আকাশে তারার মেলা পর্ব ১১+১২

আকাশে তারার মেলা পর্ব ১১+১২
আসরিফা সুলতানা জেবা

নিজেকে শান্ত করে হাঁটু গেড়ে নিচে বসল আদ্র। সবাই হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তুলির কান্ডে হাসবে নাকি কাঁদবে বুঝতে পারছে না। রাগ ঝেড়ে তুলির পায়ে হাত দিল আদ্র। সাথে সাথেই প্রচন্ড জোরে চিল্লিয়ে উঠল তুলি। ব্যাথায় চোখ খিঁচে পা সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতেই গম্ভীর স্বরে ধমকে উঠল আদ্র। ভয়ে চুপসে গেল তুলির মুখ। কিন্তু চোখে মুখে ব্যাথার প্রভাব স্পষ্ট। আদ্র আঁড়চোখে এক নজর তাকিয়ে হাত টেনে কোলে তুলে নিল । চোখ বন্ধ রেখেই আদ্রর গলা জরিয়ে ধরল তুলি। ভাবতেই ভীষণ লজ্জা লাগছে তার কি কান্ড টাই না ঘটল একটু আগে। কেন যে শুনল না আদ্রর কথা? অতিরিক্ত বেপরোয়া হলে হয়তো এমনটাই হয়।
কিছুক্ষণ আগে,,

আদ্রর সাথে পাশাপাশি হাঁটছিল। হুট করেই তুলি সামনে একটা পাখি দেখে দৌড় লাগাল। পিছন থেকে আদ্র অনেক ডেকেছে একটু ও শুনে নি মেয়েটা। বার বার চিল্লিয়ে বলেছে আস্তে দৌড়াতে নয়তো শাড়িতে পা ভেজে পড়ে যাবে। কিন্তু কথাগুলো যেন উচ্ছ্বসিত তুলির কর্ণধার হয় নি। আরেকটু বেগ বাড়াতেই ধপাস করে মুখ থুবড়ে পড়ল মাটিতে। নাকে ও পায়ে প্রচন্ড ব্যাথা পেল। জড়তা, লজ্জায় বুকের ব্যাথা ও তীব্র হল। ব্যাথার দাপটের চেয়ে লজ্জায় কাঁদতে লাগল ক্রমশ। সবাই একটু আকটু হাসলেও আদ্রর হাসির বদলে রাগটাই তীব্র।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আদ্রর রাগী ফেইস দেখে তুলির সেই স্মরণীয় থাপ্পড়ের কথা মনে পড়ে গেল। কেন অবাধ্য হল আদ্রর কথার? এখন নিশ্চয়ই রিসোর্টে নিয়ে আরও একটা স্মরণ রাখার মতো ঠাটিয়ে চড় মারবে। ভয়ে থরথর করে কাঁপছে তুলির পুরো শরীর। ভয় টা একটু কমানোর চেষ্টায় আদ্রর বুকে মাথা রেখে চুপ হয়ে রইল। বাকি সবাই এখনও থ মেরে দাড়িয়ে আছে। হঠাৎ অন্তু হেসে বলল,,,
–“যা হয় ভাই ভালোর জন্যই হয়। নইলে কি এমন রোমান্টিক দৃশ্য দেখার সুযোগ পেতাম?”
কপাল কুঁচকে তাকাল পায়েল। অন্তু চুপসে যেতেই এক রাশ হেসে বলল,,

–“এই প্রথম তুমি ভালো একটা কথা বলেছো অন্তু। ”
অট্টহাসিতে মেতে উঠল সবাই। পা চালিয়ে ছুটল আদ্র ও তুলির পিছু পিছু।
রিসোর্টে এনে তুলি কে ধপ করে বিছানায় বসাল আদ্র। ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠল তুলি। তাতে যেন কোনো খেয়াল নেই আদ্রর। ব্যাগ থেকে ফাস্ট এইড বক্স বের করে টুল টেনে বসল তুলির সামনে। সংশয় নিয়ে আঁড়চোখে চাইল তুলি। তার মন বলছে আদ্র বক্স টা দিয়ে তার মাথা ফাটিয়ে ফেলবে এখন। নিজের বাচ্চাসুলভ আচরণে এখন নিজেই প্রচন্ড বিরক্ত সে। নাক ও ফাটাল, পা টা হয়তো ভেঙেই গেছে আবার বিনা টিকেটে সবাই কে কমেডি শো দেখিয়ে দিল। সর্বশেষে এখন বোধহয় মাথা টা হারাতে যাচ্ছে। আদ্র হাত টা বাড়াতেই ভয়ে কেঁদে উঠল তুলি।

–“আমার মাথা ফাটাবেন না আদ্র। আমি আর কখনও আপনার কথার অবাধ্য হব না।”
তুলির ভাঙা গলায় অদ্ভুত এসব কথা শুনে রাগটা দ্বিগুণ হয়ে গেল আদ্রর। তুলো নিয়ে নাকের রক্ত টা ক্লিন করতে করতে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,,,

–“কান্না থামা। নয়তো আজ তোর কপালে শনি আছে। আমার ভালো-মন্দ দুই রূপ সম্পর্কেই তুই অবগত। এখনই কান্না থামা।”
আদ্রর কথা শুনে কান্না থামানোর আপ্রাণ চেষ্টায় লেগে পড়ল তুলি। শক্ত করে আঁকড়ে ধরল আদ্রর বুকের কাছের অংশ। দু চোখ বুঁজে ফেলল। তুলির স্পর্শ পেতেই হৃদয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল আদ্রর। নিমিষেই গায়েব হয়ে গেল রাগ টা। যত্ন করে তুলির নাকে অয়েন্টমেন্ট লাগিয়ে ফু দিল তুলির বন্ধ দু চোখের পাতায়। শিউরে উঠল তুলির সারা শরীর। আরেকটু শক্ত করে খামচে ধরে রাখল আদ্র কে। ঘন ঘন দু চোখের পলক ঝাপটিয়ে চোখ মেলে তাকাল আদ্রর দিকে। আদ্রর নীল বর্ণের চোখ জোড়া নিজের উপর সীমাবদ্ধ দেখে স্তম্ভিত হয়ে পড়ল তুলি। হৃদয় জুড়ে হতে লাগল ভয়াবহ ঝড়। আদ্রর বুক থেকে হাত সরিয়ে কিছুটা পিছে হেলে গেল। মুচকি হেসে আদ্র নিজের ঠোঁট ছোঁয়াল তুলির নাকে। একটা কথা মনে পড়তেই দাঁত কেলিয়ে তুলি বলে উঠল,,,

__”বান্ধবীদের কাছে শুনতাম বয়ফ্রেন্ড চুমু খেলে নাকি জ্বর ও চলে যায়। আপনি কি আমার নাকের ব্যাথা কমানোর জন্য চুমু খেয়েছেন আদ্র?”
বিস্ময়কর দৃষ্টিতে তাকাল আদ্র। তুলির মুখে এমন এক বাক্য শুনে অবাক হয়ে পড়ল। এই মেয়ে বয়সে মনের দিক সবদিক দিয়েই একদম বাচ্চা। নিজের ব্যাগ থেকে ইনজেকশন বের করতে করতে আদ্র ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে জবাব দিল,,,
–“যদি চুমু তেই ব্যাথা কমে যায় তাহলে ইনজেকশনের কি দরকার বলো? এজ অ্যা ডক্টর আমার মতে ইনজেকশন টা দিলেই ব্যাথা কমবে চুমু তে নয়।”

ইনজেকশন দেখে মাথা ঘুরে গেল তুলির। ভয়ে শুকিয়ে গেল গলা। আমতা আমতা করে বলল,,,
–“আমি ইনজেকশন দিব না। আমায় ইনজেকশন দিতে এলে খুব খারাপ হবে কিন্তু। ”
মুখে বাঁকা হাসি ফুটে উঠল আদ্রর। সাবলীলভাবে জিজ্ঞেস করল,,
–“কি হবে শুনি?”
–“আমি কামড়ে দিব আপনাকে। ছোট বেলায় আমি এক ডাক্তারের হাতে কামড় বসিয়ে দিয়েছিলাম। কারণ ওনিও আপনার মতো ইনজেকশন দিতে আসছিল।”
—“তা কোথায় কামড়াবে? গালে,ঠোঁটে? ”

কথা টা বলতে বলতে তুলির হাত টা চেপে ধরতেই সজোরে কামড় বসিয়ে দিল তুলি আদ্রর বুকে। বিস্ময়ে হতবিহ্বল হয়ে গেল আদ্র। সে তো ভেবেছিল তুলি হয়তো মজা করছে কিন্তু সত্যি সত্যিই কামড় বসিয়ে দিল। হাত থেকে ইনজেকশন টা পড়ে গিয়ে হালকা শব্দ করল। তুলির দুই বাহুতে ধরে টেনে বুক থেকে সরিয়ে আনল। বুকে প্রচন্ড বেগে দ্রিমদ্রিম শব্দ হতে লাগল তুলির। নিজের আচরণের উপর এখন নিজেই বিস্মিত তুলি। এখন মনে হচ্ছে বয়স যতই হোক মনে ম্যাচুরিটি আনা টা বেশ জরুরি। নয়তো এই যে এসব অদ্ভুত অদ্ভুত কান্ড করে বসে আদ্র হয়তো তাকে বেহায়া মেয়ের আখ্যায়িত দিতে পারে। নিজের মাথা তুলে তাকাতেও অস্বস্তি হচ্ছে তুলির। আদ্রর কথায় মাথা তুলতে বাধ্য হল। চোখে পড়ল আদ্রর রাগান্বিত দৃষ্টি। সাথে সাথেই অন্তর আত্মা কেঁপে উঠল।

–“আমায় কামড় দিয়ে দেখিয়ে দিলে তোমার দাঁত কতো দারালো তাই না?”
নিশ্চুপ হয়ে বসে রইল তুলি। আচমকা আদ্র কে শার্টের বোতাম খুলতে দেখে কলিজা মোচড় দিয়ে উঠল। চোখ ফিরিয়ে নিল লজ্জায়। কানে আসল আদ্রর রাগী কন্ঠের সুর,,
–“এই মেয়ে এদিকে তাকাও।”
এখনও নিশ্চুপ তুলি। লাল রাঙা মুখ নিয়ে ফিরে চাইল আদ্রর দিকে। প্রথমেই চোখ পড়ল আদ্রর ফর্সা উম্মুক্ত বুকে রক্তে কিছু টা লাল হয়ে যাওয়া স্থানে। বুক টা ধুক করে উঠল সাথে সাথেই। কি করল এটা? তুলির ছোট্ট মনে এক ফালি লজ্জা যেন উড়ে এসে জড়ো হয়ে বসল। বহু কষ্টে আদ্রর চোখের দিকে চাইতেই আঁতকে উঠল। আজ আর নিস্তার নেই। নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারল তুলি। তীক্ষ্ণ নজরে চেয়ে আছে আদ্র।

–“আমার বুক রক্তাক্ত করার শাস্তি তোমায় পেতে হবে।”
শাস্তির কথা শুনেই ঢোক গিলল তুলি। আদ্রর দিকে করুন চোখে তাকাতেই বলে উঠল,,
–” গুণে গুণে দশ টা চুমু দিবে তুমি আমার বুকের ক্ষত জায়গা তে। নয়তো আমি গুণে গুণে ঠিক দশটা থাপ্পড় লাগাব তোমার গালে।”
অবলীলায় কথা গুলো বলে চোখের দৃষ্টি তুলির উপর স্থির রেখেই বসে রইল আদ্র। বেলুনের মতো চুপসে আছে তুলির মুখটা। মনে হল যেন জোর করে তাকে কেউ করলার জুস খাইয়ে দিয়েছে।

মনে মনে ভীষণ হাসি পেল আদ্রের। মেয়ে টা কে জ্বালাতে এখন খুব ভালো লাগে তার। ছোট্ট তুলি যখন লজ্জায় মুখটা কে নিচু করে ফেলে তখন তার খুব ইচ্ছে হয় নিজের সাথে মিশিয়ে নিতে। বুকের মাঝখানে লুকিয়ে ফেলতে। লুকাবে খুব শীগ্রই মেয়েটা কে আবদ্ধ করে ফেলবে নিজের বাহুদ্বয়ে। দরকার হলে সবকিছু ধ্বংস করে দিবে তবুও এই মেয়েটা কে চায় তার। তপ্ত একটা নিঃশ্বাস ছাড়ল। তুলির কানে আদ্রের কথাটা এখনও প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। চোখ জোড়া বুঁজে আদ্রর বুকের কাছে মুখ নিয়ে বলল,,,
–“আপনি কিন্তু তাকাবেন না আদ্র। আপনি তাকালে আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে। প্লিজ চোখ দুটো বন্ধ করে রাখবেন। কোনো ক্রমেই অবলোকন করবেন না আমাকে।”

তুলির শ্রুতিমধুর লজ্জিত স্বর কর্ণকুহর হতেই আদ্রর চোখ জোড়া বন্ধ হয়ে এল আবেশে। কিছু সেকেন্ডের ব্যবধানেই অনুভব করল নরম ঠোঁটের স্পর্শ। ঠোঁটের কোণে প্রতীয়মান হল এক তৃপ্ততার মৃদু হাসি। পর পর দশ দশটা চুমু দিয়ে সরে এল তুলি। নিজের দু হাত দিয়ে ঢেকে ফেলল শ্যামলা মুখশ্রী। আদ্র ও বসে থাকতে পারল না। মজা করতে গিয়ে নিজেই ফেঁসে গেল ভালোবাসার স্নিগ্ধ সম্মোহনে। ঘোর কাটতেই বেরিয়ে এল রুম থেকে। নিজের ফোন বের করে স্ক্রিনে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল আদ্র। মেসেজ ও কলের ভিড়। সায়েরা বেগম ফোন দিয়েছেন অনেক গুলো। ফোন ব্যাক করতেই ওইপাশ থেকে সায়েরা বেগম বলে উঠলেন,,,

–” তোর সেমিনার কবে শেষ হবে আদ্র? এই মাসে দু দু’বার সেমিনার। ইনশিতার বিয়ের ডেট ঠিক করতে আসবে পরশু রনকের ফ্যামিলি। তুই আসলে ভালো হতো। তুই তো জানিস,,,
–” বুঝেছি আম্মু। আর বলতে হবে না। কাল রাতে বাসায় থাকব। রাখছি।”
ভারী গলায় শেষ কথাটা বলে ফোনটা রেখে দিল আদ্র। বুক চিরে বেরিয়ে এল দীর্ঘশ্বাস। চোখে মুখে পানি দিয়ে তুলির কাছে আসল ফের। তুলি এখনও লজ্জায় মুখ ঢেকে রেখেছে। মিনমিন করে আদ্র বলে উঠল,,–
“তুমি আমার প্রশান্তির আরেক নাম তুলা। যতদিন পর্যন্ত এ হৃদয়ে তোমার বিচরণ চলবে ততদিন পর্যন্ত সুস্থ থাকব আমি। শান্তি বিরাজ করবে আমার অস্তিত্ব জুড়ে।”

পায়ে কারো স্পর্শ অনুভব করল তুলি। অনুভূতি গুলো মনে নাড়া দিতে লাগল অনবরত। এক হাত সরিয়ে আদ্র কে দেখতেই কিছু টা আওয়াজ করে বলল,,
–“কি করছেন আদ্র? পায়ে হাত দিবেন না প্লিজ। ”
–” এতো ফর্মালিটি অথবা সংকোচ বোধের কিছুই নেই তুলা। আমি তোমার পায়ে হাত দিতেই পারি। কারণ ফার্স্ট ইয়ার ফাইনাল এক্সাম শেষ হলেই বিয়ে করছি আমরা।তখন তো তোমার আঠারো হয়ে যাবে। হবু স্বামী বউয়ের সেবা করতেই পারে তাই না?”
“বউ” শব্দ টা এতো মধুর হয়? নাকি আদ্রর মুখেই এতো মধুর শুনাচ্ছে? চোখের পলকেই যেন তুলি এক সংসার কল্পনা করে ফেলছে। তবুও ভয় লাগছে তার। নরম কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,,,

–“খালা মণি, খালু সবাই মানবে তো?”
–“আমায় বিশ্বাস করো তো?”
পায়ে মালিশ করতে করতে প্রশ্ন টা তুলির দিকে ছুঁড়ে দিল আদ্র। তুলির ঠোঁটে প্রশস্ত হাসি। লম্বা একটা শ্বাস টেনে বলল,,
–“আপনাকে বিশ্বাস করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই আমার। যার প্রেমের মোহনায় হারিয়েছি আমি সেই তো আমার শেষ অবলম্বন। আপনি ঠকালে চিরতরে বিলীন হয়ে যাব। কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস আপনি কখনও ঠকাবেন না আমায়। আপনার ভালোবাসার তুলনায় আমার কিছুদিনের ভালোবাসা অতি নগন্য। বছরের পর বছর আড়ালে সার্থহীন ভাবে যে আমায় ভালোবেসেছে সে কখনও ঠকাতেই পারে না।”

–” আমরা আজ ঢাকা চলে যাব তুলি। একটা অনুরোধ থাকবে তোমার কাছে কেউ যেন না জানে আমি ও তুমি সিলেট ছিলাম। ”
–“কখনও বলব না। সিলেট শহর টা কে ও ভুলতে পারব না। আমাদের দু জনকে ভালোবাসায় সিক্ত করার অবদান কিন্তু এই শহরের অনেক। এই শহরের চেয়ে ও বেশি আপনার।”
তুলির কপালে আলতো করে ভালোবাসার স্পর্শ একে দিল আদ্র। কপালে কপাল ঠেকিয়ে ঘোর লাগা কন্ঠে বলল,,
–“ভালোবাসি তোমায় তুলি। খুব বেশি ভালোবাসি। ”

চোখের কার্ণিশে জমা হল জল। “ভালোবাসি” শব্দ টা তুলির তৃষ্ণা বাড়িয়ে দিল শতগুণ। সুখের জমায়িত পানি কোনো বাঁধা না মেনে গড়িয়ে পড়ল গাল বেয়ে। শুষে নিল আদ্র। গালে ও একে দিল ঠোঁটের গভীর ছোঁয়া। তুলির ইচ্ছে করছে সময় টা থমকে যাক। সারাজীবন আঁটকে থাকুক এই পরম শান্তির সময়টায়। ভালোবাসায় মেতে থাকুক সবটুকু প্রহর। থেমে গেলে কি খুব খারাপ হবে? থেমে যাক না সময়টা। লেপ্টে থাকুক তুলি সারাটা কাল এভাবেই আদ্রর বুকে।

রাতের আঁধারে ক্লান্ত তুলি ঘুমে মগ্ন আদ্রের বাহুতে। সিলেট থেকে ঢাকা এসে পৌঁছাল খানিকক্ষণ আগেই। লং জার্নি তে ক্লান্ত হয়ে পড়ে তুলি। গাড়ি এসে থামল সাগর দের বাসার সামনে। তুলি কে ধীর কন্ঠ ডাকল আদ্র। একটু নড়েচড়ে তুলি আবারও ঝাপটে ধরল আদ্র কে। ঘুমের ঘোরে যে মেয়েটা কি করছে সে যদি বুঝত তাহলে লজ্জায় মরে যেত। মাথায় হাত বুলিয়ে আবারও ডাকতেই আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসল তুলি। ঘুম ঘুম চোখে চারপাশে চোখ বুলাতেই গাড়ির বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল সবাইকে। জায়গা টাও বেশ অপরিচিত তার নিকট। আদ্রর দিকে তাকাল জিজ্ঞাসা সূচক দৃষ্টিতে। আদ্রর ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি বহমান। তুলির সচেতন মন বলে উঠল,,

–“তুলি তোর ডাক্তার সাহেব এতো হাসে কেন? ওনার তো গুমরো মুখো হওয়া উচিত ছিল। দেখিস এই হাসিতে ঘায়েল হয়ে কোন মেয়ে না জানি তোর কাছ থেকে কেঁড়ে নেই ওনাকে।”
ভাবান্তর হতেই তুলি হাত বাড়িয়ে শক্ত করে জরিয়ে ধরল আদ্র কে। ভ্রু কুঁচকাল আদ্র। কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,,
–“কি করছো তুলা? বাহিরে সবাই ওয়েট করছে তো পরী। আমাকে ছেড়ে একটু বাহিরে চলো।”
তুলির অবাধ্য মন বলে উঠল,,
–“আপনি এতো সুন্দর অথচ পরী ডাকছেন আমায়? ”

–“শ্যামবতী হলেও আমার হৃদয়ের গহীনে আবদ্ধ হওয়া রূপবতী কন্যা তুমি। তোমার এই মায়ায় জরিয়েই তো ডেকে এনেছি নিজের সর্বনাশ। তোমায় ছাড়া নিশ্বাস টুকু নেওয়া কষ্টকর হয়ে যায়। ”
লাজুক তুলি ছেড়ে দিল আদ্র কে। খুব করে বলতে ইচ্ছে করল,,–“এমন হৃদয় নাড়িয়ে দেওয়া কথা কেন বলেন আদ্র? আপনি কি দেখতে পান না আমার মনটা দিন দিন অসুস্থ হয়ে পড়ছে? কঠিন অসুখে ভুগছে।”
আদ্রর সাথে গাড়ি থেকে বেরিয়ে এল তুলি। পায়েল ও রিমি তুলি কে জড়িয়ে ধরল শক্ত করে। মুচকি হেসে বলল,,
–“আবারও দেখা হবে কিউটি।”

আমরিন ইশারায় নিবিড় কে বিদায় জানাল। আদ্র আজ সাগর দের বাসায় থাকবে। ড্রাইভার কে ভালোভাবে পৌঁছে দিতে বলল ওদের।সবাই কে বিদায় জানিয়ে তুলি গাড়িতে উঠতে যেয়েও ফিরে তাকাল আদ্রর দিকে। কালই তো আদ্র বাসায় যাবে তবুও সামান্য একটু দূরত্ব যেন তুলি মেনে নিতে পারছে না। বার বার দ্বিখণ্ডিত হয়ে যাচ্ছে মন। আশঙ্কা জাগছে প্রিয় মানুষ টা কে হারিয়ে ফেলার। করুন চোখে চেয়ে দিক বিদিক ভুলে দৌড়ে গিয়ে ঝাপটে ধরল আদ্র কে। ফুপিয়ে কেঁদে উঠল। অস্বাভাবিক কন্ঠে বলে উঠল,,,

–“আমি যাব না আদ্র। আপনিও চলুন প্লিজ। আপনাকে ফেলে যেতে মন সায় দিচ্ছে না। এতটুকু দূরত্ব ও আমার মনে আঘাত করছে। ”
হতবুদ্ধি হয়ে গেল আদ্র।বুকের সাথে শক্ত করে চেপে ধরল তুলির মাথা টা। রিমি,অন্তু,নিবিড়, পায়েল,আমরিন,সাগর সবাই খুব বেশি বিস্মিত হল। মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে পিচ্চি মেয়েটা কত ভালোবেসে ফেলেছে আদ্র কে। ভালোবাসা আসলেই সময় বেঁধে হয় না। কখনও কখনও ক্ষণিকের দেখাতেও অচেনা,অজানা মানুষের জন্য ভালোবাসার উদয় হয় মনের পিঞ্জিরায়। আর সেই জায়গায় তুলি তো আদ্রের এতো বছরের জমানো ভালোবাসায় ডুব দিয়েছে যার ফলে আদ্রর প্রতি তার অনুভূতি, মায়া,ভালোবাসা আরও প্রখর হয়ে উঠেছে। মাথায় হাত রেখে মিহি সুরে আদ্র উচ্চারণ করল ভালোবাসাময় কিছু বাক্য।

“আমাকে কেঁড়ে নেওয়ার সাধ্য কারো নেই তুলি। একটা কথা কি জানো? তুমি ছাড়া তো আমিই জীবন্ত লাশ হয়ে যাব। তাই নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে পৃথিবীর যেই প্রান্তেই থাকি না কেন আমি তোমার কাছেই ছুটে যাব। ছুটে যাব স্নিগ্ধ প্রণয়ের গভীর রঙে নিজেকে রাঙিয়ে নিতে। নিজের ঠোঁটে একটু প্রাণোচ্ছল হাসি ফুটাতে। একটু তৃপ্ততার শ্বাস নিতে।”
আদ্র কে ছেড়ে দিয়ে গাড়িতে উঠে পড়ল তুলি। জানালা দিয়ে চেয়ে রইল অপলকভাবে। আদ্রের মুখে প্রশস্ত হাসি ও চোখে ফুটে আছে তুলির জন্য অসীম ভালোবাসা। আদ্র হাত দিয়ে ইশারা করল একটু হাসার। তুলিও ঠোঁটে ফুটিয়ে তুলল অমায়িক মুগ্ধ হাসি।

বেশ গরম পড়ছে আজকাল। এতো লং জার্নি তার উপর আদ্র ও তার মাঝে সাময়িক দূরত্ব সবমিলিয়ে ক্লান্ত তুলি। হতাশা ঘিরে ধরেছে মন কে। সায়েরা বেগমের সাথে কথা বলে মাত্র রুমে আসল। লম্বা একটা শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে আসতেই তুলির ছোট্ট বাটন ফোন টা বেজে উঠল শব্দ করে। ফোন হাতে নিতেই চোখে পড়ল অচেনা একটা নাম্বার। ভ্রু কুঁচকাল তুলি। প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে ফোনটা রিসিভ করতেই আপনাআপনি খুশির ঝলক ভেসে উঠল চেহারায়।

-কি করছো?
আদ্রর মধুর স্বর কর্ণকুহর হতেই কেঁপে উঠল তুলি। মাত্র শাওয়ার নিয়ে আসার পর শরীরে শীতল বাতাস অনুভব করতেই ক্ষণে ক্ষণে মৃদু কাঁপছে। নরম কন্ঠে জবাব দিল,,
–কিছু না। আপনি?
-শুয়ে আছি।
–ওহ্।
–তুলি???
হৃদপিণ্ডের উঠা নামা দ্রুত হয়ে গেল তুলির। এভাবে কেউ ডাকে? সামান্য ডাকে এমন হৃদয় কাঁপানো অনুভব হয়? তুলি যেন নিজের মুখের ভাষা টুকু হারিয়ে ফেলল। তবুও বহু কষ্টে অস্ফুটস্বরে উচ্চারণ করল,,
–“হু।”

—“ভেজা চুলে থাকলে ঠান্ডা লেগে যাবে তুলা। তাড়াতাড়ি চুল গুলো মুছে নাও।”
স্তব্ধ হয়ে গেল তুলি। পা দুটো ভেঙে আসছে। আর না পেরে ধপ করে বসে পড়ল বিছানায়। বুকে অজস্র অনুভূতির ছড়াছড়ি। আদ্র কিভাবে জানল সে ভেজা চুলে দাড়িয়ে আছে? ঘাবড়ানো কন্ঠে প্রশ্ন করল,,
–“আপনি কিভাবে জানলেন?”
–“এই কয়দিনে তোমার আচরণ দিব্যি খেয়াল করেছি। তাই আন্দাজে বললাম।”–হালকা হেসে কথাটা বলল আদ্র।
তুলির যেন তবুও কথাটা বিশ্বাসযোগ্য মনে হল না। আলতো স্বরে আবারও প্রশ্ন করল,
–” সত্যি? ”
–“একদম সত্য। আচ্ছা ডিনার করে ঘুমিয়ে পড়ো। কাল কথা হবে।”
–“আপনি খেয়েছেন?”
–“না খাব।”
—“ঠিক আছে। আল্লাহ হাফেজ। ”

ফোনটা পাশে রেখে হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে চুল শুকিয়ে নিল তুলি। ওড়না টা গায়ে জড়িয়ে ডাইনিং টেবিলে আসতেই চোখে পড়ল আদ্রর বাবা কে। চেয়ারে বসে সালাম দিল তুলি।
–“কেমন আছেন খালু?”
তুলির দিকে এক পলক চেয়ে তিনি গম্ভীর স্বরে জবাব দিলেন,
–“আলহামদুলিল্লাহ। তুমি কেমন আছো? আর ট্যুর কেমন ছিল?”
–“আলহামদুলিল্লাহ খালু। কবে ফিরলেন? ”
–“আজ সকালেই। ”

আর কোনো কথা না বলে তুলি মনোযোগ দিল খাবার খাওয়ায়। আমরিন ও ইনশিতা ও পাশে বসে খাচ্ছে। খাবার শেষ করে আমরিন কে চেপে ধরে ছাঁদে নিয়ে এল তুলি। হতভম্বের চেয়ে রইল আমরিন। তুলির মুখে দুষ্টু হাসি। ছাদে পাতানো দোলনায় বসে আকাশের বুকে প্রশস্ত চাঁদের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল।আমরিন বেক্কলের মতো শুধু চেয়ে থাকল। তুলির হাবভাব ভালো ঠেকছে না তার। নিশ্চয়ই কোনো ফন্দি এঁটেছে নয়তো তাকে বাঁশ দেওয়ার চিন্তা করছে। ছোট্ট করে একটা নিশ্বাস ছেড়ে তুলির পাশে বসে পড়ল আমরিন। সোজাসাপ্টা প্রশ্ন করল,,

–“কি হয়েছে তুলো? এভাবে হাসছিস কেন পাগলের মতো?”
চাঁদের উপর থেকে নজর সরিয়ে আমরিনের দিকে দাঁত কিটে তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল। কপাল কুঁচকে প্রশ্ন করল,,
–“আমি পাগলের মতো হাসছি?”
–“তা নয়তো কি? শেষ পর্যন্ত আমার ভাই একটা পাগল কে ভালোবাসল। হায়! হায়!”
—” তাহলে নিবিড় ভাইয়া ও একটা পাগল মাইয়া রে ভালোবাসে। তুই তো পাগলই। আর পাগলেই পাগল চিনে।”

কটমট করে কথাটা বলেই দম নিল তুলি। আমরিনের মুখ হা হয়ে গেছে সাথে সাথেই। মশাও ঢুকতে পারবে অনাসয়ে। বিস্ময় তাকে ঘিরে ধরেছে আষ্টেপৃষ্টে। বিস্ময়কর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তুলির দিকে। মিটমিট করে হাসছে তুলি। গলা ঝেড়ে বলে উঠল,,
–“আমি কিভাবে জানলাম সেটাই তো? নিবিড় ভাইয়া যে তোর হাত ধরেছিল আর তোর চোখে মুখে হাসির ছাপ ছিল তখনই বুঝেছি কিছু তো চলছে। তা পুরোপুরি ক্লিয়ার হল তাহিরপুর শিমুল বাগানে। সবার দৃষ্টিতে না পরলেও আমার চক্ষুতে ঠিকি ধরা পেরেছে। আহারে কতো গভীর অনুভূতি নিয়ে তুই নিবিড় ভাইয়ার হাতটা আঁকড়ে ধরেছিলি। আহা কি প্রেম!”

একটু ও বিলম্ব না করে তুলির মুখ টা চেপে ধরল আমরিন। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিল। কোনো হেঁয়ালি না করে জিজ্ঞেস করল,,
–“কি চাই? ”
–“বেশি কিছু না। জাস্ট কাল কলেজ শেষে হসপিটালে যাবি আমার সাথে।”
চোখ বড় বড় করে তাকাল আমরিন। অবাক কন্ঠে বলল,,
–“আমি পারব না। ভাইয়া রেগে যাবে। রোগী দেখার সময় ডিস্টার্ব পছন্দ করে না।”
–“ঠিক আছে যেতে হবে না। আমি ওনাকে এখনই ফোন করে জানিয়ে দিচ্ছি তুই ওনার ফ্রেন্ড এর সাথে,,”
—“হয়েছে আর ব্ল্যাকমেইল করতে হবে না। আমি নিয়ে যাব।”
আমরিনের গাল টেনে মুচকি হাসল তুলি।

কলেজ শেষে হসপিটালের সামনে চলে এল তুলি ও আমরিন। আজ হাফ ডে ছিল।দুপুরের কড়া রোদ এসে লাগছে চোখে মুখে।রোদের প্রখর টা একটু বেশিই। রোদের তাপে গরম ও লাগছে তীব্র। মনে হচ্ছে যেন চৈত্রের আগমন ঘটে গেছে। ফাল্গুন হোক আর চৈত্র তা নিয়ে বিশেষ মাথা ব্যাথা নেই তুলির। তার মন তো কাল রাত থেকেই ছটফট করছে আদ্র কে এক নজর দেখার জন্য। সকালে অবশ্য আদ্র মেসেজ দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে আজ তার জরুরি ওটি আছে নয়তো তুলির সাথে দেখা করতে আসত। তুলির ধারণা আদ্র আসতে পারে নি তো কি হয়েছে রাতের প্ল্যান মাফিক সে নাহয় চলে আসল। আমরিনের হাত ধরে হসপিটালের ভিতর ঢুকল। আদ্রর কেবিনের সামনে এসে দাঁড়াতেই আমরিন কে দেখে পরিচিত একজন নার্স বললেন,,

“স্যার তো রোগী দেখতে গিয়েছেন। আপনারা স্যারের কেবিনে অপেক্ষা করুন।”
ধন্যবাদ জানিয়ে ভিতরে গিয়ে বসল তুলি ও আমরিন। আজ দ্বিতীয় বারের মতো আদ্রর কেবিনে আসল তুলি। আদ্র তাকে দেখে হয়তো চমকে যাবে সেটা ভেবে খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠল। হঠাৎ কেবিনের দরজা খুলে কেউ প্রবেশ করতেই চোখ তুলে তাকাল দুজন। চোখে পড়ল নিবিড় কে। নিবিড় ও চমকে গেল দু জন কে। মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল,,

–“তোমরা দুজন এখানে? আদ্রর সাথে দেখা করতে এসেছো?”
মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বুঝাল তুলি। কিছুটা জড়তা নিয়ে আমরিন উঠে দাঁড়াল। তুলির দিকে তাকিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,,
–“তুলি ভাইয়া হয়তো এখনই চলে আসবে। আমি বোন হয়ে কাবাবে হাড্ডি হওয়া টা বেমানান। তার চেয়ে বরং আমি নিবিড় ভাইয়ার সাথে বাহিরে গিয়ে অপেক্ষা করি।”
আমরিনের কথায় সমর্থন জানাল তুলি। তবুও তার বেহায়া মন চুপিসারে বলে উঠল,,
“তুলি ইহা তো মাত্র বাহানা।”

আমরিন ও নিবিড় চলে গেল। তুলি গালে হাত দিয়ে অপেক্ষার প্রহর গুণতে লাগল আদ্রর জন্য। আকস্মিক তার মনে পড়ল প্রথম যেদিন এসেছিল একটা মেয়ে ভয়েস মেসেজ পাঠিয়েছিল। কে ছিল মেয়েটা?আদ্রর কাছ থেকে জানতে হবে। নয়তো খুব একটা স্বস্তি পাবে না। অবশেষে অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে দরজা ঠেলে প্রবেশ করল আদ্র। কোনোদিকে না তাকিয়ে গায়ের এপ্রোন টা খুলতে খুলতে বলল,
–“কখন আসলে?”
আঁতকে উঠল তুলি। আদ্রর সাবলীল কন্ঠ শুনে আদ্র কে চমকে দেওয়ার বদলে নিজেই প্রচন্ড পরিমাণে চমকে উঠল। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল,,

–“একটু আগে। আপনি চমকান নি?”
–“মোটেও না। আমার মন বলছিল তুমি আসবে। নার্স কে বলে গিয়েছিলাম আসলে যেন কেবিনে বসতে বলা হয়।”
চরম অবাক হল তুলি।দ্রুত গতিতে আদ্রর কাছে হেঁটে এল। মুখ ফুলিয়ে বলল,,
–“একটু চমকালে কি হতো ডাক্তার সাহেব? ”

জবাব না দিয়ে তুলির কোমর জরিয়ে ধরে নিজের কাছে টেনে আনল আদ্র। হার্ট বিট জোরে লাফাতে লাগল তুলির। নিজেকে সামলানোর জন্য আঁকড়ে ধরল আদ্রের কালো শার্টের কিছু অংশ। চোখে মুখে আছড়ে পড়ছে আদ্রের গরম নিশ্বাস যা তুলির কাঁপুনি বাড়িয়ে দিচ্ছে ক্রমশ। মুখ তুলে আদ্রর ক্লান্ত মুখে চাইতেই টুপ করে চুমু একে দিল আদ্র তুলির বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে থাকা কপালে। এসি চলছে অথচ তুলি ঘেমে যাচ্ছে অনবরত। নিশ্বাস টা ও ভারী হয়ে আসছে। চোখে ভাসছে আদ্রর মুখটা।

খোঁচা খোঁচা দাড়িতে আদ্র কে অনেক সুন্দর লাগছে। নীলাভ চোখ দুটো তে মাদকতা যা শিহরণ জাগাচ্ছে তুলির সারা দেহে। এই দৃষ্টি যেন তুলির জন্য নিষিদ্ধ। তাকালেই বুঝি লজ্জায় মরণ হবে। দুরুদুরু মন নিয়ে আদ্রর বুকে মুখ লুকিয়ে ঝাপটে ধরল আদ্র কে। মুচকি হেসে আদ্র ও জড়িয়ে ধরল। কানের কাছে স্লো ভয়েসে বলল,,
–রাতে তো বাসায় যেতাম কষ্ট করে না আসলে হতো না? ক্লাস করে ক্লান্ত শরীরে চলে আসলে।
–আপনাকে দেখার তর সইছিল না আদ্র।

কথাটা বলে আদ্রর বুকে আবারও মুখ গুঁজে দিল তুলি। দু চোখ বন্ধ করে নিল আদ্র। ঘোর লাগা স্বরে তুলি কে আকড়ে ধরে বলে উঠল,,
–এভাবে বুকে মাথা রাখলে নিজেকে পাগল পাগল মনে হয় তুলা। ইচ্ছে করে বিয়ে টা এখনই করে ফেলি। সারাক্ষণ এই বুকে আগলে রাখি তোমায়। কয়েক মিনিটের জন্য বুকে মাথা রেখে আবারও দূরে গেলে প্রচন্ড কষ্ট হয় আমার। শূন্য শূন্য লাগে বুক টা। রক্তক্ষরণ হয় হৃদপিণ্ডে।

আদ্রর কথায় প্রচন্ড লজ্জা অনুভব করল তুলি। বুকের ধুকপুকানি বাড়তে লাগল ক্রমাগত। বুক থেকে মাথা তুলে সরে আসতে চাইলে নিজের সাথে মিশিয়ে নিল আদ্র। নেশাময় চোখ দুটো তুলির চেহারায় স্থির করে রাগী স্বরে ফিসফিস করে বলল,,,
–তোমার তো ভারী সাহস আমি এভাবে বলার পরও সরে যাওয়ার চেষ্টা করলে। আর কখনও এমন সাহস করলে মেরে ফেলব একদম।
আদ্রর কথার কোনো প্রতিউত্তর করল না তুলি। নিশ্চুপ হয়ে আদ্রর হৃৎস্পন্দন শুনতে লাগল। এতো দ্রুত গতিতে স্পন্দন হচ্ছে যা কানে যেতেই শরীর কাটা দিয়ে উঠছে তুলির।

ছোট্ট মনে বাসা বাঁধা অনুভূতি গুলো ও ক্ষণে ক্ষণে জাগ্রত হচ্ছে। তুলির মনে হচ্ছে এই ভালোবাসা তার জন্যই গচ্ছিত রাখা। এই গভীর প্রণয় চিরকাল ছিল তারই অপেক্ষায়। কেন আরো আগে দেখা হল না তার আদ্রর সাথে। তাহলে তো আগে থেকেই পরিচয় হতে পারত অন্তর কাঁপানো এই ভালোবাসার সাথে। তুলির সুখ অনুভূত হচ্ছে। আজ সে ভীষণ সুখী। তার এই সুখের কারণ তার ডাক্তার সাহেব। আনমনে আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়াল আদ্রর বুকের বা পাশ টায়। আদ্র ও চুপ করে অনুভব করতে লাগল তুলি কে। কিছু না বলেও অনুভবে হাজারো কথা বলছে দু’জন। একে অপরের প্রতি অসীম ভালোবাসা বিলিয়ে দিচ্ছে অনুভবের প্রহরে।

সময় যে কখন গড়িয়ে যায় টেরই পাওয়া যায় না। আজ ইনশিতার বিয়ের ডেট ঠিক করতে আসবে। গতকাল রাতে ইনশিতা, আমরিনের সাথে ভালোই আড্ডা দিয়েছে তুলি। ঘুমোতে ঘুমোতে প্রায় দুইটা বেজে গেছে। আড্ডা ছিল ইনশিতা কে কেন্দ্র করে। কথায় কথায় জানতে পারল রনক ইনশিতার বড় চাচার ছেলে।পাঁচ বছর ধরে প্রেমের সম্পর্ক তার রনকের সাথে। বিয়ে আগে থেকেই ঠিক করা। তুলির চোখে এখনও ঘুম। একটু তে ও ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়ে মেয়েটা।

নিজেও বুঝে পায় না এতো অবসাদ কেন তাকে ঘিরে ধরে। চোখ কচলাতে কচলাতে কিচেনের কাছে এসে দাঁড়াল। সকাল দশটা বাজে কিন্তু এখনও সবাই ঘুমে। সকলে বললে ভুল হবে আদ্র বেরিয়ে গেছে সকালেই। সায়েরা বেগম সার্ভেন্ট দের সাহায্য নিয়ে সবকিছু রান্না করছেন। কারণ দুপুরের দিকেই গেস্ট চলে আসবে। আচমকা তুলি কে দরজায় দাড়িয়ে থাকতে দেখে আঁচলে হাত টা মুছে মুচকি হেসে এগিয়ে গেলেন তিনি। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,,

–এতোক্ষণে উঠার সময় হল? তাড়াতাড়ি আয় নাস্তা করে নিবি।
ইতস্তত করে তুলি জিজ্ঞেস করল,,
–আমরিন,ইনশিতা আপু,আদ্র ভাইয়া ঘুমাচ্ছে খালা মণি?
–আরে না। আদ্র তো প্রায় একঘন্টা হবে হসপিটালে চলে গেছে। দুপুরে ফিরবে। আর আমরিন,ইনশিতা এখনও ঘুমে।তুই খেয়ে গিয়ে ওদের উঠিয়ে দিস মা।

অভিভূত হয়ে দাড়িয়ে পড়ল তুলি। আদ্র তাকে না বলেই চলে গেল? সেটা ভেবে একটা চাপা কষ্ট অনুভব করল। খানিক বাদেই মনে হল হয়তো ঘুমিয়ে ছিল তাই আর জাগায় নি।মুচকি হেসে নাস্তা খেতে মনোযোগ দিল। খাওয়া শেষ করে আমরিন ও ইনশিতা কে ঘুম থেকে উঠিয়ে দিয়ে রুমে এল। ঘড়ির কাটার দিকে তাকাতেই দেখল এগারোটা বেজে গেছে। আলমারি থেকে নিজের জন্য একটা ড্রেস বের করে নিল দুপুরে পড়ার জন্য। ড্রেস টা আদ্র কিনে দিয়েছে। সেদিন হসপিটাল থেকে শপিং করতে নিয়ে গিয়েছিল। তিন টা ড্রেস কিনে দেয় তুলি কে। এর মধ্যে থেকে নীল রঙের লং ড্রেস টা বের করল তুলি। আলমারি লাগাতে গিয়ে নজর গেল একটা বক্সের দিকে। বিস্মিত হয়ে বক্স টা হাতে নিল। একটা মোবাইল ফোনের বক্স। তার নিচেই চাপা দেওয়া ছিল একটা চিরকুট। অতি আগ্রহ নিয়ে চিরকুট খুলতেই হাসি ফুটে উঠল তুলির ঠোঁটে।

~ “মোবাইল টা তোমার জন্য। ঘুমিয়ে ছিলে তাই ঘুম ভাঙায় নি তবে একটা ছোট্ট চুমু খেয়েছি তোমার কোমল ঠোঁট দুটো তে। জানি এখন লজ্জা পাবে তুমি কিন্তু দুঃখের বিষয় সেই লজ্জা রাঙা মুখ টা আমার দেখা হবে না। আমার বুকের বা পাশে চিনচিন ব্যাথা ও অনুভব করব না। তবুও কল্পনায় একে নিব তোমার সেই মুখ খানা যা প্রতি রাতে নির্ঘুম রাখে আমায়। এই মেয়ে আমায় মেরেই দম নিবে তাই না?”
চিরকুট টা বুকের সাথে জড়িয়ে মুচকি হাসল তুলি। কিশোরী তুলির কাছে একটা খুবই ভয়ংকর অনুভূতি। এ অনুভূতি গুলো শান্তিতে নিশ্বাস পর্যন্ত নিতে দেয় না। সারাক্ষণ বিচরণ করে বেড়ায়। আর ইচ্ছে করে সর্বদা মেতে থাকতে এমন মন মাতানো অনুভূতির মাঝে। তুলি জানে না এই অনুভূতি গুলোর শেষ পরিণতি কি হবে। কিন্তু তার দৃঢ় বিশ্বাস আদ্র ঠিক সামলে নিবে, জড়িয়ে নিবে তার হৃদয়ের গহীনে। লাজুক হেসে ধীর কন্ঠে বিড়বিড় করে বলল, ,–” আপনি অনেক অসভ্য ডাক্তার সাহেব। ”

ইনশিতার রুমে বসে বসে ইনশিতা কে রেডি হতে দেখছে তুলি। আমরিন নিচে গেছে। সায়েরা বেগম পাঠিয়েছেন। তিনি ও মেয়ে কে শাড়ি পড়িয়ে কপালে চুমু একে দিয়ে চলে গেলেন নিচে। ইনশিতা কে খুব সুন্দর লাগছে। বউ বউ লাগছে তুলির কাছে। লজ্জার ছাপ ও ফুটে আছে চেহারায়। তুলি ভাবতেই লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠছে একদিন সে ও ইনশিতার মতো শাড়ি পড়ে অপেক্ষায় থাকবে আদ্রর বউ হবার জন্য। আদ্র হয়তো বেশি অপেক্ষা করাবে না। তুলি মনে মনে বলে উঠল,,–” লোকটা যা পাগল আর বেহায়া দেখা যাবে তিনি নিজেই অপেক্ষা করবেন আমার জন্য। ” কথাটা ভেবেই ব্লাশিং করতে লাগল।

হঠাৎ কালো রঙের শাড়ি পড়া একটা মেয়ে রুমে আসতেই হালকা হেসে উঠল ইনশিতা। মেয়েটা সুন্দর। অনেক বেশি সুন্দর। চোখ গুলো কেমন টানা টানা। পিঠে ছড়িয়ে থাকা চুল গুলো কোমর ছুঁই ছুঁই। ঠোঁটে লেগে আছে হাসি। অবাক হয়ে তুলি মেয়েটা কে দেখতেই ব্যস্ত। ইনশিতা জরিয়ে ধরল মেয়েটা কে। অভিমানী সুরে বলে উঠল,,
—“নিজের বাড়িতে আসতে কারণ লাগে? যেই বাড়িতেই সারাজীবনের জন্য ঠাঁই হয়ে গেছে তোর সেখানেই আপনি আসতে বিলম্ব করলেন?”
—” আরে তুই তো জানিস ভাইয়ার সাথে লন্ডনে ছিলাম। চলে আসতাম কিন্তু ভাইয়ার কাজে আঁটকে গেলাম। বাই দ্যা ওয়ে ভাবী আপনাকে কিন্তু অপরূপ লাগছে।”
–“হয়েছে আর পাম দিতে হবে না। তোকে মোবাইলে বলেছিলাম না আমাদের বাড়িতে একটা কিউট মেয়ে এসেছে? আয় পরিচয় করিয়ে দেই।”

আকাশে তারার মেলা পর্ব ৯+১০

কথাটা বলেই তুলি কে ডাক দিল ইনশিতা। মুচকি হেসে তুলি ওদের দিকে এগিয়ে গেল। মেয়েটা তুলি কে অবলোকন করল ভালো করে। মিষ্টি হেসে বলল,,
–“বাহ্ বেশ মিষ্টি তো দেখতে।”
–হুম। তুলি পরিচয় হ এই বাড়ির আরো একজন সদস্যর সাথে। আমাদের ভাবী সামিরা। সম্পর্কে আমার ননদ ও।
তুলির চোখে মুখে ভয়ের ছাপ ফুটে উঠল। হারিয়ে ফেলার ভয়ে বুকে শুরু হল আর্তনাদ। ছোট্ট মনে নেমে এল বিষাদের ছায়া। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,,

–“ভভাবী মানে? ”
তীক্ষ্ণ নজরে তাকাল সামিরা। ইনশিতা হেসে বলে উঠল,,
—“আরে বুঝিস নাই? আদ্র ভাইয়ার বউ। আদ্র ভাইয়া তো,,
পুরো দুনিয়া থমকে গেল তুলির। পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট বাক্য টা হয়তো শুনেছে সে। চোখ ভর্তি হল জলে। কোনোমতে আঁটকে রাখার চেষ্টায় নেমে পড়েছে। আর কোনো কথা শুনার শক্তি টুকু নেই তার। পুরো শরীর অসার হয়ে পড়ছে। বুকে অসহনীয় ব্যাথা হচ্ছে। তীব্র থেকে তীব্রতর ব্যাথা। শ্বাস টুকু নিতে পারছে না।মাথা ঘুরে পড়ে যেতে নিলে কথা থামিয়ে পিছন থেকে আকড়ে ধরল ইনশিতা। আতংক কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,,

–“এই তুলি কি হয়েছে তোর?”
মুখ দিয়ে একটা কথাও উচ্চারিত করতে পারছে না তুলি। ইনশিতার হাতটা চেপে ধরে বহু কষ্টে বলল,,
–“আমায় রুমে দিয়ে আসো আপু।”
সাথে সাথেই চোখের কার্ণিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল এক ফোঁটা জল।

আকাশে তারার মেলা পর্ব ১৩+১৪