কহিনুর তৃতীয় খণ্ড পর্ব ২৫

কহিনুর তৃতীয় খণ্ড পর্ব ২৫
লাবণ্য ইয়াসমিন

সুরঞ্জনা, ওইখানে যেওনাকো তুমি,
বোলোনাকো কথা ওই যুবকের সাথে;
ফিরে এসো সুরঞ্জনা:
নক্ষত্রের রুপালি আগুন ভরা রাতে;
ফিরে এসো এই মাঠে, ঢেউয়ে;
ফিরে এসো হৃদয়ে আমার;
দূর থেকে দূরে— আরো দূরে
যুবকের সাথে তুমি যেওনাকো আর।

গভীর রজনী, নির্জন বন্ধ কক্ষে পুরুষালী ভারি কণ্ঠে উচ্চারিত হচ্ছে জীবনানন্দের অমর রচনার কয়েক চরণ। একবার না বারবার। বাংলাদেশ থেকে দূরে সূদুর জার্মানিতে বসে একজন বাঙ্গালী কবির কবিতা ভালোবেসে কেউ এভাবে অকূল হয়ে আবৃত্তি করতে পারে বলে বিশ্বাস হচ্ছে না কহিনুরের। কিছুক্ষণ পূর্বেকার কথা ভাবলো কেউতো ছিল যে ওর কানে ফিসফিস করে কথা বলে গেলো। কহিনুর পেছনে ফিরে আর কাউকে পেলনা।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তারপর নিজের গতিবিধি পরিবর্তন করে যখন ছাদে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েছিলো ঠিক তখনই পাশের কক্ষ থেকে কণ্ঠটা ভেসে আসলো। কর্ণগোচর হতেই কহিনুর সাবধানে দরজার সামনে গিয়ে উঁকি দিতে চাইলো। কিঞ্চিৎ ফাঁক দিয়ে দেখল একজন যুবক বেলকনিতে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে। চাঁদের আলো ঠিকরে পড়েছে সেখানে। যুবকের কণ্ঠে জাদু আছে।কেমন মাদকতাই ভরপুর।

নেশা চড়ে যাওয়ার উপক্রম।যুবকের হৃদয় নিংড়ানো অকূল অনুরোধ সেই অবাধ্য প্রিয়তমার জন্য। কহিনুর কানে হাত লাগিয়ে ফেলল। অন্য পুরুষের প্রতি মুগ্ধতা ওর শোভা পাচ্ছে না। নাকি কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে ওকে বশ করতে চাইছে? কহিনুর নিজেকে সামলে নিলো। ভাবলো চলে যাবে তাই দরজা থেকে সরে আসতে চাইলো তখনই হঠাৎ আবৃত্তি বন্ধ হয়ে গেলো। নির্জনতা ছেয়ে গেলো চারদিক। ভেতর থেকে গম্ভীর আওয়াজে গমগম করে পুরুষালী কণ্ঠে বলে উঠলো,

ভেতরে এসো। পালাচ্ছো কেন মেয়ে? পালিয়ে যাওয়ায় বুঝি তোমার স্বভাব?
কহিনুর থমকে গেলো। কতশত অদৃশ্য শক্তির সামনে নিজেকে প্রস্তুত রেখেছে আর আজ কেমন সবটা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। কোথাও একটা ছন্দপতন ঘটেছে। কহিনুর চাইছে না এই যুবকের সামনে যেতে কিন্তু কিছু করার নেই। চুপচাপ সামনে এগিয়ে গিয়ে উত্তর করলো,

দুঃখিত আপনাকে বিরক্ত করার জন্য। চমৎকার আবৃত্তি শুনে থমকে গেছি। কিছু মনে করবেন না একটা কথা জিঞ্জাসা করতে পারি?
কহিনুরের কৌতূহলী প্রশ্ন শুনে যুবকের হেলদোল হলোনা। যেভাবে ছিল সেভাবেই আছে। গায়ে সাদা রঙের টিশার্ট আর কালো প্যান্ট। লম্বা চুলগুলো চিকন রাবার দিয়ে ঝুটি করে বাঁধা। সনাতন ধর্মের ধর্মনিষ্ঠ পুরুষেরা টিকি রাখে যেভাবে তেমন হতো যদি চারদিকে চুল না থাকতো। ফর্সা হাতদুটো লোহার সঙ্গে আবদ্ধ। কহিনুর ঢোক গিলে পূণরায় কিছু বলতে সামনে এগিয়ে আসলো তার পূর্বেই লোকটা বলল,

একজন বাইরের সুদর্শন পুরুষের দিকে নজর দিয়ে অপরাধ করছো জ্ঞান নেই তোমার? কেনো এসেছো এখানে? মিথ্যা বলার চেষ্টা করবে না।
কহিনুর হতভম্ভ হলো যুবকের কথা শুনে। হুটকরে মেজাজ চরম খারাপ হচ্ছে। একটু দেখেছে বলে কি আসক্ত হয়ে পড়েছে? কহিনুরের চরিত্রে দাগ লাগাতে চাইছে। ও কি জানেনা ফালতু রূপের মোহে কহিনুর জীবনেও পড়বে না?নেহায়েত আবৃত্তি ভালো লেগেছে তাই। কহিনুর ফুলে ফেপে উঠলো। দাঁত কিড়মিড় করে উত্তর দিলো,

যথেষ্ট জ্ঞান আছে আমার। আপনার বোধহয় নিজের রূপের প্রতি বড্ড অহমিকা। কিন্তু আফসোস আমি এমন সস্তা মোহে পড়িনা। কবিতার প্রতি চরণে বিশেষ কিছু ছিল ওটাই মনোযোগ কেড়েছে আমার। আমি প্রহেলীকা এলেক্স লয়েডের অনুগত ভৃত্য তাই এখানে কোনো ঝামেলা চাইছি না।
কহিনুর উত্তরের আশায় বেশ কিছু কথা শুনিয়ে দিলো। অহেতুক বাচ্চাদের মতো ঝগড়া করছে কিন্তু এটা ছাড়া কিছু কারার নেই। নিজেকে গোপন রাখতে সাধারণভাবে সবটা মানতে হবে। কহিনুরের ধ্যান ভাঙলো ছেলেটার উত্তর শুনে,

আমার রূপে সত্যিই জাদু আছে। এক নজরে যেকোন নারী ঘায়েল হবে এটা নতুন কিছু না। তুমি যতই নিজেকে শক্ত আবরণে নিজেকে আবদ্ধ করে রাখো তবুও আমার মোহে পড়তে তুমি বাধ্য। খুব বাজেভাবে ফেঁসে যাবে আমার প্রেমে। আমি অভার সিউর খুব তাড়াতাড়ি তুমি কঠিনচিত্তে আমার প্রেমে পাগল হয়ে বনবাসী হতে চাইবে। আমি প্রেমিক পুরুষের ন্যায় প্রেয়সী ভেবে তোমাকে নিজের বক্ষস্থলে আগলে নিতেই পারি তবে নিব না। তুমি বড্ড নিষ্ঠুর। কারো হৃদয়ের দহন তোমার মনে দাগ কাটেনা।

লোকটার এলোমেলো কথা শুনে কহিনুর হেসে ফেলল। দ্রুতগতিতে এলোমেলো হেটে গিয়ে ছেলেটাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরতে চাইলো কিন্তু পারলোনা। ছেলেটার শরীর নেই আছে ছায়া। কহিনুর চোখ বন্ধ করে দাঁত দিয়ে ওষ্ঠদ্বয় চেপে ধরলো। চোখ থেকে দুফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। অদৃশ্য স্পর্শ কপালে অনূভব হতেই পিটপিট করে চোখ মেলে চাইলো। পাথর দাঁড়িয়ে আছে সামনে। ছেলেটার মুখটা মলিন হয়ে আছে। জীবনে প্রথমবার কহিনুরের মনে হলো বড্ড ভুল হয়ে গেছে। নিজের বুদ্ধি সঠিকভাবে কাজ করছে না। পাথর ফিসফিস করে বলল,

সরি আমি লুকোচুরি করতে চাইনি। তাছাড়া আমি জানতাম তুমি আমাকে চিনে ফেলবে। তাই একটু মজা করেছি। কিন্তু মোটেই আমি প্রেয়সীর জাদুকরী নেত্রজলে ভেসে যেতে চাইনা নূর। এভাবে কান্নাকাটি করে আমাকে ঘায়েল করতে পারনা।
কহিনুর উত্তর দিলোনা প্রশ্ন করলো,

কেনো এসেছেন এখানে? আর কেমন লুক এটা? প্রথমে চিনতেই পারিনি। ধোকা দিচ্ছেন আমাকে? জানেন এখানে কতটা বিপদ আছে?
পাথর পা ভাজ করে হাতদুটো বুকের সঙ্গে বেঁধে দাঁড়িয়ে পড়লো। কিছুক্ষণ পত্নীর মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে ধীর কণ্ঠে বলল,

শরীরের নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেও আমি কিন্তু আত্নার নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনা। তুমি এতোকিছু জানতে এটা জানোনা যে আর্ধমানবদের শরীর অচেতন হলেও তাদের আত্না অচেতন হয়না? কিছু করার নেই আমি তোমার সঙ্গেই থাকছি। আফসোস আমার শরীর নেই দেখে তুমি আমাকে জড়িয়ে ধরতে এসেছিলে। যেটা পূর্বে কখনও করোনি।

কহিনুর অসহায় চোখে ওর দিকে চেয়ে থাকলো। লোকটার জন্য কতটা সময় অপচয় হলো। সেদিকে খেয়াল নেই। ওর মনে কতটা প্রেম জমে আছে আল্লাহ মালিক জানেন। কহিনুর সিদ্ধান্ত নিলো এর শেষ দেখে ছাড়বে এবার। এতো প্রেম কোথা থেকে আসে। বেকুব জামাই জুটেছে কপালে চারদিকে ঝামেলার মধ্যেও তার হৃদয়ে ভালোবাসার ঘূর্ণিঝড় হয়। অনাবৃষ্টি খরা লেগেই থাকে।

বকাবকি করে লাভ নেই নূর। সত্যিটা ধামাচাপা দিয়ে আটকানোর চেষ্টা করবেনা। যাইহোক সাঈদ কোথায়? ওই ফাজিল আমাকে ওষুধ দিয়েছে ওর সঙ্গে একটা বোঝাপড়া আছে আমার। তোমার মালকিন প্রহেলীকা এলেক্স লয়েডের কিন্তু ঘুম ভেঙে গেছে। উনি নিশীথে জঙ্গলে গিয়ে কি একটা করেন জানো সেটা? মহিলার বোকামি দেখে আমি হতাশ। আল্লাহ, নিজের ভালো পাগলেও বোঝে।

কহিনুর ভ্রু কুচকে ফেলল পাথরের কথা শুনে। এখানে এসে এই ছেলেটার ফাঁদে পড়ে সবটা এলোমেলো হয়ে গেছে। তাছাড়া এখনো পযর্ন্ত এলেক্স লয়েডের মুখ দর্শন করা হয়নি। কোথায় আছে কে জানে। রাত তিনটা বেজে দুই মিনিট। কহিনুর চনচল হয়ে উঠলো। বেলকনি থেকে বেরিয়ে আসতে দ্রুত পা চালালো। পাথর ওর পেছনেই আছে। ওরা সাবধানে সিঁড়ির আড়ালে দাঁড়িয়ে পড়লো। উপর থেকে খটখট আওয়াজ ভেসে আসছে। কিছুক্ষণের মধ্যে প্রহেলীকা এলেক্স লয়েড বেরিয়ে আসলেন।

হাতে কিসের একটা ডালা রাখা। শরীর প্রায় অর্ধনগ্ন দৃষ্টিকটু স্থান ছাড়া কাপড়ের ছিটেফোঁটা নেই। তবে উনার চেহারা পূর্বের থেকে বেশ সুন্দর লাগছে। বয়স বছর দশেক কমে গেছে। মহিলার মধ্যে রহস্যের ছড়াছড়ি। ভদ্রমহিলা চুপচাপ সদর দরজা খুঁলে বেলিয়ে পড়লো। কহিনুর পা মেলালো উনার সঙ্গে। সদর দরজা পেরিয়ে ওরা পেছনের গেট দিয়ে জঙ্গলের রাস্তায় গিয়ে উঠলো। এই অঞ্চলে বাগানের পরিমাণ বেশি। ঘরবাড়ি বেশ দূরে দূরে। প্রতিবেশীদের বাসা খানিকটা দূরে তবে এটা সুলতান ভিলার মতো না।

জঙ্গলের গভীরতা মোটামুটি বোঝা যায় কারণ ওপাশে একটা রেস্টুরেন্টে আছে। জঙ্গলের ভেতরে প্রবেশ করতেই চারপাশ থেকে কয়েকজন মেয়ে এসে প্রহেলিকার পাশাপাশি হাটতে শুরু করল। ওরা খানিকটা এগিয়ে গিয়ে একটা গাছের নিচে গিয়ে চুপচাপ হাত জোড় করে বসলো। কিছুক্ষণ পর সেখানে কয়েকজন মুখোশ পরা লোক এসে দুটো ড্রাম দিয়ে রেস্টুরেন্টের দিকে চলে গেলো। একটা মেয়ে উঠে গিয়ে মগ ভর্তি তরল জাতীয় কিছু তুলে এনে প্রহেলীকার মাথা ঢেলে দিলো। এভাবে চলতে থাকলো নিয়ম। মোমবাতির নিভু নিভু আলোতে ভদ্রমহিলার মুখটা রাঙিন লাগছে। পাথর এতোক্ষন চুপচাপ ছিল তবে এখন আর পারলোনা ফিসফিস করে বলল,

দেখেছো কি পাগলামি করছে নিজের রূপ ধরে রাখার জন্য। এসব ফালতু কাজকর্ম করে কিসের লাভ? বয়স থাকতে সঙ্গীকে একটু পাত্তা না দিয়ে বুইড়া বয়সে রঙ তামাশা করে মনরে বুঝ দিয়ে কি হবে? যা চলে গেছে সেকি ফিরবে?
কহিনুর ওর কথায় পাত্তা দিলোনা। লোকটা উল্টোপাল্টা বকছে। কহিনুর আগেই জানতো প্রহেলীকা এলেক্স লয়েড কালো জাদু করে। নিজেকে অনন্যা সুন্দরী করে তুলতে এসব করছে।এটা খুব সাধারণ বিষয় কিন্তু এর বাইরেও কিছু আছে। ছোটবেলা সম্পর্কে কহিনুরের সব কিছু মনে নেই। কিছু অংশ অজানা, কোনো কারণে হয়তো ভুলে গেছে। গালিব আর প্রহেলিকা এটা ভালো বলতে পারবে।

আমার ড্যাড আর মম এখানে আছে বলেছিলেন না আপনি? কোথায় তারা?
পাথর হাসলো,
ওরা সত্যি তোমার বাবা মা? মানে তোমার মনে আছে ছোট থেকেই তুমি ওদের কাছে আছো? সুলতানা কহিনুর ফারুকীর জন্ম দুবার হয়েছে অদ্ভুত না? পূর্ণজন্মে বিশ্বাস আছে নাকি তোমার?
কহিনুর থমকে গেলো পাথরের প্রশ্ন শুনে । সবটা মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। এতোদিন যা ভেবেছিল এখন নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। এলোমেলো লাগছে। গভীর রহস্যে তলিয়ে যাচ্ছে। এর থেকে উদ্ধার হতে এই মহিলার সাহায্য লাগবে। কহিনুর মিনমনে কণ্ঠে বলল,

আমার কিছু মনে পড়ছে না কেনো? আমি ড্যাডের কাছে কবে এসেছিলাম জানিনা। তাছাড়া গত পূর্ণিমাতে আমি একটা মেয়েকে দেখেছি বাচ্চাকে পাশে নিয়ে ছটফট করছিল। আমার মনে হল ওটা আমি ছিলাম। তাছাড়া পূর্বেকার সবটা সেদিন রাতেই মনে পড়েছে। সুলতান হাউজের শেষের দিন অর্ধমানবদের সঙ্গে কি আমিও কাল ঘুমে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম? নাকি আমার মৃ/ত্যু হয়েছিলো? মৃ/ত্যুর পরেও ফিরে আসা কিভাবে সম্ভব?

আমার কিছুটা সন্দেহ হলো তাই জিঞ্জাসা করলাম। গালিব নামটা আমার অনেক চেনা চেনা লাগে জানো? আচ্ছা নূর তোমার মেজো ফুপার নামটা কি ছিল যেনো? ভদ্রলোকের চেহারা কখনও দেখেছো তুমি?
কহিনুর আনমনে ভাবতে শুরু করলো। সবটা কেমন গোলমেলে লাগছে। কাকে ভালো বলবে কাকে খারাপ বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। কথায় বলে শস্যের মধ্যে ভুত থাকে।

নিশী মানেই পৃথিবী জুড়ে অদৃশ্য শক্তির অঘাত বিচরণ শুরু। অদৃশ্য শক্তিগুলো মানুষের আশেপাশে ঘুরে বেড়ায়। শয়/তানের কাজকর্ম শুরু হয়ে যায়। বিশাল একটা বৃক্ষের ডালে ঝু/লন্ত অবস্থায় দুলছে অরিত্রী। ওষ্ঠে বাঁকা হাসি তবে চোখদুটো লাল হয়ে ফুলে আছে। হাতের কব্জিতে সুক্ষ খ/ঞ্জরের রেখা সেখান থেকে কালো র/ক্ত টপটপ করে মাটিতে পড়ছে। একজন লোক অরিত্রীর পায়ের কাছে মাটিতে বসে আছেন। ভদ্রলোকের পোশাক আলখাল্লা টাইপ।

শরীরের গঠন বেশ লম্বা তবে তুলনামূলক চিকন। কালো রঙের জটলা দাড়ি পায়ের কাছে ঝুলছে। গায়ের রঙ ফর্সা । লোকটা চোখ বন্ধ অবস্থায় অনবরত মন্ত্র পড়ছেন। উনার সামনে একটা খেলনা ডল রাখা আছে। চাঁদের আবছা আলোতে কিছুটা বোঝা যাচ্ছে। দূরের একটা গাছে ডালে কালো রঙের একটা পাখি ঝিমধরে বসে আছে। নির্জনতা কাটিয়ে লোকটা বিড়বিড় করে বলল,

স্বাগতম,তোমার যাত্রা সফল হোক। ক্ষমতাবতী হয়ে উঠো।
সঙ্গে সঞ্চয় দমকা হওয়াতে অরিত্রীর গ/লার রশিটা খুঁলে গেলো।ঝাপ দিয়ে মেয়েটা নিচে নেমে এসে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। নির্জন জঙ্গলের মধ্যে হাসির শব্দ তরঙ্গ হয়ে চার‍দিকে প্রতিধ্বনি হয়ে ঘুরতে শুরু করলো। নিচে বসে থাকা ব্যক্তির ধৈর্য কম তাই উনি ধমক দিয়ে উঠলেন,

থামো অর্বাচীন বালিকা। তোমাকে অযথা হাসাহাসির জন্য এখানে ডাকা হয়নি। কথার অবাধ্য হলে এই শরীরটা জ্বা/লিয়ে দিতে দুবার ভাবতে যাবনা। অনেকদিন পরে শরীর পেয়েছো সন্তুষ্ট থাকো। আমার কাজটা কিন্তু ঠিকঠাক হওয়া চাই।
লোকটার কথা শুনে হাসির শব্দ বন্ধ হয়ে গেলো। আবারও চুপচাপ নিরবতা। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটার চুলগুলো বাতাসে উড়ছে। মস্তিষ্ককে দুরধিগম্য চিন্তা। মেয়েটা কিছু না ভেবে হুটকরে লোকটার সামনে বসে পড়লো। লম্বাটে হাতটা একটু একটু বাড়িয়ে দিলো গ/লার দিকে। কিছু বুঝে উঠার আগেই ছদ্মবেশী লোকটার গ\লা ধরে আছাড় দিয়ে হুঙ্কার ছাড়লো,

আমাকে চিনিস না তুই? একেবারে প্রা/ণ নিয়ে নিব। একদম আমাকে রাগা/বিনা বলে দিলাম। আমাকে হুকুম দিচ্ছিস?
লোকটা ঘাবড়ে গেলো এমন কথাবার্তা শুনে। এসব পি/শাচ ভুত পেত্মিকে বিশ্বাস করা মুশকিল। কখনও রেগে যায় বলা কঠিন। যখন তখন যা কিছু হয়ে যেতে পারে। লোকটা ভয়ে ভয়ে উঠে বসলো। দ্রুত চোখ বন্ধ করে মন্ত্র উচ্চারণ করতে লাগলো। মেয়েটা সেদিকে চেয়ে কিছু বলল না। হুটকরে দৌড়াতে শুরু করলো। দৌড়াতে দৌড়াতে এক সময় রাতের আঁধারের সঙ্গে মিশে অদৃশ্য হয়ে গেলো।

মুখ ফুলিয়ে বসে আছে মিরা। দৃষ্টি ঘুম ঘুম চোখে মায়ের মুখের দিকে চেয়ে আছে। কিছুটা দূরে জামসেদ ল্যাপটপ মুখ ডুবিয়ে বসে আছে। আশেপাশের দিকে ওর খেয়াল নেই। আপাতত সুলতান ভিলাতে বড়সড় কোনো ভূমিকম্প হলেও ওর মনোযোগ নষ্ট হবে না।সেটা নিয়েই মিরা কিছুটা টেনশনে আছে। কিছুক্ষণের মধ্যে জুবায়ের এসে হাজির হলো। অধরা কিচেনে সকলের জন্য চা তৈরী করছে। এখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ মিটিং হবে। মীরা সবাইকে এখানে উপস্থিত হতে বলেছে। আলফা ঢুলতে ঢুলতে এসে সোফায় হেলান দিয়ে পা তুলে বসে হামি ছেড়ে বলল,

ছোট আম্মু তোমার বান্ধবীর খবর কি? শপিং করবে না? দুদিন আগে ওদেরকে দেখলাম শপিংমলে।তোমার বান্ধবীর দুটো ছেলেমেয়ে আছে সেই কিউট।
মীরার চোখ দুটো ঝলমল করে উঠলো আলফার কথা শুনে। খুশীতে উত্তেজিত হয়ে উত্তর দিলো,

বাবু এটাইতো সবাইকে বলতে ডেকেছি। ওর ছেলেটাকে দেখেছিস? সেই দেখতে কিন্তু । জামাই হিসেবে আমার বড্ড মনে ধরেছে। ছেলেটা ড্যান্স ক্লাবে মেয়েদের ক্রাশ বয়। যেমন দেখতে তেমন ওর প্রতিভা। অরি আমাদের দৃষ্টিকে ওর ছেলের জন্য চেয়েছে। শাশুড়ি এমন ভালো হলে সেই পরিবারের আমার মেয়ে গেলে সুখী হবে। তোমাদের মতামত কি?
নির্জন কক্ষে বড় ধরণের ঘূর্ণিঝড় বয়ে গেলো। সকলের দৃষ্টি মীরার মুখের দিকে। আলফা শব্দ করে হেসে গড়িয়ে পড়লো দৃষ্টির গায়ের উপরে। মেয়েটা এবার চটে গেলো। আলফাকে ধাক্কা দিয়ে সোজা করে বসিয়ে মায়ের দিকে কঠিন নজরে তাকিয়ে বলল,

পৃথিবীতে ছেলে আর পেলে না? শেষমেশ ওই ছ্যাঁচড়াকে তোমার পছন্দ হতে হলো? জানো ড্যাড ওই ফাজিলের জন্য আমার ইউনিভার্সিটির মেয়েগুলো বিরক্ত হয়ে গেছে। হুটহাট ভিডিও তৈরী করে সে ফেমাস। তিড়িং বিড়িং করে নাচতে জানে। আমাদের চৌদ্দ পুরুষের মধ্যে এমন কুখ্যাত গুণের অধিকারী কেউ আছে বলো?

মেয়ের কথা শুনে মীরার মুখটা দেখার মতো হলো। আপাতত বিষয়টা কেউ সিরিয়াস ভাবে নিচ্ছে না। জুবায়ের ফোনের মধ্যে ব্যস্ত। অধরা কফির স্বাদ নিচ্ছে চোখ বন্ধ করে। কাজ শেষ করে কফি নিতে নিতে জামসেদ উত্তর দিলো,
তোমার মমের কোনো কাজকর্ম নেই হুদাই এসব আজেবাজে চিন্তাভাবনা করে ওর দিন কাটে। তুমি ওসব বাদ দাও। টেনশন নেওয়ার জন্য আমি আছিতো।
দৃষ্টি খুশি হলো। মায়ের দিকে চেয়ে মিষ্টি করে হাসি দিয়ে বলল,

মম তুমিও চিন্তা করোনা।
মীরা উত্তর দিলোনা। মুখ গোমড়া করে আছে। কতটা আশা নিয়ে সবাইকে ডেকেছিলো অথচ কেউ রাজি হলোনা। বান্ধবীকে এখন কি বলবে সেই চিন্তাতে রাগ হচ্ছে। জুবায়ের ওকে শান্ত করতে বলল,
দৃষ্টির জন্য আমরা রাজপুত্র খুঁজে আনবো। এমন বিখ্যাত কুখ্যাত জামাই আপাতত আমাদের দরকার নেই। আমাদের জামাই সাধারণ মানুষের মতো নরমাল হবে বুঝলে?

মীরা মাথা নাড়ালো। জুবায়ের মগ হাতে উঠে আসলো। গতকাল রাতে অদৃশ্য একটা ছায়া দেখেছিলো বাগানের দিকে। সিসি ক্যামেরা আছে সেখানে কিছুই ধরা পড়েনি । ওটা মানুষের আকৃতি ছিল নিশ্চিত। জুবায়ের সোজা বেলকনিতে গিয়ে চমকে উঠরো। সঙ্গে হাতের মগটা নিচে পড়ে গেলো। ফ্লর জুড়ে র/ক্ত আর পচা মাং/সের অংশ ছড়িয়ে আছে। দেয়ালে ছোট ছোট অক্ষরে লেখা আছে,

কহিনুর তৃতীয় খণ্ড পর্ব ২৪

” বধির বোবার ললাট লিখন ভাগ্য দোষে হয় খণ্ডন। প্রদীপ শিখার মৃত্যু হলে ঊষার দোয়ার বন্ধ হবে।কালো শক্তি রাজ করবে।”

কহিনুর তৃতীয় খণ্ড পর্ব ২৬

1 COMMENT

Comments are closed.