আমার একটাই যে তুই পর্ব ৩০ || সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি

আমার একটাই যে তুই পর্ব ৩০
সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি

তীব্র কড়া রোদ এসে চোখ পড়তেই ঘুম ছুটে যায় ইউসুফের। পিটপিট করে চোখ খুলতে খুলতে উঠে বসে কই আছে বুঝতে চেষ্টা করে। কিন্তু ব্যর্থ হয় মাথায় অনেক ব্যথা। দু হাতে মাথায় চেপে “আহ্” করে ছোট আর্তনাদ করে সে! ধীরে ধীরে আবার চোখ মেলতে ট্রাই করে। নিজেকে কুহুর রুমে পেয়ে কিছুটা ভ্রুকুটি কুঁচকে ফেলে। গায়ে থেকে চাদর সরিয়ে নিচে নামতে নিবে তখন খেয়াল করে কুহুর ওড়না ইউসুফের হাতে গোল করে বাঁধা।

ইউসুফ তাজ্জব বনে যায়!ওড়না তার হাতে কি করে এলো? মাথায় প্রেশার দিয়ে বুঝতে চেষ্টা করছে কি হয়েছিল কাল রাতে! কখন আসল কুহুর রুমে? আর কুহুই বা কই?এদিক-ওদিক তাকালো ইউসুফ কুহু রুমে নেই। ধক করে উঠলো তার বুক। খালি খালি লাগচ্ছে কেন যেন? সে বুকে হাত ঢলতে লাগলো। হুট করে এমন কেন লাগচ্ছে তার? কুহু নিশ্চয় আশেপাশে আছে! কিন্তু এমন কেন মনে হচ্ছে? আপন কেউ ফেলে গেছে তাকে? মাথা ব্যথা বাড়ছে। আর ভাবতে পাড়ছে না সে। বেড থেকে উঠতেই টুপ করে একটি কাগজের টুকরো নিজে পড়ে গেল। কাগজটি কুড়িয়ে নিয়ে মেলতেই আকাশ যেন ভেঙ্গে পড়লো ইউসুফের মাথায়। ধুপ করে খাটে বসে পড়ে সে!গগনবিদারী এক চিৎকারে সামনে থাকা টেবিল ল্যাম্পটি তুলে ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় ছুড়ে মারে। ঝন ঝন শব্দ করে কয়েকটুরো হয়ে যায় কাঁচ গুলো। তাও যেন রাগ কমছে না তার। চিৎকার করে বলেই যাচ্ছে,,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

–” কুহু আমি তোকে ছাড়বো না। এর শাস্তি তোকে পেতে হবে! ভয়নাক শাস্তি! তুই বড্ড ভুল করে ফেললিরে! এত দিন আমার ভালবাসার চাদরে মুড়ে রেখেছিলাম তোকে! এখন থেকে তুই আমার রাগ আর জেদটাই দেখবি!”
এদিকে কুহুর রুম থেকে চেঁচামেচি শুনে বাড়ির সবাই এসে হাজির। এসব দেখে তিথি নিরবে কাঁদচ্ছে। বাকি সবাই নির্বিকার। ইউসুফের দাদু এসে ইউসুফের পাশে বসে মাথা হাত বুলিয়ে বলে,
–“যা হয় ভালোর জন্য হয় দাদু ভাই! ওরে ভুলে যা। নতুন জীবন শুরু কর!”

দাদুর এমন কথায় ইউসুফ তাঁর দিকে তাকায়। যা দেখে আতকে উঠে তিনি। ইউসুফের চোখ-মুখ ভয়ানক লাল হয়ে আছে! দেখে মনে হচ্ছে এই মুহূর্ত সে পুড়ো বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেবে!সে তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলল,,
–” কুহু নিজ ইচ্ছেয় তো যায় নি! তোমাদের জন্য ঘর ছেড়েছে! এর আগেও চেষ্টা করেছে বহুবার! শুধু তোমাদের জন্য। দাদু এমনটা যেন না হয় দোয়া করো ওকে না পেলে ওর সাথে সাথে আমিও হারিয়ে যাই!”
বলে উঠে চলে গেল নিজের ঘরে! এদিকে ইউসুফের কথায় ছেত করে উঠে তার বুক। সত্যি কি তারা ভুল কিছু করে বসেছে?

ইউসুফ নিজের ঘর বন্ধ করে খাটের সাথে ঠেসে বসে আছে! কুহুর সেই কাগজের টুকরোটি তার হাতের মুঠোয়। যেখানে গোটা গোটা অক্ষরে লিখা,,
–“” ইউসুফ ভাই!
যখন চিঠিটি পাবেন তখন আমি আপনার থেকে বহু দূর থাকবো! জানি আপনি আমাকে এর জন্য কখনো ক্ষমা করবেন না। কিন্তু আমার করার কিছু ছিল না। তাই বলে এই নয় যে আমি আপনাকে ভালবাসি না। খুব ভালবাসি তাই দূরে যেতে পাড়ছি। আপনার স্মৃতি গুলো সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি! আমাকে আর খোঁজার ট্রাই করিয়েন না। কোনো দুঃস্বপ্ন ভেবে ভুলে যেয়েন। নিজের খেয়াল রেখেন। লাল টুকটুকে একটি বউ নিয়ে আসবেন বিয়ে করে। সুখ-শান্তিতে সংসার করবেন। আমার উপর রেগে থাকবেন না প্লীজ। আমরা একে অপরের জন্য না।
কুহু!”

ইউসুফ এবার কাগজটি ছুড়ে মারলো! নিজের মাথার চুল গুলো দু হাত দিয়ে টেনে ধরলো আর বলল,,
–“তোর জায়গা কেউ পাবে না বাবুইপাখি! কেউ না!”
বলতে বলতে উঠে দাঁড়িয়ে কাউকে ফোন করলো,,
–” আমি ছবি পাঠাচ্ছি! সব জায়গায় খোজ লাগা। আর টিভিতে এড দে টাকার এমাউন্টও এড করিস। ওকে আমি চাই ২প ঘন্টার মধ্যে। নয়তো সব ধংস করে দিবো আমি!”

ফোন কেঁটে দূরে ছুড়ে মারে।তখনি কিছু একটা মনে পড়তেই। ইউসুফ উঠে কুহুর রুমে চলে যায়। কুহুর বিছানার নিচে এক কোনায় নিচে একটি সুন্দর হাতে কাজ করা ডায়রি পায়! কাঁপা কাঁপা হাত ডায়রিটি তুলে সে! একদিন রুমে বসে কুহু লিখচ্ছিল এঁটাতে। ইউসুফকে দেখে সে লুকিয়ে ফেলে। যা ইউসুফের চোখে এড়ায় নি। সেদিন অন্য খেয়ালে ছিল বলে দেখা হয়নি তার। ডায়রিটি খুললো ইউসুফ! প্রথম পেইজেটি তে খুব সুন্দর করে লিখা,,

” আমার_একটাই_যে_তুই❤️”
লিখাটিতে হাত বুলালো ইউসুফ! ইউসুফের দেশে আশা থেকে কাল রাত পর্যন্ত প্রতিটি ঘটনা এটাতে লিখা! ইউসুফের সাথে কাঁটানো মুহূর্ত গুলো। সব লিখা। ইউসুফ ডায়রিটি বন্ধ করে দিল। চোখ দুটি ছলছল করছে তার। বাবুইপাখি তাকে ভালবেসে যতটা সুখ না পেয়েছে! তার থেকে দুঃখ পেয়েই গেছে। যা বুঝতেই দেয় নি সে! ডায়রিতে একটি মেমোরি ফেয়েছে ইউসুফ। নিজের ঘরে এসে লেফটপে মেমোরি ঢুকলো। মেমোরি ওপশনে যেতেই ইউসুফ স্তব্ধ। হাজার ইউসুফের ছবি। সব তার অগোচরে তুলা। কিছু ভিডিও পেল। তা দেখে থম মেরে গেল সে,

একটি ইউসুফ ভাইয়ার রান্না করার ভিডিও। একটি ছাদের মাঝে গান গাইছে সে তার ভিডিও। সাজেকের কিছু ভিডিও। সব ইউসুফ কে নিয়ে। এক এক করে সব দেখতে লাগলো ইউসুফ তার বাবুইপাখি যে তাকে এতটা চাইতো তা আজ বুঝতে পারছে সে!

আজ ইউসুফের মা অনেক খুশি! সে বিছানা ছেড়ে নিজের ছেলের জন্য রান্না করতে গেছেন। রান্না শেষে খাবার বেড়ে ইউসুফের ঘরে পা বাড়ালেন। ইউসুফ তার রুম অন্ধকার করে বসে আছে
বাহির থেকে আসা আলোয় তাকে দেখা যাচ্ছে! তিনি ডাকলেন,,
–“ইউসুফ”
ইউসুফ সাড়া দিল না। তিনি কাছে বসে মাথায় হাত রেখে বললেন,,

–” ইউসুফ!দেখ আজ আমি নিজ হাতে তোর জন্য রান্না করে এনেছি! চল খাইয়ে দি!”
ইউসুফ তার মার দিকে তাকালো। খুশিতে গদ গদ করছেন তিনি! তাকে দেখে বিরক্তি লাগচ্ছে তার। কিন্তু প্রকাশ করতে চাইছে না। ইউসুফের সামনে এক লোকমা ভাত তুলে দিল। ইউসুফ খেল। আবার দিল আবার খেলে। খাওয়া শেষে তিনি বললেন,,
–“বললি না খাবার কেমন হয়েছে?”
–“ভাল!”
–“তোর কি এখনো মন খারাপ ইউসুফ!”
–“নাহ্!”
–“তুই রেগে আছিস আমার উপর তাই না!”
ইউসুফ এবার পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তার মার দিক তাকালো। বলল,,

–” নাহ্! বাবা-মা যা করে ভালোর জন্যই করে! কিন্তু মাঝে মাঝে এত ভালই তারা করে! যে ছেলে-মেয়েরা ভিতর থেকে মরে যায়!”
হাসলো ইউসুফ বেদনাদায়ক হাসি! এমন কথা শুনে বুকে গিয়ে লাগলো ইউসুফের মার। ধরা গলায় বলল,,
–” আমি যা করেছি তোর ভালোর জন্য!”
ইউসুফ হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে বলে ,,
–” হে তাই তো বললাম! এতে তোমার ছেলে খুশি নাকি ভিতরেটা পুড়েছে বা মরছে তা দেখলে না একবার? তার ভালবাসার মানুষটিকে দূরে ঠেলে দিয়ে, ভালো থাকার কারণ নিয়ে গিয়ে বলছো তোর ভালোর জন্য করেছি?”
ইউসুফের মা কাঁদচ্ছে। ইউসুফ বলল,,

–” আম্মু ঘর থেকে যাও তোমায় বিরক্ত লাগচ্ছে। তোমার কান্না সহ্য হচ্ছে না।”
ইউসুফের মা বিলাপ শুরু করে বললেন,,
–“ওই মেয়ের জন্য আমাকে তোর বিরক্ত লাগচ্ছে? আমি কি ওই মেয়েকে তাড়িয়ে দিয়েছি নাকি?সে নিজেই গেছে! তোর জন্য মুখ বুজে ওকে মেনেই নিলাম।”
তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো ইউসুফ বলল,,
–” দিন রাত যাকে পতিতালয়ের সাথে তুলনা করেছো! অভিশাপ করেছো! তাকে কবে মানলে আম্মু!”
চমকে তাকালো ইউসুফের মা। তোতলাতে তোতলাতে বলল,,
–“আ..মি ক..খ..ন বললা..ম!”
ইউসুফ ছোট শ্বাস ফেললো বলল,,

–” আমি সব জানি! যা জানা কথা যা অজানা কথা!”
ইউসুফের মা ভয় পেয়ে গেল। বলল,,
–” কি জানিস!”
–“অনেক কিছু!”
ইউসুফের মা চুপসে গেল। মিন মিন করে বলল,,
–“কি!”
ইউসুফ তার মার দিকে ঘুরে বসলো। তার মুখ পানে তাকালো। মুখে চিন্তার ছাপ। ইউসুফ হাসলো। তার বোকা সোকা মায়ের মাঝে এত কুটিলতা দেখে নিজেই বিস্মিত। ইউসুফ বলল,,

আমার একটাই যে তুই পর্ব ২৯

–” আম্মু তুমি কুহুকে নাজায়েজ বলেছো! কেন? ওকে তো ওর বাবা তার নাম দিয়েই ছিল! তাহলে? কেন অতটুকু মেয়ে এসব বলে তার কোমল মনটা নষ্ট করলে? তুমি না তাকে মেয়ে মানো? ও তো সহজ সরল ছিল। সবার কাছে একটু আদর ভালবাসা চাইতো! যাকে নিজের হাতে তুলে খাইয়ে দিতে তাকে কি করে এসব বললে আম্মু? তুমিও তো মা এক মা আরেক মার সন্তানকে কিভাবে খারাপ বলতে পারে? ওই সোজা সরল মেয়েটির বাচ্চামোতে ওকে ভালবাসি আম্মু চরিত্রহীনের ট্যাগ ওরে না লাগিয়ে তোমার ছেলেকে লাগতে! তোমার ছেলের যে অনেক বড় হাত এ সবে?”

ইউসুফে মা কেঁদে যাচ্ছে। নিজের করা ভুল গুলো তার ছেলে এভাবে তুলে ধরবে ভাবতেই লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করছে তার। সে নীরব রইল। ইউসুফ দাঁড়িয়ে কঠিন গলায় বলল,,
–“দোয়া কর আম্মু কুহুকে যেন ফিরে পাই। নয়তো তোমার এই ভাল ছেলেটা আর ভাল থাকবে না। দিলটা হয়তো মরে যাবে তার।”
বলে বাহিরে চলে গেল ইউসুফ। আর ডুকরে কাঁদতে লাগল ইউসুফের মা। সত্যি কি সে তার ছেলেকে চিরতরে হারিয়ে ফেলল??

আমার একটাই যে তুই পর্ব ৩১