অর্ধাঙ্গিনী পর্ব ১০

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব ১০
Mousumi Akter

প্রভাতের চোখের দৃষ্টি কেমন আগ্নেয়গিরির ন্যায় দেখা যাচ্ছে।চোখ দুটো যেন এখনি ভেতর থেকে বাহিরে বের হয়ে আসবে।রাগে চোয়াল শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে।হাত এমনভাবে মুষ্টিবদ্ধ করে রেখেছে নখ বসে গিয়েছে তালুতে।পূর্ণ দৃষ্টি আরোপ করে তাকিয়ে আছে সজল এবং পূর্ণতার দিকে।এক পা,দু পা করে এগিয়ে যাচ্ছে ওদের দিকে।সজলের হাতের সাথে পূর্ণতার হাতের স্পর্শ লেগে আছে।সজলের চোখে মুখে মুগ্ধতা।পূর্ণতার দিকে তাকিয়ে বলল,

“পূর্ণতা আজ আমার কেমন ইদ ইদ লাগছে জানো।”
আচমকা সজলের উপস্থিতি দেখে পূর্ণতা প্র‍থমে কেঁপে উঠেছিলো।সে প্রভাত ভেবেছিলো।কিন্তু তাকিয়ে সজল কে দেখে সজলের থেকে একটু সরে দাঁড়াল।স্বভাব সুলভ হেসে বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

” কেন সজল ভাই?”
“এইযে বহুদিন পর ইদের চাঁদ উঠেছে আমার আকাশে।”
সজলের কথায় পূর্ণতা কিছুটা অবাকচোখে সজলের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আপনার আকাশে ইদের চাঁদ উঠলে তো আমাদের আকাশেও উঠবে সজল ভাই।আমাদের আকাশে তো আমাবস্যার চাঁদ।”

“আমার একান্ত ব্যক্তিগত আকাশ হল আমার হৃদয়,সেই আকাশের একটাই চাঁদ হল তুমি।আমার আকাশের সব মেঘ তোমার আগমনে কেটে গিয়েছে।”
পূর্ণতা প্রশ্ন ছুড়ল,
“আমার আগমনে?”

“আমার কাছে এটা আগমন ই।দীর্ঘদিন পর তোমাকে দেখার লাইসেন্স পেয়েছি।গত এক বছর কত ছটফট করেছি তোমাকে দেখার জন্য কিছু দেখতে পারিনি।”
“তা এখন কীভাবে লাইসেন্স পেলেন?”
“এইযে মামা নিষেধ করেছিলো যেন এ বাড়িতে না আসি, অথচ মামাই আবার এ বাড়িতে থেকে যেতে বলল।বলল অনেকদিন যেন থেকে যায়।”

পূর্ণতা খানিকটা অবাক হল।তার চাচার হঠাৎ পরিবর্তন কেন? উনিতো নিজের কথার পরিবর্তন করা মানুষ নন।নিজেদের আত্মীয় স্বজনের মাঝে বিয়ের সিদ্ধান্ত সব চেয়ে বেশী অবাক করেছে সবাইকে।পূর্ণতার সবকিছুতে কেমন যেন সন্দেহ হচ্ছে।তার বিয়ে যে রাজনীতির একটা পার্ট সে ভালভাবে আঁচ করতে পারছে।এইদিকে সজলকে এই বাড়িতে এভাবে রেখে দিতে চাওয়াটাও বড় অদ্ভুত লাগল পূর্ণতার কাছে।তার চাচা জানে তার ছেলের হবু বউকে সজল পছন্দ করে।জেনে বুঝে এমন কাউকে বাড়িতে রাখতে চাওয়া মানুষ তো উনি নন।পূর্ণতা কোথায় যে হারিয়ে গিয়েছে।সজল পূর্ণতার মুখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে বলল,

“কোথায় হারিয়ে গেলে?”
পূর্ণতা ভাবনা থেকে বের হল।মৃদু হেসে জবাব দিল,
“বেশ সাহিত্যিক হয়ে গিয়েছেন দেখছি।”
“তুমি সামনে এলেই তো ভেতর থেকে সব এলোমেলো কথা বের হয়।এটাকে তুমি সাহিত্য বললে বলতে পারো।”
“এসব আমাকে বলে কি রিহার্সাল করছেন।আমাদের ভাবি কিন্তু ভাগ্যবতী হবে।স্বামীর মুখে প্রেমের এমন মহাকাব্য শুনতে কার না ভাল লাগে।”

“সব জেনে বুঝে কেন এমন করো কেন? কেন আমাকে কষ্ট দেওয়া কথা বলো পূর্ণতা।আমি ছোট বেলা থেকেই তোমাকে পছন্দ করি,তোমাকে ভালবাসি।সেটা সব সময় ই প্রকাশিত। আমিতো কোনদিন লুকায়নি।কিন্তু প্রভাত ভাই এর ভয়ে বেশী জোরাজোরি ও করিনি।তোমাকে আর পুষ্পতাকে প্রভাত ভাই সব সময় নজরে রেখেছে।তবে বিশ্বাস করো পূর্ণতা আমি সেই ছোট বেলা থেকে একটু একটু করে তোমাকে পাহাড় সমান ভালবেসেছি।

ভেবেছিলাম বড় হলে তোমাকে ঠিক ই পাব।কারণ সত্যিকারের ভালবাসার জয় একদিন না একদিন হবেই।তোমাকে তোমার পরিবারের কাছে চাইলাম কিন্তু পেলাম না।প্রিয় মানুষকে নিজের করে না পাওয়ার মত হাহাকার এ দুনিয়াতে আর কিছুতে নেই।তবে আমি হাল ছাড়িনি।আর ছাড়ব ও না।আমি এখনো বিশ্বাস করি চাইতে চাইতে ঠিক ই একদিন তোমাকে পেয়ে যাব।একবার যদি তুমি আমার হাতটা ধরতে তোমাকে নিয়ে আমি এ পৃথিবী ছেড়ে পালিয়ে যেতাম।”

“প্লিজ সজল ভাই! এসব আর বলবেন না।এসব বলেও কোনো লাভ নেই এখন।এতে অশান্তি বাড়বে।”
“কীসের অশান্তি?”
“আমার কপাল কোনদিন ভাল ছিলনা,আর এখন ও নেই।ছোট বেলা থেকে আপনি আমার খুব কাছের একজন মানুষ। যে কোনো সমস্যার কথা চাইলেই আপনাকে বলতে পারি।চোখ বুজে আপনাকে আমি বিশ্বাস করি।এইটুক বিশ্বাস আমার আছে আপনার দ্বারা কোনো ক্ষয়-ক্ষতি আমার কোনদিন হবেনা।আপনার আর আমার সম্পর্কটা এভাবেই ঠিক আছে সজল ভাই।এর চেয়ে বেশী আর কিছুই সম্ভব নয়।”
সজল পূর্ণতার হাতটা মোলায়েম ভাবে ধরে বলল,

“এখনো সময় আছে পূর্ণতা। ভেবে দেখো।”
প্রভাতের চোখ দু’টো জ্বলছে। এতক্ষণ ধরে সে ধৈর্য্য সহকারে ওদের কথোপ-কথন শুনছিলো।কিন্তু যখনই সজল পূর্ণতার হাত ধরেছে তখন ই প্রভাত দ্বিগুন জ্বলে উঠে ওদের একদম কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়াল।আচমকা গিয়ে সজল আর পূর্ণতার হাত ধরে দু’জনকে দু’দিকে সরিয়ে দিল।প্রভাত পূর্ণতার দিকে অগ্নিচোখে তাকিয়ে সজলের দিকে তাকাল।সজলের দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি কিছুটা শীতল করল।চোয়াল শক্ত করে বলল,

“কি হচ্ছে এখানে?”
সজল হেসে বলল,
“আরে প্রভাত ভাই, এইযে পূর্ণতা আমাকে রেডি হতে বলে আমাকে না নিয়ে বাইরে চলে গিয়েছে। ওর জন্য আমি কষ্ট করে রেডি হলাম অথচ আমাকে না নিয়ে চলে গেল।ওর শাস্তি পাওয়া উচিৎ তাইনা ভাই?”
প্রভাত সজলের দিকে থমথমে মুডে তাকিয়ে বলল,
“তুমি ফিরছো কবে?”

সজল খানিকটা তোতলালো।প্রশ্নটা একদম অপমানজনক।সে এসেছে কতদিন থাকবে এখানে সে পরিবর্তে কীনা প্রশ্ন করছে তুমি ফিরছো কবে।সজল অপমানিত হলেও স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করল।হেসে উত্তর দিল,
“ফিরছি কবে মানে? আসলাম তো আজই।মামাবাড়ি এসছি তাও আবার কতদিন পর দুদিন না থেকে যায় কীভাবে?”
“এই বয়সে মামাবাড়ি থাকার বয়স আছে তোমার?”

“তুমি সেটা বুঝবে না সজল ভাই।কারণ তোমার তো মামাবাড়ি নেই।কখনো যাওনি।এইজন্য বুঝবা না মামাবাড়ি যাওয়ার আনন্দ,থাকার আনন্দ।”
কথাটা প্রভাতের একদম হৃদয়ে তীরের মত গিয়ে ছিদ্র করে দিল।যন্ত্রণার এক চিনচিন ব্যাথায় আহত হল হৃদয়।এত বড় আঘাত দেওয়া কথা তাকে আজ পর্যন্ত কেউ দেখাতে সাহস পায়নি।প্রভাতকে আঘাত দিয়ে দূর্বল করা সহজ নয়।সে ভেতরে ভাঙলেও উপরে দূর্গের মত শক্ত।ক্ষীন হেসে বলল,

“মামাবাড়ি থাকলে অবশ্যই যেতাম।যদি মামার সুন্দরী মেয়ে থাকত তাহলে আরো বেশী যেতাম।মামার সেই সুন্দরী মেয়ে যদি রিজেক্ট করত তাহলে বেসরম এর মত তার পিছে আরো বেশী ঘুরতাম।”
সজলের মুখটা একদম অপমানে থমথমে হয়ে এল।কিছু বলার মত ভাষা নেই তার।প্রভাতের এইবার পৈচাশিক আনন্দ হচ্ছে।সে অপেক্ষায় আছে এইবার কিছু একটা বল।এর চেয়ে বড় কামান তোর জন্য রেডি রেখেছি।প্রভাত কে কষ্ট দিয়ে পার পায়নি কেউ এখনো আর তো তুই ভ্যাবলাকান্ত সজল।সজল অনেক ভেবেও কোনো উত্তর পেলনা।রাগ করে এ বাড়ি ছেড়েও যাওয়া যাবেনা।সে শেষ যু-দ্ধে নেমেছে।এইবার জিতেই মাঠ ছাড়বে।সজল আবার ও হেসে জবাব দিল,

“কিসব বলো প্রভাত ভাই! পূর্ণতার সাথে তোমার বিয়ে ঠিক।এখন এসব বলার মানে আছে।”
প্রভাত সজলের দিকে কপাল কুচকে বলল,
“নট পূর্ণতা,পূর্ণতা ভাবি।পূর্ণতাকে আজ থেকে ভাবি বলে ডাকবে।আর আপনি করে বলবে।মাইন্ড ইট! ”
সজল কিছুটা অদ্ভুতভাবে হেসে বলল,
“তোমাদের বিয়েটা একবার হোক তারপর না হয় ডাকব।”
“বিয়েটা হোক মানে? আগামি বছর তুই মামা ডাক শুনবি,লিখে রাখ।”

প্রভাত পূর্ণতার দিকে আগের ন্যায় চক্ষুগরম করে তাকিয়ে বলল, ” আমার রুমে এসো এখনি।জাস্ট ২ মিনিট।নাহলে মহাপ্রলয় ঘটে যাবে।” বলেই প্রভাত নিজের রুমে চলে গেল।রাগে তির তির করে কাঁপছে প্রভাত।সজলের অপমানের তীর টা সে হজম করতে পারেনি।তার মামাবাড়ি নিয়ে এত বড় কথা বলার সাহস পেল কীভাবে সজল।তারপর আবার পূর্ণতার হাত ধরা, গায়ে গা ঘেষে দাঁড়ানো।অগ্নিচোখে বার বার পূর্ণতার হাত ধরার দৃশ্য ভেষে উঠছে প্রভাতের।

নিজের রুমের রাজকীয় খাটের উপর দাঁতে দাঁত কামড়ে বসে আছে প্রভাত।অপেক্ষা করছে পূর্ণতার।
প্রভাত চলে গেলে সজল গেলে বলল, ” দেখলে পূর্ণতা প্রভায় ভাই আমাকে কি বাজে ভাবে অপমানটা করল।”
পূর্ণতা এমনি চিন্তায় আছে।প্রভাত রেগে আছে।তাকে এখন কীসের সম্মুখীন হতে হবে সে জানেনা।এই মুহুর্তে সে সজলের কথায় বিরক্ত হয়ে উত্তর দিল,

“কে বলেছিলো পানির ছিটা দিয়ে চৈড় এর গু’তা খে’তে।জানেন তো সে এমন কেন লাগতে গেলেন তার সাথে।আপনাকে তো এখন আর কোনদিন ই দু’চোখে দেখতে পারবে না।”
“আমি কি বলেছি?”
“আপনি কি বলেছেন মানে? আপনি চরম অন্যায় করেছেন প্রভাত ভাই এর মামা বাড়ি নিয়ে খোটা দিয়ে।কাজটা মোটেও ঠিক করেন নি।আমি জানি উনি উপরে যতই তেজ দেখাক ভেতরে কষ্ট পেয়েছে।আপনার এই কথাটা আমার মোটেও ভাল লাগেনি।”

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব ৯

“বাহ! প্রভাতের প্রতি এত দরদ।মুখে বলো দেখতে পারোনা।আবার তাকে কিছু বলাতে দেখছি তার চেয়ে তোমার বেশী লেগেছে।আমি তো ভেবেছিলাম প্রভাত কষ্ট পেলে তুমি খুশি হবা।”
“দিন শেষে উনিই আমার অভিবাবক।ছোট বেলা থেকে আমি উনাকে দেখতে পারিনা এটা আমার সমস্যা।তাই বলে উনাকে কেউ কষ্ট দিলে আমার ভাল লাগবে এমন কোথাও লিখে দিইনি আমি।উনি কষ্ট পেলে আমি মোটেও আনন্দিত হইনা সজল ভাই।বরং আরো কষ্ট পেলাম। ”

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব ১১