আমি ফাইসা গেছি পর্ব ৩৮

আমি ফাইসা গেছি পর্ব ৩৮
মুমতাহিনা জান্নাত মৌ

–সত্যি কথা বলেন মিসেস সেলিনা বেগম। তা না হলে অন্যজনের বাচ্চা চুরি করে বিক্রি করার অপরাধে আপনাকে আমরা পুলিশে দিবো কিন্তু।

জারিফ চৌধুরীর কথা শুনে মিসেস সেলিনা বেগম উলটো রাগ দেখিয়ে বললো,অপরাধ শুধু কি আমি একাই করেছি?আমার শাস্তি হলে মিসেস কামিনী বেগমের ও হবে।কারণ উনি কিনতে চেয়েছেন বিধায় আমি কিন্তু বিক্রি করেছি।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

জারিফ চৌধুরী তা শুনে রাগান্বিত হয়ে বললো, কামিনীর শাস্তি কি জন্য হবে?তুমি যদি বাচ্চাটাকে না বিক্রি করতে চাইতে তাহলে কামিনী কিভাবে কিনতো?তুমি বিক্রি করতে চেয়েছো বিধায় সে কিনেছে।এখানে তোমার দোষ টাই বেশি।তাছাড়া কামিনী কেনে নি বাচ্চা। কামিনীর মায়ে কিনেছে।আবোলতাবোল কথা না বলে সত্যি সত্যি কুশানের আসল বাবা মার কথা বলে দাও।
সেলিনা বেগম তখন বললো,

দেখুন এটা অনেক বছর আগের কথা।এতো দিনের কথা আমার মনে নেই কিছু।কার বাচ্চা যে ছিলো এটা?মনে পড়লে জানিয়ে দিবো।এই বলে সেলিনা বেগম দরজা খুলে বের হয়ে গেলো।
এতোক্ষণ জারিফ চৌধুরী আর সোলেমান চৌধুরী সেলিনা বেগমকে আলাদা কক্ষে নিয়ে এসব বিষয়ে আলাপ আলোচনা করছিলেন।তারা অনেক চেষ্টা করেও সেলিনা বেগমের মুখ থেকে সত্য টা বের করতে পারলেন না।

সেলিনা বেগম রুম থেকে বের হতেই জামিলা জিজ্ঞেস করতে লাগলো কি হয়েছে মামি?কেনো জারিফ চৌধুরী আর সুলেমান চৌধুরী এভাবে আপনার সাথে দেখা করতে এসেছেন?আর কেনোই বা এভাবে আলাদা কক্ষে ডেকে নিয়ে গেলেন?
সেলিনা বেগম কোনো উত্তর দিলো না।সে দ্রুত পায়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলো।

কারন সেলিনা বেগম জারিফ চৌধুরীদের কড়া কথা শোনালেও তিনি মনে মনে ভীষণ ভয় পাচ্ছেন।না জানি এই বয়সে আবার তাকে জেলে যেতে হয়?আবার সত্য কথাটা স্বীকার করতেও পারছেন না তিনি।কারণ সত্য কথা স্বীকার করলে তার জীবনে অন্য আরেক ঝড় উঠে যাবে।কারণ কুশান যার সন্তান সে যখন জানবে সত্যি টা তখন তো সেও তাকে একদম ডাইরেক্ট মেরে ফেলবে।

সেলিনা বেগমকে এই অসময়ে বাড়ি থেকে চলে যাওয়া দেখে জামিলা বেগম খুবই আশ্চর্য হলেন।তাছাড়া সেলিনা তো তার প্রশ্নের উত্তরও দিলো না।তখন জামিলা কোনো উপাই না দেখে নিজেই জারিফ চৌধুরী কে সেম প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেন।
জারিফ চৌধুরী জামিলার প্রশ্ন শুনে সোলেমান চৌধুরীর দিকে তাকাতেই মিঃ সুলেমান চৌধুরী আর কিছু গোপন রাখতে চাইলেন না।তিনি জামিলাকে সব সত্যি কথা বলে দিলেন।

কারন এখন জামিলাই পারে সেলিনার মুখ থেকে সত্যি কথাটা বের করতে।
জামিলা সোলেমান চৌধুরীর কথা শুনে এতো বেশি আশ্চর্য হলো যে তার পুরো দুনিয়া যেনো অনবরত ঘুরতে লাগলো।সে ভাবতেই পারছে না সেলিনা বেগম অন্য জনের বাচ্চা এভাবে চুরি করে বিক্রি করেছে?তবে অন্যদিকে কুশানের কথা ভেবে হঠাৎ করেই জামিলার মন টা খারাপ হয়ে গেলো।না জানি কুশান কত বড় একটা মানসিক যন্ত্রনার মধ্যে আছে?এতো ভালো একটা ছেলের জীবন টা কেনো এমন এলোমেলো হলো? জামিলা এটাও ভাবতে লাগলো না জানি কোন ভাগ্যবান মা কুশানের মতো এতো ভালো একজন ছেলের জন্ম দিয়েছে।

সোলেমান চৌধুরী জামিলাকে এভাবে চুপচাপ থাকা দেখে বললো,
আপনি আপনার মেয়ের জন্য আমাদের কাছে সাহায্য চেয়েছিলেন।আমরা কোনো স্বার্থ ছাড়াই আপনাকে সাহায্য করেছি।কিন্তু আজ আমরা বিপদে পড়েছি।আমাদের কুশানের বাবা মাকে খুঁজে দেওয়ার জন্য রিকুয়েষ্ট করছি।এই কাজটা আপনাকে করে দিতেই হবে।আপনার মামীকে ভালো করে বোঝান প্লিজ।আর তাকে মনে করতে বলুন কে কুশানের বাবা মা।আমি সিওর উনি সবকিছু জানেন।

জামিলা বেগম সোলেমান সাহেবের এমন কাকুতি মিনতি শুনে বললো, আপনারা প্লিজ এভাবে বলবেন না।কারণ আপনাদের ঋণ আমি আর আমার মেয়ে কখনোই ভুলতে পারবো না।যে করেই হোক মামীর মুখ থেকে আমি সত্য কথাটা বের করবো।এর জন্য আমাকে প্লিজ কয়েকটা দিন একটু সময় দিন।
জারিফ চৌধুরী আর সোলেমান চৌধুরী জামিলা বেগমের উপর আস্থা রাখলো।কারণ জামিলা বেগম মানুষ হিসেবে যথেষ্ট ভালো একজন মানুষ।

কামিনী হাসপাতালের বেডে একা একাই শুয়ে আছে।তার আশেপাশে কাউকে আসতে দেয় নি সে।কারণ কামিনীর এখন কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছা করছে না।বিশেষ করে কামিনী কুশানের দিকে তাকাতে পর্যন্ত পারছে না।এতো কিছুর পর সে কোন মুখ দিয়ে ডাকবে তার ছেলেকে?কিভাবে ছেলেকে আদর করে বুকে জড়িয়ে নেবে?

আর কিভাবেই মায়ের অধিকার দেখাবে?এসব ভাবতেই কামিনী কেমন যেনো অসুস্থ বোধ করতে লাগলো।কামিনীর জ্ঞান অনেক আগে ফিরলেও সে ডাক্তার সাহেব কে বলে দিয়েছে কেউ যেনো তাকে দেখতে না আসে ভিতরে।সে কিছুক্ষন একটু একাকি থাকতে চায়।আর সবাইকে বলে দিতে বলেছে যে কামিনীর জ্ঞান এখনো ফেরে নি।

এদিকে কুশান বার বার শুধু ডাক্তার সাহেব কে বলছে তার আম্মুর জ্ঞান ফিরবে কখন?তার আম্মু এখন কেমন আছে?
কুশানকে এরকম উদ্বিগ্ন দেখে ডাক্তার সাহেব কামিনীর কাছে এসে বললো, ম্যাডাম!আপনার ছেলে ভীষণ টেনশনের মধ্যে আছে?উনি বার বার শুধু আপনার কথা জিজ্ঞেস করছে।কি বলবো ওনাকে?

কামিনী তখন বললো ওকে বলুন যে আমি ঠিক আছি,আর পুরোপুরি সুস্থ আছি।কিন্তু এখনি কথা বলা যাবে না আমার সাথে।
ডাক্তার তখন বললো এতো রাগ কেনো ম্যাডাম ছেলের উপর?যে ছেলে আপনার টেনশনে একদম পাগলের মতো হয়ে গেছে তার সাথে কেনো কথা বলতে চাইছেন না?

কামিনী ডাক্তার সাহেবের কথা শুনে বললো, ও আপনি বুঝবে না ডাক্তার সাহেব।সব কথা সবাইকে বলা যায় না।প্লিজ আমি এখন একটু একা একা থাকতে চাই।আমার কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।
ডাক্তার সাহেব কামিনীর কথা শুনে বের হয়ে গেলেন রুম থেকে।আর বাহিরে গিয়ে সবাইকে জানিয়ে দিলো কামিনী সুস্থই আছে এখন।ওনাকে ঘুমের ঔষধ দেওয়া হয়েছে।যার জন্য উনি এখন ঘুম পারছেন।ওনার সাথে খবরদার এখন কেউ কথা বলবেন না।

কুশান ডাক্তার সাহেবের কথা শুনে বললো, স্যার আমি একটা কথাও বলবো না।জাস্ট আম্মুকে এক নজর দেখবো শুধু।এই বলেই কুশান কামিনীর কেবিনে প্রবেশ করলো,ডাক্তার সাহেব কে কিছু বলার সুযোগ ই দিলো না।
কুশান ধীরে ধীরে কামিনীর পাশে চলে গেলো,আর কামিনীর দিকে তাকিয়ে হাত ধরে থাকলো কিছুক্ষন। তবে সে ডাক্তারের কথা মতো একটা কথাও বললো না।অন্যদিকে কামিনী কুশানকে আসা দেখে চোখ বন্ধ করে থাকলো।তবে কামিনী আর নিজেকে বেশিক্ষন সামলাতে পারলো না।সে চোখ মেলে তাকিয়ে বললো,

সব সত্য শোনার পরও তুই এখনো আমাকেই আম্মু ভাবছিস কুশান?আমাকে তো তোর এখন ঘৃনা করা উচিত।আমার থেকে মুখ সরিয়ে নেওয়া উচিত।কথাগুলো বলতেই কামিনীর দু চোখ বেয়ে পানি পড়তে লাগলো।
কুশান তার আম্মুর কথা শুনে বললো,

আম্মু প্লিজ এভাবে বলো না।তোমার মুখে এরকম কথা শুনলে আমার মনের ভিতর টা একদম দুমড়ে মুচড়ে যায়।আর দ্বিতীয় বার বলবে না প্লিজ।আমি যতদিন বেঁচে থাকবো ততোদিন তোমাকেই আম্মু মানিয়ে চলবো।
কামিনী তখন বললো,

যখন তোর নিজের আম্মু সামনে এসে দাঁড়াবে তখন কি করবি কুশান?তোর নিজের আম্মু তো আমার কাছে তোকে আর রাখবে না।আমার কাছে আসতেও দেবে না তোকে।তাহলে কিভাবে আসবি আমার কাছে?আর তখন ডাকবিই বা কিভাবে?
এবার কামিনী হু হু করে কেঁদে উঠলো।

কুশান নিজেও কাঁদতে লাগলো।সে এবার কামিনীর চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বললো, আম্মু প্লিজ এখন চুপ করে থাকবে একটু।প্লিজ এভাবে বলো না।মৃতু ব্যতীত আমাকে যেমন কেউ তোমার কাছ থেকে আলাদা করতে পারবে না তেমনি তোমার কাছ থেকে আমাকেও কেউ নিয়ে যেতে পারবে না।তুমি আর এসব চিন্তা করবে না খবরদার।তুমি এখন ভীষণ অসুস্থ আম্মু।তাড়াতাড়ি সুস্থ হতে হবে তোমাকে।
হঠাৎ তোড়া প্রবেশ করলো কেবিনে।

ছেলে আর মায়ের কথার মাঝে সে থাকলে ডিস্টার্ব হবে দেখে নিজের থেকে কোনো কথা বললো না তোড়া।তবে তার শরীর টা কেনো জানি ভালোও লাগছে না।বাসায় গিয়ে রেস্ট নিলে বোধ হয় একটু ভালো লাগতো।সেজন্য তোড়া সোনিয়ার সাথে চলে যেতে যাচ্ছে বাসায়।এটাই বলার জন্য আসছিলো তোড়া।কিন্ত কুশানকে কিভাবে বলবে বুঝতে পারছিলো না।
সোনিয়া তখন নিজেও আসলো ভিতরে,আর তোড়াকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকা দেখে নিজেই বললো,

কুশান ভাইয়া তুই কি এখন বাসায় যাবি?না চাচিকে নিয়েই ফিরবি?
কুশান কোনো উত্তর দিলো না।
সোনিয়া তখন বললো, আসলে ভাইয়া ভাবি আর আমি বাসায় চলে যেতে চাচ্ছি।ভাবির নাকি শরীর টা ভালো লাগছে না।
কুশান সোনিয়ার কথা শোনামাত্র পিছন ফিরে তাকিয়ে তোড়াকে বললো,
কি হইছে তোড়া?খারাপ লাগছে?

–কিছু হয় নি।তবে কেমন যেনো লাগছে আমার।সেজন্য বাসায় যেতে চাইছিলাম।
কামিনী তখন বললো, বাবা তুই না হয় রেখে আয় তোড়াকে।আমি তো ভালোই আছি এখন।আমাকে নিয়ে এতো বেশি চিন্তা করতে হবে না।

–না আম্মু।তোমাকে এভাবে এখানে একা একা রেখে আমি যাবো না কোথাও।সোনিয়াই পারবে নিয়ে যেতে।আমি শুধু ওদের কে একটা গাড়ি ঠিক করে দিয়ে আসি।এই বলে কুশান তোড়া আর সোনিয়ার হাত ধরে বের হয়ে গেলো কামিনীর কেবিন থেকে।আর যাওয়ার সময় ইরা,মিরা,লিরাকে বলে গেলো তারা যেনো ভালোভাবে খেয়াল রাখে কামিনীর,সে শুধু যাবে আর আসবে।

তোড়া তখন বললো আমরা একাই পারবো গাড়ি ঠিক করতে।তুমি আবার আম্মুকে একা রেখে কেনো আসতে গেলে?
কুশান কোনো উত্তর দিলো না।
কিন্তু কুশান হসপিটাল থেকে বের হয়ে গাড়ি ঠিক করার বদলে তোড়া আর সোনিয়াকে নিয়ে সোজা একটা রেস্টুরেন্টে চলে গেলো।
তোড়া তা দেখে বললো,

এখানে আবার কেনো?আমি তো শুধু বাসায় যেতে চাইছিলাম।আমার মাথাটা প্রচন্ড ব্যাথা করছে।কেমন যেনো বনবন করে ঘুরছে।
কুশান তখন বললো, কিছু খাও নি যে, সেজন্য এভাবে মাথা ঘুরছে।বেশি কথা না বলে চুপচাপ দুইজনে খেয়ে নাও।যাও টেবিলে গিয়ে বসো।
কুশানের কথা শুনে সোনিয়া টেবিলে গিয়ে বসলেও তোড়া তার জায়গাতেই দাঁড়িয়ে রইলো।আর কুশানকে জিজ্ঞেস করলো,
তুমি খাবে না?তুমি নিজেও তো কিছু খাও নি।

–হ্যাঁ খাবো।তবে এখন না।আম্মু আর আপুদের রেখে একা একা কি করে খাবো?তুমি সোনিয়ার সাথে গিয়ে খেয়ে নাও।আমি আম্মু আর আপুদের জন্য খাবার নিয়ে যাচ্ছি।আম্মুর সাথে একসাথে খাবো।
তোড়া আর বেশি কথা বললো না।চুপচাপ নিজেও সোনিয়ার পাশের চেয়ার টাতে বসলো।এদিকে কুশান তার মা আর বোনদের জন্য খাবার নিয়ে,সমস্ত বিল পরিশোধ করে তোড়ার কাছে গিয়ে বললো,

খাওয়াদাওয়া শেষ হওয়া মাত্র বাসায় চলে যাবে।বাহিরে গাড়ি ঠিক করে রেখেছি।
সোনিয়া তখন বললো ভাইয়া তুই চিন্তা করিস না তো।আমরা যেতে পারবো।তুই যা এখন।আর চাচির সাথে তুই ও খেয়ে নিস।
কুশান তখন বললো ঠিক আছে।তোরা সাবধানে যাস।এই বলেই কুশান খাবারের প্যাকেট গুলো নিয়ে বেড়িয়ে পড়লো।

জামিলা বেগম সেলিনার বাচ্চা চুরির ব্যাপার টা যেনো ভুলতেই পারছে না।তার মনে কেনো জানি নানা রকম চিন্তার সৃষ্টি হতে লাগলো।কারণ এই সেলিনার হসপিটালে তার নিজের ও বাচ্চা হয়েছিলো।সেলিনা নিজে তদারকি করেছে জামিলার বাচ্চার।সেলিনার উপর যখন একটা বাচ্চা চুরির অপবাদ পাওয়া গেছে এমন নয় তো সে আরো বাচ্চা চুরি করে বিক্রি করে দিয়েছে।

জামিলা আর ভাবতে পারছে না কিছুতেই।কারণ তার নিজের ও জমজ বাচ্চা হয়েছিলো সেদিন।একটা ছেলে আর একটা মেয়ে হয়েছিলো তার।মেয়েটি বেঁচে থাকলেও ছেলেটি মারা গিয়েছিলো।কিন্তু আজ সেলিনা বেগমের এমন লোভী চরিত্রের কথা শুনে জামিলার মনে নানা প্রশ্ন ভাসতে লাগলো।সেলিনা আবার টাকার লোভে তার ছেলেটাকে বিক্রি করে দেয় নি তো?আর তাকে শান্ত্বনা দেওয়ার জন্য কারো একটা মৃত বাচ্চা এনে দেখিয়ে বলেছে এটাই তার বাচ্চা।

জামিলা আর ভাবতে পারছে না কিছুতেই।আজ সেলিনা বেগম বাড়ি আসলে যে করেই হোক সেলিনার মুখ থেকে সত্য টা তার বের করতেই হবে।তার নিজের ছেলে সম্পর্কে কিছু না বললো অন্তত কুশানের বাবা মার পরিচয় টা তাকে জানতেই হবে।কারণ জারিফ চৌধুরীরা তার মেয়ের কত বড় উপকার করেছে তার বিনিময়ে তাকে এই কাজটা করতেই হবে।

জামিলা বেগমের বাড়ি থেকে সোলেমান আর জারিফ চৌধুরি সোজা হসপিটালে চলে গেছে।সোলেমান কামিনীর সাথে কথা না বললেও কামিনী নিজেই জিজ্ঞেস করলো,
কুশানের বাবা মার খোঁজ পেলে?

সোলেমান সেই কথা শুনে বললো, তোর সে খোঁজ কেনো?তুই নিজের চিন্তা কর।কোনো বাবা মার থেকে সন্তান কেড়ে নেওয়ার যন্ত্রণা টা কেমন সেটা উপলব্ধি করার চেষ্টা কর।নিজে তো অন্যের বাচ্চা চুরি করে দিব্যি মা সেজে বসে আছিস?
কামিনী সেই কথা শুনে বললো, কুশান কখনোই আমাকে ছেড়ে যাবে না বাবা।তুমি যতই কুশানের বাবা মাকে খুঁজে বের করে ওনাদের হাতে কুশানকে দিয়ে দাও না কেনো কুশান তবুও বার বার আমার কাছেই ছুটে চলে আসবে।আর আমাকেই আম্মু আম্মু বলে জড়িয়ে ধরবে।

জারিফ চৌধুরী এবার সুলেমান চৌধুরী কে বললো,বাবা!প্লিজ,কামিনী কে আর আঘাত দিয়েন না।ও ভুল করেছে মানলাম।কিন্তু ও এখন ভীষণ ভাবে অনুতপ্ত। তাছাড়া কামিনী যে কুশানকে কতখানি ভালোবাসে,আর কুশান তাকে কতখানি ভালোবাসে তা তো আপনি জানেনই।ওকে আর রাগায়েন না বাবা।কামিনীর চেহারার দিকে সত্যি আমি তাকাতে পারছি না।

সুলেমান সেই কথা শুনে বললো, তাই বলে এখন আমি অন্যায় কে প্রশয় দেবো?এটা কখনোই সম্ভব না জারিফ।এখন আমার প্রধান দায়িত্ব কুশানের বাবা মাকে খুঁজে বের করে তাদের কাছ থেকে ক্ষমা চাওয়া,তারপর তাদের সন্তানকে তাদের হাতে তুলে দেওয়া।তা না হলে এই পাপের বোঝা আমাদের সবাইকে বয়ে বেড়াতে হবে।

–হ্যাঁ,এটা তো অবশ্যই করবো।কুশানের বাবা মাকে তো খুঁজবোই।ওনাদের হাতে কুশানকে তুলেও দিবো।কিন্তু সমস্যা তো অন্য জায়গায়।কুশানের সেই বাবা মা যে কেমন প্রকৃতির হয়?কে জানে?এদিকে সমস্ত কিছু আপনি,,,,,
বলেই থেমে গেলো জারিফ চৌধুরী।

সুলেমান তখন বললো, আমি বুঝতে পারছি জারিফ।তুমি কি বলতে চাচ্ছো?কুশানের নামে সমস্ত প্রোপার্টি আমি লিখে দিয়েছি।আমার নামে আর কিছুই নাই।এটাই তো?
এজন্য আমার একটুও খারাপ লাগছে না।কারন আমি তো সবকিছু মন থেকেই কুশানকে দিয়ে দিয়েছি।এখন যদি কুশান তার নতুন বাবা মা পেয়ে আমাদের ভুলে যায় সেটা ওর ব্যাপার।আমাদের এতে কারো কিছুই করার নাই।

সেই সময় কুশান খাবার নিয়ে প্রবেশ করলো কেবিনে।কিন্তু কুশান আসার আগেই শাহিন,মাহিন,তুহিন সবার জন্য তাদের বাড়ি থেকে খাবার দাবার নিয়ে এসেছে।শাহিন,মাহিন,তুহিনের মা নিজের হাতে সবার জন্য রান্না করে পাঠিয়েছেন।
কুশানকে দেখামাত্র জারিফ চৌধুরী আর সুলেমান চৌধুরী তাদের আলাপ আলোচনা থেমে দিলো।তারা সবাই নরমাল বিহেভ করতে লাগলো,যেনো এখানে কোনো কথাই হয় নি।

কিন্তু কুশান তার হাতের খাবারের প্যাকেট গুলো টেবিলে রেখে দিয়ে সুলেমান চৌধুরীর হাত ধরে হঠাৎ করে বললো,
নানু ভাই!আপনাদের সাথে তো আমার রক্তের কোনো সম্পর্ক নাই।তাহলে আমার নামে আপনি যা যা লিখে দিয়েছেন আমি চাচ্ছিলাম তা আপনাকে সব ফেরত দিতে।কারণ বলা তো যায় না আমি আপনাদের পর ভেবে এসব সম্পদের সঠিক ব্যবহার করলাম না।তাছাড়া আমি তো জানি পরের সন্তান কখনো আপন হয় না।তাহলে আমি কি করে তোমাদের আপন হবো?

সুলেমান কুশানের কথা গুলো শোনামাত্র ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললো, এভাবে বলিস না নানুভাই।তোকে না দেখলে আমরা কেউই থাকতে পারবো না।যতদিন বেঁচে থাকবো আমরা তোকে সবসময় আমাদের কাছেই রাখবো।আর তোকে ভালোবাসে যেসব দান করেছি তা কখনোই ফেরত নিতে পারবো না আমি।এই কথা আর ভুল করেও বলবি না।এই কামিনী তোকে জন্ম না দিলেও আজীবন সেই তোর আম্মু হয়ে থাকবে আর এই জারিফই তোর বাবা হয়ে থাকবে।আর আমরা তো আছিই।

কুশান তা শুনে বললো, তাহলে এভাবে আমাকে তোমাদের থেকে আলাদা করে দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগছো কেনো?কেনো এভাবে পাগলের মতো খুঁজে বেড়াচ্ছো আমার নিজের বাবা মাকে?যে আমার বাবা মা সে নিজে আমাকে খুঁজবে।তোমরা প্লিজ আর এভাবে হয়ারানি হও না তোমরা।আমার আম্মুকে তোমরা আর কষ্ট দিও না প্লিজ।এই বলে কুশান তার আম্মুকে জড়িয়ে ধরলো। আর বললো,

আম্মু এখন একটু খেয়ে নাও।কুশান এবার নিজেই কামিনী কে তুলে তুলে খাওয়াতে লাগলো।
এদিকে তোড়া আর সোনিয়া খাওয়া দাওয়া শেষ করে কুশানের ঠিক করে যাওয়া গাড়িতে গিয়ে বসলো।যেহেতু কুশান ড্রাইভার কে বলেই দিয়েছে কোথায় যেতে হবে সেজন্য ড্রাইভার আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না।

তোড়া আর সোনিয়া গাড়িতে বসা মাত্র ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দিলো।এদিকে তোড়ার মাথার ব্যাথা টা এখনো ঠিক হয় নি।গাড়ি স্টার্ট দেওয়া মাত্র হঠাৎ তার মাথাটা একটা চক্কর দিয়ে উঠলো।সে আর নিজেকে সামলাতে পারলো না।সোনিয়ার গায়ের উপর ঢলে পড়লো।
সোনিয়া তোড়াকে এভাবে পড়ে যাওয়া দেখে চিৎকার করে ডাকতে লাগলো,

ভাবি?ভাবি?
কি হয়েছে তোমার?কথা বলো ভাবি।
কিন্তু তোড়া কোনো রেস্পন্স করলো না।
সোনিয়া তখন ড্রাইভার কে বললো,
মামা তাড়াতাড়ি করে গাড়ি ঘুরান প্লিজ।আমাদেরকে আবার হাসপাতালে যেতে হবে।ভাবি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে।
ড্রাইভার সোনিয়ার কথা শোনামাত্র তাড়াতাড়ি করে আবার হাসপাতালের দিকে চলে গেলো।আর সোনিয়া কুশানকে কল দিয়ে তোড়ার অসুস্থতার কথা জানালো।

তোড়ার অসুস্থতার কথা শুনে সবাই হাসপাতাল থেকে বের হলো।আর ওদের আসার অপেক্ষা করতে লাগলো।
কুশান টেনশনে দাঁতের উপর দাঁত চেপে রইলো।আর নিজের উপর নিজেই রাগান্বিত হলো।তোড়া কত বার বললো তার ভালো লাগছে না কিছু,কেমন যেনো লাগছে তার,এসব শুনেও সে কেনো নিজে গেলো না তোড়ার সাথে?

আমি ফাইসা গেছি পর্ব ৩৭

কেনো তাকে এভাবে একা একা পাঠিয়ে দিলো?এখন যদি খারাপ কিছু হয়ে যায়?তাহলে সে নিজেকে ক্ষমা করবে কিভাবে?
এখন তার নিজের বলতে এই বউ টায় তো আছে।সেই বউ এর অসুস্থতার কথা শুনে কুশান নিজেও অসুস্থ বোধ করতে লাগলো।

আমি ফাইসা গেছি পর্ব ৩৯