আমার শহরে তোমার আমন্ত্রণ সিজন ২ পর্ব ৩৪

আমার শহরে তোমার আমন্ত্রণ সিজন ২ পর্ব ৩৪
Raiha Zubair Ripte

রাতের আকাশে আজ ইয়া বড় দেখতে থালার মত চাঁদ উঠেছে। আর সেই চাঁদের পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে জ্বলে আছে নক্ষত্র তারা। বেলকনির মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে আছে তৃষ্ণা রাফি। দুজনের দৃষ্টি ঐ আকাশের দিকে। নিরবতা কে শ্বাসরুদ্ধ করার জন্য রাফি তৃষ্ণার বা হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিলো। হাতের উল্টো পাশে হালকা করে ওষ্ঠ ছুঁয়ে দিলো। কেঁপে উঠলো তৃষ্ণা। ডান হাতে খামচে ধরলো পড়নের পেঁয়াজ কালারের শাড়ি। রাফি হাত মুঠোবন্দি করেই আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে-

-❝ পৃথিবী বলো কার চাঁদ সবচেয়ে সুন্দর, তোমার আকাশে থাকা চাঁদ নাকি আমার হৃদয়ে থাকা চাঁদ,কোনটা?❞
কথাটা বলে তৃষ্ণার দিকে তাকালো। চোখাচোখি হলো দু’জনের। তৃষ্ণা মাথা নত করে ফেললো তা দেখে রাফি মুচকি হাসলো। তৃষ্ণার নত হয়ে যাওয়া মুখ উঁচু করে কপালে চুমু খায়। চোখে চোখ রেখে বলে-
-“ যাও ঘুমিয়ে পড়ো রাত অনেকটাই হয়েছে।
তৃষ্ণার ঠোঁট কম্পিত হলো। এদিক ওদিক তাকিয়ে মিহি কন্ঠে বলে উঠলো-

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

-“ আপনি ঘুমাবেন না?
রাফি তৃষ্ণার ধরে রাখা নিয়ে রুমে ঢুকতে ঢুকতে বলে-
-“ আমার কিছু কাজ বাকি আছে। সেগুলো শেষ করেই ঘুমাবো। তুমি ঘুমিয়ে পড়ো।
-“ আজ আমাদের বাসর রাত ভুলে গেছেন?
বেফাঁস মুখে কথাটা বলে ফেলে তৃষ্ণা। রাফির ভ্রু কুঁচকিত হয়। নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল-
-“ বাসর করার জন্য ভীষণ তাড়া নাকি?

তৃষ্ণা এদিক ওদিক তাকালো। মুখ ফস্কে কথাটা বলে ফেলছে। এখন এটা নিয়েও রাফি খেপাবে।
-“ আ..আপনার না কি কাজ আছে আপনি শেষ করুন। আমি ঘুমাবো।
কথাটা বলে তড়িঘড়ি করে তৃষ্ণা বিছানায় গিয়ে একপাশ ঘেঁষে শুয়ে পড়লো। রাফি ঠোঁট কামড়ে হেঁসে চাদর টা তৃষ্ণার শরীরে দিয়ে লাইট অফ করে সোফায় বসে ল্যাপটপ টা কোলে নিয়ে।
বিছানায় তুষারের লোমযুক্ত বুকের উপর মাথা দিয়ে শুয়ে আছি চিত্রা। তুষারের হাত চিত্রা চুলের ভাজে। কখন চিত্রার কপালে ওষ্ঠ ছুঁয়ে দিচ্ছে তো কখন চুলের ভাজে। আর চিত্রা মনোযোগ সহকারে তুষারের বুকে আঁকিবুঁকি করে যাচ্ছে। রুম জুড়ে পিনপিনে নিরবতা। নিরবতা ভেঙে চিত্রা আহ্লাদী স্বরে বলে-

-“ এমপি মশাই।
তুষার হুমম বললো। চিত্রা মাথা তুলে তাকালো। তুষারের মুখ বরাবর মুখ এনে বলল-
-“ আমি কিছু চাইবো দিবেন?
তুষার হাল্কা মাথা উঁচু করে চিত্রার নাকের ডগায় চুমু খেয়ে বলে-
-“ মুখ ফুটে চেয়ে দেখুন শুধু।
চিত্রা মুচকি হাসলো। তুষারের গলা জড়িয়ে বায়নার স্বরে পিচ্চিদের মতো বলল-
-“ আমার একটা ছোট্ট তুষার চাই দিবেন?
তুষার চিত্রার মুখে সামনে আসা চুলগুলো কানের পেছন গুঁজে দিয়ে বলে-

-“ তুমি নিজেই এখনও পিচ্চি শোনা। এই তুষারকেই সামলাতে গিয়ে হিমশিম খাও। ছোট্ট তুষার আসলে তোমাকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।
-“ আমি মোটেও পিচ্চি না। আমার ছোট্ট একটা তুষার চাই। যার নরম তুলতুলে স্পর্শে আপনার আর আমার সকাল ভাঙবে আর ভাঙা কান্নার গলার আওয়াজে ঘুম। আমি আর আপনি সমন্বয়ে ও আসলে হবো আমরা।
-“ পাগলি বাচ্চা দেওয়ার মালিক আল্লাহ। তুমি আমি চাইলেই তো আর বাবু এসে পড়বে না।
-“ আমি আর এখন থেকে কোনো মেডিসিন খাবো না।
তুষার চিত্রা কে ভালো করে জড়িয়ে ধরে বলে-

-“ ছেলে মানুষি কেনো করছো জান। সময় এখনও ফুরিয়ে যায় নি। মাত্র মাস কয়েক হলো আমাদের বিয়ের। বছর খানিক যেতে দাও।
-“ উহু এমপি মশাই আমার ভীষণ শখ একটা ছোট্ট তুষারের। আপনি না করছেন কেনো এতো? আমি খুব আদর করবো ছোট্ট বাবু টাকে। একটু ও কাঁদাতে দিবো না।
-“ আচ্ছা ভেবে দেখবো। এখন ঘুমানোর চেষ্টা করো।
-“ কতদিন লাগবে ভাবার জন্য?

-“ ভীষণ প্রশ্ন করছো পাখি। আমি এই বিষয় টা এভয়ড করতে চাচ্ছি।
-“ এভয়ড কেনো করতে চাইছেন? আপনি সারাদিন বাসায় থাকেন না। কয়েকদিন পর আমার এক্সাম ও শেষ। তখন এই চার দেওয়ালে একা একা কি করবো আমি? একটা বাচ্চা থাকলে আমি তাকে নিয়ে মেতে থাকতে পারবো।
চিত্রার গমগমে গলায় বলা কথা গুলে শুনে তুষার বলল-

-“ আচ্ছা আচ্ছা আমরা বেবি নিবো।
-“ পাক্কা?
-“ হুমম।
-“ ভালোবাসি।
-“ বুঝলাম।
-“ কি বঝলেন?
-“ ভালোবাসো এটা বুঝলাম।
-“ আর আপনি বাসেন না বুঝি?
তুষার শোয়া থেকে উঠে চিত্রার উপর ঝুঁকল। চিত্রার তুলতুলে গালে নিজের খোঁচা দাড়ি ওয়ালা গাল ছুঁইয়ে দিয়ে বলে-

❝ আমি তোমাকে ভালোবেসে চেয়েছি বলেই,,আমাকে যে ভীষণ ভাবে ভালোবেসে চেয়ে গেছে সে আমাকে পায় নি।❞
চিত্রা তুষারের গালে হাত রাখলো। কুঁচকে যাওয়া কপাল নিয়ে চেয়ে বলে-
-“ আপনাকে কেউ ভালোবেসে চেয়েছিল?
তুষার হাল্কা হাসলো

-“ চাইতেই পারে অস্বাভাবিক তো নয়। যথেষ্ট হ্যান্ডসাম ড্যাশিং দেখতে তোমার বর। কলেজ ভার্সিটিতে বেশ সংখ্যক মেয়ের স্বপ্নের পুরুষ ছিলাম। তাদের মধ্যে তো চাইতেই পারে তাই নয় কি?
চিত্রা পলকহীন নয়নে তাকিয়ে রইলো তুষারের দিকে।
-“ আপনি এতে সুন্দর কেনো এমপি মশাই? অসুন্দর হলে তো আর এতো মেয়ের স্বপ্নের পুরুষ হতেন না।
-“ আমার বউয়ের পেছনে কম ছেলের লাইন নাকি? একটা যেতে না যেতেই আরেকটা এসে জুটে।
চিত্রা এবার হেসে উঠলো। তুষারের উন্মুক্ত পিঠে হাত দিয়ে বলল-

-“ এবার ঘুমান। শুভ রাত্রি।
তুষার চিত্রার কথার প্রতিত্তোরে চিত্রার গলায় চুমু খেয়ে পাশে শুয়ে বলে-
-“ শুভ রাত্রি বউ জান।
জানালা ভেদ করে সূর্য্যি মামা তার রশ্মি ছড়িয়ে দিচ্ছে রুম জুড়ে। আশপাশে পাখি গুলোর কিচিরমিচির গুঞ্জনে আশেপাশ টা মনোমুগ্ধকর হয়ে উঠেছে। আর পাশে উল্টো হয়ে শুয়ে তার ব্যাক্তিগত পুরুষ। এমন এক সকালের স্বপ্ন দেখে এসেছে একুশের ঘরে পা দেওয়া রমণী। কথটা গুলো ভাবতেই ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠলো এক চিলতে হাসি। বিছানা থেকে নেমে তড়িঘড়ি করে নিজের রুমে চলে গেলো তৃষ্ণা।

তৃষ্ণা যেতেই রাফি চোখ মেলে তাকায়। তারপর নিজেও বিছানা থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নেয়।
চিত্রা আর তানিয়া বেগম রান্না করছে। তুষার বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। তৃষ্ণা এসে রান্না ঘরের সামনে দাঁড়ায়। তানিয়া বেগম এক পলক তাকায় তারপর নিজের কাজে মনযোগ দেয়। চিত্রা তৃষ্ণা কে দেখে বলে-
-“ কিছু লাগবে?

তৃষ্ণা মাথা নেড়ে না জানায়। এরমধ্যে উপর থেকে তুষারের গলার আওয়াজ আসে। এক কাপ ব্লাক কফি চাচ্ছে। তানিয়া বেগম কফির মগে কফি ঢালতে ঢালতে চিত্রার উদ্দেশ্যে বলে-
-“ কফি টা নিয়ে যাও চিত্রা।
চিত্রা শ্বাশুড়ির কথা মতো কফির মগ টা নিয়ে উপরে চলে যায়। তানিয়া বেগম এবার আরেক মগে কফি ঢেলে বলে-
-“ রাফিকে গিয়ে দিয়ে আয় এটা।

তৃষ্ণা এটারই অপেক্ষায় ছিলো। দাঁড়িয়ে থেকে সময় ব্যায় না করে কফির মগ নিয়ে উপরে চলে গেলো।
অধরা আজ সকাল সকাল ই বাসা থেকে বের হয়েছে। কাল প্রোগ্রাম ভার্সিটি তে। সে নিয়ে ভীষন ব্যাস্ততা তার। ম্যানেজমেন্টের এক বিশাল বড় দায়িত্ব এসে পড়েছে তার কাঁধে। সেই দায়িত্ব পালন করতেই তাকে এই সাত সকালে ছুটতে হচ্ছে। রাতুলের সাথে কালকের পর আর কথা হয় নি এখনও অব্দি। রাতুলও ফোন দেয় নি দেখে অধরা নিজেও আর ফোন দেয় নি৷ ভার্সিটি থেকে বাসায় ফিরে তারপর ফ্রী হয়ে ফোন দিবে।

ভার্সিটির গেইটে পা রাখতেই দেখে পুরো রাস্তা মাঠ সাজানোর পুরোদমে কাজ চলছে। প্রজাপতি মেলা বলে কথা যেনোতেনো করে সাজালে চলে নাকি?
অধরা মুগ্ধ হয়ে তাকালো চারিপাশে। বেশ কিছুদিন আগেই অতিথি পাখির মেলা হয়ে গেলো।
কয়েকদিন পর পরই এই ভার্সিটি টা বিভিন্ন উৎসবমুখর হয়ে মেতে থাকে। অধরা হাঁটতে হাঁটতে তার ডিপার্টমেন্টের দিকে এগিয়ে গেলো।

ক্লাসে ঢুকতেই দেখা হয়ে গেলো সুমন স্যারের সাথে। যিনি অধরাদের ডিপার্টমেন্টের হেড। অধরা বিনয়ী হয়ে সালাম জানালো। লোকটা প্রতিত্তোরে মিষ্টি হাসি উপরহার দিয়ে সালামের জবাব দিলো। অধরা ক্লাসে গিয়ে দেখলো তার বন্ধু বান্ধবীদের প্রোগ্রাম নিয়ে প্ল্যান প্রায় শেষের দিকে। অধরা হাফ ছেড়ে বাঁচে। চুপচাপ গিয়ে স্মৃতির পাশে গিয়ে বসে।
তেমন ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বের সম্পর্কে এখনও হয়ে উঠে নি কারো সাথে অধরার। হালকা পাতলা কথা হয় এই যা। তবে ক্লাসের বেশ কিছু সংখ্যক ছাত্র ছাত্রী অধরাকে বেশ মানে। ক্লাসে স্যার আসতেই সবাই ক্লাসে মনোযোগী হয়।

বসন্তের বিকেলে, চিত্রা কে নিয়ে অধরা এসেছে মার্কেটে। কাল উৎসব কলেজে সে উপলক্ষে কেনাকাটা করতে। একাই আসতে হতো মার্কেটে তাই চিত্রা কে নিয়ে এসেছে। প্রচুর ভীড় জমেছে মার্কেটের সামনে। চিত্রা আর অধরা ভীড় ঠেলে কোনো রকমে বের হয়। শাড়ির দোকানে গিয়ে একটা বাসন্তী কালারের শাড়ি কিনে অধরা। শাড়ি নিয়ে বের হতেই অধরা চিত্রা কে এক সাইডে দাঁড় করিয়ে একটা কসমেটিকসের দোকানে ঢুকে এক জোড়া পায়েল কিনতে।

চিত্রা চুপচাপ দাঁড়িয়ে না থেকে রাস্তার পাশ ঘেঁষে হাঁটতে লাগলো। আবার সেই ভীড় গুলোর মাঝে এসে থেমে গেলো। বিরক্তি নিয়ে আশেপাশে তাকালো। উদ্দেশ্য তার ভীড় ঠেলে গাড়ির কাছে যাবে। ভীড়ের মধ্যে যেতেই চিত্রা অনুভব করলো কেউ তাকে জোরে ধাক্কা মারলো। ধাক্কা সামলাতে না পেরে উল্টো হয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে যেতে নিলে কেউ একজন ভীড়ের মধ্যেই চিত্রার বাহু ধরে ফেলে। চিত্রা পড়ে যাওয়া থেকে বেঁচে যায়। হাত ধরে রাখা মালিকের দিকে তাকিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।

আমার শহরে তোমার আমন্ত্রণ সিজন ২ পর্ব ৩৩

-“ ওহ্ অধরা আপু।
অধরা চিত্রা কে সোজা করে দাঁড় করলাো। ভীড় ঠেলে গাড়ির কাছে এসে বলে-
-“ তোমাকে না আমি দাঁড়াতে বললাম। ভীড়ের মধ্যে একা একা আসতে নিয়েছিলে কেনো? একটুর জন্য তো ধাক্কাধাক্কি তে পড়ে যাচ্ছিলে।
চিত্রার মনে হওয়া কথাটা চেপে গেলো। মনের ভুল হতে পারে। সত্যিই হয়তো ভীড়ের ধাক্কাধাক্কি তে পড়ে যাচ্ছিলো।

আমার শহরে তোমার আমন্ত্রণ সিজন ২ পর্ব ৩৫