আমার শহরে তোমার আমন্ত্রণ সিজন ২ পর্ব ১২

আমার শহরে তোমার আমন্ত্রণ সিজন ২ পর্ব ১২
Raiha Zubair Ripte

-“ কি ব্যাপার ইদানীং তুমি এতো চুপচাপ কেনো? কোনো সমস্যা হয়েছে তোমার?
তৃষ্ণা ছাঁদের কার্নিশ ঘেঁষে সুর্যাস্ত দেখছিলো। মন ভালো নেই। মন ভালোই বা থাকে কি করে? ভালোবাসার পুরুষ কে অন্য নারীর পাশে দেখলে কারোরই মন মেজাজ ভালো থাকে না।
তৃষ্ণা কে কথার প্রতিত্তোরে চুপ থাকতে দেখে রাফি ফের জিজ্ঞেস করলো-

-“ বললে না তো তোমার এতো পরিবর্তন কিসের জন্য?
তৃষ্ণা দৃষ্টি ডুবতে থাকা সূর্যের দিকে চেয়ে বলে-
-“ আমার কোনো পরিবর্তন ঘটে নি রাফি ভাই। অযথা আমাকে নিয়ে না ভাবলেই খুশি হবো।
রাফি ভ্রু কুঁচকাল।
-“ অবশ্যই ঘটেছে তোমার মধ্যে পরিবর্তন। কারন টা বলো কুইক।
-“ হুকুম করছেন?
-“ যদি মনে করো হুকুম তাহলে হুকুমই।
-“ বলবো না।
-“ বলতে হবেই।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

তৃষ্ণা ছাঁদ থেকে নেমে যেতে নিবে এমন সময় রাফি তৃষ্ণার হাত টেনে ধরে। তৃষ্ণা রাফির হাত থেকে নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে থাকে।
-“ চেষ্টা করে লাভ নেই। রাফি নিজ থেকে হাত না ছাড়াতে দিলে তুমি হাত ছাড়াতে পারবে না। সো বৃথা চেষ্টা করো না।

-“ হাত টা ছেড়ে দিন রাফি ভাই।
তৃষ্ণা গমগম মুখের কথা রাফি শুনেও না শোনার ভান করে।
-“ আগে বলো সমস্যা টা কি তোমার? বয়ফ্রেন্ড ছ্যাকা দিছে নাকি লাইফ নিয়ে হতাশায় ভুগছো?
-“ আপনাকে নিয়ে দ্বিধায় ভুগছি।
তৃষ্ণার বিরবির করে বলা কথাটা রাফির কান অব্দি ক্লিয়ার ভাবে পৌঁছালো না।

-“ স্পষ্ট করে বলো।
-“ হাত ছাড়ুন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। রুমে সন্ধ্যা বাতি জ্বালাতে হবে।
-“ অধরা আছে জ্বালানোর জন্য।
-“ আর আপনি আমাকে জ্বালানোর জন্য?
-“ যেটা ভাবো।
-“ আমি তো কত কিছুই ভাবি।
-“ আর কি কি ভাবো?
তৃষ্ণার টনক নড়ে উঠলো। আবেগের বশে সব বলে দিতে বসেছে। মনের কুঠিরে রাখা লুকায়িত ভালোবাসা কখনও তৃষ্ণা সম্মুখে আসতে দিবে না। রাফির হাত আগলা হতেই তৃষ্ণা রাফির থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে ছাঁদ থেকে নেমে আসে।

ছাঁদ থেকে নেমে সোজা ড্রয়িং রুমে আসতেই অচেনা এক ছেলেকে সোফায় বসে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকায়। ছেলেটার এখনও তৃষ্ণা কে খেয়াল করে নি,ছেলেটা ফোনে মুখ ডুবিয়ে কিছু দেখতে ব্যাস্ত। তৃষ্ণা ছেলেটার থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে বলে-
-“ এই কে আপনি?

আকস্মিক কথার আওয়াজ কানে আসতে ধরফরিয়ে উঠে ছেলেটা। বুকে ফু দিয়ে দারুন হাসি উপহার দিয়ে বলে-
-“ আমি লিমন,তুষার স্যার আসতে বলেছেন।
রাফি সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে তৃষ্ণা আর লিমন কে পর্যবেক্ষণ করে। লিমনের কাছে এগিয়ে গিয়ে বলে-
-“ কে আপনি?

লিমন ইতস্ত হয়,কেবলই তো পরিচয় দিলো আবার জিজ্ঞেস করছে।
-“ লিমন আমার নাম।
রাফি লিমনের মাথা থেকে পা অব্দি চোখ বুলায়।
-“ আপনিই সেই নতুন লোক?
-“ জ্বি।
-“ ব্রো আসতে বলেছে?
-“ হ্যাঁ।
রাফি তৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে বলে-

-“ ব্রো কে গিয়ে বলো লিমন এসেছে।
তৃষ্ণা চলে যায়। লিমন তৃষ্ণার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রয়। রাফি বিষয় টা খেয়াল করে গলা খাকড়ি দেয়। লিমন দৃষ্টি সংযত করে। লিমনের পাশে বসে বলে-
-“ যার তার পার্সোনাল জিনিসে নজর দিতে নিই মিস্টার লিমন।
লিমন বুঝলো না রাফির কথার মানে।

-“ ঠিক বুঝলাম না।
-“ সময় হোক বুঝে যাবেন।
-“ লিমন ফাইল টা এনেছো?
তুষার সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে নামতে কথাটা বলে। লিমন বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ফাইল টা হাতে নিয়ে বলে-
-“ জ্বি স্যার,রাতুল ভাই এই ফাইল টা দিয়েছে।
তুষার লিমনের হাত থেকে ফাইল টা নিয়ে চোখ বুলায়। পাকিজা রোডের ওখানে একটা এতিমখানা বানানোর প্ল্যান করছে তুষার। সব প্রায় কমপ্লিট, এখন শুধু কাজ ধরা বাকি বিল্ডিং এর। তুষার ফাইলটায় সাইন করে ফাইল টা আবার লিমনের কাছে ব্যাক করে। লিমন ফাইল টা হাতে নিয়ে বলে-

-“ এবার আমি আসি স্যার?
তুষার থমথমে গলায় বলে –
-“ লাফাঙ্গারের অবস্থা কি?
-“ বেশি ভালো না।
-“ শরীর থেকে জান বের হয়ে গেলে জাস্ট মাটির ত’লে পুঁ’তে রেখে দিবে।
লিমন এক ঢোক গিলে। মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলে বের হয়ে যায়।
-“ ভাবি যদি কখনও তোমার এই ভয়াবহ রূপের কথা জানতে পারে তখন কি হবে ব্রো?
-“ তুই না বললে জানবে কি করে?

-“ বাই এনি চান্স আমি না বললেও যদি কোনো ভাবে যেনে যায় তখন?
-“ বিয়ের পর জানলে আই ডোন্ট কেয়ার। বিয়ের আগ অব্দি ওর কানে কোনো ভাবে এসব যাওয়া চলবে না।
-“ বিয়ে টা কবে হবে তোমার? তোমার পর তো আমার পালা। তোমার বিয়ে যত দেরিতে হবে আমার বিয়ে তত পিছাবে। তাড়াতাড়ি বিয়ে করে রাস্তা ক্লিয়ার করো।
তুষার বসা থেকে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলে-

-“ তোর বিয়ে করার জন্য তর না সইলে এখনই কাজি অফিসে গিয়ে বিয়ে করে আয় কেউ আটকাবে না।
-“ সবার আগে তুমিই না আটকাও বিয়ে করতে গেলে আবার।
বিরবির করে কথাটা বলে রাফি। তানিয়া বেগম তুষারের সামনে দাঁড়িয়ে বলে-
-“ সেই কবে থেকে শুনতেছি আমার তুষারের বিয়ে, কিন্তু বাপ এখনও তো মেয়ের বাড়ি যেতে দিলো না তর বাবা। বিয়ে কি হবে না নাকি আমার ছেলের?

-“ তুমি কবে দেখতে যেতে চাও মেয়ে? মেয়ে কিন্তু তোমার পরিচিত।
-“ মেয়ে আমার পরিচিত! কার মেয়ে?
-“ সাহেল আঙ্কেলের মেয়ে। চিনো তো?
-“ আরে হ্যাঁ তোর বাবার বন্ধু। মেয়েটার সাথে এখনও অব্দি দেখা হয় নি। আমি বাপ কালই দেখতে যেতে চাই পুত্র বঁধু কে।
-“ ওকে তুমি অধরা আর তৃষ্ণা গিয়ে দেখে আসো।
-“ ঠিক আছে আমি কালই যাব।

অধরা উপর থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব শুনছে। বুক টায় কেউ ধারালো ছুরি দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছে। সবার মতো নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে অধরা পারে না। বরাবরই সে নিশ্চুপ শান্ত প্রকৃতির। মতামত বলতে তার কিছু নেই,সে নির্বাক শ্রোতার ন্যায় শুধু দেখে যায়। মামারা তাকে আশ্রয় দিয়েছে এটাই তো অনেক। সেখানে আগ বাড়িয়ে নিজের জন্য কিছু চাওয়া মানে লোভী প্রমাণ করা। তুষার নাম পুরুষ টি অধরার জীবনে শখের পুরুষ হিসেবেই থেকে যাবে। শখের জিনিস গুলো সবসময় ধরাছোঁয়ার বাহিরে থাকে। তুষার ও তার ধরাছোঁয়ার বাহিরে।

তৃষ্ণা রেডি হয়ে বসে আছে,মন তার কিছুটা ফুরফুরে লাগছে। ভাইয়ের বউ দেখতে যাবে বলে কথা। শত মন খারাপেও ভালো লাগছে। রেড কালারের একটা গ্রাউন পড়েছে। হালকা পাতলা সেজেছে। অধরা চুপচাপ বসে আছে। পড়নে তার ব্লাক কালারের সেলোয়ার-কামিজ চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। মনে তার বিষণ্ণতা, শখের পুরুষের হবু বউ দেখতে যাচ্ছে। তার মত হতভাগ্য কারো আছে নাকি? না পারছে কাউকে বলতে আর না পারছে এসব থেকে দূরে সরে থাকতে।

তৃষ্ণা আয়নায় একবার নিজেকে দেখে নিয়ে বলে-
-“ অধরা আপু চলো যাওয়া যাক।
অধরার ভাবনায় বিচ্ছেদ ঘটে। মাথা নাড়িয়ে তৃষ্ণার পেছন পেছন বেরিয়ে যায়। ড্রয়িং রুমে তানিয়া বেগম রেডি হয়ে বসে আছেন। অধরা তৃষ্ণা আসতেই মেয়ে দুটো কে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। বাসায় ছেলেরা নেই,ড্রাইভার কে বলে গিয়েছিল তুষার চিত্রা দের বাসায় পৌঁছে দিতে। ড্রাইভার তুষারের কথা মতো তাদের চিত্রা দের বাসায় পৌঁছে দেয়। তানিয়া বেগম তৃষ্ণা আর অধরা কে নিয়ে বাসায় ঢুকে কলিং বেল বাজাতেই চয়নিকা বেগম দরজা খুলেন। সাহেল আহমেদ বলেছিলেন ও বাড়ি থেকে তুষারের মা বোনেরা আসবে চিত্রা কে দেখতে। সেজন্য চিনতে বেগ পেতে হলো না।

হাসি মুখে দরজা ছেড়ে দাঁড়ালো। তানিয়া বেগম মেয়েদের নিয়ে ভিতরে ঢুকলো। চয়নিকা বেগম কুশলাদি করলো তাদের সাথে। ফ্রিজ থেকে মিষ্টি ফল এনে তাদের সামনে রাখলো। তানিয়া বেগম চয়নিকা বেগম কে বললেন তার পুত্র বঁধু কে নিয়ে আসার জন্য। চয়নিকা বেগম সায় জানিয়ে মেয়ের রুমের দিকে গেলো। চিত্রা শাড়ি পড়ে আয়নার সামনে বসে আছে। শাড়ি পড়ে থাকাটা অস্বস্তিকর। চয়নিকা বেগম শাড়ির আঁচল টেনে মেয়ের মাথায় দিলো। চিত্রা বিরক্তি তে কিছু বলতে নিবে তার আগেই চয়নিকা বেগম বলে উঠে-

-“ নম্র ভদ্র হয়ে থাকবে।
চিত্রা এক হাত দিয়ে মাথার আঁচল টেনে ধরে রাখে। চয়নিকা বেগম চিত্রা কে ধরে বাহিরে নিয়ে যায়। তৃষ্ণা মায়ের সাথে গল্প করতে করতে সবেই একটা মিষ্টি মুখে তুলতে নিচ্ছিলো সামনে তাকাতেই সেই মিষ্টি আর মুখে তুলা হলো না। হা করে তাকিয়ে রইলো সামনে। সামনে ঘোমটা টেনে শাড়ি পড়ে চিত্রা আসছে! সম্ভব কি করে? তার ভাইয়ের তো অন্য জায়গায় বিয়ে ঠিক হয়েছিল চিত্রা কি তাহলে সত্যি তার ভাইকে পটিয়েছে! তানিয়া বেগম তৃষ্ণা কে এমন হা করে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলে-

-“ গাধার মতো হা করে আছিস কেনো মুখ বন্ধ কর মশা ঢুকবে তা না হলে।
তৃষ্ণা মুখ বন্ধ করলো। চিত্রাকে ধরে সোফায় বসায় চয়নিকা বেগম। চিত্রা মাথা নিচু করে রেখেছে যার কারনে সে এখনও তৃষ্ণার মুখ দেখতে পারে নি। তানিয়া বেগম চিত্রার থুতনিতে ধরে চুমু খেয়ে বলে-
-“ মাশা-আল্লাহ আপনার মেয়েটা।

তৃষ্ণা সামনে বসে থাকা ভদ্র মহিলার কথা শুনে মাথা তুলে তাকিয়ে হাসতেই মুখের হাসি সব গায়েব হয়ে যায়। তৃষ্ণা তাকিয়ে আছে তার দিকে। চিত্রা তৃষ্ণা কে আকস্মিক দেখে মুখ থেকে বের হয়ে আসে-
-“ তৃষ্ণা তুই এখানে?
তানিয়া আর চয়নিকা বেগম মেয়েদের মুখের দিকে তাকায়।

-“ তুমি তৃষ্ণা কে চিনো মা?
তানিয়া বেগমের কথা শুনে চিত্রা বলে
-“ জ্বি আন্টি। তৃষ্ণা আর আমি একই ভার্সিটি তে পড়ি। কিন্তু তৃষ্ণা কি আপনাদের রিলেটিভ হয়?
তৃষ্ণা এক ঢোক গিলে। তানিয়া বেগম হাসতে হাসতে বলে-
-“ রিলেটিভ কি গো মেয়ে আমি তৃষ্ণার মা,তোমার ননদ ও।
চিত্রার মাথা ভনভন করে। তৃষ্ণার মা কি তাহলে তুষারের কাকি নাকি ফুপি নাকি খালা?

-“ আপনি আমার কি হন সম্পর্কে?
-“ শ্বাশুড়ি।
-“ আপন?
-“ হ্যাঁ, আপন না তো কি নকল হবো নাকি।
-“ কিন্তু আন্টি আমার তো তৃষ্ণার ভাইয়ের সাথে বিয়ে ঠিক হয় নি। এই তৃষ্ণা বল না তোর ভাইয়ের না বিয়ে হয়ে গেছে। আমার বিয়ে তো তুষারের সাথে।
তৃষ্ণার মাথাও ভনভন করছে। কি হচ্ছে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না।
-“ তুষার তো আমারই ছেলে। তৃষ্ণার ভাই।

কথাটা কর্ণকুহর হতেই যেনো পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য নামক কিছু শুনলো। এদিকে অধরা এক ধ্যানে চিত্রার পানে চেয়ে আছে। মেয়েটার শ্যাম বর্ণ গায়ের রং,ঠোঁট জোড়া গোলাপের পাপড়ির মতো। চোখ দুটো টানাটানা, মুখে জুড়ে একটা কিউট কিউট ভাব। হাসলে গালে টোল পড়ে। মেয়েটাকে এক বাক্য শ্যামকন্যা বলা চলে। চিত্রার থেকে অধরার গায়ের রং ধবধবে সাদা। চিত্রার থেকে হাইট বেশি। সাদামাটা খুব,বই পড়ুয়া, ঘরকুনো সাংসারিক। মেয়েটাকে দেখে তার মন থেকে একটাই কথা ভেসে আসছে-

আমার শহরে তোমার আমন্ত্রণ সিজন ২ পর্ব ১১

-“ আমার শখের পুরুষ কে যে নারী পাবে নিঃসন্দেহে সে নারী ভাগ্যবতী। মেয়ে তুমি ভীষণ ভাগ্যবতী আমার শখের পুরুষ কে পেয়ে। তোমার মতো সৌভাগ্য নিয়ে জন্ম আমার হয় নি তাই তো তাকে জীবনে পেলাম না। আর তুমি না চাইতেই তাকে পেয়ে যাচ্ছো। মেয়ে তোমাকে মাঝে মাঝে বড্ড হিংসে করবো,কারন তুমি আমার শখের পুরুষের বড্ড পছন্দের নারী।

আমার শহরে তোমার আমন্ত্রণ সিজন ২ পর্ব ১৩