আমি মায়াবতী পর্ব ১৮

আমি মায়াবতী পর্ব ১৮
তাহমিনা মিনা

আমি স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। হঠাৎ সাব্বির আমার পাশে এসে আমার হাত ধরে আমাকে জিজ্ঞেস করলো,”মায়া আপু, বে*শ্যা মানে কি?”

আমি চমকে ওর দিকে তাকালাম। অবাক হয়ে দেখলাম, ওর হাতে চিপসের প্যাকেট। ও খুঁজে পেয়েছে। কিভাবে পেল? মা তো লুকিয়ে রেখেছিল। ও সব খুঁজে পাচ্ছে ধীরে ধীরে। ও তো আলাদা৷ আমাদের সবার থেকে আলাদা। ও তো নিষ্পাপ। আমি চাই না ও সবকিছু খুঁজে পাক।দুনিয়ার নিষ্ঠুর আর নিষিদ্ধ জিনিস ও জানুক, তা তো আমি চাই না। আমি ওকে কিছু বলার আগেই বাবা উঠে এসে সাবিহা আর সাব্বিরকে অন্য রুমে পাঠিয়ে দিল।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

নানাভাই মামার দিকে তাকিয়ে বললো, “তোমার ভাগের অংশ তো তোমাকে আমরা দিয়েই দিয়েছি। তাহলে কেন তুমি এইসব করছো?বাবা হিসেবে কি আমি ব্যর্থ?তোমাকে তো সবই দিয়েছি আমি। তোমার কোনো চাওয়াই তো আমি অসম্পূর্ণ রাখিনি।”
আমি শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলাম, ” আমার কি দোষ ছিল মামা?আমার সাথে এমন কেন করলেন?আমার কারণে তো আপনার কোনো ক্ষতি হয়নি।”

মামা হুট করেই দাঁড়িয়ে গেল। আমার সামনে এসে বললো,”কে বললো তুমি কোনো ক্ষতি করোনি? তুমি জানো, তোমার আর তোমার মায়ের জন্য কি কি হারিয়েছি আমরা? তোমার মা তো তোমাকে নিয়ে আড়ালে চলে গেল। আর আমরা? আমরা পালিয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছি এই সমাজ থেকে। কোথাও কেউ তোমার মায়ের কথা জিজ্ঞেস করলেই তোমার নানা হন্যে হয়ে বাড়ি বদলাতো। ভালোবাসার মানে জানো তুমি?তোমার মা জানে?

সে তো একটা নোংরা ভালোবাসার খেলা খেলেছে। যার ফল হচ্ছো তুমি। আর তোমার আর তোমার মায়ের কথা যখন আমাদের আত্মীয়স্বজন সবাই জানলো,আমাদের দিকে ছিছি করতে লাগলো। যে মেয়েটার সাথে আমার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল,যাকে ছোট্টবেলা থেকে ভালোবাসতাম, যাকে বিয়ে করার স্বপ্ন দেখতাম, তোমার মায়ের কুকীর্তির জন্য তাকেও হারিয়েছি। আর তোমার খালামনি। তার বিয়ে দিতে তোমার নানা আর আমার কি পরিমাণ কষ্ট করতে হয়েছে, সেটা কি তুমি জানো?লোকে বলেছে, যার বড় বোনই বে*শ্যা, সে না জানি কেমন হবে।

আর তোমার মায়ের মৃত্যুর পর কি এখন সব ভুলে যাবো? ১৮ বছর ধরে যে আগুনে পুড়ছি, সেই আগুন কি তোমার মুখের হাসি দেখেই নিভবে?কি মনে হয় তোমার? কষ্ট শুধু তুমি একাই করেছো? আমরা করিনি? তোমার সুখের দিনের শুরু। এই পরিবার তোমাকে আপন করে নিয়েছে। কিন্তু আমরা যা হারিয়েছি, তা কি আর সারা জীবনেও ফিরে পাবো?তোমার মনে হচ্ছে না, সম্পদ তো দূরের কথা, আমাদের করুনা কিংবা ভালোবাসার দাবিদারও তুমি নও? ভালোবাসার মানে বুঝো মায়া? আমি তোমার মায়ের জন্য সব হারিয়েছি। ”

আমি ধপ করে সোফায় বসে পড়লাম৷ মামার দিকে তাকিয়ে বললাম,”আমার মায়ের দোষ আমার উপর বর্তালো মামা। কিন্তু আমার পরিবার কি দোষ করলো? আমাকে যা করার করতেন। আমার ভাই-বোনের কি দোষ ছিল?”
মামা মাথা নিচু করে রইলো। নানাভাই বাবার দিকে তাকিয়ে বললো, “আমাদের মাফ করে দিও বাবা। আমার মেয়ে তোমাদের সবার জীবনই নষ্ট করে দিয়েছে। আমি এক অভাগা বাবা৷ আমার সন্তানদের মানুষ করতে পারিনি। আমাকে ক্ষমা করো বাবা।”

“আমাদের কোনো সম্পদ লাগবে না। আমার মেয়েরও লাগবে না। আমার মেয়ের ভরণপোষণের দায়িত্ব আমার। আমাকে আল্লাহ অনেক দিয়েছেন। আমি ওকে মানুষ করতে পারবো।”
নানী চোখের পানি মোছার চেষ্টা করছে বারবার। আমি ওনার চোখেমুখে অসহায়ত্ব দেখলাম। নানী ধীরে ধীরে আম্মার কাছে গিয়ে বললো,”আমার মেয়ের একটা ভুলের কারণে আজ আমি এখানে মা। তোমার সংসার ভাঙতে গিয়ে নিজের জীবনটাই বিসর্জন দিয়ে দিয়েছে সে। কিন্তু কারো পাপ অন্য কারো উপর ফেলা ঠিক না মা। আমার নাতনীকে একটু আগলে রেখো মা। ওকে কষ্ট পেতে দিও না। সারাজীবন অনেক কষ্ট পেয়েছে সে।”

“আপনি চিন্তা করবেন না আন্টি। মায়াকে আমি আমার বাচ্চার মতোই দেখবো।”
“আমি জানি মা। আমি জানি তুমি দেখবে। মায়ার মায়ের বিশ্বাস ছিল তুমি ওকে ভালোবাসবে। তখন ওর প্রতি রাগ ছিল কেন ও আমাদের কাছে মায়াকে রাখার অনুমতি দিল না। আজ বুঝতে পারছি,কেন দেয়নি।”

তারপর সবাই চলে গেল। প্রথমে মামা। তারপর নানা-নানি। আমাকে একটু জড়িয়ে ধরেই নানী চলে গেল। আমাকে একবারের জন্য বলেও গেল না তাদের বাড়িতে যেতে। বলবে কিভাবে? তারাই তো এখন ছেলের ঘরের অতিথি। সেখানে আমাকে কেন ডাকবে? আমার আরও একটা আশ্রয় হারিয়ে গেল। এইবাড়ি থেকে কখনো বের হয়ে গেলে আমার পথে বসা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।

সাগরিকা সাব্বির এর ঘরে বসে আছে। সাব্বির ঘুমুতে চাইছে না। কিছুক্ষণ পরপর এটা সেটা জিজ্ঞেস করছে। হঠাৎই আবার জিজ্ঞেস করলো, “মা, বে*শ্যা মানে কি?”
সাগরিকার মেজাজ গরম হয়ে গেল। ইচ্ছে করছিল মায়ার মামাকে গিয়ে ইচ্ছেমতো থাপড়াতে।কেমন অবিবেচক মানুষ সে। বাসায় ছোট বাচ্চাদের সামনে এইসব বলার কোনো মানেই ছিল না।

সাগরিকার হৃদয় মনে হচ্ছে ২ ভাগ হয়ে গেছে। একভাগে মায়া। আরেকভাগে তার সংসার। মায়ার জন্য একদিকে যেমন খারাপ লাগছে, তেমনি নিজের সন্তানদের জন্য ভয়ও হচ্ছে। মায়ার মায়ের একটা ভুলে সবাই ভুগছে। একবার মায়ার জায়গায় সাবিহা কিডন্যাপ হলো৷ এবার আবার তাদের এতো বড় এক্সিডেন্ট হলো। তার একবার ইচ্ছে হলো, মায়ার বাবাকে বলে মায়াকে দূরে কোথাও পাঠিয়ে দিতে। পরক্ষণেই মায়ার মা আর নানীর কথা মনে হতেই সবকিছু উল্টোপাল্টা হয়ে যাচ্ছে৷ কি করবে সে এখন? কোনটাকে গুরুত্ব দিবে?মায়াকে নাকি তার সন্তানদের?

“বাবা।”
“কে?”
“আমি। মায়া।”
“অহহ। আসো,মায়া।”
আমি ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম বাবার কাছে। মুচকি হেসে বললাম,”কি করছো বাবা?”
“কাজ করছিলাম মা।”
“বিরক্ত করলাম বাবা?”
“নাহ। সমস্যা নেই।”
“তোমার কাছে কিছু চাইতাম বাবা।”

“তুমি যা চাও আমি তোমাকে তাই দিব। শুধু আমাদের ছেড়ে যাওয়ার কথা ভুলেও বলবে না।”
“কিন্তু আমি এটাই চাই বাবা।”
“আমি এটা চাই না মা।”
“আমি হোস্টেল এ চলে যেতে চাই। আমার জন্য সবারই কমবেশি অসুবিধা হচ্ছে। আমার জন্য কেউ কষ্টে থাকুক, তা আমি চাইনা।”

“আমরা কেউ কি তোমাকে কখনো কিছু বলেছি?”
“তোমরা না বললেও তোমাদের সমস্যা হচ্ছে সেটা আমি জানি।”
“মায়া, শোনো মা আমার, তুমি হচ্ছো আমার কাছে না চাইতেই পেয়ে যাওয়া একটা উপহার। আর তোমার মায়ের কাছে আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, আমি তোমাকে তোমার বিয়ে পর্যন্ত দেখে রাখবো। এরপর আমি এমন একজন মানুষের হাতে তোমাকে তুলে দিব, যেখানে তুমি আমাদের এইখানে যেভাবে আছো, তার থেকেও ভালো থাকবে।”

“কিন্তু বাবা…”
“কোনো কিন্তু না মায়া। আমরা তোমাকে হারাতে চাই না। বুঝলে তুমি? এখন যাও, অনেক রাত হয়েছে। গিয়ে শুয়ে পড়ো। আর হ্যাঁ, আজকে যা হলো, সেটা আমরা সবাই ভুলে যাবো।ওকে?”
আমি মাথা নেড়ে চলে এলাম আমার রুমে।

“আমি তোমাকে কিছু বলতে চাই কবিতা।”
“আগে খেয়ে নে তো মায়া।”
“আগে আমার কথা শোনো। তারপর।”
“আজকে আবার তুই তুমি তুমি শুরু করেছিস। আগে খেয়ে তো নে। তারপর কথা। আচ্ছা, শোন। আজকে ক্লাস শেষে ভাইয়ার সাথে কথা বলবি। বুঝলি?”
“আমি তোকে কিছু সিরিয়াস কথা বলতে চাই কবিতা।”

“উফফ,বাবাহ। আচ্ছা, বল।”
“আমি তোমার কাছে কিছু লুকিয়েছি কবিতা।”
“কি লুকিয়েছিস?”
“আমার পরিবারের ব্যাপারে।”
“মানে?”
“মানে হচ্ছে আমি যাকে আমার মা বলে তোর কাছে পরিচয় করিয়েছি,সে আমার মা নন। সৎ মা। আর আমার ভাই-বোনেরাও সৎ ভাই-বোন। ”

“মানে কি এইসবের?”
“এইটাই সত্যি।”
“ফান করছো? মায়া?”
“নাহ। আমি সত্যি বলছি।”

আমি মায়াবতী পর্ব ১৭

আমি হয়তো আরো কিছু বলতাম, কিন্তু তার আগেই কবিতা উঠে আরেকটা টেবিলে গিয়ে বসলো। আমার দিকে ফিরেও তাকালো না। অন্য মেয়েদের সাথে খাবার খেলো। আমাকে ডাকলোও না। আবার আমি আমার দুনিয়ায় সম্পূর্ণ একা হয়ে গেলাম। সম্পূর্ণ একা। মায়ের উপর ভীষণ রাগ হলো আমার। কেন এমন অঘটন ঘটালো সে? আর কেনই বা আমাকে জন্ম দিলো? এর উত্তর কি এই জীবনে মিলবে?

আমি মায়াবতী পর্ব ১৯