আড়ালে ভালোবাসি তোমায় পর্ব ১১

আড়ালে ভালোবাসি তোমায় পর্ব ১১
নুসাইবা জান্নাত আরহা

কা’র এ*ক্সি*ডে*ন্টে শরীরের একটা পাশ একদম থে*ত*লে গিয়েছে ফারিহার। মাথাতেও বেশ গু’রু’ত’র ভাবে আ*ঘা*ত লেগেছে। একমাত্র মেয়ের এমন র*ক্তা*ক্ত, থে*ত*লা*নো শরীর আর এমন ক’রু’ণ অবস্থা যেন কিছুতেই স’হ্য করতে পারছেন না নাফিয়া রহমান। তিনি সেই তখন থেকেই চি*ৎকার করে কে’দেই চলেছেন।

এই তো, একটু আগেই, ফ্রেণ্ডরা মিলে ঘুরতে বেরিয়েছিল। ফিরে আসার সময় আড্ডা দিতে দিতেই গোধুলী লগ্নে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিচ্ছিল ফারিহা আর ওর ফ্রেণ্ডরা। তখন কে জানত যে, কিছুক্ষণ বাদেই ওরা পতিত হতে চলেছে দূ’র্ঘ’ট’না’র কবলে। যা কিনা কে’ড়ে নিতে পারে ওদের সুন্দর ভবিষ্যত অথবা জী’ব’ন, এমনকি হতে পারে মৃ*ত্যু।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ফারিহা এক হাতে গাড়ি ড্রাইভ করছিল আর অন্য হাতে ফোন চালাচ্ছিল, সেই সাথে অন্য দিক ফিরে গল্প করছিল ফ্রেণ্ডদের সাথে।
এমন সময় হঠাৎ ওদের গাড়ির সামনে আরেক টি গাড়ি চলে আসাতে স’জো’রে ধা’ক্কা লাগে। ফলে দুটি গাড়ি সংঘর্ষের ফলে সামনের দিক থেকে দু’ম’রে মু’চ’রে যায়। এবং এক সাইডে কাত হয়ে পড়ে। যে সাইডটা কাত হয়ে পড়েছিল ঐ সাইডেই ফারিহা ছিল।

পরবর্তীতে ঘটনা স্থলে লোকজন জড় হয়ে গেলে গাড়ির ভিতরের সবাইকে টে’নে হি’চ’ড়ে বের করে আনা হয়। ঘটনা স্থলে দুই জন সাথে সাথেই মা*রা যায়। আর ফারিহাসহ আরও তিন চার জনকে হসপিটালে আনা হয়। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষ’তি’ গ্র’স্থ ফারিহা। আর বাকিরা তুলনামুলক কম ক্ষ’তি গ্রস্থ হয়েছে।

একটু আগে নাফিয়া রহমান মামনিকে ফোন দিয়ে এই খবরটিই দিলেন। খবরটা শুনে আমি আর মামনি দুজনেই ছুটে গেলাম। রাশফিন যে হসপিটালে সেই হসপিটালের থার্ড ফ্লোরে ফারিহা। তাই যেতে খুব বেশি সময় লাগলো না।
ফারিহা মানুষ হিসেবে হয়তো অনেক বেশি খা’রা’প’, আমার আর রাশফিনের অনেক ক্ষ’তি করেছে, কিন্তু তার বি’প’দে’র সময় এসব মনে রাখা উচিত না বলে আমি মনে করি। আর তাছাড়াও এসময় নাফিয়া রহমানের মেন্টালি সাপোর্ট দরকার। তিনিও বা একা একা কিভাবে সামলাবেন সবটা।

নাফিয়া রহমান আমাকে দেখেই মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। তিনি যে আমায় স’হ্য করতে পারেন না, সেটা খুব ভালো ভাবেই বুঝতে পেরেছি আমি। মামনিকে জড়িয়ে ধরে কেদেই চলেছেন সেই তখন থেকে তিনি।
কেবিন থেকে ডক্টর গম্ভীর মুখে বের হতেই তার ছুটে যান নাফিয়া রহমান। কাদতে কাদতে তিনি বলেন
-‘ ডক্টর, আমার মেয়ে, কি অবস্থা ওর এখন? ওকে কি দেখা যাবে একবার?
ডক্টর গম্ভীর মুখে চুপ করে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। এদিকে আমরা উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি ডক্টরের দিকে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে তিনি বললেন

-‘ আমরা তো আমাদের যথাসাধ্য চেষ্টা করছিই তবে রোগীর কন্ডিশন তেমন একটা ভালো নয়।
কিছু একটা ভেবে ডক্টর বললেন
-‘ হ্যা, আপনারা রোগীকে দেখতে যেতে পারেন।
এতো টুকু বলে চলে গেলেন ডক্টর। ডক্টরের এমন কথা শুনে দৌড়ে কেবিনের ভিতরে চলে গেলেন নাফিয়া রহমান, পিছু পিছু আমরাও গেলাম। ভিতরে গিয়ে মেয়েকে দেখেই হু হু করে কেদে দিলেন নাফিয়া রহমান। তাকে কি বলে স্বান্তনা দিব তার ভাষা নেই আমাদের কাছে।

বেশ কিছুটা সময় পর ফারিহার জ্ঞান ফিরে এলো। পিটপিট করে চোখ মেলে তাকালো ফারিহা। আশপাশ ঘুরে দেখতে লাগল সে এখন। আমার দিকে চোখ পড়তেই যেন উত্তেজিত হয়ে উঠল ফারিহা। হাত দিয়ে ইশারায় কিছু যেন বোঝাতে চাইছে আমায়। আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম। ওর একটু কাছে গিয়ে বোঝার বৃথা চেষ্টা করছি মাত্র।
আমাকে দেখে মেয়েকে এমন উত্তেজিত হয়ে পড়তে দেখে নাফিয়া রহমান ধমকের সুরে আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন

-‘ এই মেয়ে বেরিয়ে যাও এখান থেকে। দেখতে পাচ্ছ না, আমার মেয়ে কেমন করছে তোমায় দেখে। এখন যদি ওর কিছু হয়ে যায়, তবে তোমায় আমি মে*রেই ফেলবো।
নাফিয়া রহমানের এমন কথা শুনে আমি যখনই বেরিয়ে আসতে যাব কেবিন থেকে ওমনি আমার হাতটা খপ করে ধরে বসে ফারিহা।
ফারিহার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তবুও অক্সিজেন মাক্সটা সরিয়ে ঘন ঘন শ্বাস ফেলে হাপাতে হাপাতে আমায় বলল

-‘ আমাকে মাফ করে দাও অরনিশা। আমি তোমার সাথে অনেক অ’ন্যা’য় করেছি।
আমি ফারিহার দিকে করুন দৃষ্টিতে তাকালাম। মেয়েটার এমন করুন অবস্থা দেখে আজ বড্ড মায়া হচ্ছে আমার। এই পৃথিবীতে আমরা আজ আছি, তো কাল নেই। কি দরকার ছিল দুই দিনের দুনিয়াতে, মানুষের ক্ষ’তি করা। কথায় আছে না, পা’প বাপকেও ছাড়ে না। মানুষের ক্ষ’তি করলে, কেউ নিজে কখনোই ভালো থাকতে পারেনা।
ফারিহা শ্বাস টেনে নিয়ে বলল

-‘ মাম্মি আর মামি, তোমরা একটু বাইরে যাবে, আমি একটু অরনিশার সাথে একা কথা বলতে চাই।
নাফিয়া রহমান কিছুতেই মেয়েকে একা ফেলে যাবেন না। তবে ফারিহা বলাতে তিনি বাধ্য হলেন যেতে। এদিকে মামনি আমায় কিছুতেই ফারিহার সাথে একা ফেলে যাবেন না। অবশেষে মামনিকে এমন করতে দেখে ফারিহা বলল
-‘ আচ্ছা, মামি, তুমিও থাকো অরনিশার সাথে। সমস্যা নেই।
ফারিহার কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে তবুও শ্বাস শ্বাস টেনে টেনে বলল

-‘ জানো, অরনিশা, আমার না খুব কষ্ট হচ্ছে খুব। আমার করা কৃতকর্মের ফল হয়তো আমি দুনিয়া থেকেই পেয়ে যাচ্ছি। তবে তোমায় আমি সব সত্যিটা বলে আমার পাপের বোঝা কিছুটা হলেও হালকা করতে চাই। আমার কথা গুলো একটু মনোযোগ দিয়ে শোনো।
আমি উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি ফারিহার দিকে। ফারিহা আবার বলতে শুরু করল

-‘ অরনিশা, তোমার আর রাশফিনের ডিভোর্স হয়নি। রাশফিন তোমায় সেদিন ডিভোর্স পেপার পাঠায়নি আর না আমাদের বিয়ে হয়ছিল। আমিই পাঠিয়ে ছিলাম ডিভোর্স পেপার, আর বিয়ের ছবি গুলোও আমিই পাঠিয়ে ছিলাম। কিন্তু ওগুলো আসল ছিল না। ওর ঘুমিয়ে পড়ার সুযোগ নিয়ে ছবি তুলেছিলাম সাথে এডিটও করেছিলাম যাতে বোঝা না যায় ছবি গুলো দেখলে। আর তুমিও যেন ভুল বুঝে রাশফিনের থেকে দূরে চলে যাও।

আমি চমকালাম ফারিহার কথা শুনে। তার মানে আমার আর রাশফিনের ডিভোর্স হয়নি। আমি আর মামনি একে অপরের মুখের দিকে চাওয়া চাওয়ি করলাম।
এবার আমি রাশফিনের ফোনটা বের করে ঐ ছবি গুলো ফারিহাকে দেখাই যেই ছবি গুলোর কারণে রাশফিন সন্দেহ করেছিল আমায়। ছবি গুলো দেখে ফারিহা করুণ কণ্ঠে বলল

-‘ আমিই তোমাদের বিয়ের রাতে রাশফিনকে এই ছবি গুলো দিয়ে ছিলাম সাথে উস্কানিমূলক কথা বলে ওকে একদম রা*গিয়ে দিয়েছিলাম। আমি ভালো করেই জানতাম, একটুর থেকে একটু কিছু হলেই রাশফিন প্রচণ্ড রেগে যায় তাই ওকে তোমার নামে যা নয় তাই বলে রা*গিয়ে দেই। আর তাছাড়াও রাশফিন আমাকে যথেষ্ট বিশ্বাস করতো, কারণ আমি যা বলতাম তা সবসময় সত্যিই বলতাম কিন্তু হঠাৎ করে যে ওকে আমি এমন ভাবে মিথ্যা বলবো এটা ও ভাবতেও পারেনি।

নিশ্চয়ই ছোট থেকেই যাকে বিশ্বাস করে আসছে, তাকেই বিশ্বাস করবে, দুদিনের একটা অপরিচিত মেয়েকে নয়। আর তাই তো ওর এই বিশ্বাসেরই সুযোগটা নিয়েছিলাম আমি। আর এটাকেই আমার হাতিয়ার বানিয়েছিলাম।
ফারিহার কথা শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম কয়েক মুহূর্ত। মামনি তে*ড়ে যেতে লাগলেন ফারিহাকে মা’রার জন্য। আমি তাকে ঠেকালাম। এটা দেখে ফারিহা মলিন হাসল। আমি কিছুটা গম্ভীর কণ্ঠে বললাম

-‘ আমার মনে পড়ে না, তোমার কোনো দিন ক্ষ’তি করেছিলাম কিনা? তবে তুমি কেন করলে আমার সাথে এমন?
-‘ তোমার সাথে কখনোই আমার কোনো শত্রুতা পূর্ণ সম্পর্ক ছিল না। তবে যদিন থেকে তুমি রাশফিনের বউ হয়ে এ বাড়িতে এসেছো, সেদিন থেকে আমি তোমায় স’হ্য করতে পারিনা, জাস্ট।আর তা-ই তো এতো কিছু করলাম যাতে তোমাকে হ’টি’য়ে আমি রাশফিনের বউ হতে পারি।
এতো টুকু বলে থামল ফারিহা। ওর নিশ্বাস ভারী হয়ে উঠছে প্রতিনিয়ত। এখন নিশ্বাস নিতে বড্ড কষ্ট হচ্ছে ফারিহার। তবুও কষ্ট করে বলল

-‘ আর জানো? রেস্টুরেন্টে তোমার সাথে সেদিন যে ব্যবহারটা রাশফিন করেছিল, ওটা ও মোটেও সজ্ঞানে করেনি। আমি ওর শরীরের ইনজেকশনের মাধ্যমে ড্রাগ পুষ করেছিলাম। ফলে ও তখন কি বলেছিল বা কি করেছিল, সে বিষয়ে ওর কোনো ধারণাই নেই।
এটা শুনে চমকে উঠলাম আমি। মনে হচ্ছিল এখনই গিয়ে ফারিহাকে গ’লা টি’পে মে*রেই ফেলি। কাটকাট কণ্ঠে জবাব দিলাম

-‘ তোমার জন্যই এতো কিছু হয়েছে। তুমি-ই মেইন কার্লপ্রিট। আমরা ভালো ভাবেই সংসারটা করতে পারতাম কিন্তু তোমার মতো কা*ল*না*গি*নে’র জন্যই আজ এই অবস্থা আমাদের। আর তোমার জন্য শুধু মাত্র তোমার জন্যই আজ রাশফিনের এই অবস্থা।
এতোটুকু বলে আমি কান্নায় ভে’ঙে পড়ি। ফারিহা আমার কথা শুনে বেশ উ’ত্তে’জি’ত হয়ে বলল

-‘ ক কি হয়েছে রাশফিনের?
-‘ রাশফিনের ব্রে’ই’ন টি*উ*মা*র হয়েছে। ওকে আইসিউ তে রাখা হয়েছে। ডক্টর জানিয়েছে রাশফিনের অবস্থা খুব বেশি ভালো নয়। যে কোনো সময় যা কিছু…
আর বলতে পারলাম না এতোটুকু বলে থামলাম আমি। আমার কথাটা শুনে এবার নি’স্তে’জ হয়েছে পড়ে ফারিহা। ওর চোখ দিয়ে বেয়ে পড়ে কয়েক ফোটা নোনা জল।
অনেক ক’ষ্ট করে আমার হাতটা জড়িয়ে ধরে শ্বাস টেনে ফারিহা বলল

-‘ আমায় মাফ করে দিও অরনিশা। যদিও আমি আসলেই ক্ষমার অযোগ্য। তুমি রাশফিনকে কখনো ভুল বুঝো না, ও সত্যিই অনেক ভালো। আর হ্যাঁ আমার মায়ের থেকে সাবধানে থেকো তুমি, কারণ আমি মা*রা গেলে আমার মা তোমার অনেক ক্ষ’তি করার চেষ্টা করবে, কখনোই তোমায় ছাড়বেনা আমার মা। আর হ্যাঁ আমি কিন্তু একা দোষী নই আমার সাথে তোমার বেস্টফ্রেণ্ড আহনাফও ছিল।

ফারিহার মুখ থেকে এমন কথা শুনে আমি যেন থমকে গেলাম। মানেহ্ আহনাফও ফারিহার সাথে জড়িত তার মানে। আমার বিশ্বাস নিয়ে এতোটা ছিনিমিনি খেলতে পারল কি করে আহনাফ। যাকে কিনা নিজের বেস্টফ্রেণ্ড, নিজের ভাইয়ের মতো দেখতাম। সে-ই এমন কি করে করতে পারল আমার সাথে?
ফারিহা ঘন ঘন শ্বাস টেনে টেন বলল

-‘ অ অর অরনিশা, ভালো থেকো বোন, তুমি অনেক সুখী হও। আমার হাতে যে আর খুব বেশি সময় নেই। আর শোনো, রাশফিনকে ভুল বুঝে দূরে সরিয়ে দিও না। ও তোমায় অনেক ভালোবাসে। আর ঐ আহনাফ থেকে দূরে থেকো। রাশফিনকে ড্রাগ দেওয়া, এটা ওরই প্ল্যান ছিল। রেস্টুরেন্টে তো ওই…

আর কিছু বলতে পারল না ফারিহা। ওর প্রচণ্ড রকম শ্বাসকষ্ট হতে থাকে। আমি চি*ৎকার করে ডক্টরকে ডাকি। ততক্ষণে সব শে’ষ। ফারিহা মৃ*ত্যুকে আলিঙ্গন করে নিয়েছে। ফারিহা ততক্ষণে পাড়ি দিয়েছে প’র’পা’রে।
আমার চোখের সামনে খুব দ্রুতই যেন ঘটে গেল সবকিছু। সবটা যেন দুষ্স্বপ্ন মনে হচ্ছে আমার। আজ সবটা ক্লিয়ার হলো তবে আহনাফ এমন বি*শ্বা*স*ঘা*ত*ক*তা করলে কিভাবে আমার সাথে?

আড়ালে ভালোবাসি তোমায় পর্ব ১০

মোটামুটি সব রহস্য ক্লিয়ার করলাম আজ। গল্প বেশি বড় করবো না আর। ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। হ্যাপি রিডিং~

আড়ালে ভালোবাসি তোমায় পর্ব ১২