আকাশে তারার মেলা পর্ব ১৫+১৬

আকাশে তারার মেলা পর্ব ১৫+১৬
আসরিফা সুলতানা জেবা

বাহিরে তুমুল বেগে বর্ষণ হচ্ছে। বারান্দা দিয়ে সুড়সুড় করে হিমশীতল বাতাস এসে ঢুকছে রুমে। পুরো রুম জুড়ে ঠান্ডা হাওয়া বিরাজ করছে। হঠাৎ করেই বৃষ্টির আগমনে কিঞ্চিত শীতল স্রোত অনুভব করলেও ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে যাচ্ছে তুলি। আদ্র তার সামনে বসে আছে স্কেল নিয়ে। হাত গুলো লাল হয়ে আছে বেচারির। এই নিয়ে পাঁচ বার স্কেলের বারি খেয়েছে। অপরাধ একটাই বায়োলজি বেঁটে খাওয়ালেও এই মেয়ের মস্তিষ্কে ঢুকবে না।

কার্ডিয়াক চক্রের অংশ টা আদ্র অনেকবার বুঝিয়েছে কিন্তু তুলি পড়ায় মনোযোগ না দিয়ে গালে হাত রেখে ব্যস্ত ছিল আদ্র কে অবলোকন করতে। দু দিন পরেই ক্লাস টেস্ট কিন্তু এই মেয়ের পড়ালেখা নিয়ে কোনো মাথা ব্যাথা নেই। কোনোভাবেই আদ্র এটা মেনে নিতে পারছে না। প্রথম বার আদ্র ভালোভাবে বুঝিয়ে পড়ায় মনোযোগ দিতে বললেও বার বার সেইম কাজটাই করেছে তুলি। তুলির এহেন কান্ডে প্রচন্ড রেগে গেল আদ্র। আদ্রর রাগ মানেই তো মহা বিপদের সংকেত। অবশেষে তাই হলো যা হওয়ার। স্কেলের বারি খেয়ে এখন আহ্লাদী ভঙ্গিতে কাঁদতে ব্যস্ত তুলি। যদি একটু মায়া হয় আদ্রর আর তাকে রেহাই দেয় এই বায়োলজি নামক পেইন থেকে তাই কান্নার বেগ আরো বাড়িয়ে দিল। চোখ কটমট করে টেবিলে স্কেল দিয়ে জোরে একটা বাড়ি দিল আদ্র। কেঁপে উঠল তুলি। চেয়ার থেকে উঠে দৌড় মারার প্রস্তুতি নিল। এই লোক সাংঘাতিক। বনের হিংস্র বাঘ ও বোধহয় ওনার চেয়ে অনেক ভালো কথাটা ভেবেই পা বাড়াতে নিলেই হাতটা টেনে ধরল আদ্র। রাগী কন্ঠে বলে উঠল,,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

–“পালানোর চেষ্টা করবে না তুলা। পড়া টা কমপ্লিট করো জলদি। দেখো রাত দশটা বেজে গেছে। পড়াটা শেষ করো।”
ছলছল চোখে আদ্রর দিকে চাইল তুলি। সাথে সাথেই দু চোখ বন্ধ করে নিল আদ্র। চোখ বুঁজেই টিস্যু এগিয়ে দিয়ে গম্ভীর স্বরে বলল,,
–” চোখ মুছে পড়ায় মনোযোগ দাও। আমি চোখ মেলে যদি তোমার চোখে এক ফোঁটা ও পানি দেখি এবার আর স্কেল দিয়ে মারব না সোজা ছাঁদ থেকে ফেলে দিব।”
আদ্রের হুমকি শুনে চোখ মুছে মিনমিন করে পড়তে লাগল। আঁড়চোখে আদ্রর দিকে চাইতেই চোখ আঁটকে গেল আদ্রর নীলাভ চোখে। ঠোঁটের কোণে প্রস্ফুটিত হাসি। মিইয়ে কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,,

–“আমায় দেখতে থাকলে পড়বে কখন তুলা?”
–“আপনি এতো সুন্দর হলে আমার চোখের কি দোষ বলেন তো ডাক্তার সাহেব! মন তো সারাক্ষণ আপনাকেই দেখতে চায়।”
তুলির সোজাসাপ্টা জবাবে চমকে উঠল আদ্র। তুলির আবেগময় কথা তার মনে সবসময় অস্বাভাবিক ঝর তুলে। এখনও হচ্ছে। ইচ্ছে করছে তুলি কে বুকের মাঝে চেপে ধরতে। কপালে ভালোবাসার পরশ একে দিয়ে আগলে রাখতে। নিজের হাতের মুঠোয় হাত টা আঁকড়ে ধরে বলতে,,

–“এতো আবেগী কথা বলবে না তুলা। সাতাশ বছরের যুবক টার জন্য কি তোমার একটুও মায় হয় না? সতেরো বছরের এক কিশোরী কন্যা তুমি অথচ আমাকে ভিতর থেকে নাড়িয়ে দেওয়া আমার জীবনে ধেয়ে আসা এক প্রকাণ্ড ঝড় তুমি।”
তুলি কে পড়া টা ভালোভাবে বুঝিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াল আদ্র। পা বাড়িয়ে দরজা পর্যন্ত গিয়ে ফিরে আসল আবারও। তুলি জিজ্ঞাসাসূচক দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই হাত টা টেনে লাল হয়ে যাওয়া হাতের ভাজে ঠোঁটের স্পর্শ বুলাল গভীরভাবে। তুলির হাতটা নিজের বুকের বা পাশে চেপে ধরল খুব যত্ন করে। ঈষৎ কেপে উঠল তুলি। শরীরের রন্ধে রন্ধে বয়ে গেল শিহরণ। আদ্রর হাতে নিবদ্ধ হাত টাও কাঁপতে লাগল প্রচন্ড। হাতটা আরেকটু শক্ত করে চেপে ধরে কোমল স্বরে বলে উঠল আদ্র,,

–” তোমার চোখের পানি ঠিক এখানটায় এসে আঘাত করেছে। এখনও মৃদু ব্যাথা হচ্ছে। একটু আধটু শাসন না করলে তুমি পড়ায় মন দিতে পারতে না তাই বুকে পাথর চেপে নিজের অস্তিত্বে একটুখানি ব্যাথা দিয়েছি। এখন মনে হচ্ছে তোমাকে শাসন ও করতে পারব না আমি। দিন দিন ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়ছে আমার হার্ট টা। হৃদস্পন্দন ও স্বাভাবিকভাবে হয় না।”
হাতটা ছেড়ে দিয়ে তুলির কপালে চুমু একে দিল আদ্র। স্তব্ধ হয়ে বসে আছে তুলি। তার হার্ট টাও যে দুর্বল হয়ে পড়েছে। আদ্রর কথাগুলো কানে ঝংকার তুলে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল বার বার। অক্ষি যুগল আটকে আছে আদ্রর যাওয়ার পানে চেয়ে। হাত টা এখনও কাঁপছে। আদ্র চলে যেতেই উঠে দাঁড়াল । আমরিনের রুমে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়াতেই তুলির চোখ গেল দরজায়। রাদিফ সাহেব দাড়িয়ে আছেন।তুলির মুখে হাসি ফুটে উঠল। আলতো হেসে বলল,

–“ভিতরে আসুন খালু।”
রাদিফ সাহেব এসে চেয়ারে বসলেন। তুলি বিছানায় বসে নম্র স্বরে বলল,,
–“কিছু বলবেন খালু?”
হালকা হাসলেন তিনি। তুলির মাথায় হাত রেখে জিজ্ঞেস করলেন,,
–“তুই কি আমার সাথে রাগ করেছিস মা?”
–“না খালু। রাগ করব কেন? আপনার সাথে আমার কোনো রাগ নেই। আমি জানি আপনি যা করেছেন সবার ভালোর কথা ভেবেই করেছেন।”

–“আমি আমার ছেলের ভালো টা বুঝতে পারি নি মা। সবসময় আমার সব ডিসিশন চাপিয়ে দিয়েছি ওর উপর। এতো একরোখা, রাগী মানুষ হয়েও আমার কথাগুলো অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে সর্বদা। কোনোদিনও আমার কোনো কথার অবাধ্য হয় নি। তোর বেলায় হয়েছে। তোকে পাওয়ার জন্য আমার সামনে মাথা নত করে চোখের জল ফেলেছে। কিন্তু আমি ওর এই একটা আবদার মেনে নিতে পারি নি। আমার জন্য অনেক কষ্ট পেয়েছে। আমি যে মেয়ের ভালো চেয়েছি এমনটা নয়। আমি আমার ছেলের ভালো চাইতে গিয়ে ওকে দিনের পর দিন কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। তুই তো আদ্রর থেকে বয়সে অনেক ছোট।

আমার মনে হতো আদ্রর মনে তোর জন্য জেগে উঠা ভালোবাসা টা ভুল। নিজের ছেলের জন্য তো আমি তোর সাথে অন্যায় করতে পারি না। তোর ও ভালো লাগা আছে। তোর মনেও বয়সের সাথে কারো না কারো জন্য ভালোবাসা জাগতে পারে সেটা ভেবে পিছিয়ে পড়ি আমি। সামিরার সাথে বিয়ে ঠিক করি। আমি ভেবেছিলাম সামিরা কে বিয়ে করলে আদ্র ঠিক হয়ে যাবে। ভুলে যাবে তোকে। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম। তুই আমাকে ভুল প্রমাণ করে দিলি। আমি কখনও ভাবতেও পারি নি তুই আদ্র কে ভালোবাসবি। আমি অনেক খুশি হয়েছি। কিন্তু আমি ভালো বাবা হয়েও উঠতে পারি নি তুলি। নিজের ছেলের মনের কথা বুঝেও কঠোর হয়ে ছিলাম।

কথাগুলো বলতে বলতে কেঁদে দিলেন আদ্রর বাবা। গম্ভীর মানুষ গুলোকে সহজে কাঁদতে দেখা যায় না। কোনো চাপা কষ্টের কারণেই তাদের চোখে থেকে ঝরে পড়ে জল। মলিন চোখে তাকিয়ে রইল তুলি। বাবার বয়সী এই লোক টা কে কাঁদতে দেখে খুব কষ্ট হচ্ছে তার। কন্ঠে জড়তা নিয়ে বলল,,
–” নিজেকে সামলান খালু। আদ্র ভাইয়া আপনাকে খুব ভালোবাসে। একবার কাছে টেনে নিন দেখবেন আপনার ছেলের জমে থাকা সব কষ্ট, অভিমান উদাও হয়ে গেছে। আপনি তো আমার ও আদ্রর ভালোই চেয়েছিলেন। এখন শুধু দোয়া করবেন আমাদের জন্য। সব ঠিক হয়ে যাবে।”

–“তুই ঠিক তোর মায়ের মতো। তোর মা ও ঠিক এমন করেই শান্তনা দিত। যেদিন তোর খালার বিয়ের তারিখ নির্ধারণ হয়ে গিয়েছিল আমি প্রায় পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। তোর মা ভরসা দিয়েছিল আমায় যে তোর খালার বিয়ে টা হতেই দিবে না। বয়সে ছোট থাকলেও তোর মতই বেশ সাহসী ছিল। তোর খালা কে আমার সাথে পালাতে সাহায্য করেছে। ”
–“আম্মু বলেছিল। তারপর বড় নানা ভাই অনেক বকেছিল আম্মু কে। আর নানু তো অনেক মেরেছিল আম্মু কে। টানা সাত দিন গায়ে জ্বর ছিল আম্মুর। এসব শুনে সবাই তো হেসে কুটিকুটি। ”

–” আমি অনেক খুশি। মন থেকে খুশি যে রানুর মেয়ে আমার ছেলের বউ হবে। প্রথমে চিন্তা থাকলেও এখন সব চিন্তা দূর হয়ে গেছে। আমার ছেলে টা তোর জন্য জীবন দিতেও পিছুপা হবে না। ওকে কখনও কষ্ট দিস না মা। তোরা সুখে থাকলে আমি খুব শান্তি পাব।”
–” আপনার ছেলের ধারে কাছে ও কখনও কষ্ট, দুঃখ কে ঘেষতে দিব না খালু। দোয়া করবেন আমি যেন বেস্ট পুত্রবধূ হতে পারি।”
তুলির কথায় হেসে দিলেন রাদিফ সাহেব। তুলিও হাসতে লাগল তাল মিলিয়ে। আমাদের ভাবনা একটা গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ হয়তো নিষ্ঠুর হয়। কিন্তু কখনও কখনও আড়ালে নরম প্রকৃতির একটা রূপ ও লুকিয়ে থাকে।

নীল একটা শাড়ি হাতে নিয়েই আয়নায় নিজেকে ঘুরে ঘুরে দেখছে তুলি। আজ রিমি ও সাগরের গায়ে হলুদ। সময় তো প্রবাহমান। কারো জন্যই থেমে থাকে না। দেখতে দেখতে কতোগুলো দিন কেটে গেল। শাড়ি টা আজ বিকালে এনে দিয়েছে আদ্র। শাড়ির আঁচল টা মাথায় দিয়ে লাজুক হাসল তুলি। সায়েরা বেগম দ্রুত পা চালিয়ে ছুটে এল তুলির রুমে। ঢুকতে ঢুকতে বললেন,,
–“বাহ! বেশ সুন্দর লাগছে তো আমার বউ মা কে। তা আঁচল মাথায় দিয়ে রাখলে চলবে? পড়তেও তো হবে। আদ্র তো চলে আসবে এখনই।”
লজ্জায় চুপসে গেল তুলি। শাড়ি টা সায়েরা বেগমের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,,
–“পরিয়ে দাও খালা মণি। আমরিন যাবে না?”
–“ওর শরীর টা একটু খারাপ। কাল যাবে বিয়েতে।”

শাড়ি টা পড়াতে পড়াতে জবাব দিলেন সায়েরা বেগম। খুব সুন্দর করে শাড়িটা পড়িয়ে দিয়ে তুলির দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকালেন।
–” তোকে একদম বউ বউ লাগছে তুলি। আমার তো এখনই ইচ্ছে করছে তোকে ধরে বেধে আমার ছেলেটার বউ বানিয়ে দিতে। শাড়ি তে তোর বয়স টাই ধরা যায় না।”
–” আমার লজ্জা করছে খালা মণি।”

হেসে উঠলেন সায়েরা বেগম। তাড়া দিয়ে চুল টা বেঁধে দিলেন সুন্দর করে। খোপায় গেঁথে দিলেন একটা সাদা গোলাপ। সম্পূর্ণ রেডি হয়ে তুলি নিচে নেমে এল হাতে মোবাইল টা নিয়ে। সোফায় বসে অপেক্ষার প্রহর গুণতে লাগল আদ্রর জন্য। বিকেলে এসে আদ্র আবারো হসপিটালে চলে গেছে। ফোনে মেসেজের আওয়াজ আসতেই উঠে দাঁড়াল তুলি। হাঁটতে হাঁটতে মেসেজ টা ওপেন করতেই মুখে ফুটে উঠল হাসির ছাপ। তুলি জানত মেসেজ টা আদ্রই পাঠিয়েছে। ” ঝটপট গাড়ির কাছে চলে এসো তুলা”। মেসেজ টা পড়ে পায়ের গতি আরও বাড়িয়ে দিল তুলি। গাড়ির কাছে আসতেই দরজাটা খুলে দিল আদ্র। ভিতরে বসে আদ্রর দিকে চোখ ফিরিয়ে চাইতেই থমকে গেল তুলি। নীল পাঞ্জাবি পড়েছে আদ্র। ফর্সা চেহারা তে নজরকাড়া হাসি। হয়তো হসপিটাল থেকেই রেডি হয়ে এসেছে। তুলির চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে বার বার। শত চেষ্টা করেও চোখ সরাতে পারছে না সে। আদ্র এক দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। গাড়ি স্টার্ট দিতেই ধ্যান ভাঙল তুলির। ধীর স্বরে বলে উঠল,,,

–“আপনি আমার দিকে তাকাচ্ছেন না কেন আদ্র?”
—” তোমার দিকে তাকালে যে ভয়ংকর কিছু ঘটে যাবে তুলা।”
দৃষ্টি সামনে রেখেই ঘোর লাগা কন্ঠে কথাটা বলল আদ্র। তুলি রোবটের ন্যায় চক্ষু স্থাপন করে রইল আদ্রের দিকে। আদ্রর কথার মানে বুঝার চেষ্টায় লেগে পড়েছে তার মস্তিষ্ক। সারা রাস্তাই আদ্রর দিকে কাটিয়ে পাড় করে দিল মেয়েটা। তবুও খুঁজে পেল না আদ্রের সেই কথার মানে। গাড়ি থেকে বের হতেই আদ্র মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করল,,,
–“চোখ ব্যাথা করছে নাতো?”

তুলি যেন এখনও কোনো ঘোরের মাঝে ডুবে আছে। আনমনেই মাথা নেড়ে না বুঝাল। আলতো হেসে তুলির এক হাত টেনে কমিউনিটি সেন্টারে প্রবেশ করল আদ্র। মেয়েটা বড্ড অবুঝ। রিমি তুলি কে দেখতে পেয়েই জড়িয়ে ধরল।
–“কেমন আছো তুলি?”
–“আলহামদুলিল্লাহ আপু। শুভ কামনা তোমার নতুন জীবনের জন্য। ”
–” তোমাকে ও অগ্রিম শুভ কামনা তোমার ও আদ্রের বিয়ের জন্য। ”
পায়েল, অন্তু,সাগর, নিবিড় ও শুভ কামনা জানাল। আফসোসের সুরে অন্তু আদ্রের দিকে তাকিয়ে বলল,,
–” ইশশ! কত কষ্টদায়ক যে অপেক্ষা করা। পিচ্চি মেয়েদের প্রেমে পড়লে এই এক জ্বালা। অপেক্ষা করতে থাকো। করতে করতে বুড়ো হয়ে যাও।”

অন্তুর কথা শুনে লজ্জায় মাথা নত করে ফেলল তুলি।আদ্র তুলি কে এক হাতে জড়িয়ে নিয়ে অন্তুর উদ্দেশ্যে বলল,,
–” মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ও আমি অপেক্ষা করতে রাজি।”
সবাই হই হুল্লোড় করে বলে উঠল,,–” ইহাই তো টুরু লাভ।”
আদ্র মুগ্ধ হাসি উপহার দিয়ে বলল,,–“দেখবি আমাদের প্রণয় কাহিনী একদিন তোরা তোদের নাতি-নাতনীদের শুনাবি।”

এক রাশ হাসি হাসল সবাই। মেতে উঠল অনুষ্ঠানে। তুলির এসব অনুষ্ঠানে ভীষণ অস্বস্তি লাগে। ক্লান্তি ও ঘিরে ধরে। শুধুমাত্র রিমির জন্যই আসা। বারোটা বেজে গেছে। সবাই কে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে এল সেন্টার থেকে। গাড়িতে বসেই তুলির খালি কোমরে আঁকড়ে ধরে নিজের একদম কাছে টেনে নিয়ে আসল আদ্র। আচানক হামলায় প্রচন্ড জোরে কেঁপে উঠল তুলির হৃদপিণ্ড। আদ্রর চোখে চোখ রাখতেই নিজেকে সামলানো বেগতিক হয়ে পড়ল তুলির। চোখ দুটো তে মুগ্ধতার ছাপ। ঠোঁটে লেগে আছে অমায়িক হাসি। দমবন্ধ হয়ে আসছে তুলির। এই হাসি তুলির মনে মাদকতার মতো কাজ করে। আদ্র নিজের গাল টা এগিয়ে তুলির গালে স্লাইড করল আলতো করে। তুলির কানের পাতায় ঠোঁট ছুঁয়ে দিল। শাড়িতে খামচে ধরল তুলি নিজের দু হাত। কানের কাছে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে আদ্রর স্লো ভয়েস।

–” বলেছিলাম না ভয়ংকর কিছু ঘটে যাবে?”
দু চোখ বুঁজে আদ্রর বুকে মাথা এলিয়ে দিল তুলি। নিশ্চুপ থাকা ছাড়া আর কোনো পথ দেখছে না সে। হৃদপিণ্ডের দ্রুত গতিতে উঠানামা ক্ষণে ক্ষণে কাঁপিয়ে তুলছে তাকে। এক হাতে তুলি কে জড়িয়ে গাড়ি স্টার্ট দিল আদ্র। সমস্যা বাঁধল মাঝ পথে এসে। গাড়ি বন্ধ হয়ে যেতেই ঘুম ঘুম চোখে মাথা তুলে তাকাল তুলি।
–“কি হয়েছে আদ্র?”
–” গাড়ির চাকা হয়তো পাঞ্চার হয়ে গেছে। এক্সট্রা চাকা ও তো নেই গাড়িতে।”
–” এখন আমরা বাড়িতে কিভাবে যাব আদ্র?”
আঁতকে উঠে কথাটা উচ্চারণ করল তুলি।
–” দেখি গাড়ি পায় কিনা!”

রাস্তার কিনারায় আদ্রর বাহুতে হাত জরিয়ে মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল তুলি। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পরও কোনো গাড়ি না পেয়ে বাড়ির ড্রাইভার কে কল করার জন্য মোবাইল টা বের করতেই একটা মেয়ে এসে বলে উঠল,,,
–” ওও স্যার পাশের মাইয়া ডার থাইক্কা আমি বহুত সুন্দর। আপনে আমারে লইয়া যান। কম টেকা দিলেও হইব। আপনি যা হ্যান্ডসাম,,
কথাটা তুলির কর্ণপাত হতেই চড়চড় করে রক্ত উঠে গেল মাথায়। কষিয়ে থাপ্পড় মেরে দিল মেয়েটার গালে। হতভম্ব হয়ে গেল আদ্র। কলে ব্যস্ত থাকায় ভালোভাবে খেয়াল করে নি সে। তুলির রাগী মুখ দেখে বিস্ময়ে থ মেরে গেল। থাপ্পড় মেরে ক্ষান্ত হয় নি তুলি। তেড়ে গেল মেয়েটার দিকে। গলা চিপে ধরতেই পিছন থেকে কোমর ধরে টেনে আনল আদ্র। তুলি লাগাতার চিল্লিয়ে বলতে লাগল,,

–” অসভ্য মাইয়া। তোরে আজ মেরে ফেলমু আমি। আমার আদ্রর দিকে তাকাইলি কেন? আমার আদ্র কে বাজে অফার করস? তোর চোখ খুলে ফেলমু আজ। হাত ভেঙে ফেলমু। জিহ্বা কেটে হাতে ধরিয়ে দিমু।”
কথাগুলো বলে হাত -পা ছুড়তে লাগলে অনবরত। হাতের কনুই গিয়ে বিধছে আদ্রর বুকে। ব্যাথা পেলেও দাঁত চেপে সহ্য করে নিচ্ছে। বড় বড় শ্বাস ফেলে মেয়ে টা ভয়ে দৌড় লাগাল কোনোদিকে না তাকিয়ে। তুলির ছুটাছুটি থামানোর কোনো উপায় না পেয়ে ঘুরিয়ে নিজের সাথে শক্ত করে চেপে ধরল আদ্র। আদ্রর বুকে মাথা রেখে ডুকরে কেঁদে উঠল তুলি
। বুকটা ধুক করে উঠল আদ্রর। অস্থিরতা ফুটে উঠল চোখে মুখে । তুলির মুখটা দু’হাতে আগলে নিয়ে বলল,,,

–“কাঁদছো কেন?”
–” আমি কখনও আপনাকে অন্য কারো হতে দিব না আদ্র। আপনি আমার থাকবেন সবসময়। থাকবেন তো?”
–” থাকবো। এখন কান্না অফ করো। বলেছি না তোমার চোখের পানি আমার হৃদয়ে রক্ত হয়ে ঝড়ে?”
–” হু।আরেকটা ভয়াবহ কান্ড ঘটে গেছে আদ্র। “( মলিন স্বরে)
—” কি?”(ভ্রু কুঁচকে)
–“শাড়ির কুঁচি গুলো বোধহয় খুলে পড়ে যাবে।”
করুন সুরে কথাটা বলল তুলি। আদ্রর ভীষণ হাসি পেল তুলির কথা শুনে। ঠোঁট দুটো প্রসারিত করে বলল,,,
–” কুঁচি গুলো ধরে রাখতে পারবে তো?”
–“হুম।কিন্তু! ”
–“ব্যাস! তাহলে আরকি। চলেন তুলা রাণী।”

তুলি কে কোলে তুলে নিল আদ্র। এক হাতে আদ্রর পাঞ্জাবি খামচে ধরে অন্য হাতে কুঁচি গুলো চেপে ধরে রাখল তুলি। এক নজরে তাকিয়ে রইল আদ্রর হাসোজ্জল মুগ্ধময় চেহারার দিকে। প্রশান্তির বাতাস ছেয়ে গেল মনে। তুলির ছোট্ট মনের একটাই প্রত্যাশা চিরকাল এই প্রশান্তির বসবাস থাকুক তার অন্তর জুড়ে।

বেলকনিতে দাঁড়িয়ে মন মাতানো হাওয়া গায়ে মেখে নিচ্ছে তুলি। একটু আগেই বাসায় এসেছে। গভীর রাতে ভেসে আসা শীতল বাতাস চোখে মুখে এসে লাগতেই দু’ চোখ বন্ধ করে উপভোগ করতে মগ্ন হয়ে পড়েছে । মনের মধ্যে জমে থাকা ভালো লাগা টা ধীরে ধীরে বিস্তার লাভ করছে।তুলির কাঁদতে ইচ্ছে করে। ভীষণ ইচ্ছে করে কাঁদতে। কল্পনাতীত ছিল জীবনে আদ্রর মতো একটা মানুষ কে পাওয়া। বাবা-মায়ের ভালোবাসা থেকে বছর খানেক আগে বঞ্চিত হওয়ার পর কখনও আর এমনভাবে কেউ আগলে রাখে নি তাকে। এই পরিবারের প্রত্যেক টা সদস্য কতটা নির্লিপ্ত ভাবে আপন করে নিয়েছে তাকে।

আদ্রর ভালোবাসা তার হৃদয়ের গহীনে জমে থাকা সবটুকু কষ্টই নিঃশেষ করে দিয়েছে। এতো বেশি তো তুলি তার ছোট্ট জীবনে কখনও চায় নি। তবুও চাওয়ার চেয়ে বেশিই তার প্রাপ্য হয়েছে। আদ্রর মুখের প্রশস্ত হাসি তার প্রশান্তির এক বিশেষ কারণ। আকাশে ছড়াছড়ি তারা গুলো ও হয়তো বিশাল খুশি তুলির জন্য। তাই তো এতো ঝলমল করছে। প্রশস্ত চাঁদ ও তার জোস্না ছড়িয়ে দিয়ে চারদিক টা কেমন আলোকিত করে রেখেছে। তুলির মনেও যে স্বচ্ছ আলোর ছড়াছড়ি। ভালোবাসার আবেশে দিন দিন আসক্ত হয়ে পড়ছে মেয়েটা। আজকাল তো মনে হয় জীবনে তার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি আদ্র। মিনমিন করে ধীর কন্ঠে বলল,,,

–” আমি আমার এতো বছরের জীবনে কিছুই করতে পারি নি আদ্র কিন্তু আপনাকে অর্জন করতে পেরেছি। আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন আমার “আদ্র আহনাফ। ” সময়ের স্রোতে শত সাফল্যতা আমায় ধরা দিলেও আপনিই আমার শ্রেষ্ঠ অর্জন হয়ে থাকবেন চিরকাল।”
–” তুমি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন নয় তুমি আমার অস্তিত্ব তুলা।”
আচমকা পুরুষালি ভরাট কন্ঠ শুনে তুলির হৃদপিণ্ড টা ছলকে উঠল বজ্রপাতের ন্যায়। ভয় পেলেও মুখে ফুটল মৃদু হাসি। ইশ্! ওনি কিভাবে শুনে ফেললেন? মনে মনে প্রশ্নটা করেই পাশ ফিরে আদ্র কে নিজের খুব নিকটে পেল। থরথর করে কাঁপতে লাগল বুক টা। আদ্রর চোখে ঘুমের রেশ। লাল হয়ে আছে চোখ দুটো। নেশা মিশ্রিত চোখে চেয়ে ছোট্ট একটা ধাক্কা খেল হৃদয়ে। মুখ ফিরিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল এক দৃষ্টিতে। নীরবতা কাটিয়ে প্রশ্ন করল,,,

–“না ঘুমিয়ে এখানে কি করছেন? ”
–” তোমার সাথে আকাশে তারার মেলা দেখতে আসলাম।”
—” তারা গুলো অনেক সুন্দর তাই না?”
কোনো জবাব দিল না আদ্র। তুলির কোমরের একপাশে হাত রেখে নিজের কাছে টেনে নিল। জমে গেল তুলি। এক হাত দিয়ে খামচে ধরল রেলিং এ রাখা আদ্রর এক হাত। মুখ তুলে চাইতেই চাঁদের ঝলমলে আলোয় দৃষ্টি আঁটকে গেল আদ্রর মুখের দিকে। তুলির চোখ যতবারই আদ্র তে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ততবারই বেহায়া মন আঁটকে যায় আদ্রর চেহারায়। নিজেকে তখন ফিকে লাগে তুলির কাছে। আবছা আলোতে ও আদ্রর চেহারায় কতটা উজ্জলতা। আর নীলাভ দু’টি চোখের মাদকতা তো গ্রাস করে নিচ্ছে তুলি কে। তুলির ইচ্ছে করছে আদ্রর সারা মুখে কালি মেখে দিতে। ঐ অসভ্য, ফাজিল মেয়েটা ও সুদর্শন বলেছিল যা মনে পড়লেই মেজাজ তুঙ্গে উঠে যায় তুলির। দাঁত কিড়মিড় করে দমিয়ে রাখছে রাগ টুকু কে। তুলির চোখের দিকে তাকিয়ে হালকা হাসল আদ্র।

–“আমার তুলার চোখে রাগের আভাস দেখতে পাচ্ছি কেন?”
–“ঐ মেয়েটার জন্য। “(তুলির সোজা সাপ্টা জবাব)।
–” তুমি তো মেরেই ফেলতে মেয়েটা কে। বাই দ্যা ওয়ে মেয়েটা কিন্তু অনেক,,, ”
আদ্র কে বলতে না দিয়ে আদ্রর হাতে খুব জোরে কামড় বসিয়ে দিল তুলি। ব্যাথায় কিছুটা বিরক্তি সূচক শব্দ বেরিয়ে এল আদ্রর মুখ থেকে। ভেজা বেড়াল হয়ে গেল তুলি। আদ্র রাগী চোখে তাকাতেই বলে উঠল,,
—“মিথ্যা কথা বলতে আঁটকে দিলাম ডাক্তার সাহেব। মেয়েটা যখন এসেছিল আপনার চোখ তো মোবাইলেই নিবন্ধ ছিল আর বাকি সময়টুকু আমাকে সামলাতে। ”

–” এই মেয়ে তোমার সাহস তো কম না আমাকে রাক্ষসের মতো কামড় বসিয়ে দিলে। বড্ড বাড় বেড়েছে তোমার।”
কথাটা বলেই তুলির দুহাত পিছন থেকে চেপে ধরে নিজের আরেকটু কাছে টেনে নিল আদ্র। ভয়ে চুপসে গেল তুলির মুখ টা। সে তো ভেবেছিল আদ্র হয়তো কিছু বলবে না কিন্তু এখন তো আদ্রর রাগী কন্ঠ শুনে গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। হার্ট বিট ও হচ্ছে দ্রুত গতিতে। ভয়ের চোটে তুলি গড়গড় করে বলল,,
–“ভুল হয়ে গেছে ডাক্তার সাহেব। আর এমন অপরাধ করব না। আপনি চাইলে সারা রাত আপনার পা টিপে দিব। মাথা টিপে দিব। গলাও টিপে দিব। হি হি হি।”

–“গলা ও টিপে দিবে তুলা?”–চোখ কপালে তুলে জিজ্ঞেস করল আদ্র।
ঢোক গিলল তুলি। আরও কিছু বলতে নিলে ঠোঁটে আদ্রর আঙুলের স্পর্শ পেয়ে থমকে গেল। প্রকান্ড এক তুফান শুরু হল হৃদমাঝারে।মুখে হাসি ঝুলিয়ে আদ্র খানিকটা ঝুঁকে গেল তুলির দিকে। লজ্জায়, অভিসঙ্কায় ধুকপুক করতে লাগল তুলির বুকটা। কিছুটা পিছনে হেলে যেতেই আলতো করে তুলির অধরে নিজের ওষ্ঠদ্বয় বুলাল আদ্র। আগের চেয়েও অধিক জমে গেল তুলি। চোখ বুঁজে ঘন ঘন নিশ্বাস ছাড়ল। আমতাআমতা করে বলে উঠল,,
–“আমি পড়ে যাব আদ্র।”
–“ভয় নেই। আমি আছি না?”

ধপ করে চোখ মেলল তুলি। আদ্রর নেশাময় চাহনি তে স্থির করল নিজের দু চোখ। আদ্রর মুখে উচ্চারিত কথাটা অনাবিল শান্তি বয়ে আনল তুলির মনে। অনুভূতি গুলো ও গহীনে চিৎকার করে বলতে লাগল,,–“ভয় নেই তুলি। তোর ডাক্তার সাহেব আছে তো।” এতোটা আশ্বাস দিয়ে কথা তো কখনও কেউ বলে নি। কেউ তো তার জন্য এতোটা ভাবে নি। হাতে হ্যাঁচকা টান অনুভব করতেই আদ্রর বুকে গিয়ে পড়ল। বুকে মাথা ঠেকিয়ে আদ্রর পিঠে নিজের দু হাত রেখে জড়িয়ে ধরল শক্ত করে। পরম আবেশে আবারও বুঁজে নিল ডাগরডাগর আঁখিদ্বয়। পূর্ণতা যেন তুলি কে ঘিরে ধরেছে আষ্টেপৃষ্টে। আজও শান্তির একটা ঘুম হবে তার। তুলির ছোট্ট জীবনের একটাই শান্তির উৎস তার ডাক্তার সাহেব ।আদ্রও কিছুক্ষণ তুলি কে জড়িয়ে রেখে নরম স্বরে ডেকে উঠল,,

–“তুলি?”
কোনো সাড়াশব্দ নেই। চারদিকে নিস্তব্ধতার মাঝে তুলিও নিস্তব্ধ হয়ে পড়েছে। কোন শব্দই আদ্রর কর্ণগোচর হল না। তুলির দিকে তাকাতেই দেখতে পেল গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে মেয়েটা। এই মেয়ের এতোক্ষণ ঘুম আসছিল না অথচ আদ্রর প্রশস্ত বুকে মাথা রাখতেই পাড়ি জমাল ঘুমের রাজ্যে। কোলে তুলে রুমে এনে শুয়ে দিল আদ্র। এসির পাওয়ার টা কমিয়ে দিয়ে কাঁথা টেনে দিল গায়ে। তুলির একটা অভ্যেস আছে শীত হোক কিংবা গরম বারো মাসই গায়ে কাথা দিয়ে ঘুমায়।তার মনে এক উদ্ভট ধারণার বসবাস আছে তা হল– গায়ে কাঁথা মুড়ি দিয়ে না ঘুমালে কেউ তাকে পা ধরে টেনে নিয়ে যাবে। প্রথম প্রথম তুলির উদ্ভট অভ্যেস টা শুনে ভীষণ চমকেছিল আদ্র। তার মন বলল– মেয়েটা আসলেই নিতান্তই বাচ্চামো স্বভাবের।তুলির মাথার কাছে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল কোনো শব্দবিহীন। তৈলাক্ত মুখে চোখ বুলিয়ে গভীর একটা চুমু খেল কপালে। নেশাতুর কন্ঠে উচ্চারণ করল,,

–” আর তো মাত্র কয়েক টা মাস। তারপর সতেরোর গন্ডি পেরিয়ে আঠারো তে পা রাখবে তুমি। ঠিক অপেক্ষা করে নিব যেমন টা করে এসেছি বছরের পর বছর। মাসখানেক পেরুলেই প্রতি রাতে আমার বুকেই হবে তোমার ঠাঁই। নিত্যদিনের মতো নতুন নতুন অনুভূতি নিয়ে উড়ে বেড়াবে আমার অন্তরের গহীনে।”
খয়েরী কালার লেহেঙ্গা পড়ে ওড়না টা এক সাইডে মেলে দিল তুলি। কালো লেহেঙ্গা টা দু হাতে আঁকড়ে ধরে দ্রুত গতিতে ছুটে এল আমরিন। বড় বড় শ্বাস ফেলে বলল,,
–“এই তুলি হয়েছে তোর?ভাইয়া নিচে অপেক্ষা করছে। ভাইয়ার কিন্তু লেইট করা একদম পছন্দ না।”
–“হুম চল।”

আমরিনের সাথে বের হয়ে আসল তুলি। লেহেঙ্গা দু হাতে আগলে নিয়ে তাড়াতাড়ি পা চালাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। অলরেডি কিছুটা লেইট করে ফেলেছে সে। আদ্র হয়তো রেগে বোম হয়ে আছে। একদমই তাকাবে না তুলি আদ্রর দু চোখে। তাকালেই দেখা যাবে চোখ থেকে আগুনের ফুলকি ঝড়ে পড়ছে যা নিমিষেই ভস্ম করে দিবে তাকে। তার চেয়ে ভালো সোজা গাড়ি তে বসে পড়বে। মাথা নুইয়ে হাঁটতে লাগল তুলি। শার্টের হাতা গুটাতে গুটাতে সামনের দিকে তাকিয়ে থমকে গেল আদ্র। শ্বাসরুদ্ধ করে কয়েক পলক নিশ্চুপ আঁটকে রইল তুলির মাঝে। স্থির তার মাদক চাহনি। ভিতর থেকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিচ্ছে তুলির কৃষ্ণবর্ণী চোখ দুটো। নিমিষেই আদ্রর বক্ষপিঞ্জর এলোমেলো হয়ে গেল। কোনো ক্রমেই সরিয়ে আনতে পারছে না দু চোখ। আদ্রের সান্নিধ্যে এসে দাঁড়াতেই আনমনেই হাত টা চেপে ধরল আদ্র। লজ্জায় চুপসে গেল তুলির মুখটা। ঠোঁট টিপে হেসে আমরিন গিয়ে গাড়িতে বসল। তুলির শক্তি আদ্রের বলিষ্ঠ হাতের তুলনায় নিছক। তাই মোলায়েম কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,,

–“কি করছেন?”
–“তুমি কি করছো?”—ঘোর লাগা কন্ঠে পাল্টা প্রশ্ন করল আদ্র।
থতমত খেয়ে গেল তুলি। গলার জোর খানিকটা বাড়িয়ে বলে উঠল,,
–“মানে?”
হাত টা টেনে সম্মুখে দাড় করাল তুলি কে। ড্যাবড্যাব চোখে তুলি তাকিয়ে রইল আদ্রর চোখে। এই চোখের মাদকতা কাটিয়ে উঠা যে তুলির জন্য দুঃসাধ্য। আদ্রর নেশাময় কন্ঠে কিছু কথা শুনে পিলে চমকে উঠল তুলির। বজ্রপাতের ন্যায় শুনাল কথাটা। আদ্রর ঠোঁটের কোণে বাকা হাসি। কানে এখনও ঝংকার তুলে বাজছে আদ্রের কথাটা।

–” তুমি আমায় নেশা ধরিয়ে জিজ্ঞেস করছো কি করছি? নিজেকে সংযত করে রাখতে পারো না? এই যে আমার বেহায়া চোখ আঁটকে যাচ্ছে তোমার উম্মুক্ত গলায়। এখন কিছু করলে তো বলবে আমি অসভ্য।”
ইশ! কি লজ্জা! তড়িঘড়ি করে ওড়না টা ঠিক করে নিল তুলি। সামনের দিকে পা ফেলতেই আবারও টেনে নিজের একদম কাছে নিয়ে আসল আদ্র। একটু নত হতেই লজ্জায় রাঙা হয়ে গেল তুলি। মুচকি হেসে সোজা হয়ে দাঁড়াল আদ্র। তুলি কে সামনে বসিয়ে দরজা টা লাগাতে লাগাতে বলে উঠল,,,

–“আজকেই বিয়ে টা করে নিলে মন্দ হয় না। তোমার লাল রাঙা ঠোঁট দুটো ভীষণ টানছে আমাকে।”
চোখের আকৃতি বড় করে পিছনে তাকাল তুলি। আমরিন কে কানে হেডফোন গুঁজে রাখতে দেখে স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ল। তুলির কাছে আদ্র কে এখন ঠোঁট কাটা বেহায়া মনে হয়। এতো ম্যাচুরিটি সম্পন্ন মানুষ অথচ কত লাগাম ছাড়া কথা বার্তা তার। জায়গায় জায়গায় তুলি কে লজ্জায় শিহরিত করার জন্য প্রস্তুত থাকে। বুকের দ্রিমদ্রিম শব্দ টা এখনও সমানতালে বেজেই যাচ্ছে।

গাড়ি থেকে নেমে নিজের ব্লেজার টা আদ্র তুলির দিকে এগিয়ে দিল। জড়তা নিয়ে ব্লেজার টা পড়িয়ে দিল তুলি। হৃদয়ে শীতল বাতাস অনুভব করল। উপলব্ধি করতে পারল বউ হওয়ার অনুভূতি। ভিতরে গিয়ে রিমির সাথে দেখা করল তুলি ও আমরিন। বরযাত্রী ও এসে গেছে। সাগরের সাথে ও কৌশল বিনিময় করে অন্যদিকে যেতে নিলে কোথা থেকে ছু করে এসে আদ্র তুলি কে জড়িয়ে নিল এক হাতে। লজ্জার৷
ছাপ ফুটে উঠল তুলির দু গালে। দাঁতে দাঁত চেপে কিছু বলতে নিবে তার আগেই থামিয়ে দিল আদ্র। এক পলক তাকিয়ে সামনের দিকে চেয়ে বলে উঠল,,
–“তুমি আমার সঙ্গে সঙ্গে থাকবে পুরো বিয়েতে। বউ হারালে বউ পাব কিন্তু তুলা কে কেউ উড়িয়ে নিয়ে গেলে আমি নিঃশেষ হয়ে যাব। তার চেয়ে ঢের ভালো নিজের কাছেই বন্দী করে রাখি।”
–“কিন্তু! ”
–“কোনো কিন্তু না। দূরে একটা মহিলা কে দেখতে পাচ্ছো?”
সূক্ষ্ম দৃষ্টি নিক্ষেপ করল তুলি। মহিলা টা ওদের দিকেই তাকিয়ে আছে কপাল কুঁচকে। তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে তুলি জবাব দিল,,,
–“হু।”

–“ওনি অলরেডি তোমাকে ও আমরিন কে ওনার দুই ছেলের হবু বউ বানিয়ে ফেলেছেন। আমাকে ডেকে জিজ্ঞেস করছিলেন আমি তোমাদের ভাই কিনা! তাই একটু দেখিয়ে দিলাম কার ভাই আর কার লাগি হাসবেন্ড। ”
কিছুক্ষণ বিস্মিত হয়ে রইল তুলি। মিনিট খানেক পর মুচকি হেসে আদ্রর এক হাত নিজের এক হাতে মুষ্টিমেয় করে নিল।কিছুটা আওয়াজ করে মহিলা টা কে শুনানোর উদ্দেশ্যে বলে উঠল,,,
–“আমি অলরেডি বুকিং। শুনেছি প্রত্যেক মানুষের জন্মের পিছনে একটা উদ্দেশ্য থাকে। আর আমার জীবনের উদ্দেশ্য এই মানুষটার জীবনসঙ্গিনী হওয়া।”
তুলির কথা শুনে এক রাশ মুগ্ধতা ঘিরে ধরল আদ্র কে। প্রচন্ড অবাক হচ্ছে আদ্র। বয়সে ছোট মেয়েটাও আজকাল কেমন পাগল করে দেওয়া কথা বলে। প্রত্যেক টা কথা হৃদয়ে গেঁথে যায়। অনুভূতি গুলো ও বৃদ্ধি পেতে থাকে। ভালোবাসা মানুষ কে সত্যিই প্রচন্ড বেহায়া বানিয়ে দেয়। আর ভালোবাসার কাঙ্গাল মানুষ গুলো তো একটুখানি ভালোবাসা পেলেও আগলে রাখে নিজের চেয়েও যত্ন করে।

ওয়াশরুমে হাত টা ধোঁয়ার জন্য এসেছিল আমরিন। বের হতে না হতেই কে যেন দেয়ালের সাথে শক্ত করে চেপে ধরল তাঁকে। ভয়ে চোখ বন্ধ রেখেই কাঁপতে লাগল অনবরত। চোখে মুখে অনুভব করতে লাগল গরম নিশ্বাস। পেটে অজ্ঞাত মানুষটার হাতের স্পর্শ পেয়ে দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগল তার।হাতের বিচরণ ক্রমশ বাড়তে লাগল। আর না পেরে চোখ মেলে তাকালো আমরিন। ছলছল চোখদ্বয়ে ভেসে উঠল নিবিড়ের রক্তিম বর্ণের চেহারাটা।
—” আমার ফোন ধরছিলি না কেন তুই? আমাকে পাগলের মতো বানিয়ে এখন নিজেই পিছু হটে যাচ্ছিস? মন চাইল কয়েকদিন প্রেম করলি আবার মন চাইল যোগাযোগ বন্ধ করে দিলি? তুই ভাবলি কি করে আমি তোকে ছেড়ে দিব? আজ তোর ভাইয়ের সামনেই আমি সব বলব তুই কতটা বেড়েছিস। আজকাল কেমন চিট করাও শিখে গেছিস।”

ভয়ে আত্মা শুকিয়ে গেল আমরিনের। দুই দিন ধরে নিবিড়ের সাথে কোনো যোগাযোগ করছে না সে। নিবিড়ের হাত টা জড়িয়ে ধরে বলল,,
–” আমার দোষ নিবিড়? তোমার কোনো দোষ নেই? তোমার এসিস্ট্যান্ট শিপরা আপুর সাথে তোমার এতো কিসের মেলামেশা? ওইদিন কলেজ থেকে ফিরার পথে আমি দেখেছি ওনি তোমার সাথে গাড়িতে ছিল। তুমি ওনার কাছেই যাও। আমার কাছে কি?”
কথাটা বলতে দেরি হলেও আমরিনের গাল চেপে ধরতে একটু ও দেরি করল না নিবিড়। অগ্নি কন্ঠে বলে উঠল,,
–” শিপরা আমার এসিস্ট্যান্ট, বউ না। কাজের সুবাদে বিভিন্ন মিটিংয়ে সাথে যায়। তোর লজ্জা করল না এমন বাজে ভাবনা আনতে? এই তোর ম্যাচুরিটি। সামান্য দেখার দোষে তুই আমায় দু’টো দিন যন্ত্রণা দিয়েছিস? তোকে কঠোর শাস্তি দিব আমি । যন্ত্রণায় ছটফট করবি তুই। ”
আমরিনের গলায় মুখ ডুবিয়ে দিল নিবিড়। সরাতে চেয়েও সরাতে পারছে না আমরিন।

—” তুই আমার এতো বছরের ভালোবাসা গুলো এক নিমিষেই মিথ্যে দাবি করলি আমরিন। আমি শান্তিতে থাকতে দিব না তোকে। রেডি থাকিস কালই বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে তোর বাড়িতে হাজির হবো।”
কথাটা বলে আর এক মিনিট ও দাঁড়াল না নিবিড়। আমরিন রোবটের মতো দাড়িয়ে আছে। নড়ার শক্তি টুকু ও হারিয়ে ফেলছে। কি ভাববে আদ্র ও পরিবারের সবাই? কিভাবে ফেইস করবে নিজের পরিবার কে?আর এতো জলদি বিয়ে? চিন্তিত হয়ে পড়ল আমরিন। তুলিই পারবে এটার সমাধান করতে সেটা ভেবে পা বাড়াল।

ছাদে আড্ডার আসর জমেছে। একপাশে বিভিন্ন খাবার,কোল্ড ড্রিংকস রাখা। রাতের আঁধারে ছাদে করা লাইটিংয়ে সবকিছু মিলিয়ে বেশ জমজমাট লাগছে। সাগরদের বাসা এটা। ছাদ টা বেশ সুন্দর। একপাশে সুইমিংপুল ও আছে। তুলি প্রথম বার এমন ছাদ দেখেছে। মুগ্ধ নয়নে অবলোকন করে যাচ্ছে পুরো ছাদ টা। বিয়ে শেষে সবাই চলে এসেছে সাগর দের বাসায়। আজ রাত টা আদ্রর পুরো বন্ধু মহল এখানেই কাটাবে। আমারিন ও তুলি যেহেতু তাদের গ্রুপেরই একটা অংশ তাই তারাও এখানে। সবাই বসে আড্ডা দিলেও তুলির গলা শুকিয়ে গেছে তাই পানি খেতে আসল। আদ্র কিছুটা দূরে দাড়িয়ে ফোনে কথা বলছে। পানি না পেয়ে একটা কোল্ড ড্রিংকস এর বোতল খুলে এক ঢোক পান করল তুলি। সাথে সাথেই মুখ টা কুঁচকে ফেলল। মাথা টাও কেমন ঝিম ধরে গেল। পরক্ষণেই আরেকবার মুখে দিতেই ভীষণ মজা পেল। একেবারে পুরোটা সাবার করেই দম নিল। অন্য একটা নিয়ে খেতে লাগল।মাথায় হাত দিয়ে চিন্তিত মুখে এগিয়ে এল অন্তু। অবাক কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,,

–“পুরোটা খেয়ে নিলে তুলি?”
–“হু। ভাইয়া আপনার কি জমজ ভাই আছে? ইশ! আপনার জমজ ভাই টা দেখতে ঠিক আপনার মতো।
তুলির উল্টা পাল্টা কথা শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল অন্তু। ভয়ে বেচারার হার্ট টা ও দুর্বল হয়ে পড়েছে। আদ্র যদি জানতে পারে তাহলে আর আস্ত রাখবে না। এসব আদ্র মোটেও পছন্দ করে না। এতো বছরের বন্ধুত্বে কখনও আদ্র কে নেশা জাতীয় কিছু পান করতে দেখে নি। এসবের নাম শুনলেও মাথায় রক্ত উঠে যায় আর সেই জায়গায় তুলি পুরো দুই দুটো বোতল খেয়ে ফেলেছে। তুলি মাতাল স্বরে বলে উঠল,,,

—“আমার আদ্র বেবি কই গেল? ”
জিভ কাটল অন্তু। আমতাআমতা করে বলল,,
–“তুলি বোন আমার এখান থেকে এক পা ও নড়াবে না ঠিক আছে? আমি তোমার জন্য দৌড়ে গিয়ে লেবু পানি নিয়ে আসছি।”
–“আচ্ছা।”
অন্তু যেতেই তুলি কে আর পায় কে। ঢুলতে ঢুলতে সবার সামনে এসে দাড়িয়ে চিৎকার করে বলে উঠল,,
–“আমি সবাই কে গান শুনাবো, নাচও দেখাব।”

আকাশে তারার মেলা পর্ব ১৩+১৪

তুলির এমতাবস্থায় চমকে গেল সবাই। আমরিন উঠে আসতেই তুলি ঠেলে আমরিন কে সরিয়ে দিল। কড়া গন্ধে আমরিনের আর বুঝতে বাকি রইল না। সুইমিংপুলের কাছে ভাই কে দাড়িয়ে থাকতে দেখে আঁতকে উঠল আমরিন। আদ্র এখনও উল্টো ঘুরে কথা বলছে। আবারও আটকাতে যাবে এর মধ্যেই তুলি গেয়ে উঠলো,,
“পরে না চোখের পলক।”
“কি তোমার রূপের ঝলক!”

লাইন টা গেয়েই চোখের পলক ঝাপটা তে লাগল। সবাই তো প্রচন্ড অবাক। ঢুলু ঢুলু পায়ে আদ্রের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। আদ্র পিছন ফিরতেই নিজের ওড়নার কিছু অংশ আদ্রের মুখের উপর দিয়ে আবারও গেয়ে উঠলো।
“দোহাই লাগে মুখটি তোমার আঁচলে ঢাকো।”
“আমি জ্ঞান হারাব, মরে যাব
বাঁচাতে পারবে না কেউ। ”
“ওও আমি জ্ঞান হারাব, মরেই যাব বাঁচাতে পারবে না কেউ।”

সত্যিই শেষমেশ মেয়েটা কে কেউই বাঁচাতে পারল না। গায়ের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে একটা চড় বসিয়ে দিল আদ্র। রাগে আক্রোশে ফেটে পড়ছে। থাপ্পড় খেয়ে তাল সামলাতে না পেরে সুইমিংপুলে পড়ে গেল ধপ করে।বাকি সবাই তো ভয়ে প্রগাঢ়পাড়। অন্তুু তো লেবু পানি রেখেই লুঙ্গি ধরে ভোঁ দৌড়।

আকাশে তারার মেলা পর্ব ১৭+১৮