আমার একটাই যে তুই পর্ব ২৯ || সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি

আমার একটাই যে তুই পর্ব ২৯
সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি

ইউসুফ ভাইয়ার সাথে ছাদে বসে আছি। আমার কান্না না থামছে না দেখে তিনি হুট করেই কোলে নিয়ে এলেন ছাদে। ঠিক সেই জায়গায় যেখানে উনি বসে গান শুনিয়েছেন আমাকে। ইন্টারেস্টিং বিষয় আজকেও পূর্ণ রূপালী থালা আমাদের সঙ্গ দিতে আসচ্ছে। সাথে আছে চিক চিক করা হাজারো তারা। আমি এসব লক্ষ করছি তখনি কানে ভেসে আসলো গিটারের শব্দ। সঙ্গে সঙ্গে চমকে তাকাতেই দেখতে পেলাম আমার নেতা সাহেবকে। গিটার কোলে জড়িয়ে ঠোঁটে মৃদু হাসি।

স্ব স্ব বাতাসে এলো মলো ভাবে এদিক ওদিক ছুটছে তার অবাধ্য চুল গুলো। চাঁদের রূপালী আলোয় দেখতে আরো যেন মায়াবী লাগচ্ছে তাকে। আজ কতদিন পর তার ঠোঁটে হাসির রেখা ফুঁটেছে তা দেখেই খুশিতে চোখের জল গড়িয়ে পড়লো আমার। ইউসুফ ভাই গিটারে সুর তুলল। আমি মাথা নত করে চুপটি করে উপলব্ধি করছি তার গান।

–” তুমি রোদেলা অরণ্যে, যেন এক মায়া হরিণ
তুমি তীব্র খরার পরেই, যেন হৃদয় বৃষ্টি দিন,
যাদুকরী এক ছোঁয়ায়, তুমি বদলে দেবে আমায়,
আমি চোখ বুজে দেখি, তুমি এলে পায়ে পায়।
ভাবিনি এত সহসায় পূর্ণ হব ভালবাসায়।”
তার গানের মাঝে “ভালবাসা ” কথাটি শুনে পূর্ণ দৃষ্টি মেলা তাকালাম। তিনি এক পলকে চেয়ে আছেন আমার দিক।তা দেখে লাজুক হাসতেই তিনি পরের লাইনি গাইলেন।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

–” তুমি খুব চাওয়ার পরেই যেন হাসলে এক ঝলক,
আমি চাইনা কিছুই তো আর, শুধু চেয়ে থাকি অপলক অবাক এক প্রভায়, কাছে টেনেছ আমায়
আমি রই যে ভাষাহীন সেই অদ্ভুত মমতায়,”
আমি লজ্জায় এদিক ওদিক তাকাতে লাগলাম। তা দেখে তিনি দুষ্ট-মিষ্টি হাসচ্ছেন। যা দেখতে খুব ইচ্ছে করছে তাই লজ্জা ভুলেই নির্লজ্জ ভাবে চেয়ে রইলাম তার দিক। তার সুন্দর বিড়াল চোখ গুলোর দিক। তার আঁকা-বাঁকা দাঁত আর টোল পড়া গলা আর সেই থুতনির খাঁজের দিক।
–“তুমি সাত সাগর দূরে, যেন চমকে দেওয়া কাহিনী।
আমি ক্ষুদ্র প্রজা যে দেশের, তুমি সেই দেশের রানী।
মিষ্টি সুখের আশায়, খুজে নেবে এই আমায়,
আমি প্রাণপনে ভাবি, তুমি আমার সীমানায়।”

গান শেষ হতেই চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়তে লাগলো শিশির কণার মতো টপ টপ করে। ইউসুফ ভাই গিটার সাইডে রেখে কাছে টেনে নিলেন আমায়। এতটা কাছে যে তার নিশ্বাস আর আমার নিশ্বাস মিলে এক হয়ে যাচ্ছে। চাঁদের আলো উনি অপলক আমার দিক তার সেই মহনীয় দৃষ্টি মেলে ধরেছেন। যেখানে আছে আজ হাজারো ইচ্ছে, আকাঙ্ক্ষা, আকুতি, মিনতি, অবৈধ অনেক আবদার। নিজের মাঝে হাজার যুদ্ধ করে এই অনুভূতি গুলো দাবিয়ে রাখার বৃথা চেষ্টা করছেন তিনি।ইউসুফ ভাই তার সেই চোখ দুটি বন্ধ করে ফেললেন। আমার কঁপালে তার ভেজা ঠোঁটের নরম স্পর্শ। যাতে আমিও আবেশে বন্ধ করে নেই আমার চোখ গুলোও। ইউসুফ ভাই চুমু খেয়ে কঁপালে কঁপাল ঠেকিয়ে মৃদু সুরে বললেন,,

–“বাবুইপাখি খুব শীঘ্রই এক হবো আমরা। একে ওপরে হাতে হাত রেখে তোমার আমার দেখা হাজারো স্বপ্ন পূরণ করবো! নিজেদের ছোট একটি নীড় বানাবো! যেখানে থাকবে না কোনো চোখের পানি! থাকবে না কোনো বিষাদের চিন্হ। আর এটাই হবে তবমার ভাল রেজাল্টের উপহার।”
বলে মৃদু হাসলেন। চকিতে চোখ মেলে তাকালাম আমি তিনি হাসচ্ছেন। আর আমার ঠোটের কোনেও হাসি। আর চোখের কোন বেয়ে চলছে অজস্রধারা। ইউসুফ ভাই আমার চোখ মুছে দিলেন। গলা থেকে কানের পিছনে হাত রেখে ফিসফিস করে বললেন,,

–” আই লাভ ইউ বাবুইপাখি! ”
আমি তার দিক কেঁদে কেঁদেই বললাম,,
–” আই হেট ইউ! আই হেট ইউ! হেট ইউ লট!
বলে বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে হাউ মাউ করে কাঁদতে লাগলাম। আর ইউসুফ ভাই শক্ত করে জড়িয়ে ধরে হেসে যাচ্ছেন। এ যে শান্তির হাসি!
আমি কি করছি?
কেনো পড়ে আছি আমি এ বাড়িতে?
কিসের আসায় পড়ে আছি?
এতসব অত্যাচার কেন সহ্য করছি?
এখানেতো আমার আপন কেউ নেই!
তাহলে? কিসের আসায় পড়ে আছি?

শুধু ভালবাসার টানে? নাকি এই মানুষ টাকে কাছে পাওয়ার আশায়! তাকে বিয়ে করে সারা জীবন আপন করে নিজের সব দুঃখ ভুলে এক বুক ভালবাসা উজার করে তাকে আপন করে নেওয়ার লোভে? কি চাই আমি?
আমার জন্য দিন দিন মামি পাগলের মতো আচরণ করছে। রাত-দিন অভিশাপ করছেন! গালা গাল দিচ্ছেন! এই তো আজ দুপুরের ঘটনা। সেই ঘটনার পর থেকে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আছি আমি! আর মনের মাঝে হাজার প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। ইউসুফ ভাই আমাকে রেটিনা কোচিং সেন্টারে ভর্তি করিয়ে দেন মেডিকেলে পড়ার জন্য কিছুদিন হলো। আজ ক্লাস শেষ করে বাসায় ফিরি। নিজের ঘরে যাওয়ার সময় বড় মামির ঘর থেকে কিছু ভাঙ্গার আওয়াজ পাই। বাসায় তখন কেউ ছিল না। আমি তাঁর রুমে গেলাম। মামি পানি নিয়ার চেষ্টা করছেন হয়তো তৃষ্ণার্ত সে! গ্লাসটি নিচে পরে ভেঙ্গে গেছে। মামা মারা যাওয়ার পর থেকে মামি বিছানা নিয়ে ফেলেছেন। আমি তার কাছে যেয়ে ক্ষীণ স্বরে বললাম,,

–“মামি কিছু লাগবে?”
মামি কিছু বললেন না তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রইলেন।
আমি কাছে গিয়ে তাকে পানি দিলাম। তিনি খেলেন না
মুখ ফিরিয়ে অন্য দিকে চেয়ে রইলাম। আমি নিরবে ছোট শ্বাস ফেলে পানি রেখে চলে যেতে নিতেই তিনি শক্ত কন্ঠে বললেন,,
–“তুই কিভাবে ভাবলী তোর হাতের পানি আমি খাবো? তুই লোভী, তোর মতো লোভী মানুষ আর একটা আমি দেখিনি। এতো লোভ তোর আমার ছেলেকে ফাঁসিয়ে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে চাষ! নিজের রূপ দেখিয়ে আমার ছেলেকে বস করেছিস। এত রূপ দেখানের শখ তোর পতিতালয় যা। রাত দিন রূপ দেখিয়ে ইনকাম করতে পাড়বি। না তুই তাদের থেকে নিকৃষ্ট। তার নিজের শরীর বেঁচে তো খায়। কিন্তু তুই? অন্যের ঘাড়ে বসে খেয়ে যাচ্ছিস। তাকেও বস করেছিস। আমার সন্তানকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিচ্ছিস।আমাদের জীবন জাহান্নাম বানিয়ে ছেড়েছিস তুই।আমি তোকে অভিশাপ করি তোর জায়গা নরকেও না হয়।”

একটানে কথা বলে মামি হাপিয়ে উঠলেন। তার সামনে আমি দাঁড়িয়ে কান্না করতে লাগলাম। এতটাই খারাপ আমি! মামির চোখে বিষে পরিণত হয়ে গেছি আমি? দৌড়ে ঘরে চলে আসলাম। এ বাসায় আর থাকতে পারবো না আমি! যেভাবেই হোক বের হতে হবে আমাকে। এসব ভাবচ্ছি।
মধ্যরাত ব্যাগপত্র গুছিয়ে ফেলেছি। চলে যাবো। আর সহ্য হয় না। কেন এমন হচ্ছে? একটি হাসি খুশি পরিবার এভাবে ভেঙ্গে যাচ্ছে! শুধু আমার জন্য? এইতো রাতের খাবারের টেবিলে খাবারে জন্য মাত্র বসেছিলাম আমরা। আমি বড় মামা মারা যাবার পর থেকে আলাদা রুমে খেতাম। আজ ইউসুফ ভাইয়ার জেদের কারণে নিজে যেতে হয় খেতে। তখনি শুরু নানুমা, মিশুপির কটু কথা।

–” এ মেয়ে এখানে কি করছে?”
–” আমাদের সাথে খাবে আজ থেকে!”
–” ইউসুফ দিন দিন তুমি বাড়াবাড়ি বেশি করছো না ওকে নিয়ে?”
–” বাড়াবাড়ির কি আছে? সবাই এখানে খাচ্ছে তো ও কেন একা খাবে!”
–“ও এখানে খেলে আমি খাবো না ভাইয়া!” খাবার টেবিল ছেড়ে দাঁড়িয়ে গেল মিশুপি।
নানুমাও রেগে আগুন। এক কথা দু কথায় ঝগড়া শুরু হলো। ইউসুফ রেগে মেগে বেড়িয়ে গেলেন। আর নানু মা আর মিশুপুর কথার বর্ষণ শুরু যা একে বাড়ে গিথে গেল।এবারের কথা গুলো ছিল পুরোটা আমার মাকে নিয়ে। যা মানতে আর পাড়লাম না। সটান হয়ে দাড়িয়ে সেখানেই ধাতস্থ করে ফেললাম। এখানে আর না।

বাসার সবাই ঘুম। এখন বাসা থেকে বের হওয়া উচিত এভেবে পা বাড়াতেই ইউসুফ ভাই ঢুকলো আমার রুমে ঢুলতে ঢুলতে। তাকে দেখে বুকে মোচড় দিয়ে উঠলো। তিনি আমার সামনে দাঁড়ালেন। তার রক্তবর্ণ চোখ, মুখ দেখে হু হু করে উঠলো আমার বুক। তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। হাউ মাউ করে কেঁদে উঠলেন। আর বার বার বলতে লাগলেন,,
–” বাবুইপাখি! আমি খুনি! আমার বাবার খুনি! আমার জন্য আজ বাবা নেই! আমি দোষী। তোমার, মার, মিশুর, বাবার! না আমি যেতাম না এ হতো! আমি যে খুব খারাপ ছেলে! খুব খারাপ!”

আর্তনাদ করতে লাগলেন ইউসুফ ভাই। তার কান্না আমার কলিজা ফেঁটে যাচ্ছে।কারণ মামা মারা যাওয়ার পর থেকে এ ব্যক্তিটির চোখে এক ফুঁটা পানি পড়তে আমি দেখিনি। আর আজ ৬ মাস ব্যক্তিটিকে কান্না করতে দেখিনি। আর আজ তার চোখে পানি। ধীরে ধীরে ভর ছেড়ে দিলেন আমার উপর। কথা জড়িয়ে আসতে লাগলো তার। তাকে আমার বিছানায় শুয়ে দিলাম।ইউসুফ ভাই আমার হাত তার বুকের সাথে জড়িয়ে নিলেন। আর ফুঁপিয়ে কান্না করতে লাগলেন। বিড়বিড় করতে লাগলেন,,
–‘” আমি খুনি! আমি বাবাকে মেরেছি! আমার জন্য সব কিছু। আমি খুনি। বাবুইপাখি আমি খুনি!”

আমার একটাই যে তুই পর্ব ২৮

বলতে বলতে তিনি চোখ বুঝে নিলেন। আমি আজ তাকে ছেড়ে যাচ্ছি এ কথা জানার পর হয়তো আর ক্ষমা করবেন না আমায়। কিন্তু আমাকে যে যেতেই হবে। উনার ভালোর জন্য। সবার ভালোর জন্য। এসব ভাবতে ভাবতে তার হাত থেকে আমার হাত ছাঁড়িয়ে উঠে পড়লাম। সামনের দিক পা বাড়াতেই আমার ওড়নায় টান পড়ে। ভয় পেয়ে যাই আমি! ইউসুফ ভাই উঠে গেল না তো? ভয়ে ভয়ে পিছনে তাকাতেই দেখি ইউসুফ ভাই শক্ত করে মুঠ করে আছে ওড়নার কোনা। আমি হালকা ঝুকে ওড়না ছাড়াতেই শুনতে পেলাম তার বিড় বিড় করে বলে কথা,,

–” বাবুইপাখি আমাকে ছেড়ে যেও না। কখনো না। মরে যাবো আমি! বাবার মতো তুমিও হারিও না।”
আমি কাঁদতে লাগলাম। মুখে কাপড় গুঁজে। আরেকটু ঝুকেঁ চুমু খেলাম ইউসুফ ভাইয়ার কঁপালে।কান্না জড়িত কন্ঠে বললাম,,
–” ভাল থাকবেন ইউসুফ! জানি না কিভাবে থাকবো। কিন্তু সবার ভালোর জন্য এটা করতেই হলো। তাই বলে ভাববেন না আমি আপনাকে ভালবাসি না। আমি অনেক অনেক ভালবাসি। আসি..!”

কথা গুলো বলতেই কান্নার বেগ বাড়তে লাগলো। শেষ বারের মতো জড়িয়ে ধরে তার হাতে আমার আঁকড়ে রাখা ওড়না তার হাতে রেখে দিলাম। অন্য হাতে একটি কাগজ রাখলাম। শেষবার সেই মুখ খানা দেখে বেড়িয়ে চলে এলাম স্বার্থপরের মতো বাসা থেকে। বার বার চোখ ভিজে উঠেছে। বাড়ির বাহিরে এসে বৃষ্টি বিলাস বাড়িটি আমার দেখে নিলাম ছল ছল চোখে। পা বাড়ালান অজানা-অচেনা কোনো গন্তব্যে।

আমার একটাই যে তুই পর্ব ৩০