আমি মায়াবতী পর্ব ১৯

আমি মায়াবতী পর্ব ১৯
তাহমিনা মিনা

মায়ের উপর ভীষণ রাগ হলো আমার। কেন এমন অঘটন ঘটালো সে? আর কেনই বা আমাকে জন্ম দিলো? এর উত্তর কি এই জীবনে মিলবে?
“মায়া আপু, নামাজ পড়বে না? ওঠো।”
ধড়ফড়িয়ে উঠলাম আমি। কয়েক মুহুর্ত সময় লাগলো কি হচ্ছে বুঝতে। আমি সামনে তাকিয়ে দেখলাম সাবিহা দাঁড়িয়ে আছে। অহহ,তারমানে আমি স্বপ্ন দেখছিলাম। একটা হাঁফ ছেড়ে উঠলাম। সাবিহা আমার দিকে তাকিয়ে বললো, “এমন করছো কেন? উঠো। নামাজ পড়বে না?”

আমি ওর দিকে তাকালাম। ওর চোখ দুটো লাল হয়ে আছে। আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম,”তুই উঠলি কিভাবে আজকে?”
“জানিনা। উঠে গেছি কিভাবে যেন।”
“আমাকে কি তোর গাধা মনে হয়?আমি বুঝি না কিছু? নামাজ পড়তে উঠে মিথ্যে কথা বলছিস কেন?”
ও মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো।
“ঘুমুসনি কেন? সারারাত জেগে ছিলি কেন?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“এমনিই। ঘুম আসেনি।”
“হুমম।”
“আপু। ”
“বড় হয়ে যাচ্ছিস৷ কি দরকার এতো তাড়াতাড়ি বড় হওয়ার? ”
“তুমি তো এখনও ছোট। তাও তো তোমার এতো কষ্ট। ”
“আমি কষ্টে আছি সেটা তোকে কে বলেছে?”
“কেউ বলেনি। ”
“তাহলে?”
সাবিহা চুপ করে থাকে। কোনো জবাব দেয় না আমার প্রশ্নের।

“তোমার আরো আগেই আমাকে সবকিছু বলে দেওয়া উচিত ছিল,মায়া।”
“আমি জানি উচিত ছিল। কিন্তু ভেবেছিলাম তুমি আমাকে বন্ধু বানাবে না। আমাকে বাকিদের মতো অপমান করবে সবার সামনে। তাছাড়া, এখন এটাই আমার পরিবার।”
“এখন তোমার কেন মনে হচ্ছে যে আমি কাউকে বলবো না?”

“আমি জানি তুমি বলবে না। আর বললেও আমার এখন আর কোনোকিছু যায় বা আসে না। আমি এখন বলতে পারো সবকিছুর উর্ধে চলে গেছি এইসব থেকে। এখন আর আমার দুঃখ বা কষ্ট কিছুই হয়না।”
“মায়ের প্রতি রাগ হয় মায়া? ঘৃণা হয়?”
“রাগ তো হয়ই কবিতা। কিন্তু ঘৃণা তো করতে পারিনা। কিছুতেই পারিনা। মা তো আমার।”
“তোমার আম্মা মানুষটা কিন্তু অনেক সহ্যশক্তির একজন মানুষ। অনেস্টলি বলছি, উনার জায়গায় আমি থাকলে কিন্তু তোমাকে মেনে নিতাম না কোনোভাবেই।”

“আমি জানি৷ উনি মানুষটা অন্যরকম। উনি বাবাকে অনেক ভালোবাসেন। বাবার কাছে সবকিছু ছেড়েছুড়ে চলে এসেছিল। বাবার বাড়িতে সে ছিল রাজকন্যা আর আমার বাবার কাছে এসে সে অনেক কষ্ট করেছে। শুধুমাত্র বাবাকে ভালোবাসে বলেই আমাকে মেনে নিয়েছেন।”
“তোমার ভাই-বোনেরা তোমাকে কেমন চোখে দেখে?”

“সাব্বির এর কোনো সমস্যা ছিল না। প্রথমদিকে সাবিহা একটু কষ্ট পেয়েছিল। আমাকে মেনে নিতে ওর সমস্যা হতো। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এখন ঐ আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু কাম বোন।”
“তাহলে তো ভালোই। কোনো সমস্যাই নেই। সবাই তোমাকে মেনে নিয়েছে।”
“নাহ। সবাই মেনে নেয়নি।”

“তোমার পরিবারে তো আর কেউ নেই। যাদের কথা বললে, তারা সবাই তো মেনে নিয়েছে৷ তাহলে কি সমস্যা? ”
“জানো, আমার কিডন্যাপ কে করিয়েছিল?”
“কে?”
“আমার মামা।”

কবিতা আমার কথা শুনে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “মানে? উনি তোমাকে কেন কিডন্যাপ করাবেন? উনার কি ক্ষতি তুমি করেছো?”
“আমি করিনি। কিন্তু আমার মায়ের কাজের জন্য উনি উনার ভালোবাসার মানুষটাকে হারিয়েছেন। সম্মান হারিয়েছেন। আমার খালামনিও অনেক কষ্ট সহ্য করেছেন। আমার নানা-নানি মরার মতোই বেঁচে আছেন। তারা আমাকে কিছু সম্পদ দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মামা সেটা মেনে নেননি। আমার মুখ দেখেই তো আর এতো বছরের কষ্ট মিটবে না তাদের। তাইনা?”

“আমি আসলে জানিনা কি বলবো আমি৷ কাকে যে দোষ দিব বুঝতে পারছিনা। তবে, তোমার মায়ের একটা ভুলের কারণে সব কিছু এইরকম হয়েছে। তোমার জায়গায় তুমি ঠিক আছো। তোমার মামার জায়গায়ও হয়তো তোমার মামা ঠিকই আছেন। তোমাকে মেনে নেওয়া এতো সহজ না সবার কাছে।”
“হুমম। ”

“যদি এমনটা হতো, তোমার জন্মের পরও যদি তোমার মায়ের সাথে তোমার বাবার সবকিছু স্বাভাবিক হতো, সংসার করতো, তাহলে কিন্তু আজ তোমার আম্মা তোমার বাবা কিংবা তোমাকে মেনে নিতো সে। আমার মনে হয়, সেও আলাদা হয়ে যেতো তার সন্তানদের নিয়ে। সে কোনো কষ্ট করেনি তোমার মায়ের কারণে এতো বছর৷ তার স্বামীও তার কাছেই ছিল। আবার তোমার মায়ের মৃত্যুর আগেই তোমার মাকে ডিভোর্স দিয়ে দিয়েছিল। তাই তার কাছে তোমাকে মেনে নেওয়া ততোটাও কঠিন হয়নি। কিন্তু তোমার নানাবাড়ির সবাই তোমার আর তোমার মায়ের জন্য অনেককিছুই বিসর্জন দিয়েছেন। তাই, তারা তোমাকে এতো সহজে মেনে নিবে, এইটা আশা করা ঠিক না।”

“তুমিই হয়তো ঠিক।”
“কিন্তু শুধুমাত্র সম্পদের জন্য তোমাকে কিডন্যাপ করা উচিত হয়নি তোমার মামার।”
“আমাকে নিয়ে সমস্যা নেই আমার। উনি আমার ভাই-বোনের ক্ষতি করেছেন। এইটার জন্য খারাপ লেগেছে। আমার জন্য ওদের কিছু হয়ে গেলে আমি আম্মার সামনে দাঁড়াতাম কিভাবে? কি জবাব দিতাম তাকে। ”
কবিতা চুপ করে রইলো। ধীরে ধীরে মাথা উচু করে বললো,”মায়া।”

“বলো।”
“আমিও তোমার থেকে একটা কথা গোপন করেছি। শুধু তোমার থেকেই না। সবার থেকেই।”
“কি গোপন করেছো তুমি আবার? প্রেম ট্রেম করছো নাকি?”
“নাহ। সেইরকম কিছু না।”
“তাহলে?”

“আমি যাদেরকে তোমার কাছে আমার বাবা-মা বলে পরিচয় করিয়েছি, তারা আসলে আমার মা-বাবা নন।”
আমি বিস্ফারিত চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম,”কি?”
“হ্যাঁ। ”
“জোকস করছো কবিতা?”
“নাহ। সত্যি কথা বলছি।”
“তাহলে কাব্য স্যার? উনি তোমার ভাই নন?”

“নাহ। উনি আমার আপন ভাই নন।”
“তাহলে তোমার মা-বাবা কোথায়? আর কাব্য স্যার এর বাবা-মা তোমার কি হন?”
“ভাইয়ার মা আমার ফুপি।”
“কিহ?”
“হুমম।”
“তাহলে তোমার বাবা-মা? উনারা কোথায়?”

“আমার মা আমার জন্মের সময়ই মারা গেছেন। এরপর বাবা আমাকে দেখেশুনে রাখার জন্য আরেকটা বিয়ে করেন। কিন্তু, উনি আমাকে ভালোবাসেননি। তাই ফুপি আমাকে দত্তক নিয়েছেন।”
“তোমার বাবা তোমাকে দিয়ে দিল?”
কবিতা একটু মুচকি হাসলো। কিন্তু ওর এই ছোট্ট হাসির মধ্যে ঠিক কতটা দুঃখ লুকিয়ে আছে আমি জানি।

“আমার দাদীর দোষ ছিল মায়া। উনি আমার নতুন মাকে শুধু আমার দেখাশোনার জন্যই এনেছিলেন। আমার বাবার কাছে নালিশ দিতো তার বিরুদ্ধে পান থেকে চুন খসলেই। ভেবেছিল গরীবের মেয়ে। মুখ বুজে সহ্য করবে। উনি আমাকে ভালোইবাসতেন। কিন্তু মানুষের তো একটা সহ্যক্ষমতা আছে। সেইটা পার হয়ে গেলে মানুষ আর নিজেকে আটকাতে পারে না। সে যে শুধু আমার মা হয়েই এই বাড়িতে আসেনি, সেটা সে হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দিয়েছে তার একটা ছেলে হওয়ার পর।

দাদী তবুও থামেনি। তার দুধের শিশুকে ফেলে আমার দেখাশুনা করতে বলতো। সে প্রথম প্রথম সব মেনে নিলেও পরে আর মেনে নেননি। সে যে ততোদিনে মা হয়ে গিয়েছিল। ছোট্ট মুরগিও যেমন নিজের সন্তানদের বাঁচাতে উড়ন্ত চিল বা শকুনের সাথে যুদ্ধ করে, তেমনি সেও বাঘিনী রুপ ধারণ করেছিলেন। আর সবকিছুর মূলে তো আমিই ছিলাম। একসময় দাদীর মুখের উপর কথা বলতে শুরু করেছিল।

যখন দেখলো বাবা কিছু বলছে না তাকে, তখন সে নিজের অধিকার আদায় করতো ষোলো আনাই।বাবা আর কতই বা মুখ বুজে থাকতো, আমার কারণে নতুন মা অনেক কষ্ট সহ্য করেছে দাদীর থেকে। আর আমিই যেহেতু ঝামেলার কেন্দ্রবিন্দু, তাই একসময় আমাকেই সহ্য করতে পারতো না। দাদীর অতিরিক্ত ভালোবাসা আমার জন্য কাল হয়ে এসেছিল। তারপর ফুপি আমাকে দত্তক নিয়েছিল। তখন মনে হয় আমার বয়স ৭ কিংবা ৮ হবে। এইজন্য দেখো না, আমার আর ভাইয়ার বয়সের অনেক গ্যাপ। আর আমি আর কাব্য ভাইয়া দুইজনই অনেকটা ফুপির মতোই হয়েছি। তাই বাইরের কেউ জানেই না যে আমি তাদের দত্তক নেওয়া মেয়ে।”

আমি ওর দিকে হা করে তাকিয়ে রইলাম। ওকে দেখে কি কেউ বলবে, ওর মধ্যে এতো কষ্ট লুকিয়ে আছে? এরপর কি আর আমার মনে হবে যে আমি কষ্টে আছি? দুঃখে আছি?
“তোমার বাবা তোমার খোঁজ নেন না?”
“নেয় তো। নতুন মাও নেন। কিন্তু আমি আর তাদের কাছে ফিরে যেতে চাই না। এখন এইটাই আমার পরিবার।”

আমি চুপ করে বসে রইলাম। কবিতা আমাকে তাড়া দিলো দ্রুত খাবার শেষ করার জন্য। লাঞ্চ টাইম শেষ হয়ে যাবে। ক্লাসে ফিরতে হবে। আমি অবাক হয়ে দেখলাম ও আবার বকবক শুরু করে দিয়েছে। আমার কাহিনি শুনে ওর আমার প্রতি কোনো খারাপ ধারণাই জন্মালো না দেখে আমি ভীষণ অবাক হলাম। আর ওর নিজের গল্প শুনেও খারাপ লাগলো। নিজেকে ভীষণ ভাগ্যবতী মনে হতে লাগলো।

আমার তো সবই আছে। এরা সবাই আমার রক্তের সম্পর্কের মানুষ। আর কিছু না হোক, আমি তো আমার বাবার সাথে আছি। সেটাই বা কম কিসে? আর এই মেয়েটা জন্মের পর থেকে মায়ের ভালোবাসা কি সেটাই বুঝেনি। আমি তো তবুও পেয়েছি। দেরিতে হলেও বাবার আদর ভালোবাসা পাচ্ছি। নাহ, আমি অনেক সুখি মানুষ।

আমি মায়াবতী পর্ব ১৮

আমার ভাই-বোনেরা আমাকে ভালোবাসে। বাবা ভালোবাসে। নানা-নানি ভালোবাসে। কবিতাও ভালোবাসে। দুনিয়াশুদ্ধ মানুষ আমাকে ভালোবাসবে, এইটা তো আমি আশা করতে পারিনা। আজ সাবিহাকে গিয়ে বলতে হবে, আমিও তাকে ভীষণ ভালোবাসি। অনেক ভালোবাসি। সেদিন যেমন সে আমাকে বলেছিল। আজ আমাকেও বলতে হবে।

আমি মায়াবতী পর্ব ২০