আমার শহরে তোমার আমন্ত্রণ সিজন ২ পর্ব ৩৭

আমার শহরে তোমার আমন্ত্রণ সিজন ২ পর্ব ৩৭
Raiha Zubair Ripte

ডক্টর মরিয়ম মান্নানের সামনে বসে আছে তুষার চিত্রা। ডক্টরের হাতে চিত্রার রিপোর্ট। ডক্টর মরিয়ম মান্নান রিপোর্ট টার দিকে কিয়ৎ ক্ষন তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে তুষারকে উদ্দেশ্য করে বলল-
-“ এই সময়ে যে শারীরিক সম্পর্ক করা ঠিক না এটা আপনারা জানেন না?
তুষার আড় চোখে তাকালো চিত্রার দিকে। বিষয় টা বেশ লজ্জার লাগছে তুষারের কাছে। কিন্তু কিছু বললো না। ডক্টর মরিয়ম মান্নান রিপোর্ট টা তুষারের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে-

-“ এমনি সব ঠিকঠাক আছে। তবে ঐ বিষয়ে সতর্ক থাকবেন। কন্ট্রোল করার চেষ্টা করবেন।
তুষার মাথা নাড়িয়ে চুপচাপ রিপোর্ট টা নিলো। মনে মনে চিত্রা কে ইচ্ছে মতো বকে নিলো। ডক্টর তো আর জানছে না তার বউ কন্ট্রোলে থাকতে পারে না। চেয়ার ছেড় উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলে-
-“ আসছি তাহলে আমরা।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

চিত্রা কে নিয়ে বেড়িয়ে আসলো কেবিন থেকে। তুষারের মুখে গম্ভীর ভাব বিদ্যমান। চিত্রা কয়েক ঢোক গিললো। তার বোকামির জন্য কতটা লজ্জায় পড়তে হলো। তুষার গাড়ির দরজা খুলে দেয় চিত্রা কে বসার জন্য। চিত্রা উঠে বসে। তুষার ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসে গাড়ি স্টার্ট দেয়।
গাড়িতে চলছে পিনপিনে নিরবতা। চিত্রা তুষারকে সেই থেকে চুপ থাকতে দেখে আমতাআমতা করে বলে-
-“ আপনি কি রেগে আছেন আমার উপর?
তুষার কথা বললো না।

-“ আমি জানতামই না ওসব করলে রিপোর্টে ওভাবে ধরা পড়ে যাবে। সরি।
তুষার দৃষ্টি সামনে রেখেই জবাব দিলো-
-“ দোষ টা আমারই৷ আমারই উচিত ছিলো তোমার তালে তাল না দেওয়া। যার জন্য লজ্জায় পড়তে হলো আজ। তোমার থেকে দূরে দূরে থাকতে হবে।

-“ কত দূরে থাকবেন?
-“ মাঝখানে একটা কোলবালিশ রাখলে যতটা দূরত্ব হয় ততটা।
চিত্রা আর কিছু বললো না। বাসায় ফিরতেই তানিয়া বেগম তুষার আর চিত্রা কে জিজ্ঞেস করলো রিপোর্ট ঠিকঠাক আছে কি না। তুষার জবাব দিলো ঠিকঠাক আছে। তানিয়া বেগম রান্না ঘর থেকে কুসুম কুসুম গরম দুধের গ্লাস এনে চিত্রার হাতে ধরিয়ে দিলো খাওয়ার জন্য। চিত্রা দুধের গ্লাসটার দিকে তাকিয়ে রইলো। বাহির থেকে আসলে ঠান্ডা পানি দিত আগে আর এখন গরম দুধ। তপ্ত শ্বাস ফেলে গ্লাস টা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করলো। তানিয়া বেগম চিত্রা কে দুধ খেতে না দেখে ধমক দিয়ে বলল-

-“ খাচ্ছো না কেনো?
চিত্রা তানিয়া বেগমের এমন টুকটাক ধমকে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। মিনমিন সুরে বলল-
-“ ঠান্ডা পানি খাবো।
-“ দুধ টা আগে শেষ করো ঠান্ডা পানি আনছি।
ব্যাপার টা চিত্রার কাছে লাগলো যেই লাউ সেই কদু। দুধ না খাওয়ার জন্যই তো বললো সে পানি খাবে আর শ্বাশুড়ি তাকে দুধ খাওয়ার পর পানি দিবে। চিত্রা নাক চেপে দুধ টা খেয়ে নিলো। তানিয়া বেগম গ্লাসে ঠান্ডা পানি এনে দেয়। চিত্রা পানিটা খেয়ে উপরে চলে যায়।

রাতে খাওয়া দাওয়া শেষে তুষার রুমে এসে দেখে চিত্রা মাঝখানে কোলবালিশ দিয়ে শোয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তুষার কিছু বললো না সেটা নিয়ে। টেবিল থেকে মেডিসিনের পাতা থেকে একটা টেবলেট নিয়ে চিত্রার সামনে ধরে বলে-
-“ ভুলে গেছো এটা খাওয়ার কথা?
-“ হুম।

ছোট্ট জবাব টা দিয়ে চিত্রা ঔষধ টা খেয়ে নেয়। তুষার বাতি নিভিয়ে দিয়ে সোফায় বসে ল্যাপটপে কাজ করে। প্রায় মধ্য রাত অব্দি কাজ করে তুষার। বিছানার দিকে তাকিয়ে দেখে চিত্রা ঘুমে বিভোর। তুষার স্মিত হেঁসে ল্যাপটপ টা বন্ধ করে বিছানায় আসলো। মাঝখান থেকে কোলবালিশ টা সরিয়ে চিত্রা কে বুকে জড়িয়ে ধরে ঘুম দিলো। চিত্রা মুচকি হেসে দিলো। সেটা দেখে তুষার চিত্রার কপালে চুমু খেলো।

এভাবেই চলল ছয় মাস। চিত্রার পেট আগের তুলনায় বড় হয়েছে। আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা সে। পেট বড় হওয়ায় দেখতে মোটা লাগে। চোখের নিচে কালচে দাগ পড়েছে। গায়ের রং আলের তুলনায় কালো কালো হয়ে গেছে। মাথার কালো চুল গুলো ঝড়ে পড়ে এখন অল্প হয়ে গেছে। প্রেগন্যান্সির সময় কত কিছুর সম্মুখীন হতে হয়। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো চিত্রা। আগের চিত্রা আর এখন কার চিত্রা কতটা আকাশপাতাল পার্থক্য। প্রায় রাত্রিরে চিত্রা তুষার কে জিজ্ঞেস করে- আচ্ছা আমাকে কি দেখতে আগের থেকেও বাজে লাগে? খুব মোটা লাগে তাই না? দেখতেও কালো হয়ে গেছি। আচ্ছা আমাকে কি তোমার এখন অপছন্দ হয়?বাহিরে কোনো সুন্দর রমণী পছন্দ হয়েছে?

এসব কথার পৃষ্ঠায় তুষার নির্নিমেষ চোখে চেয়ে থাকে তুষার। চিত্রার গালে আলতো করে দু হাত ঠেকিয়ে বলত-
-“ আগের তুলনায় তুমি এখন বেশ নাদুসনুদুস হয়েছো দেখতে। কি কিউট লাগে ইচ্ছে করে গাল দুটো টেনে ধরি। আর তোমার গায়ের রং আগের তুলনায় কালো হয়েছে কে বলেছে?। প্রেগন্যান্সির সময় এসব হয়েই থাকে। একটা প্রাণের মধ্যে আরেকটা প্রাণ কে প্রতিনিয়ত পালন করছো সেটা কি চাট্টিখানি কথা নাকি? আর রইলো বাহিরে মেয়ে পছন্দ হয়েছে কি না? আমার এতো সুন্দর কিউট হর্নি বউ থাকতে আমি বাহিরে নজর দিবো এমন অরুচি হয় নি আমার।

চিত্রা ঠোঁট উল্টে বলতো- সত্যি?
তুষার চিত্রার গালে চুমু দিয়ে বলতো হুমম সত্যি।
-“ আবার আয়নায় নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছো?
তুষার ওয়াশরুম থেকে ভেজা মাথা টাওয়াল দিয়ে মুছতে মুছতে কথাটা বলে।
চিত্রা আয়নার সামনে থেকে সরে দাঁড়ালো। কোমড়ে হাত গুঁজে বলল-

-“ এতক্ষণ লাগে! বাহিরে যে রাতুল ভাইয়ারা বসে আছে সে খেয়াল কি নেই?
-“ তুমি তৈরি হও নি কেনো?
চিত্রা নিজের দিকে তাকালো। পড়নে তো নতুন মেক্সি। আর কিভাবে রেডি হবে?
-“ আমি তো রেডিই।
-“ কোথায় রেডি? মেক্সি পড়ে আছো।
-“ তো আমি কি পড়বো?
-“ কেনো শাড়ি।

-“ পাগল নাকি। আমি এই অবস্থায় শাড়ি পড়বো হোঁচট খেয়ে পড়ার জন্য নাকি!
-“ ওহ্ সেটাও তো কথা। আচ্ছা চলো নিচে।
ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে আছে রাতুল আর রাতুলের মা রোমিলা বেগম। সামনেই বসে আছে তৃষ্ণা, অধরা,তামিম খাঁন,তাসলিমা খাঁন,তানিয়া বেগম। সবাই একে ওপরের সাথে আলাপ-আলোচনা করে অধরা আর রাতুলের বিয়ের ডেট ফিক্সড করলো সামনে মাসরে ১৫ তারিখে। চিত্রা তুষারের হাতে গুতা দিয়ে ফিসফিস করে আফসোস করে বলে-

-“ ইশ বিয়ে টা আমার ডেলিভারের পর হলে কি হতো? আমার পুচকুটাও তার ফুপির বিয়ে খেতে পারতো।
তুষার চোখ টিপে বলে- সমস্যা কি আমি তুমি আবার বিয়ে করবো। বাবা মায়ের বিয়ে খাবে আমার বাচ্চা সেটা কম কথা নাকি?
চিত্রা ভেঙচি কাটলো। বিকেলের দিকে তুষার আর রাতুল বেরিয়ে গেলো। পার্টি অফিসে আসতেই দেখা মিলল হালিম সরকারের সাথে। হালিম সরকার তুষারের কাঁধে হাত রেখে বলে-

-“ শুনলাম ছেলের বাবা হতে চলছো। মিষ্টি খাওয়ালে না তো।
তুষার হালিম সরকারের হাত কাঁধ থেকে সরিয়ে রাতুলের দিকে তাকিয়ে বলে-
-“ উনাকে পেট ভরিয়ে মিষ্টি খাইয়ে দিস তো।
হালিম সরকার রাতুলের দিকে তাকিয়ে হেঁসে বলে উঠে –
-“ রাতুল কে ছাড়া তুমি বড্ড অচল তুষার তাই না?
তুষার ভ্রু কুঁচকালো। হালিম সরকার আর কিছু না বলে চলে গেলো। রাতুল চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলে-

-“ শুনলাম কাল রাফি আসছে দেশে।
-“ হ্যাঁ। প্রজেক্টের কাজ নাকি শেষ।
-“ শোন কাল কিন্তু সিএমবি যেতে হবে তোকে। ওখানকার রাস্তা ভেঙে গেছে।
-“ আচ্ছা।

অধরা বসে আছে রুমে। মুখে তার লজ্জা মাখা হাসি। চিত্রা থেকে থেকে এটা ওটা বলে লজ্জা দিচ্ছে। তাদের থেকে একটু দূরে তৃষ্ণা দাঁড়িয়ে রাফির সাথে কথা বলছে। মানুষ টাকে কতগুলো মাস পর সামনাসামনি কাল দেখবে। এমনি ভিডিও কলে কথা হয়েছে কিন্তু সেটায় কি আর তৃপ্তি পেতো?

-“ কয়টায় ফ্লাইট কাল আপনার?
ওপাশ থেকে জবাব আসলো-
-“ সন্ধ্যার আগে তোমার কাছে পৌঁছে যাব।
-“ অপেক্ষায় থাকবো সেই মাহেন্দ্রক্ষণের।
-“ হ্যাঁ সেই মাহেন্দ্রক্ষণের জন্য আমিও অপেক্ষায় আছি।
পরের দিন সকালে,,

তুষার সিএমবি যাওয়ার জন্য রেডি হয়। চিত্রা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তুষার কে দেখলো। ভ্রু কুঁচকে বলল-
-“ এতে সেজে যেতে হবে কেনো?
তুষার স্মিত হাসলো।
-“ বাহ রে এমপি আমি। যেনো তেনো বেশে গেলে চলে নাকি?
-“ কেনো চলবে না? মেয়েদের দেখাতে হবে আপনার ফিটফাট চেহারা?
-“ হ্যাঁ তেমন টাই।

-“ বাসায় ফিরবেন না। ওখানেই সংসার পেতে ফেলবেন।
তুষার চিত্রার রেগে বলা কথা গুলো শুনে বলে-
-“ নিজেই একা একা সব ভেবে নাও। আর আমি তাল দিলেই রেগে যাও কেনো?
-“ আপনি আমাকে মানাবেন তা না করে কেনো আমার কথায় তাল মেলান?
ভেঙচি কেটে কথাটা বলে চিত্রা। তুষার গলার টাই টা খুলে ফেলে। ইন করা শার্ট অগোছালো করে বলে- ঠিক আছে এখন?

-“ আশ্চর্য এমন বেশ ধরলেন কেনো?
তুষার দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে-
-“ তুমিই তো বললে এতো সেজে যেতে না।
-“ আমি তো এমনি কথার কথা বলছি। ইন করেন শার্ট।
-“ না থাক আর করা লাগবে না। সময় নেই।
চিত্রা তুষার নিচে নামলো। ডাইনিং টেবিলে বসে অধরা আর তৃষ্ণা খাচ্ছে। তুষার গিয়ে চিত্রা কে নিয়ে বসে। খাবার খেয়ে চিত্রার কপালে চুমু খেয়ে বলে-

-“ আসছি। সাবধানে থেকো। সন্ধ্যার আগেই ফিরবো।
চিত্রা মাথা নাড়ালো। তুষার চলে গেলো। চিত্রা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে তুষারের যাওয়া দেখলো।
তুষার প্রথমে পার্টি অফিসে গেলো সেখানে রাতুলের সাথে কিছু গুরত্বপূর্ণ কাজ নিয়ে আলোচনা করলো।
চিত্রা কিছুক্ষণ শ্বাশুড়ি আর দাদির সাথে গল্পগুজব করলো। বেলা হতেই রুমেই গিয়ে গোসল করে নামাজ পড়ে ঘুম দিলো। সেই ঘুম গিয়ে ভাঙলো মাগরিবের আজানের দিকে।

চিত্রা বিছানা থেকে আড়মোড়া ভেঙে উঠে দাঁড়ালো। ঘরে সন্ধ্যা বাতি দিয়ে হাই তুলতে তুলে রুম থেকে বের হলো। সিঁড়ি দিয়ে ঢুলতে ঢুলতে নামতেই আকস্মিক বাড়ির দারোয়ান বাড়ির ভেতর দৌড়ে এসে বলল গাড়ি এক্সিডেন্ট হয়েছে। তানিয়া বেগম আর তৃষ্ণা চমকে উঠে। কথাটা আকস্মিক চিত্রার কানে আসতেই সামনে তাকিয়ে সিঁড়িতে পা রাখতেই পা পিছলে সিঁড়ি বেয়ে নিচে পড়ে গেলো। প্রচন্ড ব্যাথায় আর্তনাদ করে উঠে চিত্রা। কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দে ঘাড় ঘুরায় তৃষ্ণা। চিত্রা পড়ে গেছে। তৃষ্ণা বসা থেকে উঠে দৌড়ে আসে। চিত্রার মাথা কোলে নেয়। কাঁপা কাঁপা হাতে চিত্রার গালে হাত দিয়ে জোরে বলে উঠে –

-“ মা চিত্রা। ও পড়ে গেছে।
ভয়ে দিকশূন্য তৃষ্ণা। ফ্লোর ভেসে গেছে র’ক্তে। তানিয়া বেগম দৌড়ে আসলো চিত্রার কাছে। চিত্রা পেট ধরে ব্যাথায় ছটফট করছে।
চিত্রার অবস্থা দেখে ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসলো। বাসায় কেউ নেই। তাসলিমা খাঁন আর অধরা বেরিয়েছে বাড়ির পাশে হাঁটতে। পুরুষ গুলোও গেছে কাজে।

তানিয়া বেগমের মাথা কাজ করছে না। তুষারের নম্বরে ফোন করলো। ফোন বন্ধ। তামিম খাঁন কে ফোন করতেই তামিম খাঁন ফোন রিসিভ করলো। তানিয়া বেগম কাঁপা কাঁপা গলায় তামিম খাঁন কে চিত্রার খবর জানালো। তামিম খাঁন তড়িঘড়ি করে চিত্রা কে হসপিটালে নিয়ে যেতে বলে।

আমার শহরে তোমার আমন্ত্রণ সিজন ২ পর্ব ৩৬

সে আসছে। তানিয়া বেগম ফোন কেটে দিয়ে ড্রাইভার কে তাড়াতাড়ি করে চিত্রা কে ধরতে বলে। ড্রাইভারের সাহায্যে তানিয়া বেগম আর তৃষ্ণা চিত্রা কে গাড়িতে উঠায়৷ কারো আর শোনা হলো না সেই এক্সিডেন্টের কথা। চিত্রা কে নিয়ে ছুটে গেলো সবাই হসপিটালে।

আমার শহরে তোমার আমন্ত্রণ সিজন ২ পর্ব ৩৮