আমি মায়াবতী পর্ব ২৯

আমি মায়াবতী পর্ব ২৯
তাহমিনা মিনা

পড়ন্ত বিকেলের আলোতে মায়ার দিকে ভালোবাসাময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সোহাগ। দুটোদিন দূর থেকে দেখে এসেছে তাকে। কাছে যাওয়ার সাহস করেনি। আজ মায়া নিজে তার কাছে এসেছে। তার দিকে তাকিয়ে হেসেছে। ইশশ!কি সুন্দর তার হাসি। মায়ার ঘন কালো লম্বা চুল, চিকন চিবুক আর পাতলা ঠোঁট দেখে আকৃষ্ট হলেও সবচেয়ে বেশি ভালোলেগেছে ডাগর ডাগর চোখদুটো। এই চোখের দিকে তাকিয়ে সে নিজের জীবন দিতে পারবে। কিন্তু চোখের মালকিন কি তাকে সেই সুযোগ দিবে? মায়াকে কি বলা উচিত তার মনের কথা?

“ভাইয়া, আপনার চা।” মায়ার ডাকে ঘোর ভাঙে সোহাগের। ভ্রু কুঁচকে যায় অজান্তেই। ইশশ!কি বললো মেয়েটা? ভাইয়া? মানা যায় এইটা? সোহাগের ইচ্ছে করছে উঠে গিয়ে বলে, এই আমি তোমার কোন কালের ভাইয়া? কিন্তু সোহাগ সেটা বলতে পারে না। চক্ষুলজ্জা নাকি অধিকারবোধ না থাকা, সেটা বুঝতে পারে না সোহাগ।
চায়ের কাপ হাতে নিয়ে রিজভী বলে,”আমি যে দুইদিন ধরে আসছি, আগে আসোস নাই কেন?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মুড়ি চিবুতে চিবুতে আজগর আলী বলে,”আরেহ, আমি তো গঞ্জে গেছিলাম কামে। তোর ভাবী অবশ্য আইছিলো। তোর বউয়ের লগে কতা কইছে। কিন্তু তোরে তো আর চিনে না। তাই শরম পাইয়া আর সামনে আহে নাই।”
“তা, আজ কি গঞ্জ থেকে আইছোস? নাকি আমি আসার খবর পাইছোস?”

“না। আমার কাম শেষ হয়নাই। তোর কতা আমি আমার পোলা মাইয়ারে অনেক কইছি। আমার পোলা সোহাগ কাইলকে ফোন দিয়া কইলো যে তুই আইছোস। তাই আইজকা চইলা আইছি। তাড়াতাড়িই আইছি। যদি আবার চইলা যাস গা। ”
রিজভীর বুকের ভিতর আনন্দের ঝড় বইতে থাকে। যাক, এখানে আরো একজন তাকে মনে রেখেছে। সেই বা কম কিসে। তার ইচ্ছে করে বাল্যবন্ধুকে জড়িয়ে কান্না করা। কিন্তু সে করেনা। মুখে বলে,”তোর ছেলে কি করতেছে এখন?”

“আমি যেমন তেমন অইলে কি অইবো? আমার পোলা মাইয়া মাশাল্লাহ অনেক ভালা। আমার পোলাডা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে আর মাইয়াডা গঞ্জের কলেজে পড়ে। এইহানে তো আর ভালা কলেজ নাই। প্রতিদিন তো আর পাশের গ্রামের কলেজে যাওয়া আসা করা যায় না। মাইয়া মানুষ। বুঝোসই তো।”

রিজভীর ভীষণ ভালো লাগে বন্ধুর সাফল্যের কথা শুনে। কিন্তু রসিকতা করে বলে,”আমরা তো প্রায় সমবয়সী। তাহলে, তোর ছেলে এতো বড় কেন? আর আমার বড় মেয়েই তোর ছোট মেয়ের চাইতে ছোট কেন?”
আজগর আলী হাসেন। কিছুটা লজ্জাও পান। লজ্জামাখা চেহারায় বলেন,” আরেহ, তুই তো জানোসই আমাগো এলাকার মাইনষের কাম কারবার। কলেজে ভর্তি অইছিলাম। একদিন কলেজ থিক্যা আইসা হুনি আমার জন্য পাত্রী ঠিক।

বাপের ধানের চাতালে তহন থিকা কামে গেলাম। পড়াশোনা বন্ধ। বিয়া কইরা বউ ঘরে নিয়া কি আর পড়াশোনা করন যায় নাকি? আর আমারও অতো ইচ্ছা আছিলোনা যে পড়াশোনা করুম। কিন্তু তোর ভাবীর অনেক ইচ্ছা আছিলো পড়ালেখা করনের। তাইতো নিজের ইচ্ছা পোলাপানগো দিয়া পূরণ করতাছে। এই সারা গেরামে আমার পোলাপানই পড়ালেখা করে ভালামতো।”

“হুমম। তা তো দেখতেই পাচ্ছি। ভালো লাগলো তোর গল্প শুনে। তুই তো ভালোই। অল্প বয়সে বিয়া করছিলি বইলা এখন বড় পোলার কামাই খাইতে পারবি। আমার তো আর সেই উপায় নাই।”
“শরম দিছ না তো হা*লা। দেখতাছোস না আমার পোলায় আছে এইহানে।” নিচুস্বরে বলে আজগর আলী।
রিজভী সোহাগের দিকে তাকিয়ে বলে,”সোহাগ, বাবা এইবার কোন ইয়ারে আছো?”

“ফাইনাল ইয়ারে, আংকেল।”
“কোন ডিপার্টমেন্টে?”
“পদার্থবিজ্ঞান। ”
“অহ, ভালো সাব্জেক্টই তো পেয়েছো। ভালোই তো। আমাদের গ্রামের গর্ব তুমি। আমাদের এই গণ্ডগ্রাম থেকে অতো দূরে গিয়েছো, সেই তো অনেক। ”

সোহাগ মাথা নিচু করে বিনয়ের সাথে বলে,”জ্বি, চাচা।দোয়া রাখবেন, যেন ভালো কিছু করতে পারি।”
“তা তো অবশ্যই করি বাবা। তা তুমি টিউশনি করাও না? আমাদের সময়ে তো আমি করাতাম।”
সোহাগ বেশি টিউশনি করায় না এখন। কারণ, ওর নিজেরই পড়াশোনার চাপ বেশি। কিন্তু মুখে বলে,”হ্যাঁ, চাচা। আমি টিউশনি করাই। ”

“তা তো ভালোই। নিজের খরচ নিজে এই বয়স থেকেই গুগাচ্ছো। ভবিষ্যতে কাজে লাগবে।”
আজগর আলী বলে,” আমি তো কই পোলাপান পড়ানোর কি ঠেহা তোর? আমি তো আছিই। টাকাপয়সাও তো আমার কম নাই।”

“আরেহ, সাবলম্বী ছেলে। তুই তো জানিস না, ঢাকার শহরে টিকে থাকার কি জ্বালা। আর ওদের মতো ছেলেরা তো ঢাকাতেই থাকতে চায়। এখন থেকেই যদি নিজেরটা নিজে করে খেতে পারে, তাহলে পরেও কিছু না কিছু একটা ব্যবস্থা হবেই।” সোহাগের দিকে তাকিয়ে বলে,” তোমার ক্যাম্পাস থেকে আমার বাসা খুব একটা দূরে না বাবা। বিশ মিনিটের মতো লাগবে হয়তো। যদি তোমার অসুবিধা না হয়, তাহলে কি তুমি আমার বড় মেয়ে মায়াকে পড়াতে পারবে? না মানে যদি তোমার সমস্যা না থাকে আর কি?”

সোহাগের দম আটকে আসছিলো। কি শুনছে সে? সে তো মায়ার কাছাকাছি যেতে চাইছিলো। কিন্তু এতো কাছে? এ তো মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। কিন্তু নিজেকে সংযত করলো সে। মাথা নিচু করে জবাব দিলো,” আমি চেষ্টা করবো চাচা। আপনাকে অবশ্যই জানাবো।”
“ঠিক আছে।”

সোহাগ উঠে দাড়ালো। মায়ার দিকে একবার তাকালো সে। মায়া উঠোনের মাটির চুলোর পাশে বসে আছে। সে বাড়ি থেকে বের হতেই যাচ্ছিলো কিন্তু তখনই সাব্বির এসে বাবার কাছে কেঁদেকেঁদে বলে,”বাবা, মেজো কাকী আমার শাপলা রান্না করে ফেলেছে। আমি এখন কি নিয়ে খেলবো? শাপলা কি খাওয়ার জিনিস নাকি?”

রিজভী হাসে। হাসতে হাসতে বলে,”শাপলা রান্না করে খাওয়া যায়। আমিও রান্না করতে পারি। এই যে তোমার এই আংকেল কে দেখছো, তার সাথে আমি কত রান্না করে খেয়েছি।জিজ্ঞেস করো। শাপলা খেতেও কিন্তু ভীষণ ভালো। ”
সাব্বির জলভরা চোখে আজগর আলীর দিকে তাকায়। আজগর আলী বলে,”তোমার বাপ তো মিয়া সেরা রাধুনি। কত মাইনষের মুরগী চুরি কইরা রাইন্দা খাইছে। হিসাব আছে নাকি?”

“আজাইরা কথা কইস না আজগর আলী। আমার দোষ নাই। তুই মুরগী চুরি করছোস। আমি শুধু রানছি। দোষ কার বেশি?”
মায়া খিলখিল করে হেসে উঠে। মেয়ের সামনে খানিকটা লজ্জা পায় দুজনেই। সাব্বিরও হাসে। আজগর আলী কথা ঘুরানোর জন্য বলে, “ঐ সোহাগ, ওরে নিয়া বিল থিকা শাপলা নিয়া আয় যা। এহনই যা।”
“এখন কিভাবে যাবে? সন্ধ্যা হয়ে গেছে তো প্রায়। কালকে নাহয় এনে দিবোনে ওকে।”
“আরেহ, কিসের সন্ধ্যা? যা তো ওরে নিয়া।”

“আমি একা যাবো না বাবা। মায়া আপুকেও যেতে বলো আমার সাথে।”
“এখন তো প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেছে সাব্বির। মায়া আপু যেতে পারবে না।”
“আরেহ, কিসের সন্ধ্যা? মায়া মা, যাও তো ওদের সাথে। রিজা কই রে? রিজাও যা।”
মায়া কিছু বলতেই যাচ্ছিলো কিন্তু তার আগেই রিজা মাথায় ওড়না টেনে বের হয়ে আসে। সাব্বির এর কাছে গিয়ে ওর হাত ধরে সোহাগ এর কাছে গিয়ে বলে,”মায়া আপু, তুমিও এসো। ”

অগত্যা মায়া হাত ধুয়ে ওদের পিছনে যায়। সোহাগ কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। মায়া আর রিজা পাশাপাশি হাটছে। সে সাব্বির কে সাথে নিয়ে হাটছে। সাব্বির এটাসেটা জিজ্ঞেস করছে। ও উত্তর দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কিছুই করার নেই। আর তাছাড়া এই ছেলের জন্যই এখন সে এখানে। তাই কিছুই বলারও নেই। রিজা হঠাৎ করে বলে উঠে,”সোহাগ ভাই, ঢাকার শহর কি অনেক সুন্দর? তুমি না কইছিলা একবার ঘুরতে নিয়া যাইবা? জানো, আমিও এইবার মায়াদের সাথে যামু। তুমি কি ওদের বাড়ি চিনো?”

“তুই ঢাকায় যাবি মানে?”
“হুমম। যামু তো। বড় মামা কইছে আমারে নিয়া যাইবো। মারেও নিয়া যাইবো। আমারে ঐহানে নিয়া যাইবো। ঐহানের স্কুলে পড়মু আমি। তুমি কি মায়া আপুগো বাসা চিনো?মাঝে মাঝে কি আমারে দেখতে যাবা?”
“আমি তো ওদের বাসা চিনি না। কিন্তু ওর বাবা বললো ওকে পড়াতে। হয়তো পড়াতে যাবো ওকে। তখন তোকেও দেখে আসবো।”

“তুমি মায়া আপুরে পড়াবা? তাহলে আমারেও পড়াইও?”
“আরেহ বোকা, তুই তো মানবিক বিভাগ নিয়েছিস। আমরা তো সাইন্সের। তোকে তো পড়াতে পারবো না আমি। পড়ালে শুধু সাধারণ গনিত হয়তো। আর তাছাড়া আমি কলেজের বাচ্চা ছাড়া পড়াই না।”
“কেন? তুমি আমারে পড়াইবা না কেন? আমি কি করছি?”
“আরেহ, আমি স্কুলের বাচ্চা পড়াই না। ”

“না পড়াইলা। আমারে পড়াইবা। মায়া আপুরে পড়াইলে আমারেও পড়াইতেই হইবো।”
সোহাগের ইচ্ছে করছে রিজাকে ধরে একটা আছাড় মারতে। কিন্তু মায়া থাকায় একটা ধমক ও দিতে পারছে না। সোহাগ বিরক্ত হয়ে বলে,” আচ্ছা, ঠিক আছে। পড়াবো।”

মায়া লক্ষ্য করলো রিজা সোহাগকে নিয়ে কতোটা বেশি ভাবছে। সামনেই শাপলা বিল। মৃদুমন্দ হাওয়া সবাই উপভোগ করছে। বিলের কাছে যেতেই রিজা মায়া আর সাব্বিরকে পাড়ে দাড় করিয়ে রেখে, “সোহাগ ভাই, তুমি আসো। আমরা নিয়ে আসি। ওরা দুজন থাক।”

সোহাগ আর এইবার কন্ট্রোল করতে পারলো না। রুক্ষ গলায় বললো,”কয়েকটি শাপলাই তো আনবি। একা গেলেই তো হয়। গেলে যা। না গেলে আমাকে একা যেতে দে।”
কিন্তু ওকে একা যেতে দিলো না সাব্বির। সে একা উঠে এসে নৌকার মাঝখানে বসে। রিজা মুখ গোমড়া করে বসে নৌকা বাইতে থাকে।

“ওকে এমনভাবে না বললেও কিন্তু পারতেন। বেচারি কষ্ট পেলো।” রিনরিনে গলায় বলে মায়া।
“আমি বলতে চাইনি। কিন্তু ও অতিরিক্ত কথা বলে। আমার মাঝেমাঝে সহ্য হয়না। কিভাবে বলে ফেলেছি জানিনা। স্যরি,মায়া।”

“আরেহ, আমাকে কেন স্যরি বলছেন? আর ও আসলেই একটু বেশি কথা বলে।” কথাটা বলেই চুপ করে যায় মায়া। নাহ, রিজা বেশি কথা বলে না। অন্যের সংসারে আশ্রিতা মেয়েদের বেশি কথা বলতে নেই। রিজাও বলেনা। কিন্তু সোহাগের কাছে যেন কথার ফুলঝুরি খুলে বসেছিলো। তবে কী রিজা সোহাগ ভাইকে ভালোবাসে? এটা কি সত্যি? যদি এটা সত্যি হয়, তবে রিজাকে অনেক কষ্ট সহ্য করতে হবে। রিজার প্রতি কোনো আকর্ষণই নেই সোহাগ ভাইয়ের।

তাছাড়া, আর্থিকভাবে সোহাগ ভাইয়েরা অনেক ভালো। আর রিজারা তো তাদের কাছেপিঠেও নেই। কি হবে এই ভালোবাসার পরিনতি?
গোধুলির পড়ন্ত আলোতে মায়া দেখলো নৌকায় বসে শাপলা তুলতে তুলতে রিজা অভিমানী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সোহাগের দিকে। কিন্তু মায়া এটা দেখলো না সোহাগ নামের যুবকটাও তার প্রেয়সীর দিকে তাকিয়ে আছে নিষ্পলক দৃষ্টিতে।

“তুমি কি আর যাবে না আমাদের বাড়িতে আপু?” কায়রা জিজ্ঞেস করে কবিতাকে।
কবিতা উদাস নয়নে তাকায় তার দিকে। জীবনটাকে বিষাদ মনে হচ্ছে।কেন সে জন্মেছিল? সে দুনিয়ায় আছে বলেই তার মা মারা গেছে। সে দুনিয়ায় আছে বলেই নতুন মায়ের জীবনটা শেষ হয়ে গিয়েছে।

আমি মায়াবতী পর্ব ২৮

সে দুনিয়াতে আছে বলেই একটা নিষ্পাপ প্রান দুনিয়ার আলো দেখেনি। অতিরিক্ত ডিপ্রেশনে ভুগছে সে। অসহ্য লাগছে সবকিছু। যদি মরে যেতে পারতো, তবেই হয়তো শান্তি পেতো। যদি দুনিয়া থেকে নিজের অস্তিত্ব মুছে ফেলতে পারতো, তবেই হয়তো মুক্তি পেতো। এতোগুলো মানুষের দীর্ঘশ্বাস এর কারণ সে।কিভাবে বাঁচবে সে বাকি জীবন?

আমি মায়াবতী পর্ব ৩০