আমার আছে জল পর্ব ৮

আমার আছে জল পর্ব ৮
মাহিমা রেহমান

আকাশের বুকে অহরহ পাখির ঝাঁক। ঝাঁক বেঁধে তারা আপন নীড়ে ফিরে যাচ্ছে।করো ডাকে চেতনা ফিরতেই আঁখি ঘুরিয়ে ডেকে উঠা ব্যক্তির পানে তাহল শিথি। শিথিকে নিজের দিকে ঘুরতে দেখেই ঋতু শিথির পানে চঞ্চল চিত্তে বলে উঠল,
_”শিথি তাড়াতাড়ি রেডি হো।অলরেডি রাত হয়ে গেছে অনেকটা।আজকে ট্রিট চাইই চাই!”
পরমুহুর্তে লামিয়া শিথিকে জিজ্ঞেস করে উঠল,

-“শান বাচ্চাটাকে কাল থেকে কোন সময় পড়াবি?”
উত্তরে শিথি বলে উঠল,
-“শানকে সকাল বেলা পড়াব কাল থেকে।শানের মা খুব ভালো মানুষ।উনাকে সমস্যার কথা খুলে বলার পর উনি খুব সহজে মেনে নিলেন সবটা।আমি একদম রেডি হয়ে বেরিয়ে পরবো।শানকে পড়িয়ে একদম অফিসের দিকে চলে যাবো।
কথাগুলো বলে শিথি তৈরি হতে চলে গেল।তিনজনের তৈরি হওয়া শেষ হলেই বেরিয়ে পড়ল তারা। শিথি আজও একটা রেড গাউন পড়েছে।ঋতু আর লামিয়া পড়েছে থ্রিপিস।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

সবে মাত্র ঢাকার বুকে পা রেখেছে তাহসিন।উত্তরার আশে-পাশের একটা হোটেলে আপাদত উঠবে সে। তাই হোটেলে যাওয়ায উদ্দেশ্যে একটা ট্যাক্সি ডেকে উঠে বসল।টেক্সি চলতে শুরু করল। নির্নিমেষ আশেপাশে চোখ বুলিয়ে আপন চিত্তে ফোন চাপতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল তাহসিন।

একটা কফি শপে বসে আছে তিন তরণী।কিয়ৎ কাল অপেক্ষা করার পর তাদের অর্ডার করা বার্গার আর কফি এসে হাজির হলো।তিনজন গল্প করতে করতে কফি শেষ করল।আকস্মাৎ ঋতু বলে উঠল,
-” এই শিথি জানিস বাহিরে রাস্তার পাশে বেশ মজার মজার খাবার পাওয়া যায়।আমরা যাওয়ার পথে খেয়ে যাবনে।”
শিথি মুচকি হেসে সায় জানায়।

রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে ঝাল মুড়ি খাচ্ছে তিনজন।আকস্মাৎ লামিয়া ঈষৎ চেঁচিয়ে উঠল,
-“ইয়ার এই দেখ পানি পুরির মামা এসেছে।চল পানি পুরি খাই।”
হাই লেভেলের ঝাল দিয়ে পানি পুরি খাচ্ছে ঋতু আর লামিয়া।শিথি ও নিয়েছে তবে হালকা ঝালে।কিয়ৎ কাল বাদ দুজন লাফিয়ে উঠল।ঝালে দুজনের অবস্থা খারাপ।তাদের এহেন লাফালাফি দেখে হেসে উঠে শিথি।

ট্রাফিক সিগন্যালে কারণে আকস্মাৎ থেমে গেল সকল যান।বিরক্তির শ্বাস ত্যাগ করে বাহিরের দিকে মুখ করে বসে পড়ল তাহসিন।আকস্মাৎ তার চোখ গেল খিলখিল করে হেসে উঠা এক সুশ্রী তরণীর দিকে।মুগ্ধ নয়নে সেদিক তাকিয়ে রইল সে।সহসা চমকে উঠল তাহসিন।আপন চিত্তে আওড়াতে লাগল,
-“শিথি!এটা শিথি?”

সত্বর গাড়ি থাকে নেমে পড়ল তাহসিন।শত-সহস্র জনমের তৃষ্ণা যেন ভর করেছে তার দুই আঁখি জোড়ায়।মনে হচ্ছে কত-শত যুগ ধরে সে দেখেনা শিথিকে।আজ যেন এক নতুন শিথি তার সমীপে। যেই শিথিকে দেখে সে প্রেমে পড়েছিল ঠিক কয়েক বছর আগে। বিয়ের আগে শিথিকে ঠিক যতটা সুন্দর আর স্নিগ্ধ লাগত তাহসিনের কাছে।আজকে ঠিক তেমনি লাগছে শিথিকে।পুরনো প্রেমের কথা মনে পড়ে গেল আজ তাহসিনের। শিথিই ছিল তার জীবনের প্রথম প্রেম।তারপর কি থেকে কি হয়ে গেল?আজ কেমন ঝাঁপসা-ঝাঁপসা লাগছে তার কাছে সব কিছু।

কেনো সে শিথিকে তার লাইফ থেকে বিতাড়িত করলো?আর কি বা দেখে রিমির প্রেমে পড়ল? মাথা ঘুরে উঠল তাহসিনের।অস্থির হয়ে পড়ল সে।শিথিকে সেই আগের রূপে দেখে সবকিছু কেমন অগুছালো হতে লাগল তাহসিনের।শিথির দিকে এগিয়ে যেতে নিয়েও নিজেকে গুটিয়ে নিল তাহসিন।কিঞ্চিৎ ভেবে শিথিকে ডাক দিতে উদ্যত হলো।তখনই নজরে এলো শিথি দৌড়ে রাস্তায় অপর পাশে চলে যাচ্ছে কিছু একটা আনার উদ্দেশ্যে।তারই অদূরে একটা গাড়ি আসছে তেড়ে।যার দিক মোটেও খেয়াল নেই শিথির।কলিজা কেঁপে উঠল তাহসিনের।ত্বরিত পা চালালো শিথির দিকে।

গাড়িটা প্রায় তেড়ে আসছে,,যেন শিথিকে সত্যি মারার প্লেন এই গাড়িটার।এবার তাহসিন দৌড় লাগাল। শিথির সমীপে এসে যেই তাকে টান মারতে যাবে আকস্মাৎ অপরদিকে থেকে কেউ শিথিকে খুব জোড়ে নিজের দিকে টেনে নিল। হ্চকিয়ে উঠল শিথি। বুঝতে পারল কেউ তাকে এতটাই তীব্রতার সহিত নিজের দিকে টেনে নিয়েছে যে তার মাথাটা গিয়ে থেকেছে সেই মানুষটার বক্ষঃপটে।মাথা তুলে কিছু বলতে নিবে সহসা তাকে ঘেঁসে একটা গাড়ি খুব দ্রুত গতিতে শো করে তার পাশ কাটিয়ে চলে গেল।ঈষৎ কেঁপে উঠল শিথি।তখনই শুনতে পেল এক গম্ভীর পুরুষ কণ্ঠস্বর,

-“চোখ কোথায় থাকে আপনার?দেখে রাস্তা পার হতে পারেন না। এখন যদি কিছু একটা হয়ে যেত তাহলে?খুব কি ভালো হতো?”
গোলগোল চোখ করে গম্ভীর কণ্ঠনালীর পুরুষটির পানে তাকাল শিথি।চোয়াল শক্ত করে একেরপর এক কথা শুনিয়ে যাচ্ছে শিথিকে লোকটি।লামিয়ার ডাকে সংবিৎ শক্তি ফিরে পেতেই মৃদু ধাক্কা দিয়ে নিজের থেকে ছাড়তে চাইল তার সমীপে থাকা পুরুষটিকে।কিন্তু পারলো না।কারণ লোকটি তাকে খুব শক্ত করে চেপে ধরেছে।ছাড়া পাওয়ার জন্য খুব চঞ্চল হয়ে উঠল শিথি। আকস্মাৎ লোকটা তার পানে কিঞ্চিৎ ঝুঁকে বলে উঠল,
-“এতো ছটফট করার কি আছে মিস.?এই চরিত্রহীন লোকটাই কিন্তু পুনরায় আপনাকে বাঁচালো।তাই এতো ছটফট না করে তার আগে একটা ধন্যবাদ ও তো দিতে পারেন।”

মুখ ঘুরিয়ে নিল শিথি। চরিত্রহীন বলেই তো মুখ ফোসকে ‘চরিত্রহীন’ বলে ফেলেছিল সে।তাই বলে প্রতিবার এই কথাটা মনে করিয়ে তাকে এভাবে খোঁচা দিতেই হবে এই লোকের? পুনরায় লামিয়ার কণ্ঠ কর্ণগোচর হতেই তার দিকে ফিরে তাকালো শিথি।তার মধ্যে নুসাইব শিথিকে ছেড়ে দিয়েছে।ঋতু লামিয়া দুজনই উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে উঠল,
-“তুই ঠিক আছিস তো? চল তাড়াতাড়ি ফিরে যাই।আর ঘুরতে হবে না।”

বলেই শিথিকে সত্বর টানতে টানতে নিয়ে যেতে লাগল দুজন। আজও নুসাইবকে ধন্যবাদ দেওয়া হলো না তার।দৃষ্টি ঘুরিয়ে পিছনে ফিরে তাকাল শিথি।তাকাতেই তার দৃষ্টিতে এসে ধরা পড়ল একজোড়া গম্ভীর আঁখি জোড়া।যা তার দিকেই খুব গভীর দৃষ্টিতে আবদ্ধ।সেই দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে রইল শিথি।দুহাত পকেটে পুরে গাড়িতে হেলান দিয়ে শিথির যাওয়ার পানে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল নুসাইব।

সহসা কারো ডাকে ঘোর থেকে বেরিয়ে এলো তাহসিন।ড্রাইভার পুনরায় বলে উঠল,
-“স্যার তাড়াতাড়ি গাড়িতে আসেন। গ্রিন সিগন্যাল দিয়ে দিসে।তাড়াতাড়ি গাড়ি ছাড়তে হইবো।”
ড্রাইভারের কথাটুকু শেষ হতেই পুনরায় রাস্তার অপরপাশে তাকাতেই দেখতে পেল শিথি নেই।অস্থির হয়ে বারংবার আশেপাশে চোখ বুলাতে থাকশ তাহসিন। কোথাও শিথিকে না পেয়ে গাড়িতে উঠে পড়ল।তবে তৃষ্ণার্থ দৃষ্টি মেলে বাহিরে তাকিয়ে রইল নির্নিমেষ।যদি দেখা মেলে সেই মানুষটার? রুদ্ধশ্বাস ত্যাগ করল তাহসিন।

পূর্বদিকে সূর্যের আগমন ঘটেছে বেশ ক্ষানিক পূর্বের।প্রাতঃভ্রমনে বেরিয়েছে তিন রমনী।কিয়ৎ কাল হাঁটার পর তারা পুনরায় ফিরে আসল হোস্টেলে।সকলের নাস্তা শেষ করে শিথি নিজেকে তৈরি করে বেরিয়ে পড়ল শানকে পড়াবার উদ্দেশ্যে।শানকে পড়ানো শেষ হলে সে সোজা চৌধুরী ইন্ডাস্ট্রি লি. উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল।
রিকশা এসে চৌধুরী ইন্ডাস্ট্রি লি. সন্মুখে থাকলে তাড়াহুড়ো করে নেমে রিকশার ভাড়া মিটিয়ে সত্বর পা চালিয়ে ভিতরে প্রবেশ করল শিথি।আজ তার প্রথমদিন অফিসে।আর আজকেই সে লেট করে ফেলল কিছুটা। হাতে পরিহিত ঘড়ির দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে দেখে নিল সময়।দশটা বেজে দশমিনিট।পূনরায় ত্বরিত পা চালিয়ে সম্মুখে এগিয়ে গেল সে।ভেতরে প্রবেশ করতেই সকলে কেমন জহুরি নজরে তাকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল।

এখানকার সকলে ফরমাল ড্রেসআপে অফিসে আসে।
ছেলে মেয়ে উভয়ই।কেবল সেই এসব গাউন পড়ে এসেছে। অসস্তিতে পড়ে গেল শিথি।নিজেকে ধাতস্থ করে সে পুনরায় দ্রুত পা চালিয়ে রিসেপশনের মেয়েটির কাছে ম্যানেজারের রুম কোথায় টা জেনে নিয়ে সম্মুখে পা বাড়াতে লাগল।প্রায় দশতলা পর্যন্ত এই অফিস। সাথে বেশ প্রশস্ত।আকস্মাৎ রিসেপশনে থাকা মেয়েটি তাকে ডেকে জানাল সকলে বর্তমানে কনফারেন্স রুমে।কনফারেন্স রুম আটতলায়।

ত্বরান্বিত পায়ে শিথি গিয়ে লিফটে উঠল।অতিরিক্ত তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে করো সহিত ধাক্কা লাগল।নিজেকে সামলে সম্মুখে তাকাতেই দেখতে পেল একজন যুবকে। যে ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে আছে।যুবকের এহেন চাহনি দেখে শিথি কিছু বলতে নিবে তার পূর্বেই যুবকটি বলে উঠল,

-“এক্সকিউজ মিস. আপনি ঠিক আছেন তো? এতো তাড়াহুড়ো করে কোথায় যাচ্ছেন? একটু দেখে শুনে চলবেন কেমন?”
শিথি মাথা নেড়ে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে পড়ল।লিফট অষ্টম ফ্লোরে এসে থামতেই হতভম্ব হয়ে ছুট লাগল দুজন।দুজনেই কনফারেন্স রুমের সামনে এসে হাপাতে লাগল। শিথি ভিতরে উঁকি দিয়ে দেখতে পেল একজন পুরুষ প্রজেক্টর স্কিনের সমীপে দাঁড়িয়ে আছে।সকলের উদ্দেশ্যে লোকটি কিছু একটা বলছে। আর রুমে উপস্থিত সকলে খুব মনোযোগ সহকারে তার কথা শুনে যাচ্ছে। শিথি কিছুটা সাহস জুগিয়ে বলে উঠল,

-“মে আই কাম ইন?”
সহসা গম্ভীর কণ্ঠে কেউ বলে উঠল,
-“নো। লেট করে যখন এসেছেন তাহলে আপনার আর এখানে কোনো প্রয়োজন নেই।যতক্ষণ অব্দি মিটিং কন্টিনিউ থাকবে ঠিক ততক্ষন আপনি এভাবেই বাহিরে দাড়িয়ে মিটিং এটেন্ড করবেন।’

কথাটা বলে পুনরায় লোকটি নিজের কাজে মনোনিবেশ করল। হচকিয়ে উঠল শিথি।বলে কি এই লোক?কখন না কখন মিটিং শেষ হয়?এতক্ষন দাড়িয়ে থাকতে হবে? রুদ্ধশ্বাস ছাড়ল শিথি।এখনো লোকটাই চেহারা দেখা হলো না তার।তাই পূনরায় রুমের ভিতরে উঁকি দিতে যাবে সহসা তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সেই ছেলেটি বলে উঠল,

আমার আছে জল পর্ব ৭

-“নড়াচড়া না করে চুপচাপ এখানে দাড়িয়ে থাকুন মিস.। বস কিন্তু খুব কড়া। একদম এদিক-সেদিক হলে সোজা চাকরি খেয়ে দিবে।”
শিথি সায় জানিয়ে চিন্তিত মুখে দাড়িয়ে রইল বাহিরে।

আমার আছে জল পর্ব ৯