেরি অসহায় অনাথ বাচ্চাদের খাবার খাওয়ায়।সবাই জিজ্ঞেস করলে বলে, ‘তার আপনজন হারিয়ে যাওয়ার দিন।’

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

এই কথা শুনে পরিবারের সবাই ভাবে হয়ত মেরির মা অথবা বাবা কারো মৃত্যু দিবস হবে।কিন্তু পুষ্প এখন বড় হয়েছে।এই কাঁন্নার সে ভিন্ন মানে খুজে পায়।প্রচন্ড আবেগের এই কাঁন্না। যেন গভীর কোনো ক্ষত লুকায়িত।সাধারণ কোনো কষ্ট হলে সময়ের সাথে সাথে ক্ষত বিলীন হয়ে যায়।কিন্তু মেরির ক্ষত আজও বিন্দুমাত্র কমেনি।পুষ্পের ভীষণ জানতে ইচ্ছা করছে, “আম্মু সত্যি করে বলবা কেন এই দিনটায় তুমি এত ভেঙে পড়ো।কীসের এত কষ্ট তোমার?”

মেরির মুখের দিকে তাকিয়ে কেন যেন পুষ্প প্রশ্নটা করতে পারল না। তার নানা অথবা নানীর ব্যাপারেও কিছু জানেনা পুষ্প।মেরির বাবার বাড়ি ইন্ডিয়াতে।সেখানের কারো সাথে যোগাযোগ নেই।কীভাবে আর কী করে ইন্ডিয়ার মেয়ে আর বাংলাদেশের একজন মন্ত্রীর বিয়ে হয়েছে সেই রহস্য কারো জানা নেই।মেরির মা-বাবা নেই তাই বলে কি তার আর ভাই-বোন বা আত্মীয় স্বজন কেউ নেই।শোনা যায় মেরি ভালবেসে দেশ ছেড়ে ইন্ডিয়া থেকে বাংলাদেশে চলে আসে।যার জন্য তার পরিবারের কেউ আর যোগাযোগ করেনি।মেরির বৈবাহিক জীবন থেকে পুরোটায় একটা রহস্যঘেরা।

প্রভাত ওই রাস্তা দিয়েই যাচ্ছিলো।প্রভাত ও জানে মেরি আজ অনাথ বাচ্চাদের খাওয়াবে।মেরি প্রতিবার এই দিনে অনাথ বাচ্চাদের খাওয়ানোর সময় প্রভাত কে সাথে নিয়ে আসে।প্রভাতের কোনো ব্যস্ততা থাকলেও মেরি শোনেনা।যে কোনো ভাবে প্রভাত কে এনেই ছাড়ে।আজ ও তাই।প্রভাত কে বলে দিয়েছে পৃথিবীর যে প্রান্তে থাকো না কেন উপস্থিত হতেই হবে তোমাকে।প্রভাত গাড়ি চালাচ্ছে। পূর্ণতা পাশেই বসে আছে।কেন যেন পূর্ণতার মনে একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে।পূর্ণতা সন্দিহান মন নিয়ে প্রশ্ন করল, “আচ্ছা প্রভাত ভাই একটা জিনিস খেয়াল করেছেন।”

প্রভাত পূর্ণতার দিকে তাকাল।কিছুটা অবাক হল।অনেকদিন হল পূর্ণতা তার সাথে ভাল ভাবে কথা বলেনা।কিছু বলতে গেলেই ঝাড়ি মারে।চোখে সব সময় রাগ থাকে।এই মুহুর্তে সেসব নেই।প্রভাত পূর্ণতার কৌতুহলী মুখটার দিকে তাকিয়ে বলল, ” কি খেয়াল করার কথা বলছো?”

“কাকিমনি আপনাকেই কেন জোর করে এই দিনে নিয়ে আসে।পুষ্প আপুকে তো সেইভাবে জোর করেনা।যেন আপনি রিলেটেড কোনো ব্যাপার। আপনি না আসলে হবেই না।”
প্রভাত মৃদু হেসে বলল, ” আরেনা। সেসব কোনো ব্যাপার নেই।আজ তো পুষ্প ও এসছে।”
“সে তো মাঝে মধ্য আসে।বাট আপনার কি খেয়াল আছে কোনবার আপনি ছাড়া কাকিমনি এসছে।”
“মা আমাকে একটু বেশী ভালবাসে।অন্যরকম ভালবাসে।কেন সেটা জানিনা।প্রতিটা সন্তানকেই মায়েরা ভালবাসে।তবে আমাকে একটু বেশীই ভালবাসে।”

“আসলেই তো মানুষ নিজের পেটের সন্তানকেও এত ভালবাসেনা।আপনাকে একটু বেশী ভালবাসে।তার মানে আপনি এ বাড়ির কুড়িয়ে পাওয়া ছেলে।পরের ছেলেতো তাই একটু বেশী কেয়ার করে।”
প্রভাত পূর্ণতার দিকে আড়চোখে তাকাল।ঠোঁট নাড়িয়ে মৃদু হেসে বলল,
“চৌধুরী বাড়ির একমাত্র ছেলেকে কুড়িয়ে পাওয়া বানিয়ে দিচ্ছো।কি হিটলার তুমি।বাই দ্যা ওয়ে পূর্ণতা তুমি কি আমায় কুড়িয়ে পাওয়া বরের নজরে দেখো কাছে আসতে চাওনা।”

“একদম নিজের ভাই-এর নজরে দেখি।ভাই ভাই ফিলিংস হয়।”
প্রভাত দুষ্টু হেসে বলল, “হট ফিলিংস হয়না?” বলেই পূর্ণতার দিকে তাকাল।পূর্ণতার চোখ আবার কপালে উঠল।সে আশ্চর্যজনক চাহনি নিয়ে প্রভাতের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ছিঃ ছিঃ এমন অসভ্যর মত কথা কীভাবে মুখে আসে আপনার।”
“জীবনে আর কোনদিন যদি ভাই ডাকো পরেরবার এর চেয়েও অধীক অসভ্য কথা মুখ দিয়ে বের হবে।”
“এর চেয়ে অসভ্য কথা দুনিয়ায় আছে।”
“শুনতে চাও? তাহলে শোনো।”

পূর্ণতা দুইকানে হাত দিল।চেপে ধরে বলল, ” আপনার পায়ে ধরি আমি আর কিচ্ছু শুনতে চায়না।আর জীবনেও ভাই ডাকব না।”
প্রভাত স্টিয়ারিং ঘুরাতে ঘুরাতে লুকিং গ্লাসে নিজেকে দেখে সামনের চুলে হাত বুলিয়ে দুষ্টু হেসে বলল, “তোমার স্থান আমার পায়ে নয়, বুকে।”

পূর্ণতা বিরক্ত চোখে তাকাতেই প্রভাত বলল, ” না মানে বাসর ঘরে বলতে হবে আরকি।সামান্য রিহার্সাল করে নিলাম।”
কথা বলতে বলতে প্রভাতের গাড়ি মেরির কাছে পৌছে গেল।প্রভাত গাড়ি থেকে নেমে দেখল মেরি অশ্রুসজল চোখে দাঁড়িয়ে আছে।এই দিনে মেরি যেন প্রভাতকে একটু বেশী কাছে রাখতে চায়।বেশী আদর যত্ন করে।প্রভাত মেরির কাছে গিয়ে বলল, ” আম্মু কাজ শেষ হলে চলো।”

মেরি চোখের পানি মুছে বলল, ” যাবে মানে? তুমি সবাইকে পোশাক গুলা দাও।আর খুব ভাল ভাবে দোয়া করো।যার উদ্দেশ্য এইসব দেওয়া মৃত্যুর পর যেন তার সাথে আমাদের সবার দেখা হয়।”
পূর্ণতার কথা প্রভাতের মনে কিছুটা ধরেছে গাড়িতেই।এই দিনটা ঘিরে অনেক প্রশ্ন মনে জাগলেও প্রভাত কখনো প্রশ্ন করেনি।তবে আজ প্রশ্ন করল, ” সে কে আম্মু? যার জন্য তুমি এত কাদো।আবার আমাকে বেশী বেশী দোয়া করতে বলো।”
“সে আমাদের আপণজন তাই দোয়া করতে বলি।দোয়া করা তো খারাপ জিনিস নয়।”

প্রভাত মেরির মনের অবস্থা বুঝে আর কোনো প্রশ্ন করল না।ওখানের কাজ শেষ করে সবাই বাসায় ফিরল।
জাহানের জ্বর কমেছে অনেকটা।ওয়াজেদ এখনো বাসায় ফেরেনি।জাহান এখন আর এসব নিয়ে ভাবেনা।ভাবতে ইচ্ছা করেনা।পুষ্প কিছু ফল কেটে জাহান কে খাওয়াচ্ছে।নতুন কাজের বুয়া আগামিকাল আসবে।এইদিকে জয়নাবের ও সন্ধান মেলেনি।
তখন সন্ধ্যা ঘুরে গিয়েছে।পূর্ণতা একটা লাল রঙের থ্রি -পিছ পরে মাত্র সাওয়ার নিয়ে বের হয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে।

থ্রি-পিস টা আজ ই প্রভাত কিনে দিয়েছে।প্রভাত ও বাইরে যাবে বলে মাত্রই রুম থেকে বের হয়েছে।রুম থেকে বের হয়েই বারান্দায় লাল রঙের পোশাকে পূর্ণতাকে দেখে মুগ্ধতায় ছেয়ে গেল তার দু’চোখ।সন্ধ্যার ক্ষীন আলোয় চকচক করছে পূর্ণতার চোখ মুখ।ভেজা চুলে বেশ স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে।

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব ৮

প্রভাতের ঠোঁটের কোনে ঠোঁট বাঁকা করা মুগ্ধ একটা হাসি।প্রভাত ও লাল গেঞ্জি আর কালো জিন্স পরেছে।ক্রমশ পূর্ণতার দিকে এগিয়ে আসছে।তখন ই সজল কোথা থেকে এসে পূর্ণতার সাইডে একদম গা ঘেষে দাঁড়াল।প্রভাতের পা’দুটো থেমে গেল।আগ্নেয়গিরির ন্যায় জ্বলে উঠল তার দু’চোখ।

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব ১০