আকাশে তারার মেলা পর্ব ৫+৬

আকাশে তারার মেলা পর্ব ৫+৬
আসরিফা সুলতানা জেবা

তুলি কে টানতে টানতে বাসায় এনে ড্রইং রুমের সোফায় বসাল আদ্র। মাথা নিচু করে বসে রইল তুলি। তুলির পাশে দাড়িয়ে আমরিন ভিতু চোখে চেয়ে আছে ভাইয়ের দিক। সামনের সোফাতে বসে আদ্র ও মাথা নিচু করে নিজের রাগ দমানোর চেষ্টায়। সারা রাস্তায় একটা শব্দ করে ও নি। এমনকি তুলির দিকে ফিরেও তাকায় নি। তুলি কে এভাবে টেনে আনতে দেখতে পেয়ে সায়েরা বেগম ও ইনশিতা দৌড়ে এল ড্রইং রুমে।

দুজনেই বাহিরে বাগানের সাইডে বসে কথা বলছিলেন। একজন সার্ভেন্ট তড়িঘড়ি করে এক গ্লাস পানি নিয়ে আসল আদ্রর জন্য। পানির গ্লাস টা শেষ করে মায়ের দিকে তাকাল আদ্র। ছেলের নীলাভ চোখের মণি লাল বর্ণের দেখতেই বুক টা ধুক করে উঠল সায়েরা বেগমের। তুলিও মাথা নিচু করে আছে। আমরিন ও কেমন ঠকঠক করে কাঁপছে। সবকিছু খুব এলোমেলো মনে হচ্ছে ওনার কাছে। আতঙ্কিত স্বরে প্রশ্ন ছুঁড়লেন আমরিনের দিকে,,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

–“কি হয়েছে আমরিন?”
আমরিন কাঁপা কাঁপা কন্ঠে কিছু বলতে নিবে তার আগেই হাত দেখিয়ে থামিয়ে দিল আদ্র। তুলির নতজানু মুখের দিকে এক পলক চেয়ে তাচ্ছিল্যের সহিত বলে উঠল,,,
–“তোমার বোনের মেয়ের খবর রাখো আম্মু? পড়াশোনা না করে ফুর্তি করে বেড়ায়।আজ,,
মাথা তুলে আদ্রর দিকে চাইল তুলি। কলিজা মুচড়ে উঠল তার। আদ্র সব বলে দিবে নাতো? বললে সায়েরা বেগম হয়ত কষ্ট পাবেন। কিভাবে মুখ দেখাবে তুলি মায়ের মতো মানুষ টা কে যে তাকে নতুন ভাবে বাঁচার একটা রাস্তা দেখিয়েছে?
–“আজ ওদের ক্লাস টিচারের সাথে দেখা হয়েছিল। তুলি নাকি একদমই পড়াশোনা করে না। কোনো পড়া ও পারে না।তাই ওকে আজ থেকে আমি পড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি মা। ”

অপলকভাবে চেয়ে গম্ভীর স্বরে বলে উঠল আদ্র।
চমকাল তুলি ও আমরিন। ড্যাবড্যাব চোখে দু’জনেই চাইল আদ্রর দিকে। আদ্র সায়েরা বেগম কে সত্য টা বললেন না দেখে হতভম্ব হয়ে পড়ল দু’জনেই। সায়েরা বেগম ফুঁস করে একটা নিশ্বাস ছেড়ে ছেলের দিকে তাকালেন। সোফায় বসতে বসতে বললেন,,,
–“আমি তো ভাবলাম তুলি কি না কি করেছে যার কারণে তুই রেগে গেছিস। যাক আল্লাহ বাচিয়েছে নাহলে তোর যা রাগ আমার তুলি মা টা কে তো মেরেই ফেলতি তোকে রাগানোর অপরাধে।”
তুলির দিকে তাকিয়ে আবারও বলে উঠলেন,,
–“এই তুলি মাথা নত করে বসে আছিস কেন?”

ভড়কে গেল তুলি। মাথা তুললে তো সায়েরা বেগমের চোখ সবার আগেই গালের উপর গিয়ে পড়বে। গাড়ির আয়নায় স্পষ্ট দেখতে পেয়েছে গাল টা তে পাঁচ আঙুলের ছাপ দৃশ্যমান।
–“আসলে খালামণি মাথা টা খুব ব্যাথা করছে। সোজা হয়ে বসলে ব্যাথা ভীষণ বেড়ে যায়। তাই নত হয়ে বসে আছি। ”
সিরিয়াস মোমেন্টে তুলির অদ্ভুত কথা শুনে মনে মনে ভীষণ হাসি পেল আমরিনের। মুখ চেপে কোনোমতে আঁটকে রাখল হাসি টা। আদ্র এখনও ভাবলেশহীন ভাবে তুলির দিকে তাকিয়ে যা তুলিকে আরও অস্বস্তিে ফেলে দিচ্ছে। তুলির মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন সায়েরা বেগম। পরম মমতা পেয়ে আবেশে চোখ বুঁজে এল তুলির।

–“ঠিক আছে রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নে। আমি খাবার রুমেই পাঠিয়ে দিব।”
মাথা নেড়ে বহু কষ্টে সিঁড়ি বেয়ে উঠে রুমে আসল তুলি। পা দুটো ও চলছিল না। মনে হচ্ছিল কেউ বোধহয় শিকল দিয়ে বেঁধে রেখেছিল। দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল ধপ করে। বালিশে মুখ গুঁজে ডুকরে কেঁদে উঠল। এতোক্ষণ কান্না গুলো আঁটকে রেখেছিল খুবই কষ্টে। বদ্ধ রুমে দেখার মতো কেউ নেই তাই ফুপিয়ে কেঁদে উঠল তুলি। মন টা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না আজকের কান্ড টা। গালটা ও জ্বলছে ভীষণ। এক ঝাঁক অভিমান এসে বাসা বেঁধেছে মন মাঝারে। ফুপাতে ফুপাতে বলে উঠল,,

–“আমি আপনাকে কখনও ক্ষমা করব না আদ্র ভাই। এতো নিষ্ঠুর আপনি! অসভ্য, পাষাণ লোক। আমি আর কোনোদিন ও কথা বলব না আপনার সাথে। চলে যাব আমি এখান থেকে। থাকব না আর এখানে।”
–“কোথায় যাবে?”

ভরাট কন্ঠস্বর কানে এসে ধাক্কা খেল তুলির। সে কি ভুল শুনেছে? কন্ঠ টা আদ্রর কন্ঠ ছিল না? পরক্ষণেই মনে হল বদ্ধ রুমে আদ্র কিভাবে আসবে? তাই কোনোদিকে না তাকিয়ে আবারও বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদতে লাগল। পাশে কারো শুয়ার শব্দ পেতেই কান্না থেমে গেল তুলির। ভয়ে কেঁপে উঠল মন। কোনো ভূত নেই তো রুমে? প্রশ্ন টা মনে জাগতেই শঙ্কিত চোখে ধীরে ধীরে পাশ ফিরে দেখল। হুঁশ উড়ে গেল তুলির। লাফ দিয়ে উঠে বসল বিছানায়। তুলির চেহারার দিকে চেয়ে ভ্রু কুঁচকাল আদ্র। মাথার নিচে দু হাত রেখে আরেকটু আরাম করে শুয়ে পড়ল যেন চমকানোর মতো কিছুই হয় নি। অবাক হলো তুলি। বারান্দার দিকে তাকাতেই বুঝতে পারল আদ্র কিভাবে এসেছে।

–“বললে নাতো কোথায় যাবে?”(হেসে)
আদ্রর হাসিতে গা জ্বলে উঠল তুলির।

“এভাবে মেরে আবার হাসা হচ্ছে। একদম কথা বলবি না তুলি এমন খারাপ মানুষের সাথে।ওনি তো ডাক্তার না আস্ত বড় এক কসাই।”
তুলি উঠে পড়ল বিছানা থেকে। আদ্র ও তুলির সাথে উঠে পড়ল। তুলি যে অভিমানে কথা বলছে না তা ঠিকি বুঝতে পেরেছে আদ্রর মন। কাভার্ড থেকে কাপড় বের করে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়াল তুলি। সাথে সাথেই টান পড়ল হাতে।থমকে গেল তুলি। যা-ই হয়ে যাক আজ মুখ দিয়ে কোনো শব্দ ও বের করবে না তুলি।

হাত মুচড়াতে লাগল তুলি ছোটার জন্য। আদ্রর বলিষ্ঠ হাতের শক্তির কাছে তুলির মতো দুর্বল মানবীর পেরে উঠা সহজ না। তবুও তার নিছক চেষ্টা। মুচকি হাসল আদ্র। হাত টা টান দিতেই তুলির পিঠ এসে ঠেকল আদ্রর বুকে। শরীরের সর্বাঙ্গ শিথিল হয়ে এল তুলির। পা দুটো ও ভেঙে ভেঙে আসছে। নিজের শরীরে সবটুকু ভর ছেড়ে দিল আদ্রর বুকে। ঠোঁটের কোণায় হাসি ফুটে উঠল আদ্রর। কোলে তুলে নিল তুলি কে। আচমকা নিজেকে শূন্যে অনুভব করতেই ভয়ার্ত চোখে তাকাল তুলি। হাত থেকে কাপড় গুলো পড়ে গেল মেঝেতে। আদ্রের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল কিছু সময়। বুকের দ্রিমদ্রিম শব্দ সময়ের সাথে বেড়েই চলেছে।

এ কেমন অনুভূতি জন্মাচ্ছে তুলির মনে? কোথায় গেল জেদ,অভিমান? মনের আনাচে-কানাচে শুধু হিম বাতাস বয়ে চলেছে। তুলি কে খাটে বসিয়ে দিল আদ্র। চেয়ার টেনে নিজে বসল তুলির সম্মুখে। পাশের টেবিলের উপর রাখা বরফের বাটি থেকে বরফের টুকরো নিয়ে তুলির গালে ছোঁয়াতেই আহ্ করে উঠল তুলি। চোখ মুখ খিঁচে সরিয়ে নিল কিছুটা দূরে। সূক্ষ্ম নিঃশব্দ নিশ্বাস ফেলল আদ্র। মৃদু সুরে বলে উঠল,,,

–“গালটা খুব জ্বলছে তাই না তুলা? ইশ! থাপ্পড় টা খুব জোরেই লেগে গেছে। রাগ উঠলে কেন যে নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারি না। তোমার কি দরকার ছিল ঐ ছেলের কাছ থেকে গোলাপ নেওয়ার? বয়স একটুখানি অথচ এখনই প্রেম করতে মাঠে নেমে পড়েছে। ”
নিষ্পলক চোখে চেয়ে রইল তুলি। আদ্রর খোঁচা মারা কথা গিয়ে চাপা পড়ে থাকা রাগ টা বেড়ে হয়ে গেল পাহাড়সম। করে বসল এক দুঃসাহসিক কান্ড। আদ্রর কলার দু হাতে খামচে ধরল শক্ত করে । অভিমান, রাগে এক নাগাড়ে চিতকার করে বলে উঠল,,,
—“আপনার সাহস কিভাবে হয় আমাকে মারার? কে আপনি আমাকে থাপ্পড় মারার? কি অধিকার আছে আপনার আমার উপর? সম্পর্কে খালাতো ভাই হন তাই যথাযথ সম্মান করি। তারজন্য এই না যে বিনা দোষে আপনি আমাকে মারবেন। ফুল নিয়েছি আরো নিব। আমার ইচ্ছে হলে আমি প্রেম করে বেড়াব।”

কথাগুলো বলে আবারও কান্নায় ফুপাতে লাগল তুলি। দৃষ্টি আদ্রর দিকে স্থির করতেই শিউরে উঠল সে। আদ্রর মুখের ভঙিমা বুঝা বড় দায়। চেহারায় ও নেই রাগের কোনো প্রতিফলন। তুলির দিকে চেয়ে আছে নিষ্পলক। নীলাভ চোখ জোড়ায় অজস্র মায়া ভাসমান। ধুকধুক করছে তুলির বুকটা। সে যে কত্ত বড় সাহস দেখিয়ে ফেলেছে বুঝতে পেরেই ধীরে ধীরে হাত ছাড়িয়ে আনতে লাগল আদ্রর কলার থেকে। কিন্তু আনতে চেয়ে ও পারে নি। কলারে দু-হাত রেখেই চেপে ধরল আদ্র। আচমকাই চোখে ফুটে উঠল রাগের ছাপ।

ভীত চোখ তাকাল তুলি।প্রাণটা বেড়িয়ে যাওয়ার উপক্রম। আদ্রর কলার ধরা তার একদম ঠিক হয় নি। রাগের বশে কি করে বসলাম? মনে মনে প্রশ্ন টা আওড়াল তুলি।চোয়াল শক্ত করে তুলির দিকে আরেকটু ঝুঁকে পড়ল আদ্র।দু’জনের নাক ছুঁই ছুঁই। আদ্রর গরম নিশ্বাস আবেগের তুমুল বর্ষণ করছে তুলির ভীতি মনে।আদ্র নামক মানুষটা তার হৃদয়ের স্পন্দন বাড়িয়ে দিচ্ছে। অনুভূতি গুলো চিতকার করে কিশোরী মন টা তে জানান দিচ্ছে,,, –“তুই প্রেমে পড়ে যাচ্ছিস তুলি। প্রেমের বর্ষণ হচ্ছে তোর হৃদয়ে। ”

নিজেকে পাগল পাগল লাগছে তুলির। আদ্রর এতো টা নিকটে আসা নিতে পারছে না সে। মুখ বাম দিকে ফিরিয়ে নিতেই শক খেল তুলি। কি হল এটা? হৃদয়ের গহীনে অদ্ভুত ভাবে বিচরণ করতে লাগল এক নতুন অনুভূতি। কল্পনা ও করে নি তুলি এমন কিছু হবে। নিজের ডান গালে আপনা আপনি হাত চলে গেল তার। এলোমেলো হয়ে গেল মন। নড়ে উঠল ভিতর টা। জীবনে প্রথম, প্রথম বার কোনো পুরুষের এমন স্পর্শ। আদ্রর দিকে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকাল তুলি। নিজের গালে আদ্রর ঠোঁটের স্পর্শ ভাবতেই তুলি এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে বারবার। সটানভাবে বসে আছে আদ্র। মুচকি হেসে তুলির দিকে তাকিয়ে বলল,,

–“আশা করি আর কিছুই বলতে হবে না। অধিকার থাকুক আর না থাকুক এ জীবনে তোমার বোধহয় আর প্রেম করা হবে না। নেক্সট টাইম কলারে হাত দেওয়ার আগে ভেবে নিবে আমি তোমার চেয়ে কতটা বড়। এখনো আদবকায়দা শিখা বাকি। আমি তোমার চেয়ে কতটুকু বড় জানো তো?”
তুলি এখনও নিস্তব্ধ। হাতটা ও গালে চেপে রেখেছে। নিজ চক্ষু তে বিশ্বাস করতে পারছে না তার সাথে এক শিহরিত ভয়ংকর ঘটনা ঘটে গেছে। মনের মাঝে হাজারো অনূভুতি নিয়ে নিশ্চুপ ভাবে তাকিয়ে আদ্রর দিকে। হালকা হাসল আদ্র। এ হাসির রেখা তুলির হৃদয়ের গহীনে আঘাত হানল তীব্রভাবে।

–“কি হল জবাব দাও?”
— “সসসাত বছরের বড় হবেন।”
আমতাআমতা করে বলল তুলি। আদ্র সম্পর্কে বিশেষ জানা নেই তার। বুঝ হওয়ার পর কখনোই আদ্র কে দেখে নি সে। মায়ের কাছ থেকে শুনেছে একটু একটু। আগ্রহ না থাকায় খুব বেশি জানা হয় নি তার। খুব বেশি বললে ভুল হবে তার পুকুরে পড়ে যাওয়ার ঘটনা বাদে আর কিছুই কখনো জানতে পারে নি তুলি। মৃদু হাসল আদ্র। শীতল কন্ঠে বলল,,,
–“আমি তোমার চেয়ে দশ বছরের বড় তুলি।”

প্রচন্ড অবাক হল তুলি। বিস্ফোরিত চোখে চাইল আদ্রর দিকে। আদ্র কে দেখে তার মনেই হয় নি এতো বড় হবে নিজের থেকে। দেখলেই মনে হয় যেন চব্বিশ কিংবা পঁচিশ বছরের এক সুদর্শন যুবক। মনে মনে ভীষণ লজ্জিত হচ্ছে তুলি। কম হোক আর বেশি হোক তার একদমই কলারে হাত দেওয়া উচিত হয় নি।
–“ক্ষমা করবেন। আসলে আমি,,, ”
থামিয়ে দিল আদ্র। শান্ত কন্ঠে বলল,,,
–“আমার কাছে তুমি কখনো ও ক্ষমা চাইবে না তুলি। পেইন কিলার রেখে গিয়েছি খেয়ে নিও।”
কথাটা বলেই বারান্দা দিয়ে চলে গেল আদ্র। তুলি এখনও বিস্ময়ে থ মেরে রইল। আদ্রর কথার পেচ,,কাজগুলো কেন ধারণ করতে পারে না তুলির মস্তিষ্ক? আচ্ছা আদ্র ভাইয়া কি আমায় পছন্দ করেন?–বিড়বিড় করে আনমনে বলে উঠল তুলি।

রাত নয়টা বাজে,,
আদ্র হসপিটালের একটা জরুরি কাজ করছে বসে বসে। দরজায় টোকা পড়তেই বিরক্ত বোধ হল আদ্রর। চোখ ফিরিয়ে দরজার কাছে বোন কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বিরক্তিমাখা চোখ দুটো শান্ত হয়ে এল। আলতো হেসে বলল,,
–আয় আমরিন।
ভীতু মন দিয়ে ধীর পায়ে হেঁটে এসে বিছানায় বসল আমরিন।মন উশখুশ করছে বিকালের সত্য টা বলার জন্য যে তুলির কোনো দোষ ছিল না।
—কিছু বলবি?
—হুম ভাইয়া।
–কি বলবি একটু তাড়াতাড়ি বল।

–আসলে ভাইয়া তুলির কোনো দোষ ছিল না। আমিই তুলি কে এসব করতে বলেছি।
একে একে সব খুলে বলল আমরিন। দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ছাড়ল আদ্র। কান্নারত আমরিন কে বুকে টেনে নিয়ে বলল,,
–তুলির দোষ ছিল তোর ও ছিল আমরিন। তোদের উচিত হয় নি এমনটা করার। এর বিপরীত ও হতে পারত তোদের সাথে।ছেলেটা তোদের ক্ষতি ও করতে পারত। দুষ্টমির ছলে ও এমনটা করা ঠিক হয় নি।
–আমাকে ক্ষমা করে দাও ভাইয়া।
–দিব তবে একটা শর্ত আছে।
মাথা তুলে আদ্রর দিকে তাকাল আমরিন। অস্ফুটস্বরে জিজ্ঞেস করল,,
–কি শর্ত ভাইয়া?

আদ্র উঠে গিয়ে দরজা টা চাপিয়ে আসল। বলা তো যায় না কে শুনে নেয়। তারপর আমরিন এক এক করে বুঝিয়ে বলল সব। অতিশয় অবাক হল আমরিন। মনে মনে ভাইয়ের জন্য খুশি হলেও একটা সত্যি যে লুকিয়ে থাকবে না। আজ না হোক কাল তো তুলি জেনেই যাবে। বাবা জানতে পারলে বাড়িতে তুফান হবে। আর আদ্রই বা কিভাবে ম্যানেজ করবে? পারবে তার ভাইয়ের কাছে অসম্ভব বলে কিছু নেই। আল্লাহ চাইলে হয়তো তার ভাইয়ের খুশি গুলো কেউই কেঁড়ে নিতে পারবে না। এখন বাকি টা নির্ভর করছে তুলির উপর।হাসি মুখে সম্মতি জানাল আমরিন। জবাবে বোনের মাথায় হাত বুলাল আদ্র।

ইনশিতার রুমে বসে আড্ডা দিতে দিতে এগারো টা বেজে গেছে। এখন না ঘুমোলে সকালে ঠিক সময় আর উঠা হবে না। পায়ের গতি বাড়িয়ে রুমের কাছে এল তুলি। দরজা ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করতেই প্রথমে নজর গেল টেবিলের উপর। একগুচ্ছ কালো গোলাপ খুব সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা টেবিলে যা দেখে মাথা ঘুরে গেল তুলির। বিকালের কথা মনে হতেই ভয় আরো চেপে ধরল গভীর ভাবে।ভীতি, শঙ্কায় মাথা ঘুরে পরে যেতে নিলে পিছন থেকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরল কেউ। তুলির ঝাপ্সা চোখে দৃশ্যমান হল আদ্রর ভয়ার্ত চেহারা। সাথে সাথেই বিড়বিড় করে বলে উঠল,,,

–“আমি কালো গোলাপ খাব না আদ্র।”
চারদিকে নিস্তব্ধতা। নেই কোনো নিশাচর প্রাণীর ডাক বা কোনো শব্দের উৎস।সারা ঘরময় ছড়িয়ে আছে নিস্তব্ধ অনুভূতি। শ্যামবর্ণা কন্যা ডুবে আছে গোলাপের নেশায়। অজস্র আবেগের, অনুভূতির সঞ্চার হচ্ছে তুলির হৃদয়ে। কালো গোলাপ গুলোর কাছে নাক নিয়ে নিঃশ্বাস টেনে নিচ্ছে তুলি। ক্রমশই ভারী হয়ে আসছে তার নিঃশ্বাস। বুকের মাঝে অজানা অনুভূতি ঝড় তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। মনের মাঝে ক্ষণে ক্ষণে উঠছে উত্তাল ঢেউ। ভাবতেই শিহরিত হচ্ছে আবার লাজুক লাজুক হাসি ও হাসছে যে আদ্র ওর জন্য কালো গোলাপ এনেছে। খানিক সময় আগেও কতো ভয় পাচ্ছিল। অথচ এখন অনুভূতির স্রোতে ভেসে যেতে ব্যস্ত।

তখন চোখ খুলে দেখল আদ্র হাত মুষ্টিবদ্ধ করে চেয়ে আছে এক ধ্যানে। নীল বর্ণী চোখ দুটো টকটকে লাল। চেহারায় অস্থিরতার ছাপ। চুলগুলো ও কেমন এলোমেলো হয়ে আছে। আদ্রর এই অস্থির চেহারা তুলির হৃদপিণ্ডে এক শীতল অনুভূতির জন্ম দিল।বুকটা ও দরফর করতে লাগল প্রচন্ড গতিতে।এমন লাগছে কেন আদ্র কে? প্রশ্ন টা মনে রেখেই উঠে বসতে নিলে নড়েচড়ে উঠল আদ্র। তুলি কে বসিয়ে দিয়ে নিজের হাতে মুষ্টিবদ্ধ তুলির হাত টা আলতো করে চুমু খেল। শিউরে উঠল তুলি।

এসির ঠান্ডায় ও কপালে জড়ো হল বিন্দু বিন্দু ঘাম। আবার মনের আষ্টেপৃষ্টে বয়ে যেতে লাগল প্রশান্তির বাতাস। আচ্ছা প্রেমে পড়লে কি এমনটাই হয়? তবে কি আমি প্রেমে পরে গেছি নাকি এটা নিতান্তই আবেগ? মন পাঁজরে প্রশ্ন টা সৃষ্ট হতেই আদ্রর দিকে তাকাল তুলি। মলিন কন্ঠে বলে উঠল আদ্র,,,
–এভাবে সামান্য কারণে ভয় পেয়ে কেউ বেহুশ হয়ে যায়?তুমি জানো কতটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম আমি?মুহুর্তেই মনে হচ্ছিল কে যেন আমার কলিজা ছিঁড়ে নেওয়ার চেষ্টায় উঠে পড়ে লেগেছিল।

অতিশয় বিস্ময়ে জড়ীভূত হয়ে পড়ল তুলি। আদ্রর কথার জবাবে কি বলবে জানা নেই তার৷ সে তো অনুভূতির সাথে যুদ্ধে নেমেছে। যেই যুদ্ধে মস্তিষ্কের চেয়ে মনে সঞ্চারিত অনুভূতি গুলো জয়ী হচ্ছে বার বার। হৃদপিন্ডের উঠানামা অস্বাভাবিক হয়ে পড়েছে। আদ্রর কথার মায়ায়, অস্থির চোখের মায়ায় ডুবে যাচ্ছে তুলি। কেমন নেশা ধরিয়ে দিচ্ছে তুলির মাঝে। আদ্রর স্পর্শ যেন তার জন্য কারেন্টের ঝটকার মতো। ঝটপট হাত টা সরিয়ে নিল তুলি।

ভীষণ হতভম্ব সে। সামান্য জ্ঞান হারাতেই কি তার জন্য আদ্রের এমন অবস্থা? সত্যি কি তাই? নিজের মাঝে যেন নিজেকেই হারিয়ে ফেলছে তুলি। নিমিষেই অস্তিত্বে মিশে গেল আদ্র আহনাফ নামক মানুষটা। দু চোখ বন্ধ করে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিল আদ্র। টেবিল থেকে কালো গোলাপ নিয়ে একটা গোলাপ গেঁথে দিল তুলির কানের পিঠে। চমকাল তুলি। হতবিহ্বল চোখে তাকাল আদ্রর মুখের দিকে। আদ্রর ঠোঁটের কোণে প্রস্ফুটিত এক হাসি। আচমকাই তুলির মনে হল তার হৃদয় অন্য কারো দখলে চলে যাচ্ছে। পরক্ষণেই আবার মনে হল তার মনের গহীনে তো আদ্রর জন্য তীব্র আর্তনাদ । দখল করে নিতে চাই আদ্র কে। প্রেমের বর্ষণে ভিজতে চায় আদ্রর সাথে।

–গোলাপ গুলো তোমার জন্য ছিল। আমি এতোটাও খারাপ না যে তোমায় গোলাপ খাওয়াবো। আমাদের বাসায় পর্যাপ্ত পরিমাণ খাবার আছে এবং আমার যা স্যালারি তাতে তোমাকে খাওয়ানোর সাধ্য ও আছে। সো তোমার গোলাপ খাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই তুলা।
মৃদু স্বরে কথাটা বলল আদ্র। গোলাপ গুলো বাড়িয়ে দিল তুলির দিকে। আদ্রর নেশাময় চাহনি তে নিজের চক্ষু জোড়া আবদ্ধ রেখে ফুল গুলো হাতে নিয়ে নিল তুলি। আদ্রর ঠোঁটের হাসি টা আরেকটু প্রস্ফুটিত হল। আর একটু ও দেরি না করে বেরিয়ে গেল রুম থেকে। হয়তো এতো সময় অব্দি নিজেকে সামলে রাখা টাই কঠিন হয়ে পড়েছিল।

দু চোখে ঘুম নেই তুলির। নয়া নয়া প্রেমে পড়লে বুঝি এমনই হয়? আদ্রর স্পর্শ, আদ্রর মায়ায় জড়ানো সেই নীলাভ চোখ কল্পসা করতে মগ্ন কল্পনাবিলাসী তুলি। শুয়া থেকে উঠে বসল তুলি। গোলাপ গুলো বুকে জড়িয়ে বলে উঠল,,,
–আমি আপনার প্রেমে পড়ে গেছি আদ্র। আপনার জন্য জমায়িত অনুভূতি গুলো আমায় অসহনীয় পীড়া দিচ্ছে। ঘুমোতে পর্যন্ত দিচ্ছে না।হৃদয়টা কেঁপে উঠছে বার বার। আচ্ছা এটা কে কি প্রেম বলে নাকি ভালোবাসা? প্রেম আর ভালোবাসা কি এক? আমি একদমই বুঝতে পারছি না আদ্র। তবে এতটুকুই ঠাওর করতে পারছি আমি আবেগের বশীভূত নয় আমি আপনাতে মত্ত হয়ে পড়েছি। আপনি আমায় ভালোবাসেন তো আদ্র?আপনার জীবনে অন্য কোনো নারী নেই তো?

কথাগুলো মিনমিন করে বলতে বলতে গোলাপ গুলো বুকে জড়িয়েই শুয়ে পড়ল তুলি।আজ হয়তো প্রশান্তির ঘুম হবে।
আদ্র রুমে আসতেই দেখতে পেল সায়েরা বেগম বসে আছেন। তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল আদ্র। এখন মা কি বলবেন ভালো করেই জানা আছে তার। নিঃশব্দে রুমে ঢুকল সে। বিছানায় বসতেই সায়েরা বেগম বলে উঠলেন,,,
–তুলির রুমে ছিলি তাই না?
–থাকলে?
ছেলের ভাবলেশহীন জবাবে প্রচন্ড পরিমাণে অবাক হলেন সায়েরা বেগম। কঠোর গলায় বলে উঠলেন,,

—তুই কি নিজের দেওয়া কথা ভুলে যাচ্ছিস আদ্র? তুলি এ বাড়িতে কেন আছে জানিস তো? ওরাও ব্যাক করছে আদ্র। তোর বাবা যদি এমন কিছু টের পান তাহলে তুলি কে আর এ বাড়িতে রাখবে না। তুই কি এমনটাই চাচ্ছিস?তুই কিন্তু কথা দিয়েছিলি তুলিকে নিয়ে আসলে তুই,,,
সায়েরা বেগমের কথাটা শেষ করতে দিল না আদ্র। পুরো উপেক্ষা করে পা বাড়াল ওয়াশরুমে। ঝরনার নিচে দাঁড়িয়ে গায়ের গেঞ্জি টা খুলে ছুঁড়ে মারল ফ্লোরে। নিজের হাত মুষ্টি করে লাগাতার ঘুষি মারতে লাগল দেয়ালে। সায়েরা বেগমের বুক চিরে একটা উত্তপ্ত শ্বাস বেড়িয়ে এল। তিনি ভালো করেই জানতেন আদ্র কোনো কথা বলতে রাজি হবে না। নিরুপায় তিনি। ভয় হচ্ছে বাবা ও ছেলের মাঝে দূরত্ব আরো বেড়ে যাবে নাতো!!!!!

কাছের মসজিদ থেকে আযানের শব্দ ভেসে আসছে তুলির কানে। হুড়মুড়িয়ে উঠল তুলি। আড়মোড়া ভেঙে উঠে দাঁড়াল বিছানা থেকে। অযু করে এসে নামাজ আদায় করে নিল। আয়নার সামনে দাড়িয়ে নিজেকে কিছুটা পরিপাটি করে নিল। অদ্ভুত এক ইচ্ছে জেগেছে তার মনে। আদ্রর ঘুমন্ত স্নিগ্ধ ভরা চেহারা দেখার ইচ্ছে। আয়নায় নিজেকে খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে বলে উঠল,,,
–তুই তো আদ্র ভাইয়ার সঙ্গে একদম বেমানান তুলি। ওনি কতো সুন্দর, চোখ গুলো কেমন নেশাময়। অবশ্য তোর চোখ গুলো ও মায়ার অধিকারী। কিন্তু আদ্র! আদ্র একটু না অনেক বেশিই সুন্দর। বয়স সাতাশ অথচ এখনও চোখে মুখে তরুণের ছাপ।

বারান্দায় এসে আদ্রর রুমের বারান্দায় উঁকি মারল তুলি। খুশিতে লাফিয়ে উঠল সাথে সাথেই। কারণ আদ্রর বেলকনির দরজা মেলা। তুলি কে আর পায় কে! লাফ দিয়ে আদ্রর বারান্দায় উপস্থিত হল মুহুর্তেই। পা টিপে টিপে শব্দহীন রুমে প্রবেশ করল । আবছা আবছা অন্ধকার রুম টা তে। আদ্র থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পড়ে খালি গায়ে উপুড় হয়ে ঘুমোচ্ছে। সারা রুম শীতল হয়ে আছে। লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠল তুলির গাল দুটো। সংকোচ এসে ঝেকে ধরল প্রচুর পরিমাণে। দৃঢ় পায়ে এগিয়ে গিয়ে আদ্রর মাথার কাছের খালি জায়গা টায় বসল।আদ্রর ঘুমন্ত মুখ দেখে এক মুঠো শান্তি ছুঁয়ে গেল হৃদপিণ্ডে।

বেহায়া মন চেয়ে বসল আদ্র কে একটু! শুধু একটু পরিমাণ ছুঁয়ে দিতে। মন কে সায় দিয়ে কাঁপা কাঁপা হস্তে আদ্রর কপালে পরে থাকা চুল গুলো ছুঁয়ে দিল তুলি। হাতে চাপ অনুভব করতেই চোখ বড় বড় করে তাকাল তুলি। শ্বাস ভারী হয়ে আসতে লাগল ক্রমাগত। চোর ধরা পড়লে যেমনটা হয় ঠিক তেমন অবস্থা তুলির। নিজের কপালে তুলির হাত টা চেপে ধরে সূক্ষ্ম দৃষ্টি নিক্ষেপ করল আদ্র। চোখ জোড়া ভীষণ লাল। হাসফাস করতে লাগল তুলি। এভাবে ধরা পড়ে যাবে ভাবে নি সে। সব দোষ বেহায়া মনের। কি জবাব দিবে এখন আদ্র কে সেটা ভেবে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে।
–কি হল হাত বুলিয়ে দাও।

আদ্রর কোমল স্বরে এমন বাক্য শুনে দেহে প্রাণ ফিরে পেল তুলি। খানিক বাদেই বাক্য টা ভালো করে কর্ণপাত হতেই অভিভূত হয়ে তাকিয়ে রইল আদ্রর দিকে। আদ্রর ঠোঁটে তৃপ্তির হাসি। হাসি টা খুবই মুগ্ধময়। সব ভয় দূর হয়ে গেল তুলির। কোমল মনটা ও নুইয়ে পড়ছে লজ্জায়। আদ্র কোনো প্রশ্ন করল না অথবা খারাপ কিছু ভাবল না সেটাই অবাক হওয়ার মূখ্য বিষয় তুলির নিকট। হাত বুলিয়ে দিতে নিলে হাতটা আবারও চেপে ধরল আদ্র। নিজে উঠে বসল। আদ্রর বুকের লোমশ অংশ দেখে লজ্জায় মুখ ফিরিয়ে নিল তুলি। তুলির লজ্জিত মুখ যেন খুব করে টানছে আদ্র কে। পাশ থেকে গেঞ্জি টা নিয়ে পড়ে তুলিকে বলে উঠল,,,

–আমার দিকে তাকাও তুলি।
তুলি তবুও ফিরতে রাজি নয়। ধমকে উঠল আদ্র। আদ্রর ধমকে তাড়াতাড়ি করে ফিরে চাইল তুলি।
–পা উঠিয়ে বসো খাটে।
আদ্রর দিকে বিস্মিত নয়নে চেয়ে জড়তা-সংকোচ কাটিয়ে পা উঠিয়ে বসল তুলি। হঠাৎ নিজের কোলে আদ্রর মাথা অনুভব করতেই শরীরের প্রত্যেক টা পশম শিউরে উঠল। ইচ্ছে জাগল আদ্র কে অনুভূতি মিশিয়ে বলতে–“আপনি হুটহাট কাছে আসবেন না আদ্র। প্রচন্ড ভাবে কেঁপে উঠে আমার হৃদপিন্ড। লজ্জা শরম উচ্ছন্ন করে আপনার বুকে মিশে যাওয়ার প্রবল ইচ্ছে জাগে।”

—বারান্দা টপকে আসতে গেলে কেন তুলি? যদি পড়ে যেতে?আর কখনও এমনটা করবে না প্লিজ।
আদ্রর কথার পৃষ্ঠে কিছু বলার শক্তি টুকু ও যেন হারিয়ে ফেলছে তুলি। নিজের অজান্তেই হাত বুলাতে লাগল আদ্রর চুলে। পরম আবেশে দু-চোখ বুঁজে ঘুমের দেশে পাড়ি দিল আদ্র। রাত টুকু কেটেছে তার নিদ্রাহীন। ভোরের দিকে লেগেছিল চোখ দুটো তখনই এক অন্যরকম সুবাস নিয়ে রুমে প্রবেশ করল তুলি। তুলি তাকিয়ে দেখল গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে আদ্র। দীর্ঘ! দীর্ঘ একটা শ্বাস ছাড়ল তুলি। এখন সে পুরো নিশ্চিত আদ্র ঘুমিয়ে পড়েছে। মুচকি হেসে টুপ করে চুমু খেয়ে নিল আদ্রর কপালে। খোঁচা খোঁচা দাড়িতে দিতে লাগল নিজের নরম হাতের পরশ। সাথে সাথেই চোখের কোণে জমে থাকা এক ফোঁটা অশ্রু বৃষ্টির ন্যায় টুপ করে পড়ল আদ্রর চোখে। নড়ে উঠল আদ্র। এই অশ্রু টা তুলির কষ্টের অশ্রু নয়। এটা তো আনন্দের অশ্রু। আকস্মিক তুলি ঝুঁকে পড়ল আদ্রর মুখের একদম সন্নিকটে। চোখ বুঝে ফেলল সাথে সাথেই। আদ্র গম্ভীর স্বরে বলে উঠল,,,

–চোখ খুল।
আস্তে আস্তে করে চোখ খুলল তুলি। দুরুদুরু বুক নিয়ে আদ্রর দিকে চেয়ে রইল। তুলিকে ছেড়ে দিয়ে উঠে পড়ল আদ্র। গালে হাত রেখে জিজ্ঞেস করল,,,
–কাঁদছিলে কেন?
–কাঁদছিলাম না। এমনিতে চোখে হঠাৎ পানি চলে আসল।
হাসল আদ্র। দৃঢ় কন্ঠে বলল,,
–উল্টো পাল্টা বকার অভ্যেস কি আজীবন থাকবে?
–আমি কখন উল্টো পাল্টা বকলাম?
তুলির সাহস যেন হুট করে বেড়ে গেল। তীর্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আদ্র বলে উঠল,,,
–তাই নাকি?আপনি উল্টো পাল্টা বকেন না কুমিল্লার তুলা?
–একদমই না।

কথাটা বলেই উঠে পড়ল তুলি। মুখের উপর আচড়ে পড়ছিল আদ্রর অসীম অনুভূতি মিশ্রিত ভারী নিঃশ্বাস যা তুলি কে গ্রাস করে নিচ্ছিল। আদ্রর মাদকতায় হারিয়ে যেতে বাধ্য করছিল। ছোট্ট হৃদপিণ্ডের দ্রুত উঠা নামা প্রক্রিয়া অস্বাভাবিক করে তুলছিল তুলি কে।এক দৌড়ে চলে গেল বারান্দায়। অবাক হল আদ্র। পিছু পিছু গেল তুলির। নিজেকে সামলে একটু আওয়াজ করে তুলি হেসে বলল,,,
–আমি উল্টো পাল্টা বকলে দোষ অথচ আপনি যে হুটহাট করে কসাই হয়ে যান।
চোখ গরম করে চাইল আদ্র। তুলি বুঝে গেছে রক্ষে নেই। লাফ দিয়ে নিজের বেলকনিতে যেতে নিলে আদ্র আঁতকে উঠল।

–এই তুলি পড়ে যাবা।
–কিছু হবে না ডাক্তার সাহেব। এতটুকু জায়গা লাফ দেওয়া আমার জন্য ছোট্ট খাট্টো ব্যাপার।
আদ্র নরম স্বরে ধীর কন্ঠে বলল,,,–“তোমার প্রাণটা আমার জন্য নিজের প্রাণের চেয়ে ও অধিক মূল্যবান। ”
রুমে আসতেই মেসেজ টোন ভেসে আসল আদ্রর কানে। মোবাইল টা হাতে নিয়ে মেসেজ টা ওপেন করতেই ঠোঁটে ফুটে উঠল রহস্যময় হাসি।

আকাশে তারার মেলা পর্ব ৩+৪

ডাইনিং টেবিলে বসে নাস্তা করছে সবাই। আদ্রর বাবা বিজনেস রিলেটেড কিছু কাজে দেশের বাহিরে গিয়েছেন। নিরবতা ভেঙে আমরিন সাহস জুগিয়ে বলে উঠল,,,
–আম্মু আমাদের কলেজ থেকে ট্যুরে নিবে দুই দিন পর।
খাওয়া বাদ দিয়ে মাথা তুলে চাইল তুলি। কই সে তো শুনে নি এমন কিছু? বেশ জোরেই বলল,,
–কই আমি তো এমন কিছু শুনি নি আমরিন।
এই ভয়টাই পাচ্ছিল আমরিন। যার জন্য এতোকিছু সেই পুরো প্ল্যানে জল ঢেলে দিতে প্রস্তুত। সন্দেহের চোখে মেয়ের দিকে চাইলেন সায়েরা বেগম। ঢকঢক করে পানি খেয়ে তুলির দিকে চেয়ে শুকনো হাসি হাসল আমরিন।

–তুলি তুই তখন ক্লাসে মনোযোগ দিস নি নাহলে তো স্যারের কথা গুলো শুনতে পেতি। থাক আমি তো শুনলাম। আমি শুনলে যেই তুই শুনলে তো একই কথা তাই না?
বিমূঢ় স্থির হয়ে বসে রইল তুলি। সায়েরা বেগম খেতে খেতে বললেন,,,
–ঠিক আছে দু জনেই চলে যাস। তুলির ও ভালো লাগবে ঘুরে আসলে।
তীব্র আনন্দ নিয়ে মা কে মিষ্টি হাসি উপহার দিল আমরিন। তুলি ভ্রু কুঁচকে মিনমিন করে উচ্চারিত করল,,,
“আমরিন তুই একটা ডাহা মিথ্যুক। ”

আকাশে তারার মেলা পর্ব ৭+৮