আকাশে তারার মেলা পর্ব ১৭+১৮

আকাশে তারার মেলা পর্ব ১৭+১৮
আসরিফা সুলতানা জেবা

গরমের মাঝে ও সুইমিংপুলের পানিতে দাড়িয়ে থরথর করে কাঁপছে তুলি। সুইমিংপুল টা ততটা গভীর না। আকস্মিক পড়ে যাওয়ায় পানি নাকে মুখে ঢুকে বেহাল দশা মেয়েটার। তার উপর পানি টা বেশ ঠান্ডা। সারা শরীরে কাঁপুনি ধরে গেছে। দাঁত ও কিড়মিড় করছে। অথচ আদ্র তার যেন কোনো চিন্তা নেই। সে এখনও ক্রোধান্বিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রেখেছে তুলির দিকে। তুলি ভীতি ও নেশাগ্রস্ত ভাব নিয়ে কাঁপতে লাগল। পুরোপুরি হুঁশ নেই তবুও আদ্রের রাগী দৃষ্টি দেখে আত্মা বেরিয়ে যাওয়ার অবস্থা। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আদ্র উঠে দাঁড়াল। পা বাড়াল তুলি কে ফেলেই। কাঁপতে কাঁপতে তুলি ডেকে উঠল।

–“আমায় নিয়ে যান। ঠান্ডা লাগছে তো।”
পিছনে না তাকিয়ে আদ্র অসম্ভব রেগে বলে উঠল,,
–“তুই আজ সারারাত পানির মধ্যেই থাকবি। ভুলে হোক আর যেভাবে হোক আমার অপছন্দের কাজ তো তুই করেছিস। এখন আগে শাস্তি ভোগ করে নে তারপর উঠিয়ে ও আনব। নিজের বুকেও ঢুকিয়ে রাখব।”
আদ্রের কথাটা শ্রবণ হতেই অভিমানে ভরে গেল তুলির মনটা। নেশার রেশ পুরোপুরি কাটে নি তার মাঝেই অভিমান ঝেকে ধরেছে প্রখরভাবে। ঠোঁট উল্টে বিড়বিড় করতে লাগল।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

–“পাষাণ লোক। আমি জানতাম ডাক্তার রা পাষাণ হয়। শক্ত মনের মানুষ হয়। তাই তো মানুষের শরীরে অংশ কাটতে ও ভয় পায় না। একটুই তো খেয়েছি তার জন্য বুঝি ওনি আমাকে মেরে ফেলার ফন্দি আঁটবে। একবার উঠি তারপর দেইখেন আমি আপনার ধারে কাছে ও যাই কিনা। তুলোর মতো নরম আমি কিন্তু ঐ পাষাণ লোকটা আমায় আরও নরম করে দিচ্ছে। ”

এভাবে অনবরত বিড়বিড় করতে লাগল তুলি। এতোক্ষণ আদ্র ছিল তাই ভয়ে চুপসে ছিল। সুযোগ পেয়ে উঠতে লাগল। সামনে আদ্র কে দেখে পা পিছলে পড়ে গেল সুইমিংপুলে। এবার রাগে জেদে কেঁদেই দিল। তীক্ষ্ণ নজরে তাকাল আদ্র। গম্ভীর স্বরে কাছে আসার জন্য ডাকল। ভয়ে ভয়ে একদম কর্ণার ঘেঁষে দাঁড়াল তুলি। নিজের হাতের গ্লাস টা এগিয়ে দিল আদ্র। কাঁপা কাঁপা হস্তে তুলি গ্লাস টা হাতে নিয়ে জিজ্ঞাসা সূচক চাহনি নিক্ষেপ করল আদ্রর লাল রাঙা হয়ে উঠা আঁখিদ্বয়ের দিকে।

–” লেবু পানি। পুরোটা খাবে। যদি একটুও থেকে যায় তবে আমি তোমায় কাঁচা গিলে খেয়ে ফেলব।”
ধরফর করতে লাগল তুলির বুক টা। মন তৎক্ষনাৎ বলে উঠল,,–” তুলি তোর ডাক্তার সাহেব রাক্ষস। তাড়াতাড়ি খেয়ে ফেল বোন নয়তো তোকে চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে রাক্ষস টা।”

বিলম্ব না করে তড়িঘড়ি করে শরবত খেয়ে নিল তুলি। পরক্ষণেই চোখ মুখ খিঁচে নিল। ওয়াক! শব্দ করতেই হাত টা টেনে দ্রুত পানি থেকে তুলে আনল আদ্র। ছাদের কিনারায় নিয়ে পিছন থেকে তুলির শরীরের লেপ্টে থাকা ভেজা শাড়ি বেদ করে মসৃণ পেটে হাত টা চেপে ধরতেই গড়গড় করে বমি করে দিল তুলি। ক্লান্ত হয়ে পিছন থেকে মাথা হেলিয়ে দিল আদ্রর বুকে। পকেট থেকে রুমাল বের করে তুলির মুখ টা মুছে দিল আদ্র। অন্য হাতটা এখনও তুলির খালি পেটে স্থির।তুলির ভেজা চুলের পানিতে আদ্রর সাদা শার্ট টা ভিজে যাচ্ছে।

ভিতর থেকে এলোমেলো হয়ে পড়ছে আদ্র। অস্থির অনুভব হচ্ছে। তাড়াতাড়ি করে হাত টা সরিয়ে আনল পেট থেকে। বুকে দমকা হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। ইচ্ছে হচ্ছে তুলি কে একদম নিজের সাথে মিশিয়ে নিতে। অবাধ্য মন কে সায় না দিয়ে তুলি কে কোলে তোলে নিজের বুকে আগলে নিল। ভীষণ রাগ লাগছে মেয়েটার প্রতি কিন্তু রাগের চেয়েও অন্যরকম অবাধ্য অনুভূতি জড়ো হচ্ছে আদ্রর মনে। তুলির ভেজা স্নিগ্ধ চেহারা ভীষণ টানছে তাকে। নিজেকে সামলানো কঠিন হয়ে পড়ছে। কোনোভাবেই ভুল করতে পারবে না সে। ক্ষণিকের একটা ভুল এতো বছরের অপেক্ষার কাছে জিতে যাবে। তুচ্ছ হয়ে পড়বে বহু যন্ত্রণা সয়ে প্রহর গুণা সময়গুলো। চক্ষু সামনের দিকে স্থির রেখে হাঁটতে লাগল আদ্র। তুলি ঠান্ডায় আদ্রর বুকে গুটিশুটি মেরে রইল।

“ইডিয়ট একটা! আন্টির কাছে জোর গলায় বলেছে আন্টি বিয়ে বাড়িতে লুঙ্গি পড়লে আমার মধ্যে একটা জামাই জামাই ফিলিং আসবে। শশুর বাড়িতে গিয়ে তো লুঙ্গি পড়ি নি আজ নাহয় আপনাদের বাড়িতেই পড়ব। আন্টি যদি জানত তুই অফিস বন্ধ করতেই ভুলে যাস তাহলে ওনি তোরে লুঙ্গি দেওয়ার আগে হয়তো একশবার চিন্তা করত। করার পর আর লুঙ্গি টা দিত না। তোরে কাছে যে কেন বিয়ে বসছিলাম? আমার মান সম্মান ও ধুলোয় মিশিয়ে দিলি। এখন কি শর্ট প্যান্ট পড়েই থাকবি নাকি লুঙি টাও খুঁজে আনবি অন্তু?”

মাথায় হাত দিয়ে কাঁদো কাঁদো স্বরে কথাগুলো বলে উঠল পায়েল। হাত -পা ছড়িয়ে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে তার। লুঙ্গি আঁকড়ে ধরেও জায়গার টা জায়গায় রাখতে পারল না অন্তু। লুঙ্গি কোথায় তাও জানেনা বেচারা। ভাগ্যিস নিচে থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট ছিল নয়তো আজ নিশ্চিত পায়েল গলায় ফাঁস দিত। নিজের না অন্তুর! দাঁত কেলিয়ে সবার সাথে দাড়িয়ে রইল অন্তু। সাগর শব্দ করে হেসে দিল।
–“বইন পোলাডা যে জান টা লইয়া ফিরা আইছে এইডায় তো বেশি। তুই পইড়া আছস এখনও লুঙ্গি লইয়া। ”

–” নিজে তো বেঁচে ফিরছে কিন্তু তুলি? আমার তো ওর জন্য কান্না পাচ্ছে। সব দোষ তোদের। একেকটা এতো অসভ্য তোরা। আজ তো রিমি কে আমি বলব তোকে যেন বাসর ঘরে কঠিন শাস্তি দেয়। তোর ঠাঁই যেন মেঝেতে হয়।”
কটমট করে বলল পায়েল। সাগর মুখটা কাচুমাচু করে জবাব দিল,,
–” এভাবে হুমকি দেস কেন পায়েল? তুই ভালোই তো জানস রিমির রাগ কে আমি কতটা ভয় পায়। তুলির কিছুই হবে না। আদ্র ভালোবেসে শাস্তি দিবে।”

কথাটা বলেই হি হি করে হেসে উঠল সাগর সাথে অন্তুও। ফুশ করে একটা তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়ল পায়েল। আমরিন আতঙ্কিত হয়ে একপাশে দাড়িয়ে আছে। তার আতঙ্কের কারণ তুলির জন্য নয় নিবিড়ের জন্য। কারণ নিবিড় অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে তার দিকে। ছেলেটা সকাল থেকেই রাগী চোখে তাকাচ্ছে তার দিকে। আদ্র কে ছাদের সিড়ি বেয়ে নামতে দেখে সবাই দ্রুত পায়ে হেঁটে লুকিয়ে পড়ল। তুলি কে নিয়ে দুই তলায় এসে আদ্র তেজী কন্ঠে বলে উঠল,,

—“লুকিয়ে কি আর পার পাবি অন্তু? লুঙ্গি সিঁড়িতে পড়ে আছে। তুলে আনিস। তোর সাথে হিসাব-নিকাশ পরেই হবে।”
মুখটা চুপসে গেল অন্তর। এক এক করে বের হয়ে আসল সব। আদ্র কথা না বাড়িয়ে তুলি, আমরিনের জন্য নির্ধারিত রুমে নিয়ে আসল তুলি কে। সবগুলো উঁকি দিতেই দরজাটা লাগিয়ে দিল প্রচন্ড জোরে। আমরিন সামনে থাকায় ভয়ে পড়ে যেতেই নিবিড়ের বুকে গিয়ে ঠেকল। বড় বড় শ্বাস ফেলতে লাগল। কানের কাছে ধীর কন্ঠে নিবিড় বলে উঠল,,

–” আমার বুকটা তোমার বাপের দিনের কেনা সম্পদ না। এভাবে আমার বুকে পিঠ ঠেকিয়ে নিশ্বাস না ফেলে সোজা হয়ে দাঁড়াও। ”
কথাগুলো কর্ণকুহর হতেই সোজা হয়ে দাড়িয়ে পড়ল আমরিন। নিবিড়ের কন্ঠে রাগের ছাপ। কিছুটা দূরে সরে আসল। রাগ হোক না হোক একটা চাপা অভিমান কাজ করছে আমরিনের মনের গহীনে। নিবিড়ের মুখে উচ্চারিত কথাগুলো হৃদয়ে রক্তক্ষরণ করছে। সবাই চলে যেতে নিলে হুট করে দরজা খুলার আওয়াজে থমকে গেল। আদ্র ডেকে উঠল আমরিন কে। তড়িঘড়ি করে পা ফেলে ভাইয়ের কাছে গেল আমরিন।
–” আন্টির কাছ থেকে আরকেটা শাড়ি নিয়ে আয়। তাড়াতাড়ি ভেজা কাপড় পাল্টাতে হবে।”

কথাটা বলেই তুলির কাছে চলে এল আদ্র। তুলির পায়ের তলায় নিজের হাত ঘষতে লাগল। রাগের বশে মেয়েটা কে কষ্ট দিয়ে এখন দ্বিগুণ কষ্ট পাচ্ছে। পায়ে আদ্রর ছোঁয়া অনুভব করলেও কিছু বলতে ইচ্ছে করছে না তুলির। মাথাটা ভীষণ ভারি হয়ে আছে। আমরিন সুতি একটা শাড়ি হাতে নিয়ে দৌড়ে এল। দরজার কাছে এসেই থমকে গেল। চোখে ফুটে উঠল অবাকতা।একটা ছেলে কতটা ভালোবাসলে এমনটা করতে পারে? আজকাল যেখানে মানুষ নত হতেই চায় না সেখানে তার প্রচন্ড কঠোর ভাই টা কেমন অস্থির হয়ে পড়েছে ছোট্ট একটা মেয়ের জন্য। দরজায় টোকা দিল আমরিন। আদ্র তুলির চুল মুছে দিতে দিতে বলল,,,

–“তাড়াতাড়ি আয় আমরিন। তোর ভাবীর কাপড় টা পরিবর্তন করে দে। আমি বাহিরে দাড়াচ্ছি।”
দ্রুত পা চালিয়ে বাহিরে চলে গেল আদ্র। আমরিন সেথায় জমে রইল। তার ভাই কি বলল? “তোর ভাবী!” একরাশ ভালো লাগায় ছেয়ে গেল আমরিনের মনটা। সে তো কোনোদিন ও তার চেয়ে তিন মাসের ছোট মেয়েটা কে ভাবী বলে সম্বোধন করার কথা ভাবে নি। ভাবে নি বললে ভুল হবে এটা তো কখনও তার মনে জাগে নি। তোর ভাবী শব্দ টা আমরিনের মনে অন্য ধরনের অনুভূতি জাগিয়ে তুলছে। দু দিন পর এই পিচ্চি মেয়েটা সত্যিই তার ভাবী হবে তবে এখন থেকে ডাকতে কি দোষ! আমরিন ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বলল,,

–“একটু কষ্ট করে উঠে দাঁড়াও ভাবী। শাড়ি টা পড়িয়ে দিই।”
তুলির পরিপূর্ণ হুঁশ না থাকলেও আমরিনের মুখে ভাবী ডাক শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল। দুর্বল শরীর নিয়ে উঠে বসল। ঝটপট করে শাড়ি টা বদলে দিতে শুরু করল আমরিন। মুখে প্রস্ফুটিত হাসি নিয়ে বলে উঠল,,,
–“ভাইয়া এসব ছাইপাঁশ খাওয়া একদমই পছন্দ করে না। তাই রাগের চোটে থাপ্পড় মেরে দিয়েছে। আমার ভাই কে কখনও ভুল বুঝবি না দয়া করে। মানুষ টা অত্যন্ত রাগী স্বভাবের হলেও তোর বেলায় নিতান্ত দুর্বল। আজকাল ভাইয়া কে দেখলে মনে হয় ওনি বোধহয় তোকে ছাড়া নিশ্বাস টুকু ও নিতে পারবে না।”
নিশ্চুপ হয়ে রইল তুলি। আসলে তার কাছে সবকিছু যেন আবছা লাগছে। কিছু সময়ের ব্যাপার হলেও ঘটে যাওয়া কিছু কিছু মুহুর্ত যেন অস্পষ্ট। নেশা জাতীয় ড্রিংকস খেয়ে ফেলেছে সেটা মনে আছে। আদ্রর থাপ্পড় খেয়ে টালমাটাল হয়ে পানিতে হাবুডুবু খেয়েছে তাও চোখের পাতায় অস্পষ্ট। কিছু বলতে যেয়েও বলতে পারছে না তুলি। শরীর টা খারাপ লাগছে। আর না পেরে বিছানায় বসে পড়ল।

বিয়ে বাড়িতে আত্মীয় স্বজনদের ভিড়। সাগরের মা কে খুঁজতে খুজতে কিচেনের দরজায় এসে দাঁড়াল আদ্র। দেখতে পেয়ে ভিতরে প্রবেশ করতেই হাসি মুখে এগিয়ে এলেন তিনি।
–” আদ্র তুমি কিচেনে? কিছু লাগবে বাবা?”
–“আমি কি আপনার কিচেন টা ইউজ করতে পারি আন্টি? ”
–” অবশ্যই করতে পারো। কিন্তু কিছু লাগলে আমায় বলো আমি বানিয়ে দিব। ”
–” আপনার কষ্ট করতে হবে না আন্টি। আপনি অনেক কাজ করছেন সন্ধ্যা থেকেই দেখতে পাচ্ছি।”
–“ঠিক আছে। কিছু না পেলে আমায় জানাবে।”

সম্মতি জানিয়ে আদ্র জলদি করে ফ্রিজ থেকে দুধ বের করে চুলোয় বসিয়ে দিল। ভেজিটেবল স্যুপ বানানোর জন্য কিছু শাকসবজি বের করে নিল। দশ মিনিটে কাজ শেষ করে স্যুপ ও এক গ্লাস দুধ নিয়ে রুমে আসল। আমরিন বসে আছে তুলির পাশে। তুলি ঘুমিয়ে পড়েছে। আদ্র কে দেখে বের হয়ে গেল আমরিন। বাহির থেকে দরজাটা চাপিয়ে গেল। তুলির মলিন চেহারা টা দেখে ক্ষত বিক্ষত হতে লাগল আদ্রর হৃদপিণ্ড। পাশে বসে ঘুমন্ত তুলি কেই টেনে নিল নিজের বুকে।

নড়ে উঠল তুলি। বহু কষ্টে চোখ দুটো মেলে চাইল আদ্রের চেহারার দিকে। আরকেটু টেনে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরল আদ্র। দুধের গ্লাস টা মুখে ধরতেই অর্ধেক টা খেল তুলি। স্যুপ টাও যত্ন করে খাইয়ে দিল আদ্র। তুলির নেশার রেশ কেটে গেলেও আদ্রর প্রতি আসক্তি গ্রাস করে নিচ্ছে তাকে। আদ্রর চোখে মুখে অস্থিরতার ছাপ তুলির ঝাপ্সা চোখে ভেসে উঠছে যার দরুন ভালোবাসাময় অনুভুতির উদয় হচ্ছে তুলির বিক্ষিপ্ত মনে। দুর্বল গলায় মিনমিন করে বলল,,

–“আপনি কোথাও যাবেন না আদ্র। আমার পাশেই থাকবেন সবসময়।”
কথাটা শেষ করেই অচেতন মনে আদ্রর ডান হাত টা টেনে নিল তুলি। নিজের মাথা আদ্রর হাতে রেখেই পাড়ি জমাল ঘুমের দেশে। সময়ের ব্যবধানে জমে যাওয়া ক্ষণিকের কষ্টের মাঝেও মৃদু হাসি ভেসে উঠল আদ্রর ঠোঁটের কোণে। অপলকভাবে চেয়ে রইল তুলির শ্যামবর্ণ মুখশ্রীর দিকে। তুলির চোখের পাপড়ি গুলো বড় বড় যা প্রথম দেখায় আদ্রর মনে শিহরণ জাগিয়েছিল। নিজের ঠোঁটের উষ্ণ ছোঁয়া একে দিল তুলির দু চোখের পাতায়। অন্য হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরল তুলির এক হাত। মুষ্টিমেয় নিয়ে সূক্ষ্ম একটা চুমু খেল। আমরিন রুমে ঢুকতেই নজর পড়ল তুলির মাথার নিচে থাকা আদ্রর হাত টা।

–“ঘুমাবে না ভাইয়া? সারাদিন তো বিয়েতে ছিলে।”
খাটের সাথে একটু হেলান দিয়ে বসল আদ্র।তুলির যেন ঘুম না ভেঙে যায় তাই ধীর কন্ঠে বলল,,
–“আমি এভাবে এখানে থাকলে তোর কোনো সমস্যা নেই তো? ”
–“কোনো সমস্যা নেই ভাইয়া। কিন্তু সারা রাত তোমার হাত টা এভাবে রাখলে তো কষ্ট হবে তোমার।”
–” যেই হাত আমার তুলা কে আগলে রাখতে পারবে না সেই হাত দিয়ে আমি কি করব? সব যন্ত্রণা সহ্য করেও এই মেয়েটা কে একটুখানি সুখ দিতেও রাজি আমি।”

অভিভূত হল আমরিন। এতো ভালোবাসতে পারে কেউ কাউকে? কই সে তো নিবিড় কে এমন করে ভালোবাসতে পারে নি? তার ভাইয়ের মনে এতো ভালোবাসা জমে আছে এই মেয়েটার জন্য? এই মুহুর্তে আমরিনের মনে হচ্ছে তুলি নামক মেয়েটা তার ভাইয়ের প্রাণভোমরা ঠিক রূপকথার গল্পের মতো। মানুষ ভালোবাসায় কতটা দুর্বল হয়ে যায়। কতটা বেহায়া প্রকৃতির হয়ে উঠে। নিজের অস্তিত্ব, শান্তি,অনুভূতি, সুখ নির্বিশেষে নিজেকেও বিলিয়ে দেয় অনাসয়ে। আচ্ছা নিবিড় ও কি এমন করে ভালোবাসবে তাকে? বাসবে কি বাসেই তো। তবুও তার ভাইয়ের মতো করে নয়। আদ্রর মতো কোনো প্রেমিক পুরুষ দেখা হয় নি আমরিনের। আমরিনের খুব করে বলতে ইচ্ছে করছে —
“তুলি তুই সার্থক কারণ আমার ভাই কে পেয়েছিস তুই। কিছুই করিস নি তবুও চেয়ে দেখ আমার ভাইয়া দিনকে দিন পাগল হয়ে যাচ্ছে তোর ভালোবাসায়।”

স্নিগ্ধ এক সকাল। রুমে শীতল বাতাস প্রবাহমান। তুলি চোখের পলক ঝাপটিয়ে ভালোভাবে মেলল। নিজের হাত টা টান দিতেই অনুভব করল হাত টা কেউ ধরে রেখেছে। স্পর্শ টা তুলির অনুভবে মিশে আছে তাই বুঝতে কষ্টকর হল না। চোখ উপরের দিক করতেই মাত্রারিক্ত চমকে গেল । কিছুটা সংকোচ নিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিল। আদ্র তার দিকেই এক নজরে তাকিয়ে। উঠে বসল তুলি। মাথার নিচে আদ্রর ছিল বুঝতে পেরেই আরেক দফা চমকে গেল। উৎকন্ঠা কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,,

–“আমি আপনার হাতে মাথা রেখে ঘুমিয়েছি সারারাত?”
কিছু বলল না আদ্র। উঠে দাঁড়াল নিঃশব্দে। একটু ঝুঁকে তুলির ললাটে চুমু খেল আলতো করে। চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,,
–“ঘুমের ঘোরে তুমি শুধু নিজেই এলোমেলো হও নি। এলোমেলো করে দিয়েছ আমাকেও।”
স্তম্ভিত হয়ে বসে রইল তুলি। আদ্রের কথার মানে বুঝতে না পেরে কিছু বলতে যাবে তার আগেই আদ্র যেতে যেতে বলে উঠল,,
–” লেহেঙ্গা টা পড়ে তাড়াতাড়ি চলে আসো। বাসায় যেতে হবে তো!”

” মাফ কইরা দে ভাই। আমি আর জনমেও বিয়ার আনমু না। আজ তোরে পাক্কা কথা দিলাম। ছেড়ে দে ভাই আদ্র। তোর মতো বলিষ্ঠ পোলা আমারে এমনে চেপে ধরলে পায়েল জামাই হারায়বো। পায়েলের জন্যই ছাইড়া দে দয়া কইরা।”
অন্তর পিঠ থেকে হাত টা সরিয়ে আনল আদ্র। একটু আগে এসেই হামলা চালিয়েছে বেচারা অন্তুর উপর। গম্ভীর স্বরে বলল,,
–“নেক্সট টাইম যদি আর একই কান্ড করেছিস তাইলে পায়েল রে অন্যখানে বিয়ে দিয়ে দিমু।”
–” আরে না কি কস? জীবনে ও করমু না। পায়েল তো আমা
র একটা মাত্র বউ। আমার পরাণ পাখি।”

অন্তুর কথা শুনে উচ্চশব্দে হেসে উঠল সবাই।কিন্তু তুলির মুখে হাসি নেই। একপাশে দাড়িয়ে আছে নিশ্চুপ হয়ে। আদ্র সাগরের বাবা -মার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। সাগর ও রিমি আসল পিছু পিছু। গাড়ির কাছে এসে হালকা হাসল রিমি। আদ্রর দিকে এক নজর চেয়ে সাগরের হাতে নিজের হাতটা রাখল। আদ্র ও তুলি দু’জন কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল,,
–” তোদের ভালোবাসার পূর্ণতা পাওয়ার অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় আছি আমরা। আমাদের বেশি অপেক্ষা করাবি না। কখনও তোকে কাঁদতে দেখি নি আদ্র। তবে খুব শীগ্রই তোর চোখে আনন্দের অশ্রু দেখতে চাই। তুলি কে তোর অর্ধাঙ্গিনী হিসেবে তোর পাশে দেখতে চাই। কখনও এই মানুষ টা কে ছাড়বে না তুলি। তাহলে জীবনে পস্তাবে তুমি। আদ্র কে ভালোবাসার মানুষের অভাব নেই। অথচ দেখো তুমি আগে তাকে ভালোবাসতে না তবুও সে তোমাকেই বেছে নিয়েছে। সুখী হও তোমরা।”

রিমির চোখ থেকে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। সবার অগোচরেই মুছে নিল। সাগর কানের কাছে মৃদুস্বরে বলল,,
–” তোমার এক ফোঁটা অশ্রু আমায় পাহাড়সম যন্ত্রণা দিচ্ছে। ”
সাগরের বাহু জরিয়ে ধরল রিমি। বাকি সবাই চলে গেল বিদায় জানিয়ে। কিন্তু যাওয়ার আগে আদ্রর বলা –” গোপনে সবাই সেক্রিফাইস করে যেতে পারে না রিমি তুই পেরেছিস। তুই কি বুঝতে পেরেছিস এটা তোর একটা বিশেষ গুণ? এই গুণ টা সবার হয় না।তোর এই গুণ টা সত্যিই আমায় বিমোহিত করেছে শুরু থেকেই। ” এই কথাটা ভীষণ প্রশান্তিতে ছুঁয়ে দিচ্ছে রিমি কে। ভালোবাসা পাওয়া হয় নি কিন্তু কোনো একটা কারণে ভালো লাগার জায়গায় তো ঠাঁই হয়েছে। এটা রিমির জন্য অনেক বড় পাওয়া।

চুপটি করে রুমে বসে আছে তুলি। সাগরে দের বাসা থেকে আসার পর একবারও সম্মুখীন হয় নি আদ্রর। হয় নি বললে ভুল হবে ইচ্ছে করেই যায় নি। গাড়ি থেকে নেমেও আদ্র পিছু ডেকেছিল কিন্তু না শুনার ভান ধরে চলে এসেছে। দুপুরে নিচেও যায় নি খাবার খেতে। আসার পর থেকেই লুকিয়ে বেড়াচ্ছে আদ্রর কাছ থেকে। সন্ধ্যার প্রহর চলছে। আকাশে রক্তিম আভার মেলা। তুলির চক্ষুদ্বয়ে আতঙ্ক বিরাজমান। আদ্রর দু চোখে গোধূলি বেলার আকাশটার মতো রক্তিম বর্ণের ছড়াছড়ি নয় বরং মাত্রাধিক কষ্টের ছাপ।
~”আমার বিরুদ্ধে তোমার মনের কোণে যদি জমে থাকে অজস্র অভিমান তবে সেটা অতি যত্নসহকারে ভেঙে দিব আমি। সবটুকু নিঃশেষ করে দিয়ে আবারও তোমাকে ফেলব আমার প্রেমের মোহতে।”

এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থামল আদ্র। তুলি বরাবরই নিশ্চুপ। তবে আদ্রর বলা কথাগুলো মস্তিষ্কে তরঙ্গিত হতেই হৃদয়ে উতালপাতাল ঢেউ গর্জে উঠছে। অনেক কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারছে না। সবকিছু যেন গলায় আঁটকে যাচ্ছে। আদ্রর অসহায় দৃষ্টি মাথা নিচু করে বসে থাকা তুলিতেই নিবদ্ধ। মেয়েটার অস্থিরতা চোখের দিকে না তাকিয়ে ও আদ্রর মনের কোণে দৃশ্যমান। তুলির মাঝে অভিমানের ছাপ দেখতে পাচ্ছে না বরং দেখতে পাচ্ছে এক মুঠো অস্থিরতা, অস্বস্তি। দুপুর থেকে অভিমান ভেবে তুলির নিকট উপস্থিত হলেও এখন ব্যাপার টা অন্যরকম ঠেকছে। আদ্রর বিচক্ষণ মস্তিষ্ক ধারণ করছে তুলি অভিমানী নয় বরং কোনো কারণে লজ্জিত। ধীরে ধীরে নিজের হাত টা দিয়ে তুলির হাতে স্পর্শ করল।

কেঁপে উঠল তুলি। চেপে ধরল আদ্রর হাত টা শক্ত করে। সকাল থেকে বিতৃষ্ণায় অশান্ত হওয়া মনটা নিমিষেই এক ফোঁটা বৃষ্টির পানির মতো ঠান্ডা ছোঁয়া পেয়ে শান্ত হয়ে গেল। প্রিয়তমের হাত টা আঁকড়ে ধরে নিজেকে লজ্জা থেকে নিবারণ করল। আদ্রর স্পর্শে আজ কোনো লজ্জা হচ্ছে না তুলির। এই হাত টা যেন তুলি কে শান্ত করার জন্য আস্বস্ত করার জন্য বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এমন হাত টা কিভাবে ফিরিয়ে দিবে তুলি? আঁকড়ে না ধরলে যে নিজেই ধুকে ধুকে মরবে। অন্য হাত দিয়ে তুলির থুতুনি ধরে মুখটা উপরে তুলে নিজের চক্ষুদ্বয়ে স্থাপন করল আদ্র। সুড়সুড় করে শীতল ঢেউ আছড়ে পড়ল আদ্রর বক্ষপিঞ্জরে প্রবলভাবে।

তুলির দু গালে ছেয়ে আছে রক্তিমার গাঢ় প্রলাপ। শুকিয়ে থাকা ঠোঁটে লজ্জাতুর সরু হাসির রেখা। কি আশ্চর্য মেয়েটা এমন রূপ ধারণ করে রেখেছে কেন? কোথায় অভিমান আর কোথায় লজ্জালু এই সৌন্দর্য! আদ্রর নিজেকে পাগল পাগল লাগছে। তুলির মুখশ্রীতে ফুটে থাকা রূপ আদ্র কে অসম যন্ত্রণা দিচ্ছে। হৃদস্পন্দন ক্ষণে ক্ষণে অস্বাভাবিক হয়ে পড়ছে। থুতুনি থেকে তড়িৎ বেগে হাত টা সরিয়ে নিল আদ্র। তুলির হাতের ভাজে আবদ্ধ থাকা হাত টাও ছুটিয়ে নিয়ে বড় বড় পা ফেলে চলে এল বেলকনিতে। নিঃশ্বাস ক্রমশ ভারী হয়ে আসছে। অন্তরজুড়ে থাকা অনুভূতি গুলো এলোমেলো হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। উত্তপ্ত একটা শ্বাস ছেড়ে বহু বিড়ম্বনা কাটিয়ে নিজেকে সামলে নিল আদ্র। গলার স্বর টা নিচু রেখে বিড়বিড় করল,,

~ “তুমি আজকাল বড্ড সর্বনাশী রূপ ধারণ করছো তুলা। প্রতিমুহূর্তে পোড়াচ্ছ আমাকে তোমার প্রেমের অনলে।”
হতবাক হয়ে মূর্তির ন্যায় স্থির হয়ে রইল তুলি। আচমকা আদ্রর এহেন আচরণ তার মনের প্রতিটি ভাজে ভাজে বিষাদ ছড়িয়ে দিল। আদ্র কি রেগে গেল? সকাল থেকে তার সম্মুখীন না হওয়ায় কি এরূপ আচরণ? রেগে গেলে তো হাতটা আকড়ে ধরত না। তবে! তবে হুট করেই কি হয়ে গেল? উঠে দাঁড়াল তুলি। বেলকনিতে এসে আদ্রর পাশে দাঁড়াল। কন্ঠে দৃঢ়তা এনে প্রশ্ন করল,,,
–“কি হয়েছে? ”

চোখের পলকেই তুলি কে দেয়ালের সাথে মিশিয়ে দাঁড় করাল আদ্র। দু পাশে দু হাত রেখে তুলি কে আবদ্ধ করে নিল নিজের মাঝে। হচকচিয়ে উঠল তুলি। প্রচন্ড বেগে কেঁপে উঠল হৃদপিণ্ড। বুকে হাতুড়ি পিটা শব্দ হতে লাগল। আদ্রর আকস্মিকভাবে করে বসা কান্ড গুলো তুলির অন্তরে ঝড় তুলে। শুকিয়ে যায় কন্ঠ নালি। আদ্র স্পর্শ করে নি তবুও রন্ধ্রে রন্ধ্রে শিহরণ জেগে উঠছে। মানুষ টা সামান্য একটু কাছে থাকলেই তুলির কাঁপুনি শুরু হয়ে যায়। ছোট্ট মনটা অনুভূতি গুলো ঠিক সামলে উঠতে পারে না।কিছুটা কঠিন স্বরে আদ্র বলে উঠল,,
–” তোমার কি হয়েছে? অভিমান তো নেই আমার প্রতি তা তোমার চোখ দুটোই জানান দিচ্ছে। তাহলে আসার পর থেকেই আমাকে তোমার সান্নিধ্য থেকে কেন বঞ্চিত করছো?”

অতিশয় জড়তায় আদ্রর চোখ থেকে চোখ সরিয়ে এদিক ওদিক নজর দিতে লাগল তুলি। আদ্র তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে তুলির পানে।
–“কি হলো এদিকে তাকাও? আমার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিচ্ছ কেন তুলা?”
নিশ্চুপ হয়ে কিছুটা স্থিতিশীল হল তুলি। দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেলে বলতে লাগল,,,
—” আসলে আদ্র,,!”

এটুকু বলে আবারও মৌনতা পালন করতে লাগল। কপালে ভাজ ফেলে ভ্রু কুঁচকে তাকাল আদ্র। নিজের এক হাত দিয়ে তুলির কোমরের এক পাশে হাত রেখে অত্যধিক জোরে অতি কাছে টেনে নিল। বিস্মিত হয়ে উঠল তুলি।হঠাৎ করেই আদ্রর স্পর্শ কোমরে পেয়ে শিউরে উঠল পুরো দেহ।আদ্রর বুকে হাত রেখে এক পলকে তাকিয়ে রইল নীল বর্ণের নেশা মিশ্রিত দু চোখে।
–” থেমে গেলে কেন?”
দৃঢ় কণ্ঠস্বর শুনে আদ্রর চোখের নেশার রেশ কেটে গেল তুলির। নিচু স্বরে জবাব দিল,,
–” গতকাল সাগর ভাইয়াদের বাড়িতে আমি নেশার ঘোরে যা করেছি তা আজ আমরিনের কাছ থেকে জানতে পেরে আমার ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছিল। আমি আপনাকে! আপনার সাথে যা করেছি তার জন্য লজ্জিত আমি। লজ্জায় ভীতি আমায় ঘিরে ধরেছিল। তার জন্যই আসার পর থেকেই,,

–“তাই আসার পর থেকেই ঠুনকো একটা কারণে আমার থেকে লুকিয়ে বেড়াচ্ছিলে। রাইট?”
মাথা উপর নিচ করে হ্যাঁ বোধক বুঝাল তুলি। সাথে সাথেই তুলির দিকে ঝুঁকে পড়ল আদ্র। নাকে নাক ঘষতেই আদ্রের বুকে সজোরে আঁকড়ে ধরল তুলি। তুলির নখ বিঁধছে তবুও কোনো পরোয়া নেই আদ্রর। কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলে উঠল,,
–” এতো লজ্জা কেন তোমার? এই লজ্জা তো আমার দম নিয়েই ছাড়বে। তুমি রাগ করার বদলে লজ্জায় লুকিয়ে রইলে। ”
–” রাগ কেন করব? আমি যা করেছি তা নেশার ঘোরে হোক আর চেতনায় খারাপ কাজ করেছি। তাই আমাকে শাসন করার পুরো অধিকার আপনার আছে। আপনার রাগই তো আমার মনে ভালোবাসার প্রথম অনুভূতি জাগিয়েছিল। যেদিন আপনার রাগী ফর্সা মুখ টা দেখেছিলাম সেদিনই এক অজানা অনুভূতি জড়ো হয়েছিল আমার মনের কুঠিরে।”

–” কালকের কান্ডে অস্বস্তি পাওয়ার কিছু নেই বরং আমি দুঃখিত। রাগ সামলাতে না পেরে তোমাকে চড় বসিয়ে দিয়েছি। আমাকে ক্ষ,,,”
সম্পূর্ণ কথা বলতে আদ্র কে বাঁধা প্রদান করল তুলি। নিজের নরম হাত টা দিয়ে আদ্রর মুখে কুলুপ এঁটে দিল। তুলির নরম হাতের ছোঁয়া ঠোঁটে পেতেই দু চোখ বুঁজে নিল আদ্র। তুলি আদ্রর দিকে নিষ্পলক চোখে চেয়ে বলল,,
–“আপনি কখনও ক্ষমা শব্দটা উচ্চারণ করবেন না। এতে আমি খুব কষ্ট পাব। যদি আমায় কখনও ভুলেও কষ্ট দেন তাহলে নিজের ভালোবাসা দিয়ে সবটুকু দূর করে দিবেন। টেনে নিবেন আমাকে পরম শান্তির স্থানে।”
ঠোঁট থেকে হাত টা টেনে নিয়ে একটা চুমু খেল আদ্র। জমে থাকা অনুভূতি গুলো আনন্দ অশ্রু হয়ে ভিড় জমাল তুলির চোখের কার্ণিশে। হাতটা মুঠোয় পুরে নিল আদ্র।

–” চোখের কার্ণিশে জমে থাকা জল কিন্তু আমার বুকে আছড়ে পড়বে কষ্ট হয়ে। কোনোভাবেই যেন গড়িয়ে না পরে।”
অন্য হাত দিয়ে তুলি তাড়াতাড়ি করে জল টুকু গড়িয়ে পড়ার আগেই মুছে নিল। মুচকি হাসল খানিকটা। আদ্রর ঠোঁট দুটো ও প্রসারিত হল।
–” খুব খিদে পেয়েছে তুলা।”
আদ্রর মলিন কন্ঠ শুনে প্রচন্ড অবাক হল তুলি। চোখ ছোট ছোট করে বলে উঠল,,
–“খিদে পেয়েছে মানে? দুপুরে খান নি?”
–” খাই নি। যেখানে আমার তুলা অনাহারে ভুগছে সেখানে আমি খেয়ে পেট ভরিয়ে নিব সেটা ভাবলে কি করে?”
বিস্ময়কর দৃষ্টি নিক্ষেপ করল তুলি। কোনোকিছু না বলে আদ্রর শক্ত হাত টেনে পা বাড়াল নিচে যাওয়ার জন্য। কিন্তু!কিন্তু থেমে যেতে হল আদ্রর বলিষ্ঠ হাতের টানে। সম্মুখে এসে দাঁড়াতেই আদ্র ঘোর লাগা কন্ঠে বলে উঠল,,

–” আমার তোমার কোমল ঠোঁটের স্পর্শ চাই। ”
আদ্রের আবদারে মুহুর্তেই ক্ষণিকের জন্য হৃদস্পন্দন থেমে গেল তুলির। পা দুটো ও জমে গেল বরফের মতো। এক পা নাড়ানোর শক্তি পাচ্ছে না। লজ্জার ছাপ ফুটে উঠল মুখে। আপনমনেই উচ্চারণ করল,,–” এভাবে কেউ বলে আদ্র?”
ঘনঘন শ্বাস ফেলে অন্যদিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ ঠোঁট চেপে রাখল। ভীত স্বরে জিজ্ঞেস করল,,
–“কোথায় দিতে হবে?”
এটুকু বলেই তুলি ভারী একটা নিশ্বাস ছাড়ল। জিজ্ঞেস করতেই যেন তার শ্বাস আঁটকে যাচ্ছিল। গলা টাও কাঁপছিল। আদ্র সূক্ষ্ম হেসে বলল,,
–“তোমার ইচ্ছে।”

বিলম্ব করল না তুলি। দ্রুত বেগে হেঁটে এসে নিজের সবটুকু লজ্জা দূরে ঠেলে দিয়ে আদ্রর পায়ের উপর পা রাখল। পিছন থেকে দু হাতে আদ্রর গলা জড়িয়ে ধরে নাগাল না পেয়ে অভিমানী কন্ঠে বলল,,
–” দেখতেই পাচ্ছেন আরেকটু উঁচুতে তুলতে হবে আমায়। তাহলে মুখে কেন বলতে হচ্ছে? ”
প্রতুত্তর করল না আদ্র। কোমর জরিয়ে তুলি কে একটু উঁচু করতেই তুলি নিজের নরম ওষ্ঠদ্বয় চেপে ধরল আদ্রর কপালে। সাথে সাথেই সরিয়ে আনল না। বরং আরেকটু গভীরভাবে চুমু খেল। আদ্রর কোনো রেসপন্স নেই। ভিতরে তুফান শুরু হলেও বাহিরে শীতলতা। কোনো কথা না বলেই তুলি কে নামিয়ে দিল। তুলিও অভিশঙ্কায় নিজেকে লুকাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। এক দৌড়ে নিচে চলে আসল। সেখানে দাড়িয়ে থাকলে তো জড়তায় তলিয়ে যেত। আদ্র ও নিঃশব্দে নিচে নেমে এল।

নিচে আসতেই তুলির চোখ গেল ড্রইং রুমে। রাদিফ সাহেব ও সায়েরা বেগম বসে বসে কথা বলছেন। তুলি তাদের দিকে এগিয়ে গেল। নম্র স্বরে বলল,,
–” চা খাবেন খালু?”
হালকা হাসলেন রাদিফ সাহেব। হাসি বজায় রেখেই বললেন,,
–” শুনেছি তোর হাতের চা দারুন হয়। খেতাম তবে সেটা খালু না বলে বাবা বলে সম্বোধন করলে।”
তীব্র অবাকতা আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিল তুলি কে। বুকটাও ধুক করে উঠল। চোখে অশ্রুকণারা ভিড় জমাল। কতগুলো বছর ধরে বাবা- মা ডাকটা ডাকতে পারে না সে। আজ রাদিফ সাহেবের মুখে বাবা ডাকতে হবে শুনে আনন্দের চেয়ে তুলির যন্ত্রণা টাই বেশি হচ্ছে। এটা সেই যন্ত্রণা নয় যেই যন্ত্রণায় তুলি ব্যাথিত হবে। এটা না চেয়ে ও পেয়ে যাওয়ার যন্ত্রণা। অদ্ভুত হলেও তুলির জন্য তা-ই সত্য। কিছুটা ভেজা কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,,

–” চা খাবেন আব্বু – আম্মু?”
দু’জনেই এক গাল হেসে বললেন,,
–” খাব মা।”
ডাইনিং রুমে দাড়িয়ে সবটা দেখল আদ্র। বাবার প্রতি জমে থাকা অভিমানগুলো হালকা সরে যেতে লাগল। সেদিনের পর বাবার মুখোমুখি টাও হয় না। অভিমানে নয় নিজের করা আচরণে অনুতপ্ত অনুভব হয়। একটাই চিন্তা ছিল রাদিফ সাহেব তুলি কে ছেলের বউ রূপে মেনে নিতে পারবে কিনা! তাও আজ দূর হয়ে গেল। তুলির পিছু পিছু কিচেনে চলে আসল। তুলি খেয়াল করে নি। ফ্রিজ থেকে তরকারির বাটি বের করে ফিরতেই লাফিয়ে উঠল আচমকা আদ্র কে দেখে। বাটি টা পড়ে যেতে নিলে আদ্র তুলির হাত থেকে নিয়ে নিল। চুলার কাছে গিয়ে তরকারি অন্য একটা পাত্রে ঢেলে গরম করতে করতে বলল,,

–“বউ তুমি তোমার শশুর শাশুড়ির জন্য চা বানাও আমি খাবার গুলো গরম করে ডাইনিং টেবিলে অপেক্ষা করছি।”
আহা! সংসার সংসার অনুভূত হচ্ছে তুলির মনে। চমকায়নি তুলি। আর কত চমকাবে? মাত্র তিন মাস পর তো সত্যি সত্যিই বউ হয়ে যাবে। আদ্রর বউ! শব্দটা মনে উদয় হতেই ঠোঁট হাসির রেখা দেখা দিল। চায়ের পানি বসিয়ে দিয়ে পলকবিহীন আদ্রর দিকে তাকিয়ে রইল। যতই দেখে ততই যেন হারিয়ে যায় আদ্রর মাঝে। তবুও মনটা ভরে না।মনের খাতা টা শূন্যই থেকে যায়। আবারও ইচ্ছে জাগে আদ্র কে দেখে শূন্যতায় ভোগা মনটা পূর্ণ করে নিতে।

রাদিফ সাহেব ও সায়েরা বেগম কে চা দিয়ে জলদি ডাইনিং টেবিলের কাছে আসল তুলি। আদ্র অলরেডি নিজের প্লেটে খাবার বেড়ে বসে আছে কিন্তু মুখে তুলছে না। তুলি বুঝতে পারছে ও নিজে খেতে না বসলে আদ্র খাবে না। তাই পাশের চেয়ারে বসে প্লেটে খাবার নিতে গেলে হাত ধরে থামিয়ে দিল আদ্র। প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকাতেই হাসোজ্জল চেহারা নিয়ে আদ্র বলে উঠল,,
–” আমায় খাইয়ে দাও।”
তুলি সাথে সাথেই আওয়াজ করে বলে উঠল,,
–“আমি খাব না আদ্র? ”
–” খিদে তো আমার লেগেছে তো তোমার খাওয়ার কি দরকার?”

আদ্রর উদ্ভট কথা শুনে থমকে গেল তুলি। তুলি কে বেশিক্ষণ থমকে থাকতে না দিয়ে আদ্র বলল,,
–” আমায় খাওয়াবে নিজেও খাবে। বহুদিনের ইচ্ছে বউয়ের হাতে খাব। সুযোগ পেয়ে আজ ইচ্ছে টা বহুগুণ বেড়ে গেছে। ”
প্লেট টা টেনে নিজের কাছে এনে ভাত মাখিয়ে আগে নিজে খেল। তারপর আদ্রর দিকে বাড়িয়ে দিল খাবার। তুলির হাতটা ধরে মুখে পুরে নিল খাবার টা আদ্র। ছোট্ট করে একটা কামড় দিল তুলির আঙ্গুলে। লজ্জায় চুপ করে রইল তুলি। কিন্তু মনে মনে বিড়বিড় করল,,–“অসভ্য লোক।”

খাবার শেষ করে আদ্র ও তুলি ড্রইং রুমে এসে নিবিড় কে দেখে কিছু টা চমকে গেল। নিবিড় শুধু একা আসে নি সাথে নিজের মা কেও নিয়ে এসেছে। যিনি হাসি মুখে কথা বলতে মগ্ন সায়েরা বেগমের সাথে। আদ্র কে দেখেই উঠে এল নিবিড়। হাসি মুখে বলল,,
–“আমার তোর ও আংকেল আন্টির সাথে জরুরি কথা আছে আদ্র।”
আদ্র কিছুটা আন্দাজ করতে পারছে নিবিড়ের ভাবভঙ্গি। নিবিড়ের মায়ের সাথে কথা বলে সোফায় বসল। তুলি পাশে দাঁড়াতেই ক্ষীণ স্বরে বলল,,

–“দাড়িয়ে আছো কেন?”
—“এমনি।”
–” পা দুটো ভেঙে দিব তখন এমনি এমনি দাড়িয়ে থাকতে পারবে?”
–“কিন্তু!”
একটু সরে বসল আদ্র। এই সোফা টায় দু’জন অনাসয়ে বসা যায়। ইতস্ত করে আদ্রের চোখ রাঙানোর সাথে না পেরে বসে পড়ল তুলি কিছুটা দূরত্ব রেখে। নিবিড়ের মায়ের নজর তুলির উপর পড়তেই বললেন,,
–” মাশাল্লাহ! তোমার হবু স্ত্রী প্রচন্ড মায়াবী আদ্র।”
মাথা নত করে ফেলল তুলি। প্রশংসা শুনে ভীষণ অস্বস্তি লাগছে। লাজুক লাজুক ভাব চলে এসেছে। আদ্র হেসে জবাব দিল,,,

–” ধন্যবাদ আন্টি। দোয়া করবেন আমাদের জন্য। ”
–“অবশ্যই। আমরিন কে দেখছি না যে?”
কথাটা বলতে দেরি হলেও আমরিনের হাজির হতে দেরি হয় নি। নিজের প্রাণ টা নিয়ে দৌড়ে এসেছে। দু তলা থেকে নিবিড় কে দেখেই ভয়ে আত্মা শুকিয়ে যাওয়ার উপক্রম তার। নিবিড় তার কথানুযায়ী চলেই এল। আমরিন কিভাবে সামলাবে এসব। তুলিকে বলতেও তো ভুলে গেছে বিয়ের চক্করে। নিবিড় সব বলে দিবে নাতো? হাফাতে হাফাতে মায়ের কাছে এসে দাঁড়াতেই নিবিড়ের আম্মু ডেকে উঠলেন আমরিন কে।
–” এদিকে আসো আমরিন।”

ওনার পাশে গিয়ে বসল আমরিন। রাদিফ সাহেব ও সায়েরা বেগম বুঝতে না পারলেও আদ্র ও তুলি বুঝতে পেরেছে বিষয় টা। নিবিড় আমরিনের দিকে এক পলক চেয়ে রাদিফ সাহেব কে উদ্দেশ্য করে বললেন,,
–“আমি আমরিন কে বিয়ে করতে চাই আংকেল। আমি ওকে ভালোবাসি। অবশ্য আমরিন একদম অজ্ঞাত এই ব্যাপারে। দুটো বছর ধরে ওকে ভালোবাসি আংকেল। শুধু ওর আর আমার বয়সের পার্থক্যের জন্য ভয় হতো প্রস্তাব নিয়ে আসতে। আমাকে ফিরিয়ে দিলে আমি ওকে ছাড়া নিঃশ্বাস তো ফেলব কিন্তু সুখে থাকব না আংকেল। বেঁচে থেকেও নিঃশেষ হয়ে যাব ভিতর থেকে।”

আকাশে তারার মেলা পর্ব ১৫+১৬

নিবিড়ের অকপটে ভালোবাসা জাহির করতে দেখে ভীষণ অবাক হলেন সবাই। আমরিন তো একদম বিস্মিত হয়ে আছে। নিবিড়ের অসহায় দৃষ্টি মনে দহন রুপে বিচরণ হতে লাগল। সে তো ভেবেছিল নিবিড় সব বলে দিবে কিন্তু তার তো পুরোই উল্টো হল। নিজেকে ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে আমরিনের। ক’জন ছেলে এভাবে মেয়ের বাবার কাছে এমন করে ভালোবাসার মানুষ টা কে চাইতে পারে? তুলিও অবাক চোখে তাকিয়ে রইল নিবিড়ের দিকে। নিবিড়ের অসহায় চাহনি বলে দিচ্ছে কতটা চাই সে আমরিন কে। পাশে থাকা আদ্রর হাত টা চেপে ধরে তুলি করুন স্বরে বলে উঠল,,

–“নিবিড় ভাইয়া কে ফিরিয়ে দিবেন না আদ্র। ”
তুলির বলা বাক্য টা কে উপেক্ষা করে আদ্র গম্ভীর স্বরে বলে উঠল,,
–“বাবা ফিরিয়ে না দিলেও আমি ফিরিয়ে দিব নিবিড়। ”
নিমিষেই চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল নিবিড়ের সবটুকু সাহস। আমরিনের চোখে সঞ্চারিত হল জল। তুলিও ছলছল নয়নজোড়া নিবদ্ধ করল আদ্রর রাগান্বিত চেহারায়।

আকাশে তারার মেলা পর্ব ১৯+২০