আকাশে তারার মেলা পর্ব ৯+১০

আকাশে তারার মেলা পর্ব ৯+১০
আসরিফা সুলতানা জেবা

ক্ষত বিক্ষত হৃদয়ে যেদিন থেকে আপনার আগমন
সেদিন থেকেই আমার আকাশে হাজারো তারার বিচরণ। ❞
বিষাদময় মন নিয়ে তুলি বাসে বসে আছে আমরিনের পাশে। বাস ছুটে চলেছে সুনামগঞ্জের লক্ষ্যে। মালনীছড়া চা বাগান থেকে ফিরে আদ্রর সাথে একটা কথাও বলে নি তুলি। আদ্র কে ফেইস করার সাহস টুকু আর নেই তার। আবেগের বশে বড্ড বড় ভুলে করে ফেলেছে সে। এমনটা করা উচিত হয় নি! আদ্র হয়তো খুব খারাপ ভাবছে তাকে। আদ্রর রাগী ফেইস টা চোখে ভাসলে এখনও কান্না পায় তার।

সারাদিন রুম থেকে বের হয় নি। আদ্র একবার ডেকে পাঠিয়েছিল আমরিন কে দিয়ে তবুও যায় নি। আদ্র ও ব্যাপার টা বুঝতে পেরে আর জোর করে নি। কেন যে মনে ভালোবাসার উদয় হল! কেন একবারও মনে হল না যে আদ্র ভালোবাসে না। একটু চিন্তা করলে নিজেকে সামলে নিলে হয়তো আজ এমনটা হতো না। আজ তুলির কাছে একটা কথা চরম সত্য মনে হচ্ছে তা হল—”আমরা এমন কাউকেই ভালোবেসে ফেলি যাকে আমরা কখনও পাবো না।” নিজের প্রতি নিজেই লজ্জিত তুলি। বাহির থেকে বাতাস এসে চোখে মুখে ছোঁয়া দিয়ে যাচ্ছে অনবরত। খোলা চুল গুলো ভীষণ বিরক্ত করছে। নিজের ছোট্ট ব্যাগ থেকে একটা রাবার ব্যান্ড বের করে চুল গুলো বেঁধে নিল তুলি। বিষন্ন মন নিয়ে আকাশের দিকে চোখ স্থির করল। আজকের চাঁদ টা একদম গোলাকার ও প্রশস্ত। আকাশ জুড়ে তারার ছড়াছড়ি। তুলির কাছে মনে হল আজ বোধহয় আকাশে তারার মেলা বসেছে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

হঠাৎই বুকটা শূন্যতায় ভরে গেল তুলির। মাথা ঘুড়িয়ে আড়ালে এক পলক চাইল আদ্রর দিকে। সিটে হেলান চোখ বুঁজে রেখেছে আদ্র। তুলির মন ছটফট করছে আদ্রর সাথে একটু কথা বলার জন্য। কিন্তু পারছে না সে। আদ্র ও যে সারাদিন একটু ও কথা বলে নি তার সাথে। আদ্রর আচরণে তুলি টের পাচ্ছে সে প্রচন্ড রকমের ভুল করে ফেলেছে। আদ্রর আচরণ তার বুকে অদৃশ্য ছুরি গাঁথছে যার প্রভাবে রক্ত ঝরছে অনবরত।কিছুতেই সহ্য করতে পারছে না তুলি অসহনীয় এ যন্ত্রণা। মাথা ঘুরিয়ে সোজা হয়ে বসল তৎক্ষণাৎ।

ধপ করে চোখ মেলে তাকাল আদ্র। আঁড়চোখে তুলি কে পর্যবেক্ষণ করছে শুরু থেকেই। তুলির অসহায় চাহনি ও যেন এক রাশ মায়ায় জড়ানো তার কাছে। নিজের মোবাইল বের করে তুলির আজকের ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকল নিষ্পলক। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি।নিম্নস্বরে ছবিটার দিকে তাকিয়ে বলল,,,
❝ যদি পরিস্থিতি অনুকূলে থাকত তবে নিজের সাথে মিশিয়ে নিতাম তোমায়। তুমি যে বছরের পর বছর আমার অস্তিত্বে উড়ে বেড়ানো এক সর্বনাশী তুলা। যাকে ছুঁতে গেলেও হাজার বাঁধা পেরোতে হয় আমার। তুমি আমার জীবনের এক সর্বনাশ। যেই সর্বনাশে তলিয়ে গেছে আমার মন। বিক্ষত হয়েছে আমার হৃদয়। ❞

খানিকক্ষণ আগেই রিসোর্টে এসেছে সবাই। রিমি, আমরিন, তুলি এক রুমে উঠেছে। ফ্রেশ হয়ে বাহিরে এল তুলি। রিসোর্টের সামনে একটা জায়গায় বসে চাঁদের আলোয় আড্ডা দিচ্ছে সবাই। একটা টুলে বসতেই তুলির চোখ পড়ল গাছের নিচে দাঁড়িয়ে স্মোকিং করা আদ্র কে। শেষ টান দিয়ে সিগারেট টা ফেলে দিল আদ্র। চোখ ঘুরাতেই চোখ পড়ল তুলির ছলছল চোখে। এক নজরে তাকিয়ে আছে তুলি যা কারোই চোখ এড়ায় নি। তুলির ঘন মেঘে ঢাকা মুখশ্রী সবাই কে জানান দিচ্ছে কিছু একটা ঘেটেছে আদ্র ও তার মাঝে। কিন্তু কেউ একটা প্রশ্ন ও করল না। সবাই জানে আদ্রই সামলে নিবে সব। তবুও নরমাল করার জন্য পায়েল ডেকে উঠল,,
“তুলি? ”

পায়েলের ডাকে স্বাভাবিক হল তুলি। চোখে টলটল করা পানি গড়িয়ে পড়ার আগেই মুছে নিল অবিলম্বে। মুখে হাসি টেনে পায়েল কে সম্মতি জানাল।
“তুৃমি তো আমাদের সবার ব্যাপারে জানোই না। তো একটু সবাই কে অন্যরকম ভাবে পরিচয় করাই তোমার কাছে দেখি ধরতে পারো কিনা?এটা একটা গেম ধরে নিতে পারো।খেলতে রাজি তো?”
–“অবশ্যই আপু।”
–“উদ্ভট উদ্ভট কথা বলে বেড়ায় আর মেয়ে দেখলেই দাঁত কেলিয়ে রাখে। এক সময় কলেজে মেয়েদের পিছু পিছু ঘুর ঘুর করতো। একবার এক মেয়ের বাড়িতে রাতের বেলায় দেখা করতে গিয়ে চোর ভেবে মানুষের কাছে গণপিটুনি ও খেয়ে এসেছে। কে হতে পারে?”
তুলি সাথে সাথেই হেসে জবাব দিল,,–“অন্তু ভাইয়া।”
সবাই ফিক করে হেসে উঠল। পায়েল ও মুখ চেপে হাসছে। অন্তু একবার চোখ রাঙিয়ে আবার হি হি করে হেসে দিল।পায়েল আবারও বলল,,

–“চুপচাপ থাকে। প্রয়োজন ছাড়া কথা কম বলে। ডাক্তার হিসেবে মন্দ নয়। কে সেই ব্যক্তি?
–“রিমি আপু।”
মুচকি হাসল রিমি। জোর গলায় বলল,,
–“আমি মোটামুটি না অনেক ভালো ডাক্তার বুঝেছিস পায়েল?”
–“জ্বি ম্যাডাম।” মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল,,,
—” চোখ দুটো মাদকতায় ভরপুর। গম্ভীরতা যেনো তার সৌন্দর্যের বিকাশ। তার এক চিলতে হাসি মেয়েদের জন্য ঘায়েল হওয়ার কারণ। তবুও তার আচরণে প্রকাশ পায় তাহার প্রেমে পড়া নিষিদ্ধ। ভুল করে পড়ে গেলেও খেতে হবে বলিষ্ঠ হাতের থাপ্পড়। ”
–“আদ্র”

ঘোর লাগা কন্ঠে লাফিয়ে বলে উঠল তুলি। সবাই একসাথে হেসে রসাত্মক সুরে বলে উঠল,,”ওহহ্ আদ্র!!!”
লজ্জায় এক মুহুর্ত না দাঁড়িয়ে ছুটে চলে এল তুলি। পিছে যে আদ্র ছিল সেটা ও খেয়াল করে নি। তুলির পিছু পিছু আদ্র ও এল ছুটে। রুমের দেয়ালে হেলান দিয়ে দু চোখ বুঁজে ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলতে লাগল। সারা মুখে গরম নিশ্বাস অনুভব করতেই আদ্র কে দেখে চমকে গেল তুলি। বিশ্বাস হচ্ছে না আদ্র ওর সম্মুখে দাড়িয়ে। চৌচির হয়ে যাওয়া মনে হঠাৎই যেন ঠান্ডা ঢেউয়ের দেখা মেলল। তৃষ্ণা মিটে গেল। পরক্ষণেই সকালের ঘটনা মনে পড়ে গেল। নিজেকে কিভাবে লুকাবে সেই চিন্তায় ডুবে গেল। কোনো উপায় না পেয়ে আদ্রর মোহনীয় দৃষ্টিতে দৃষ্টি রেখে বলল,,

–“সকালের জন্য আমি দুঃখিত ভাইয়া। আমি বুঝতে পারি নি এমন কিছু হয়ে যাবে।”
আদ্রর মুগ্ধময় চেহারা মলিন হয়ে গেল। এক পা পিছিয়ে দাঁড়াল তুলির থেকে। ঘাবড়ে গেল তুলি। হঠাৎ কি হল বুঝতে পারছে না। আদ্র আবার মেরে বসবে না তো? ভয়ার্ত মন নিয়ে আদ্রর চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। সাহস করে এগিয়ে গেল কিছুটা। আদ্র যেন এটাই চাইছিল। তুলির গালে এক হাত রেখে মধুর সুরে বলে উঠল,,,
–“সকালে কেন রাগ দেখিয়েছিলাম জানো?”
মাথা নাড়িয়ে না বুঝাল তুলি। তুলির হাত টা শক্ত করে ধরে কাছে টেনে নিল আদ্র। তুলির ডাগরডাগর আঁখিতে নিজের নীলাভ চোখে দুটো রাখল।

–” সকালে এই চোখে আকর্ষণ ছিল। নেশা ছিল যা হৃদয়ের গহীনে আঘাত করছিল। যার জন্য আমার এতো সাধনা, যার একটুখানি ভালবাসা পাওয়ার জন্য আমি তৃষ্ণার্ত তার চোখে ভালোবাসার বদলে আবেগ, নেশা সহ্য করতে পারি নি আমি। এখন চোখ দুটো তে সরলতা, ভালোবাসার সমাহার, এক রাশ লজ্জা। আকর্ষণ, নেশা এক সময় ফুরিয়ে যায়। কিন্তু ভালোবাসা আবেগের বশে হয় না। নেশা কেটে গেলে আমরা স্বাভাবিক হয়ে যায়। অথচ ভালোবাসা আমাদের কখনও স্বাভাবিক থাকতে দেয় না। ক্ষণে ক্ষণে বুকে ঝড় তুলে।

গভীর হতে থাকে। বিরাজ করতে থাকে হৃদয় জুড়ে। মানুষ টা হারিয়ে গেলে আমরাও হারিয়ে যায়। সুখ গুলো হারিয়ে যায়। স্মৃতির পাতায় সজীব থাকে চিরকাল। আমি আকর্ষণ বা নেশা কোনোটাই চাই না। আমি তো ভালোবাসা চাই তুলি যেন আমার শূণ্যতায় তোমার হৃৎস্পন্দন থেমে যাবে, বুকটা হাহাকার করে উঠবে বারে বার। নেশায় ডুবে না আমার ভালোবাসায় ডুবে তুমি আলিঙ্গন করে নাও আমায়। ”
টুপ করে অশ্রু ঝড়ে পড়ল তুলির চোখ থেকে। অনুভূতিরা ছুটাছুটি করছে অন্তর জুড়ে। ছোট্ট মন টা সেকেন্ডেই নিজেকে সাতাশ বছরের যুবতী ভাবতে লাগল।আদ্রর কথার মানে স্বচ্ছ পানির মতো পরিষ্কার মনে হল তার। ভুল ছিল না তার মন। বহু কাঙ্ক্ষিত জিনিসটা পেয়ে আজ হাসতে ভুলে গেল তুলি। অশ্রুসিক্ত নয়নে চাইল আদ্রর দিকে। অনুরোধের সুরে বলল,,,

–“আমায় একটু উঁচু তুলে দিবেন ডাক্তার সাহেব? আমি আপনার গাল টা নাগাল পাচ্ছি না। এতো লম্বা কেন আপনি?”
পায়ের উপর উঠে দাঁড়াতে ইশারা করল আদ্র। বিস্ময়ে জড়ীভূত হয়ে গেল তুলি। জড়তা-সংকোচ নিয়ে বলল,,,
–” আপনি আমার অনেক বড়। আপনার পায়ের উপর পা রাখলে বেয়াদবি হবে না?”
–“একদমই না তুলা। উঠো।”
জুতা জোড়া খুলে ফেলল আদ্র। খালি পায়ে তুলি উঠে দাঁড়াল আদ্রর পায়ের উপর। পড়ে যেতে নিলে কোমড় জরিয়ে নিজের সাথে মিশিয়ে নিল আদ্র। কাঁপা কাঁপা হাতে গালে হাত রাখল তুলি। খোঁচা খোঁচা দাড়িতে হাত বুলাতে লাগল। হুট করেই কেঁদে উঠল শব্দ করে। অসম্ভব যন্ত্রণা অনুভব করল আদ্র। উদ্বিগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,,,

–“কি হয়েছে তুলি?”
—“আপনি কি আমায় ভালোবাসেন আদ্র?”
—“সন্দেহ আছে?”
–“একদমই না।”
কথাটা বলেই আদ্রর কপালে কপাল ঠেকাল তুলি। এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল আদ্রর চোখের পাতায়। নিজের কম্পনরত ঠোঁট নিয়ে ঠেকাল আদ্রর কপালে। শীতল স্রোত বয়ে গেল আদ্রর শিরদাঁড়া বরাবর। লজ্জার ছাপ ফুটে উঠল তুলির চেহারায়। সরে আসতে নিলে কোমড় চেপে ধরে আরও কাছে টেনে নিল আদ্র। নিজের ওষ্ঠদ্বয় চেপে ধরল তুলির ওষ্ঠে। হৃদয়ের কম্পন প্রখর হতে লাগল তুলির। এমন অনুভূতি জীবনে আজ প্রথম! তুলি দু চোখ বুজে নিল অবলীলায়।

মিনিট পাঁচেক পর ছেড়ে দিল আদ্র। ছাড়া পেতেই তুলি মুখ লুকাল আদ্রর বুকে। নিমিষেই তুলির কাছে মনে হল পৃথিবীর সবচেয়ে শান্তির স্থান হয়তো এটা। আদ্রর হৃদপিণ্ডের স্পন্দন ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। কান পেতে মনোযোগ দিয়ে শুনতে লাগল তুলি। হয়তো পরিমাপ ও করতে পারছে। ভালোবাসার মানুষ টা কাছে থাকলে বুঝি এমনই হয়? আজ সকালেই কত কষ্ট পাচ্ছিল তুলি আর এখন এই রাতের আঁধারে প্রিয়তমের বুকে মাথা রেখে স্পন্দন পরিমাপ করছে।

রিমি,অন্তু,পায়েল, সাগর বসে বসে কথা বলছে। অন্তু চারদিকে চোখ বুলাল। মোলায়েম স্বরে জিজ্ঞেস করল,,
–“আমরিন ও নিবিড় কে দেখছি না যে?”
–“হবে হয়তো রুমে। ওদের ছাড়াও কিন্তু আরও দু’জন গায়েব।”–দুষ্ট কন্ঠে বলল পায়েল।
–“ওদের তো গায়েব হবারই কথা ভাই। এখানে আসা টাই কিন্তু ওদের জন্য। বহু কাঠখড় পুড়িয়ে কিন্তু এই সুযোগ টা তৈরি করেছে আদ্র। এবার একটু সব ঠিক হোক।”
–“একদম ঠিক বলেছিস সাগর। কিন্তু এখনও যে সবটাই বাকি!”
পাশ থেকে বলে উঠল রিমি।
–“আদ্রর মতো বিচক্ষণ মানুষ থাকতে কিসের চিন্তা ভাই? সোজা পথে নাহলে বাঁকা পথ টাই অবলম্বন করবে।”
–“হুম।”

আদ্রর কাঁধে মাথা রেখে বসে আছে তুলি। দুজনেই আকাশে তারা দেখছে। দূর থেকে ঝি ঝি পোকার ডাক ভেসে আসছে। রাতের বেলা বাহিরে বসে আকাশ দেখার তৃপ্তি একদম অন্যরকম। নীরবতা ভেঙে তুলি প্রশ্ন করল,,,
–“আপনি আমায় কবে থেকে ভালোবাসেন?”
–” বাইশ বছরের সেই যুবক বয়স থেকেই।”
সোজা হয়ে বসল তুলি। অবাক নয়নে চাইল আদ্রর দিকে। আদ্র তাকে পাঁচ বছর ধরে ভালোবাসে? তাহলে কোথায় ছিল এতোদিন? কেন সে আদ্র কে কোনোদিন দেখে নি?পাঁচ বছরের ভালোবাসা অথচ এতো দূরত্ব ছিল বছরের পর বছর। বিস্মিত তুলি কে একহাত দিয়ে বাহুতে জরিয়ে নিল আদ্র। প্রশান্তির নিঃশ্বাস ফেলে তুলির মাথায় চুমু খেল।

–” বাইশ বছর বয়সে যখন নানুর বাড়িতে যাই তখন প্রথম দেখি তোমায়। সচরাচর নানুর বাড়িতে যাওয়া হতো না আমার। কাউকে চিনতাম ও না ভালোভাবে। একটা টপস ও স্কার্ট পড়ে পুকুর পাড়ে খেলছিলে তুমি। ছোট্ট সেই তুমি টা কে দেখে অদ্ভুত মায়া জাগে আমার মনে। সারাদিন তোমাকে দেখেছি, তোমার কার্যকলাপ খেয়াল করেছি। নিজেও জানতাম না কেন এমনটা করেছি আমি। পরেরদিন সকালে তোমার পুকুরে পড়ে যাওয়ার কথা শুনে দৌড়ে গিয়ে ঝাপিয়ে পড়েছিলাম আমি।

তোমাকে পাড়ে তুলে অজানা কারণেই কেঁদে দিয়েছিলাম। অবাক হয়েছিল সবাই। প্রচন্ড অবাক। ছোট থেকেই তীব্র ব্যাথা পেলেও আমায় চোখের পানি থেকে ঝড়তে দেখে নি কেউ। সত্যি বলতে আমি নিজেও চমকে গিয়েছিলাম। এত বড় হয়ে ছোট্ট পিচ্চি একটা মেয়ের জন্য কেঁদে দিলাম। জানিনা কেন তোমার জ্ঞান হারানো ফ্যাকাশে মুখটা দেখে বুকে চাপা যন্ত্রণা অনুভব করছিলাম। ঢাকায় ব্যাক করার পর সারাক্ষণ তোমার কথাই মনে পড়ত। ছুটে যেতে ইচ্ছে করত তোমার কাছে। খেতে গেলেও মনে হতে খাবার টা হয়তো আমার জন্য বিষ। পড়াতে ও মন বসাতে পারছিলাম না অথচ সামনেই ছিল এক্সাম। আমার মনে হল আবেগে গা ভাসিয়ে দিচ্ছি আমি। এটা আবেগ ব্যতীত কিছুই না। কারণ,,

কারণ,এত্তো ছোট মেয়ের প্রতি কেন আমার ভালোবাসার অনুভূতি জাগবে? এটা ভালোবাসা না আমার বয়সের দোষ। সব ঝেড়ে ফেলে পড়াশোনায় মনোযোগ দিলাম। বলতে গেলে মনের সাথে কঠোর যুদ্ধে নেমেছিলাম আমি। চাপা দিয়েছি জাগ্রত অনুভূতি।পাক্কা তিন বছর পর আম্মুর সাথে আবারও যাওয়া হল নানুর বাড়িতে। যেতাম না কিন্তু নানা ভাইয়ের অসুস্থতার খবর শুনে বসে থাকতে পারলাম না। সেখানে গিয়ে দেখা মেলল আবারও সেই মেয়েটার। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিলাম মেয়েটার দিকে।

পুরোনো অনুভূতি জেগে উঠল নিমিষেই। মেয়েটা আগের মতো পিচ্চি ছিল না।অনেকটাই বড় হয়ে গিয়েছিল। সেই মুহুর্তে আমার অনুভূতি গুলো এক নতুন নাম পেয়েছিল। পরিণত হয়েছিল ভালোবাসায়। নতুন বললে ভুল হবে তা তো বছর খানেক আগেই হৃদপিণ্ডে সৃষ্ট হয়েছিল যাকে চাপা দিয়ে রেখেছিলাম আমি। নিয়তি যে আমায় আবার টেনে আনবে আমার হৃদয়ের গহীনে দমিয়ে রাখা ভালোবাসা জাগিয়ে তুলবে কখনও ভাবি নি।

আগের চেয়ে ও বেশি পাগল পাগল লাগছিল নিজেকে। বার বার নিজের মনে প্রশ্নের উদয় হতে লাগল কেন এতো মেয়েদের ভালোবাসার প্রস্তাব পেয়ে ও আমার হৃদয়ে নিজের চেয়েও দশ বছরের ছোট মেয়ের জন্য ভালোবাসার সঞ্চার হল! মেয়েটার সামনে আমি কখনও ধরা দেয় নি। আড়ালে ভালোবেসে গিয়েছি। সময় দিয়েছি তুলি নামক মেয়েটা কে আরেকটু বড় হওয়ার।
কথাগুলো বলে সূক্ষ্ম একটা নিশ্বাস ছাড়ল আদ্র। তুলি ফটাফট বলে বসল,,,

–“এতো ভালোবাসেন অথচ আমার বিয়ে টা আহান ভাইয়ার সাথে হতে দিচ্ছিলেন।”
আলতো হেসে আদ্র তুলির মুখের দিকে তাকাল। নিজের মোবাইল টা বের করে কল লাগালো কারো নাম্বারে। চোখ ছোট ছোট করে চেয়ে রইল তুলি। অপর পাশ থেকে ভেসে এল চেনা কন্ঠস্বর। প্রচন্ড অবাক হল তুলি। আদ্রর ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি।
–“কেমন আছিস আহান?”
–“আলহামদুলিল্লাহ ভাই। তোমরা কেমন আছো?আর তুলি টা ঠিক আছে তো?”
—“একদম ঠিক আছে।”

–“তুলি আমার ফোন ধরে না। ভীষণ কষ্ট হয়। খালা মণি মারা যাওয়ার পর তোমার কথা মোতাবেক যতটুকু পেরেছি আগলে রেখেছি। নিজের ছোট বোনের চেয়ে ও বেশি স্নেহ দিয়েছি। ওকে সবটা খুলে ও বলতে পারছি না যতদিন না অব্দি তুমি তোমার মনের কথা ওর নিকট প্রকাশ করো। আমি পারতাম আগেই বিয়ে টা ভেঙে দিতে কিন্তু ওর কাছে মিথ্যা বলার তো একটাই কারণ আগে বললে মামা কখনও মানতেন না।যেভাবে হোক বিয়েটা করিয়ে দম নিতেন। তাই তো বিয়ের দিনই মুখ্য চাল টা চালতে হল। ”
বাকরুদ্ধ হয়ে গেল তুলি। তাহলে সব আদ্রর প্ল্যান মোতাবেক হয়েছে। আদ্রর হাত শক্ত করে ধরল তুলি। চোখ বুঁজে ফেলল আদ্র। তুলির নখ গিয়ে বিঁধছে হাতে। তবুও যেন ব্যাথার বদলে পরম শান্তি অনুভব করছে আদ্র। ধীর কন্ঠে তুলি শব্দ করে উঠল।

–“আহান ভাই! ”
–“তুলি?”
–“হুম”
–“তুই ভাইয়ার পাশে আছিস? তুলি ফোন কেন ধরছিলি না বোন?”
–“তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ আহান ভাই। সেদিন বিয়ে টা না ভাঙলে আমি হয়তো এই মানুষ টা কে কখনও ভালোবাসতে পারতাম না। অনেক ধন্যবাদ তোমাকে।”
চোখ জলে টুইটুম্বুর হয়ে উঠল তুলির। কন্ঠটাও ভেজা। আহান হালকা হেসে জবাব দিল,
–” সবই আদ্র ভাইয়ার কৃতিত্ব তুলি। ওনি তোকে খুব ভালোবাসে। তোকে পাওয়ার জন্য কখনও ব্যাকুল হয় নি। জোর করে কেড়ে ও নিতে চায় নি। ধীরে ধীরে আগলে রেখেছে দিনের পর দিন। তোর ঢাকা যাওয়ার পিছনে ও আদ্র ভাইয়ার হাত। মামা তো,,”
সমাপ্ত করতে দিল না আদ্র। গম্ভীর স্বরে বলে উঠল,,

–“আহান এখন রাখছি। সচেতন হয়ে কথা বলা উচিত ভাই। কাল ফোন দিব আমি।ভালো থাকিস।”
কল টা কেটে দিয়ে তুলির দিকে তাকাতেই চোখে পড়ল তুলির অশ্রুসিক্ত নয়ন। আলতো করে চোখের পানি মুছে দিল আদ্র।
–“ঘুমাবে না?”
–“উহু! আমার ভয় হচ্ছে আদ্র। ”
–“কেন?”
–“কেউ কেঁড়ে নিবে নাতো আমার ভালোবাসা গুলো?”
–“কারো পক্ষেই সম্ভব না। আদ্রর ভালোবাসা তুলার-ই প্রাপ্য।”

তুলা ডাকটা শুনে টলটলে চোখ নিয়েই ফিক করে হেসে দিল তুলি। তুলি কে হাসতে দেখে আদ্রর ঠোঁটে ও ভেসে এল এক রাশ প্রশস্ত হাসি। নিশ্চুপ হয়ে তুলি জরিয়ে রইল আদ্রর বুকে। এক সময় ঘুমিয়ে গেল। তুলির কোনো রেসপন্স না পেয়ে কোলে তুলে নিল আদ্র। নিজের রুমে এনে শুয়ে দিল তুলি কে। ফ্রেশ হয়ে নিজে শুয়ে পড়ল সোফায়। অজানা আশঙ্কায় ঘুম ধরা দিচ্ছে না আদ্রর চোখে।

পাশ ফিরে তুলির দিকে তাকিয়ে রইল এক দৃষ্টিতে। ঘুমন্ত তুলি কে কোনো হরণকারী মনে হচ্ছে আদ্রর কাছে। এই যে নিজের ঘুমন্ত তৈলাক্ত চেহারায় হরণ করে নিচ্ছে আদ্রর হৃদপিণ্ড। দৃষ্টি স্থির করে রাখতেই মাঝ রাতের দিকে দু চোখ লেগে এল আদ্রর। আচমকাই নিজের উপর কারো ভর অনুভব করতেই হকচকিয়ে উঠল। সদ্য লেগে আসা চোখ দুটো টেনে খুলল বহু কষ্টে। ঝিম ধরে গেছে মাথা টা। চোখে ভাসমান হল তুলির ফ্যাকাশে মুখটা। কি সুন্দর করে মেয়েটা তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে! একটু নড়ে উঠল আদ্র। দু হাত তুলির পিঠে রেখে বলল,,,

–“এখানে কি করছো তুলি? বিছানায় যাও।”
–“উঁহু! ”
–“কেন?”
ঘুম ঘুম স্বরে তুলি জবাব দিল,,
–“আমি আপনার বুকে মাথা রেখে ঘুমাব আদ্র।”
গলা শুকিয়ে গেল আদ্রর। অসার হয়ে পড়ল হাত -পা।শুকনো কন্ঠে বলল,,,
–“এটা অন্যায় তুলি। প্লিজ খাটে গিয়ে ঘুমাও।”
–” আপনার বুকে ঘুমানো অন্যায়? ঠিক আছে আমি কখনও আপনার বুকে আসবো না। শূন্য থাকুক আপনার বাহু।”
স্তব্ধতা ঘিরে ধরল আদ্র কে। রক্তের ন্যায় টকটকে লাল হয়ে গেল দু চোখ। তুলি কে নিমিষেই মিশিয়ে নিল নিজের বাহুতে। চোয়াল শক্ত করে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,,

–” ফারদার এমন কথা বলবে না তুলি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তুমি আমার বুকেই থাকবে। আমি বেঁচে থাকা পর্যন্ত এ বুক কখনও শূন্য হতে দিব না। যদি কখনও তুমি বিহীন বুক টা শূন্য হয়ে যায় তবে নিঃশ্বাস টুকু ও হয়তো আমার সঙ্গ ছেড়ে দিবে।”
হতভম্ব হয়ে মাথা তুলে আদ্রর মুখ বরাবর মুখ তুলে চাইল তুলি। চোখে তার পানি চিকচিক করছে। হৃদয়ে ব্যাথা অনুভব হচ্ছে। আদ্র বিহীন যে এখন তুলি নিজেও বিলীন হয়ে যাবে। শত চেষ্টার পরেও চোখের জল বাঁধ মানে নি। টুপটুপ করে ঝরে পড়তে লাগল আদ্রর গালে। মাদকতায় ভরপুর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ঠোঁট প্রসারিত করল আদ্র।
–“এই ছিচকাদুনে মেয়ে। কান্না বন্ধ করো। মনের গহীনে তোমার কান্না গুলো রক্তের মতো ঝড়ে পড়ছে। রক্ত বর্ণ হয়ে উঠছে আমার হৃদপিণ্ড টা।”

নাক টেনে কান্না থামানোর চেষ্টায় তুলি। না পেরে আদ্রর বুকে নাক ঘষে চোখের পানি মুছল। কলিজা কেঁপে উঠল আদ্রর। যেই ছেলেটা একটু ডাস্ট দেখলেই পুরো বাড়ি মাথায় তুলত, কাপড় পরার ব্যাপারে সবসময় সচেতন থাকত, একটু খানি দাগ লাগলে মেজাজ চওড়া হয়ে যেত সেই গম্ভীর, সুন্দর, স্টাইলের ব্যাপারে সচেতন ছেলেটার বুকে হাঁটুর বয়সী একটা কিশোরী মেয়ে কতটা অবলীলায় নাকের পানি, চোখের পানি মুছতে ব্যস্ত। আদ্র নিজেও ভীষণ অবাক। আজ কেন তার শরীর ঘিনঘিন করছে না?

কেন অসম্ভব রকম ভালো লাগা সৃষ্টি হচ্ছে? কেন ক্ষণে ক্ষণে কেপে উঠছে কলিজা? ভালোবাসার কি এতোই জোর? মানুষ কে কেমন বেহায়া করে তুলে! বরফের মতো জমে যাওয়া মন টা কে গলিয়ে তরলে রূপান্তরিত করে দেয়। কঠিন হৃদয় ও কাঁপিয়ে তুলে। আর ভাবতে পারছে না আদ্র। এই মেয়েটা কে হারালে নিঃশেষ হয়ে যাবে সে। বুকের মাঝে লুকিয়ে রাখা ছাড়া আর তো কোনো উপায় দেখতে পাচ্ছে না এ মুহুর্তে। প্রেয়সীকে নিজ বাহুতে চিরদিনের জন্য আবদ্ধ করে নিতে সামনে যে ভাঙতে হবে দেয়াল। তুলি নাক টেনে কাঁদতে কাঁদতে আদ্রর বুকটা ভাসিয়ে দিয়েছে। আদ্র রসাত্মক ভঙ্গিতে বলে উঠল,,

–“অল্প বয়সী মেয়েদের এই এক সমস্যা। কিছু হতে না-হতেই পড়ে যায় কান্নার রোল। আবেগে টুইটুম্বুর থাকে মন যার ফলে কান্না টা ও হয় দীর্ঘক্ষণ। তা তুলা কাঁদতে কাঁদতে আজ বুঝি আমার বুকেই নদী বানাবে নাকি সাগর?”
তীক্ষ্ণ চোখে চাইল তুলি। সাথে সাথেই ভেসে এল আদ্রর কন্ঠ,,
–“এভাবে দৃষ্টিপাত করবে না তুলা। হৃদয়ে লাগে খুব। শেষ মেশ একজন হার্ট সার্জন হয়ে নিজেই না হার্ট এট্যাকে অক্কা পেয়ে যাই।”
আদ্রর মুখ এক হাত দিয়ে বেশ শক্ত করে চেপে ধরল তুলি। কান্নামিশ্রিত স্বরে বলে উঠল,,

–” আপনি বড্ড বেশি বকছেন আদ্র। আর এমনটা বলবেন না প্লিজ। আপনি হীনা যে আমি হারিয়ে যাব। আমার কোমল হৃদয়ে আপনি কেন ভালোবাসা জাগালেন দূরেই যখন যাবেন? কোথাও যেতে দিব না আমি। শাড়ি পড়ব। পড়ে আঁচলে আপনাকে বেঁধে রাখব আর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলব। আপনার ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে থাকব চিরদিন, চিরকাল, প্রতিটা মুহুর্তে। লোকে দেখে যেন বলতে পারে ইশ্ কতো ভালোবাসা! গভীর প্রণয়। আর ছেলেটা বড্ড বউ পাগল।”
মুহুর্তেই আদ্রর চোখে মুখে ফুটে উঠল উজ্জ্বলতা। তুলি কে মুগ্ধ হাসি উপহার দিয়ে বলল,,
–“তাই নাকি?”
–“একদম।”
আদ্রর চেহারার দিকে কিছুক্ষণ মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থেকে বলল,,

–“আপনি হাসলে এতো সুন্দর লাগে কেন আদ্র? ছেলেদের হাসি এতো মুগ্ধ হয়? আপনি হাসলে আমার বুকের বা পাশ টা ধুক করে উঠে। হৃদপিণ্ডে অসহ্য পীড়ন হয়। আপনি তো হার্টের ডাক্তার। যন্ত্রণার উপশম নাহয় আপনিই হবেন।”
ভয়ংকর প্রলয় হতে লাগল আদ্রর ভিতর। তুলির ভালোবাসাময় মিষ্টি মিষ্টি কথা ভিতর থেকে নাড়িয়ে দিচ্ছে তাকে। ঝাপটে ধরে তুলি কে চেপে ধরল নিজের বাহুতে। মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে উচ্চারিত করল,,,
–“ঘুমোও তুলি। সকালে উঠতে হবে তো।”
–“হুম।”

বসন্তের দুপুরে পাপড়ি মেলে থাকা শিমুলের রক্তিম আভা মন রাঙায় তো বটেই, ঘুম ভাঙায় সৌখিন হৃদয়ের। শিমুল বনের রক্ত রাঙা সৌন্দর্য দেখা মেলে বছরের একটি মাসে এবং তা হল–“বসন্ত। ” বসন্ত এলেই শিমুল গাছে ফুলে ফুলে ভরে উঠে। শিমুল বাগান যাদু কাটা নদীর তীরে অবস্থিত যা একশ বিঘার বেশি জায়গা জুড়ে বিস্তৃত। ওপারে ভারতের মেঘালয় পাহাড়, মাঝে যাদু কাটা নদী আর এপাড়ে শিমুল বাগান।সব মিলেমিশে গড়ে তুলেছে প্রকৃতির এক অনবদ্য কাব্য। এ যেন কল্পনার রঙে সাজানো এক শিমুল প্রান্তর।

প্রকৃতির চোখ ধাধানো এই সৌন্দর্য দেখে লাল শাড়ি পরিহিতা তুলি ও যেন মিশে যাচ্ছে প্রকৃতির রক্তিম আভায় ছেয়ে থাকা এই সৌন্দর্যের মাঝে। মিনিট দশেক হবে সবাই শিমুল বাগানে এসেছে। সাথে এসেছেন একজন গাইড। তখন থেকে তুলি চারপাশে তাকাচ্ছে ব্যস্ত ভঙ্গিতে। এতো সুন্দর ও কোনো জায়গা হয়? কখন থেকেই তুলির মন শুধু এটাই প্রশ্ন করে যাচ্ছে। পাশে শাড়ি পরিহিতা বাকি তিন রমণী ও ঘুরে ঘুরে দেখছে। হাতে টান পড়তেই সম্বিত ফিরে পেল তুলি। আদ্রর হাতে বন্দী তার একটা হাত। শিমুল গাছ গুলো থেকে চোখ সরিয়ে আদ্রর উপর স্থাপন করল তুলি নিজের দু চোখ। ড্যাবড্যাব চোখে চেয়ে রইল আদ্রর দিকে। মনে মনে বলে উঠল,,,

–“প্রকৃতি ও তো এমনভাবে টানে না আদ্র যেমন করে আপনার প্রতি টান অনুভব করি আমি। আপনি তো মোহময়। আপনাকে দেখলেই মনে শীতলতা অনুভব হয়। লাল রাঙা শিমুলের চেয়ে লাল রাঙা আদ্রই মনোমুগ্ধকর।”
তুলির দিকে অপলক নয়নে চেয়ে আছে আদ্র। তুলি কে শাড়ি তে লাল টুকটুকে বউ মনে হচ্ছে তার। শুধু ঘোমটা টাই বাকি। তুলি কে টেনে নিজের দিকে ফিরাল সে। শাড়ির আঁচল টা টেনে ঘোমটা দিয়ে দিল মাথায়। ভীষণ অবাক হল তুলি। পাশাপাশি লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠল। চোখে মুখে ও ফুটে উঠল লজ্জার ছাপ। আদ্রর সাথে আরেকটু ঘেঁষে দাঁড়াল। ফিসফিস করে বলল,,,

–“আপনি লাল পাঞ্জাবি কেন পড়েছেন আদ্র?”
তুলির ফিসফিস করে বলা বাক্যটা শুনে কিছুটা ঝুঁকল আদ্র। মেয়েটার কন্ঠস্বর টা ও আজকাল পাগল করে দেয় তাকে। আস্তে করে জবাব দিল,,,
–” তুলার সাথে একটু ম্যাচিং করে পড়ার চেষ্টা। ”
—” লাল শাড়ি, লাল পাঞ্জাবি-ই আনতে হলো আপনার? আপনি কি জানেন আপনি আমায় বিমোহিত করছেন, অভিভূত করছেন, এক রাশ মুগ্ধতায় জড়িয়ে নিচ্ছেন, নিজের মাঝে হারাতে বাধ্য করছেন?”

–“জানতাম না তবে এখন জানতে পারলাম।আমার মাঝে হারানোই তোমার মঙল। খুঁজে নিয়ে হৃদয় কুঠীরে লুকিয়ে রাখব যত্ন করে।”
আর কিছু না বলে তুলি আদ্রর এক হাতের বাহু জরিয়ে হাঁটতে লাগল। সবাই আলাদা আলাদা হয়ে ঘুরে ঘুরে দেখছে। আমরিন ও নিবিড় হাটছে পাশাপাশি। শাড়ি তে আমরিন কে একুশ বছরের যুবতি লাগছে নিবিড়ের কাছে। নীরবতা ভেঙে আমরিন বলল,,,
–“নিবিড় ভাই আমি কাকে ভালোবাসি আপনি কি জানতে ইচ্ছুক না?”

আবারও সেই কথা। মেয়েটার বড্ড বেশি সাহস। রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে এল নিবিড়ের। আমরিন কে ঠাটিয়ে একটা চড় মারতে পারলে হয়তো এ মুহুর্তে বেশ স্বস্তি পেত সে। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে অন্যদিকে চলে যেতে নিলে হাতটা ধরে বাঁধা প্রদান করল আমরিন। চমকে গেল নিবিড়। ফিরে তাকাতেই চোখে পড়ল চশমার নিচে লুকিয়ে থাকা আমরিনের মোহময় দৃষ্টি। দৃঢ় কন্ঠে আমরিন বলে উঠল,,,
–“যদি বলি আপনাকে ভালোবাসি?”
বিলম্ব না করে আমরিন কে টেনে নিজের কাছে নিয়ে এল নিবিড়। আমরিনের কপালে আসা অবাধ্য চুল কানের পিছনে গুঁজে হালকা হেসে বলল,,,

–“তবে আমাকেই ভালোবাসতে হবে চিরকাল। ”
আলতো হেসে আমরিন সায় জানিয়ে বলল,,
–“রাজি আছি।”
আদ্র ও তুলি কে পাশাপাশি হাঁটতে দেখে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল রিমি। পাশ থেকে ভেসে এল পুরুষালি কন্ঠস্বর
–“জেলাস ফিল হয় না?”
রিমি আনমনেই উত্তর দিল,,
–“না। আমার কাছে ভালোবাসা মানে ত্যাগ। ত্যাগের মাধ্যমে যে এতো সুখ আছে এমন দৃশ্যটা না দেখলে কখনও উপলব্ধি করতে পারতাম না। ভালোবাসলেই কি পেতে হবে? থাকুক না আমার এক তরফা ভালোবাসা আমার মন মাঝারে। সুখী হোক ওরা দু’জন। ”
–“চিরকুমারী থাকবি?”

আকাশে তারার মেলা পর্ব ৭+৮

প্রশ্ন টা কর্ণগোচর হতেই হুঁশ এল রিমির। পাশ ফিরে তাকাতেই চোখে পড়ল সাগরের হাসোজ্জল চেহারা টা। ছেলেটা কিভাবে বুঝে গেল তার চাহনি? তার মনের কথা? মুখে হাসি বজায় রেখে বলল,,,
–” না। চিরকুমারী থাকব না। আমিও একটা সংসার চাই। একটা মানুষ কে বলতে চাই ডাক্তার আদ্র আহনাফ কে আমি কতোটা ভালোবাসতাম, কতটা বাসি। ”
–“আমার অর্ধাঙ্গিনী হবি?”–সাগরের সোজাসাপ্টা প্রশ্ন।
থমকাল রিমি। একটু হেসে বলল,,,

–“তোর মতো ইঁচড়েপাকার কাছে বিয়ে বসতে আমার বয়েই গেছে। প্রেম তো কম করিস নাই। তা তোর গার্লফ্রেন্ড গুলোর কি বিয়ে হয়ে গেছে? সেই বিরহে বুঝি আমাকে প্রস্তাব দেওয়া?”
—” প্রেম কম করি আর বেশি আজকাল হঠাৎ করে ভালোবাসার উদয় হয়েছে তোর প্রতি। আজকাল বললে ভুল হবে গত একটা বছর ধরে তোর ভালোবাসায় ঘায়েল হচ্ছি আমি। বিয়ে তো বসবি তাই না? অন্য কারো হওয়ার চেয়ে আমার হলে কি মন্দ হয় রিমি?
সাগরের কন্ঠে আকুলতা দেখে রিমি স্তব্ধ হয়ে গেল। একটু হেসে বলল,,,
–“ঢাকা ব্যাক করে প্রস্তাব পাঠিয়ে দিস বাসায়।”

ভয়াবহ এক কান্ড ঘটিয়ে নাকের পানি চোখের পানি এক করে ফেলেছে তুলি। তুলির কান্নারত চেহারা দেখে অস্থির হয়ে পড়েছে আদ্র। রাগ ও হচ্ছে প্রচন্ড। কেন যে মেয়েটা এতোটা পাগলামি করে? রাগের মাত্রা ক্রমশ বেড়েই চলেছে আদ্রর। তুলির চোখের পানি ছুরির মতো গাঁথছে তার বুকে। নিজেকে শান্ত করে,,,

আকাশে তারার মেলা পর্ব ১১+১২