কহিনুর তৃতীয় খণ্ড পর্ব ২৪

কহিনুর তৃতীয় খণ্ড পর্ব ২৪
লাবণ্য ইয়াসমিন

ষাট ঊর্ধ্ব বয়সী মহিলার সামনে বসে আছে কহিনুর। মহিলার চোখে মুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। ঘনঘন চন্দ্র রাঙা অধরখানি সুচালু করে নাক টানা হয়তো ভদ্রমহিলার মুদ্রা দোষের মধ্যে পড়ে। উনার পরনে কটকটে পিঙ্ক কালারের টপ আর ব্রাউন কালারের স্কাট।

গায়ের রঙ শ্যামবর্ণ তবে সেটা ফাউন্ডেশনের নিচে চাপা পড়ে শহীদ হয়েছে আপাতত সেটা না বলাই ভালো।দুহাতের লম্বা নকগুলোতে নানারকম ট্যাটু টাইপ নেইলপালিশ তবে চুলগুলো খুব একটা লম্বা না কাধের উপরে ছড়িয়ে আছে। নিজেকে স্মার্ট তৈরীর যথাযথ প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। কতটা সফল সেটা উনার সঙ্গী ভালো বলতে পারবেন। তবে এসব অতিরিক্ত রঙচঙ কহিনুরের একদম ভালো লাগেনি। এই বয়সী মহিলাদের ধর্মকর্ম আর নাতি নাতনিদের সঙ্গে সময় কাটানোর কথা তানা উল্লুক হয়ে ঘুরছে। কহিনুর কথাগুলো মনেমনে ভাবছিলো হঠাৎ সামনে থেকে উনি বলে উঠলেন,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

হাই!আমি প্রহেলীকা এলেক্স লয়েড তোমার জন্য ঠিক কি করতে পারি?
কহিনুর চমৎকার করে হেসে উত্তর দিলো,

হ্যালো ম্যাম! আমি পেশায় একজন বিউটিশিয়ান। বার্লিন শহরে আমার একটা বিউটি পার্লার আছে।সেখান থেকে আপনার কন্যার সঙ্গে আমার পরিচয়। উনি আমাকে এখানে পাঠিয়েছেন। ম্যাম বলেছিলেন উনার সুন্দরী মমের জন্য আমাকে প্রয়োজন।শুনেছি আপনি একজন ঘরোয়া বিউটিশিয়ানের খোঁজ করছিলেন। আমি চমৎকার মেকআপ আর পোশাকের ডিজাইন করতে পারি । আপনি চাইলে আমার সার্টিফিকেট দেখতে পারেন। ম্যাম আপনি কি দেখবেন?

কহিনুর কথাগুলো বলে মহিলার মুখের দিকে চাইলো। ভুলভাল কিছু বলেছে কিনা বুঝতে পারছে না। কিছু একটা রিয়েক্ট বোঝা যাবে তাই অপেক্ষা করছে।
বিউটিশিয়ান সঙ্গে আবার ডিজাইনার? একের মধ্যে দুই? কোথা থেকে ডিগ্রী অর্জন করেছো তোমার প্রতিষ্ঠানের নাম কি বলো?
কহিনুর ঢোক গিলল এমন প্রশ্ন শুনে। মহিলার বয়স অনেক কিন্তু বুদ্ধিটা বেশ প্রখর।প্রথমে সেটা বুঝতে পারলে আরও সজাগ হতে পারত। ওর বাইরে থেকে কোনো প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেওয়া হয়নি। এক প্রকার ঘরোয়াভাবে শিখেছিলো এখন সেটা ধোপে টিকবে কিনা সন্দেহ।তবে কহিনুর কিছুতেই ধরা পড়তে চাইছে না। কিছু একটা বলা প্রয়োজন তাই ফট করে বলে ফেলল,

সেটা আমার সার্টিফিকেট দেখলেই বুঝতে পারবেন। মুখে বললে বিশ্বাস করবেন না। ম্যাম আপনার বয়স কি ত্রিশের কাছাকাছি? আপনার কন্যার বয়সের থেকে আপনাকে অনেকটাই ছোট মনে হয়। আচ্ছা উনি কি আপনার নিজের মেয়ে নয়?
কহিনুরের কথা শুনে ভদ্রমহিলা লজ্জা পেলেন। তবে সঠিক উত্তর দিলোনা সৌন্দর্যের বর্ণনা কার না ভালো লাগে তাই কিছু না ভেবেই বললেন,

আমি কথা না কাজে বিশ্বাসী।কক্ষে চলো দেখি তোমার পারদর্শিতা। যদি তোমার কাজ আমার পছন্দ হয় থাকতে পারো।সামনে বড় একটা ইভেন্টের আয়োজন করেছি আমার স্বামীর জন্মদিন উপলক্ষে। এই বাড়িতে একজন মহিলা আছেন উনি আমার স্বামীর প্রথম স্ত্রী। আমি চাই ওর থেকে সুন্দর দেখাক আমাকে। পারবে তুমি?
কহিনুর বাঁকা হেসে চোখের পাপড়ি নাড়িয়ে বলল,

এ আর এমন কি? আপনি চলুন ইভেন্টের আগে থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। সবটা আমার হাতে ছেড়ে দিন। প্রমিজ এমন সাজাবো আপনাকে দেখলে যেকোনো পুরুষের চোখে ঘোর লেগে যাবে। রেড ওয়াইন ব্লাক হয়ে যাবে। নেশা ধরে যাবে সকলের চোখে।
কহিনুরের অতিরিক্ত বকবকনি হয়তো উনার পছন্দ হলোনা তাই ভ্রু কুটি করে হাতের ইশারায় ওকে থামাতে বললেন,

আমাকে অনুসরণ করো। সিঁড়ির পাশের কক্ষে তুমি থাকবে। যখনই প্রয়োজন হবে আমি তোমাকে ডেকে নিব। দ্বিতীয় ফ্লোরে যাবেনা সেখানে থাকা মহিলার মুখ দর্শন করো সেটা আমি চাইছি না। আর এই ফ্লরের দক্ষিণের কক্ষগুলো বন্ধ থাকে। ওদিকে দরকারি জিনিসপত্র আছে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। তুমি শুধুমাত্র আমার জন্য এসেছো তাই সব চিন্তা ভাবনা আমাকে নিয়ে করবে ঠিক আছে?
ভদ্রমহিলা হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে কথা বলছে। অহমিকা উনার কণ্ঠ থেকে ঝরে পড়ছে। কহিনুর তাচ্ছিল্যপূর্ণ হাসলো। মাথা নাড়িয়ে বলল,

নিশ্চয়ই ম্যাম। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ আমাকে সুযোগ দেওয়ার জন্য। আমার পরিবার আপনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে। আমার বাবা অত্যন্ত ভালো মনের মানুষ। উনি খুশী হবেন আপনার উপরে। দোয়া করবেন সব সময়।
একটা কথা মনে রাখবে এখানে অতিরিক্ত কথাবলা আমার স্বামী মোটেও পছন্দ করেন না। রাত দশটার পরে নিজের কক্ষের দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়ে যাবে। তোমার কক্ষে টেলিভিশনের ব্যবস্থা করেছি বোরিং লাগবে না। তাছাড়া তুমি সেই সময় আমার পোশাকের ডিজাইন নিয়ে ভাবতে পারবে বুঝেছো?

চিন্তা করবেন না ম্যাম আমার মস্তিষ্কের ধারণ ক্ষমতা প্রখর। আপনি যা বলছেন তাই হবে।
কহিনুর কথা বলতে বলতে ভদ্রমহিলার সঙ্গে উনার কক্ষে গিয়ে হাজির হলো। বিশাল কক্ষের ভেতরে একদিকে ওয়াশরুম অন্যদিকে মেকাপের। কক্ষে দামি দামি আসবাবপত্রের ছড়াছড়ি। বেশ সৌখিন আছে। কহিনুর পূর্বেই জেনেছিলো মহিলার এসবের প্রতি একটু আলাদা মমতা আছে কিন্তু এতোটা ভাবতে পারেনি। কিছুটা অবাক হচ্ছে। মেকাপ রুমটাকে ওর বিশাল আকৃতির একটা দোকান মনে হচ্ছে। গাদাগাদি করে পোশাক জুয়েলারি আর জুতা রাখা আছে। তবে সবটা গুছিয়ে রাখা কোথাও এলোমেলো নেই। কহিনুর ঘুরে ঘুরে সবটা দেখে নিয়ে আনমনেই বলল,

ম্যাম এতগুলো কালেকশন করতে আপনার কতদিন লেগেছে? চমৎকার সব ডিজাইনার পোশাক জুয়েলারি সেট। আপনি সত্যি অন্যরকম।
কহিনুরের কথায় ভদ্রমহিলা খুশি হলো কিনা বোঝা গেলোনা। মুখটা যেমন ছিল তেমনি আছে। নিজের জিনিসপত্র নিজেই কেমন ঘোরলাগা দৃষ্টিতে দেখছে।সেদিক চেয়ে কহিনুর পূণরায় বলল,

ম্যাম আমার পরিক্ষাটা কি শুরু করবো?
নিশ্চয়ই।
প্রহেলীকা চুপচাপ গিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে আয়েশী ভঙ্গিতে পায়ের উপরে পা রেখে বসলো। উনার দৃষ্টি এখন আয়নার দিকে। কহিনুর উনার ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল সামান্য এগিয়ে এসে তুলিটা নিজের হাতের মুঠোয় তুলে নিলো। সবটা ঠিকঠাক করে কতটা পারবে জানা নেই তবে চেষ্টা করবে এই মহিলার মনে জায়গা তৈরী করে নিতে। সাঈদ ড্রেসিং টেবিলের সাইডে দাঁড়িয়ে এতোক্ষন চুপচাপ প্রহেলীকাকে দেখছিলো। ভদ্রমহিলার যে বয়স হয়েছে সেটা হয়তো ভুলে গেছে তাই ও সিদ্ধান্ত নিলো নিজ দায়িত্বে সেটা মনে করিয়ে দিবে। ধৈর্যের একটা সীমা আছে। কহিনুর কাজ করছে আর ওকে ইশারা করছে বিরক্ত না করতে। ঘন্টা খানিকটা পরে নির্জনতা কাটিয়ে কহিনুর আচমকা বলে উঠলো,

ম্যাম চোখ খুলে দেখুন পছন্দসই হয়েছে কিনা।
ভদ্রমহিলা পিটপিট করে চাইলো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা নারীকে দেখে বয়সের তারতম্য ভুলে গিয়ে যেকোনো যুবক প্রেমে পড়বে নিশ্চিত। ভদ্রমহিলার ছোট ছোট চুলের ভাজে নকল চুলের আগমন ঘটেছে সেটা কোমর অবধি ছড়িয়ে আছে। অধরে শোভা পাচ্ছে গোলাপী রঙের লিপস্টিক।এতো সুন্দর সাজিয়েছে দেখে উনি খুশি হয়ে কিছুটা উত্তেজিত হয়ে বললেন,

চমৎকার তোমার কাজ। আমার পছন্দ হয়েছে। ইভেন্ট পর্যন্ত তুমি এখানে থাকবে। অবশ্য পরেও থাকতে পারো আমার অসুবিধা নেই।
কহিনুর উত্তর দিলোনা শুধুই হাসলো। তুলিটা ঘুরাতে ঘুরাতে মিনমিনে কণ্ঠে কবি জীবনান্দের লেখা কবিতার কয়েক লাইন উচ্চারণ করলো,
“চুল তার কবে কার অন্ধকার বিদিশার নিশা, মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য, অতদূর সমুদ্রের পর হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা”

রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে কহিনুর।কিছুক্ষণ পূর্বে ভদ্রমহিলার থেকে মুক্তি পেয়ে কিছুটা স্বস্তি লাগছে। সাঈদ বরাবরের ন্যায় রেলিং ধরে হাটাহাটি করছে। বাগান থেকে অজানা ফুলের সুগন্ধ ভেসে আসছে। এই বাড়ির লোকজনকে নিয়ে ভাবতে হচ্ছে।আলেক্স লয়েডের একটা পারফিউমের কোম্পানি আছে। বেশ টাকা পয়সার মালিক বলা চলে। শহরের ধনীদের মধ্যে একজন। কিছু একটা ভেবে কহিনুর আনমনে বলে উঠলো,

সাঈদ পূর্বে খান গ্রুপের মালিক কে ছিল কিছু কি জানো? অর্ধমানবেরা তো আর ঘুমন্তাবস্থা থেকে জাগ্রত হয়েই কোম্পানি খুলে প্রচুর টাকার মালিক হয়নি। ওদের সম্পদের উৎস কি?
ওদের কাছে শক্তি আছে নূর।বড় কোনো ব্যবসায়ীকে গু/ম করে সবটা নিজেদের করে নিতে সময় লাগেনা। তাছাড়া ওদের সঙ্গে ওদের পয়সাও অদৃশ্য ছিল। যখন ফিরেছে সবটা নিয়েই ফিরেছে। ওদের চিন্তা ছেড়ে তুমি ওই পাগল মহিলাকে নিয়ে ভাবো। বয়সের সঙ্গে মানিয়ে নিজের পোশাক পরিচ্ছেদ না পরে বাচ্চাদের ন্যায় পোশাক কিভাবে পরতে পারে সে? কোনো চয়েজ নেই অদ্ভুত মহিলা। আমার মনে হয় উনি পাগল। আমি জাদু করে ওর পোশাক আর মেকাপে আগুন লাগিয়ে দিব।তুমি শুধু একবার অনুমতি দাও।

সাঈদের এলোমেলো কথা শুনে কহিনুর বিরক্ত হলো। ছেলেটার মাথা ভর্তি আজগুবি চিন্তাধারা। এখানে সখ্যতা করতে আসা হয়নি সেটা কে বোঝাবে? তাই বিরক্ত হয়ে বলল,

ভুলভাল কিছু করবে না তুমি। কিছু অঘটন ঘটালে ওর সঙ্গে তোমার বিয়েটা আমি নিজ দায়িত্বে করিয়ে দিব দেখে নিও। তখন সারাজীবন ওকে নিয়ে গবেষণা করে কাটিয়ে দিতে হবে। স্ত্রী হিসেবে সে খারাপ না চমৎকার একজন মানুষ। স্বামীকে খুশি রাখতে বাহারী সাজে নিজেকে সাজিয়ে তুলতে পছন্দ করে। খারাপ কিছু দেখিনা বরং তোমার জন্য ভালো হবে। বউয়ের চমৎকার চমৎকার লুক দেখে ক্ষণেক্ষণে অজ্ঞান হবা।
কহিনুরের কথা শুনে সাঈদ চমকে উঠে বলল,

ইন্নালিল্লাহ! এসব কি বলছো তুমি? ওই মহিলার সঙ্গে আমি কেমনে কি? মাথা গেছে তোমার। আমি যাচ্ছি এখন। ওদিকে একজন ঘুমের মধ্যেই আমাকে আচ্ছা করে গালি/গালাজ করছে এদিকে তুমি আমার বিরুদ্ধে এতো বড় ষড়যন্ত্র করছো। তোমাদের দুজনের খপ্পরে পড়ে আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি।

সাঈদের চোখ ছলছল করছে। পাথরের খাবারে ওষুধ মেশানোর পরে ভয়ে ছিল সেটা সত্য হয়েছে। পাথর বুঝে গেছে ওষুধ সাঈদ মিশিয়েছে। তারচেয়ে বড় কথা লোকটা শুধুমাত্র নিজের শরীর মুভ করতে পারছে না তাছাড়া ওর মস্তিষ্ক কাজ করছে। নিদিষ্ট সময় পরে চোখ খুঁলতে পারবে। সাঈদ মন খারাপ করে রেলিং থেকে নিচের দিকে লাফিয়ে পড়লো। কহিনুর সেদিকে চেয়ে হাসলো। এখনো অনেক কাজ বাকি আছে ভেবে চুপচাপ বেরিয়ে আসলো কক্ষ থেকে। দক্ষিণের দিকে যাওয়া নিষেধ ছিল ভেবে এগিয়ে গেলো সেদিকে।

চারদিকে পিনপতন নিরবতা বিরাজ করছে। সামান্য পিন পড়লেও শব্দ হবে। লনের আলো জানালা দিয়ে সামান্য পরিসরে ভেতরে প্রবেশ করছে তাতে আবছা অন্ধকার লাগছে পুরোপুরি না। কক্ষের দেয়ালের সঙ্গে ম্যাচ করে দরজা তৈরী করা হয়েছে ফলে খুব সহজে পার্থক্য বোঝা যায়না।দরজা চিনতে প্রথমবার সকলে ভুল করবে নিশ্চিত। কহিনুর একটা কক্ষে সামনে গিয়ে দেয়ালের সঙ্গে লাগানো হাতলটা আলগোছে তুলে নিয়ে দরজা খুঁলে ফেলল।

সামান্য উঁকিঝুঁকি দিয়ে বুঝলো ভেতরে কিছু নেই। শুধুমাত্র ফ্লর আসবাবপত্রের নিশানা পযর্ন্ত নেই। কহিনুর ভ্রু কুচকে পূণরায় অন্য দরজার সামনে গিয়ে উঁকি দিলো। এখানেও আসবাবপত্র নেই তবে ফ্লর জুড়ে নকশা করা আলপোনার মাঝে পিটপিট করে একটা মোমবাতি জ্বলছে। কক্ষের মাঝামাঝি বরাবর ওয়ালের কাছে সামান্য লাল রঙের মাথার খু/লি আর একটা পাত্রে লাল বর্ণের তরল।

কহিনুর চোখ বন্ধ করে বুঝে নিলো এখানে কালো জাদুর জন্য ব্যবহার করা হয়। ও আর অপেক্ষা করলোনা বেরিয়ে আসলো পাশের কক্ষ চেক করার জন্য। কহিনুর দরজার হাতলে হাত রাখতেই আচমকা একটা হাত ওর হাতের উপরে ছুয়ে গেলো। দমকা গরম বাতাস এসে লাগলো ওর শরীরে। কহিনুর পেছনে ফিরতে চইলো কিন্তু পারলোনা। ওর কানের কাছে ফিসফিস করে উচ্চারিত হলো,

অর্ধমানবী রাজকন্যা অবশেষে আপনার পদধুলি আমার বক্ষস্থলে পড়তেই হলো। আমার হৃদয় রাজ্যের রাণী, স্বাগতম আপনাকে।

উদাসীন চিত্তে বাগানের দোলনাতে বসে আছে দৃষ্টি। রাতের সেই দৃশ্যটা বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। কিছুতেই ভুলতে পারছে না। ছেলেটার এমন অদ্ভুত ব্যবহারের কারণ মাথাতে আসছে না। যদি লোকটা পাগল হয় তবে পাগলামি করার জন্য ওখানে আরও মেয়েরা ছিল এমনকি শহরের নামকরা নাচিয়ে মেয়েরা এসেছিলো সেখানে যেতে পারতো সেসব কিছুই করেনি। দৃষ্টির ধ্যান ভাঙলো জুবায়েরের কণ্ঠ শুনে।

আমার আম্মার কি মন খারাপ? যদি মন খারাপ হয় তবে আমি ভালো করে দিতে পারি। চমৎকার আইডিয়া আছে আমার কাছে।
দৃষ্টি চমকে উঠে পেছন ফিরে নিজেকে সামলে নিয়ে মলিন হাসলো। ততক্ষণে জুবায়ের দোলনার রশি ধরে দোল দিতে শুরু করেছে। দৃষ্টি উত্তর দিল,

আমিতো ঠিকঠাক এখন তোমার কথা বলো। হঠাৎ অফিস ছেড়ে বাড়িতে কি তোমাদের?
জুবায়ের পেছন থেকে এবার সামনে আসলো। দৃষ্টির হাতটা ধরে পাশে বসতে বসতে উত্তর দিলো,
এখন থেকে অফিস বাদ। সারাদিন বাচ্চাদের সময় দিব তার অধরা বারিকে হুকুম করবো। কেমন হবে বলো?
জুবায়েরের কথা শুনে দৃষ্টি শব্দ করে হেসে উঠে বলল,

যখন রেগে যাবে তখন কি হবে?
মানিয়ে নিবো। এটাইতো করে আসছি আজীবন তাইনা?
তুমি পারও বটে। আচ্ছা চাচ্চু তুমি রেড ওয়াইন খেয়েছো? যেটা দেখতে একদম র/ক্তের মতো লাল। চাচ্চু ওয়াইন ফ্লোরে পড়লে কি ওটা জমাটবদ্ধ হয়?
জুবায়েরের ওর কথা বুঝতে পারলোনা তাই স্থির নেত্রে বলল,

ওসব নিয়ে গবেষণা বন্ধ করো দৃষ্টি। তুমি জানো সেসব বাচ্চাদের জন্য ভালো না। তাছাড়া রেড ওয়াইন ওটা জমাট বাধেনা। ওসব ছেড়ে নিজের কক্ষে গিয়ে ঘুমিয়ে যাও। রাত হয়েছে বাইরে থাকা উচিত হবেনা। আমি যাচ্ছি তোমার আম্মু অপেক্ষা করছে। তুমি সঙ্গে যাবে?
দৃষ্টি মাথা নাড়িয়ে বলল,

না তুমি যাও আমি আরও কিছুক্ষণ থাকবো। গার্ড আছে ভয়ের কিছু নেই।
জোবায়ের কিছু একটা ভেবে চলে আসলো। দৃষ্টি সেখানেই বসে আছে। আকাশে চাঁদ উঠেছে চারদিকে লাইটের আলোতে চাঁদের সৌন্দর্য উপভোগ করার উপাই নেই। বেলকনি থেকে বাগানে ফোটা সাদা রঙের ফুলগুলো ওকে ভীষণ টেনেছিলো তাই এসেছে। কিন্তু এখন আর ভালো লাগছে না। আলসেমি লাগছে উঠে যেতে। দৃষ্টি দোলনায় পা তুলে বসে কিছুটা হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করলো।

পেছনের দিকে সারিবদ্ধ গার্ডেরা রাতভর এখানে পাহারা দিবে। তাছাড়া কোনো অবস্থাতেই এই বাড়ির আলো নেভানো হয়না। এটার সঙ্গে ও ছোট থেকেই পরিচিত। সুলতান হাউজ পুরোপুরি অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়না। এর পেছনের কারণটা আজও রহস্য। দৃষ্টি আনমনে ভাবছিলো হঠাৎ পায়ে কারো শীত হাতের ছোঁয়া পেয়ে শিউরে উঠল। ও আর অপেক্ষা করলোনা ঝটপট সোজা হয়ে চোখ খুঁলে চমকে উঠলো। ওর পায়ের কাছে বসে আছে গতকাল রাতের সেই যুবক। যার ওষ্ঠে রহস্যময় হাসি ঝুলে আছে। দৃষ্টি ভয়ে কুকড়ে গিয়ে দোলনা থেকে নেমে পড়তে চাইলো। কিন্তু পারলোনা ছেলেটা খপ করে ওর পা ধরে আটকে দিয়ে চমৎকার হেসে বলল,

ভয় পাচ্ছো কেনো দৃষ্টি? আমি কি তোমার কোনো ক্ষতি করেছি বলো? নাকি মেরেছি?
দৃষ্টি ছেলেটার চোখের দিকে চেয়ে ঘোরে চলে গেলো। মাথা নাড়িয়ে উত্তর দিলো,
না কিন্তু কে আপনি?

তোমার হৃদয়ের মধ্যে বসবাস করা আপনার কেউ একজন। তুমি খোঁজ করছোনা তাই আমার অস্তিত্ব অনুভূত করতে পারছোনা। চোখ বন্ধ করে আমাকে অনুভূত করো আমি তোমাকে সাহায্য করবো। কাছে এসো।
দৃষ্টি মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় ঝুকে গেলো অচেনা যুবকের দিকে ঠিক তখনই সেখানে আলফা গিয়ে হাজির হলো। মূহুর্ত্তের মধ্যে দৃষ্টির ঘোর কেটে গেলো। ও হুড়মুড় করে উঠে গিয়ে দুহাতে আলফার কোমর জড়িয়ে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল,

ওই ছেলেটা এসেছিল এখানে। তুমি দেখেছো ওকে? ও আমার দিকে নজর রাখছে। ওর দৃষ্টিতে আমি হিং/স্রতা দেখেছি। মে/রে ফেলবে আমাকে। খুব ভয় করছে।
আলফা ওর কান্না শুনে বিরক্ত হলো। কতবার করে বুঝিয়েছে এখানে কেউ নেই তবুও মেয়েটা সেই পুরাতন কথা ধরে বসে আছে। আলফা নিজের রাগটাকে নিয়ন্ত্রণ করে ওর মাথায় হাত রেখে বলল,

কহিনুর তৃতীয় খণ্ড পর্ব ২৩

এখানে কেউ নেই। চারপাশে এতো লোকজন তাছাড়া আলো আছে। বাইরের কেউ আসলে দেখতে পেতাম না বল? এটা তোর অবচেতন মনের কল্পনা মাত্র ঠিক আছে?
দৃষ্টি মাথা নাড়িয়ে ওর সঙ্গে বাড়িতে দিকে এগিয়ে গেলো। পেছনে একজোড়া চক্ষু অগ্নি দৃষ্টিতে সেটা পর্যবেক্ষণ করে অদৃশ্য হয়ে গেলো। সেই সঙ্গে অজানা রয়ে গেলো তার পরিচয়।কে এই চক্ষুর অধিকারী? তাঁর উদ্দেশ্য কি?

কহিনুর তৃতীয় খণ্ড পর্ব ২৫

2 COMMENTS

Comments are closed.