আমি মায়াবতী পর্ব ৩৫

আমি মায়াবতী পর্ব ৩৫
তাহমিনা মিনা

প্রিয় স্বামী আমার,
আমি জানিনা আপনি কখনো এই চিঠিটি পড়বে কি না। আমার প্রতি আপনার যে বিতৃষ্ণা, আমার চিঠির প্রতিও হয়তো তাই। হয়তো পড়বেন কিংবা পড়বেন না।পড়লেও কবে পড়বেন, খোদা জানে। তবুও আমি লিখছি। আমি যখন চিঠিটি লিখছি, এই মুহুর্তে আপনি আমার স্বামী।

কিন্তু যখন চিঠিটি আপনার হাতে যাবে, না আপনি আমার স্বামীরুপে থাকবেন আর না আমি এই দুনিয়াতে থাকবো। আমার সবকিছুর প্রতিই তো আপনার বিরক্তি । শুধু মায়া ছাড়া। আপনি মুখে যতোই বলেন না কেন, আমি জানি আপনি মায়াকে ভালোবাসেন। ভীষণ ভালোবাসেন।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

কারণ আপনি তার বাবা। আমি যেমন আমার বাবা মায়ের মান সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে, একটা মেয়ের সংসার ভাঙার চেষ্টা করেও আমার বাবার কাছে তার রাজকন্যা হয়েই আছি, সেখানে মায়ার তো কোনো দোষই নেই। ও তো আর কোনো দোষ করেনি। যদিও আমি ছিলাম আমার বাবার বহু প্রত্যাশিত কেউ। আর মায়াকে তো আপনি চানও নি। সে তো আপনার জীবনের একটা উটকো ঝামেলা মাত্র৷ যদিও এতে আপনার কোনো দোষ নেই।

আমি মোহিনী। আপনার সন্তানের মা। আমার পরিচয় আপাতত এইটুকুই। যখন চিঠিটি পড়বেন, তখন আর আমি আপনার স্ত্রী থাকবো না। কারণ আপনি আমাকে ডিভোর্স দিবেন। শুধুমাত্র মায়াকে আপনার কাছে রাখার শর্ত হিসেবে আপনি আমাকে ডিভোর্স দিবেন। আপনার কি মনে হয় নি কখনো, আমার প্রতি আপনি অন্যায় অবিচার করেছেন? আমারও তো চাহিদা ছিল। আপনাকে কাছে পাওয়ার ইচ্ছে ছিল। একটা সংসার করার ইচ্ছে ছিল। আমার একটা ভুল কি মাফ করা যেতো না?

আমি জানি আমি ভুল করেছি, অন্যায় করেছি, আপনার জীবনকে এলোমেলো করে দিয়েছি। আপনার প্রাণপ্রিয় স্ত্রীকে মিথ্যে অপবাদ দিতে চেয়েছি। সেইজন্য আপনি আপনার মেয়েটিকে দেখতেও আসেন নি। আমি জানি আমি অবিবেচক এর মতো কথা বলছি। কিন্তু আমি তো আপনার স্ত্রী ছিলাম। আমাকে কেন একটু ভালোবাসেন নি। আমি জানি আমি আপনার জীবনটাকে বিষিয়ে দিয়েছিলাম কিন্তু একটা কথা জানেন তো? সবকিছুর উপরে আমি আপনাকে ভালোবেসেছি। নিজের জীবন দিয়ে ভালোবেসেছি। এতোটাই ভালোবেসেছিলাম যে নিজের সবটুকু আপনার হাতে তুলে দিয়েছিলাম।

আমি জানি এইটা অন্যায় ছিল, ভুল ছিল। কিন্তু নিজের মনকে কিভাবে মানাতাম আমি? আপনার কি মনে আছে, আমি রান্না করলে আপনি সবটুকু খেয়ে নিতেন। কিন্তু আমি ঐ খাবার খেতে পারতাম না। আমি ভাবতাম আমি রান্না করেছি বলে হয়তো আপনি এইভাবে খেতেন। কিন্তু আমি পরে জেনেছিলাম আপনি ক্ষুধার জ্বালায় খেতেন। আপনি সেই অখাদ্য গলাঃধকরন করতেন যাতে আপনার প্রিয় স্ত্রীকে একটু বেশি খাবার খাওয়াতে পারতেন।সেদিন রাতেও কিন্তু আপনি আমার বাসায় খাবারের জন্যই এসেছিলেন। কি অদ্ভুত প্রেম ছিল আপনার। আর আমি আপনাদের মাঝে ছিলাম তৃতীয় ব্যক্তি অর্থাৎ শয়তান।

আমার যে মাঝেমাঝে আফসোস হয় না, তেমনটা কিন্তু নয়। আমার ভীষণ আফসোস হয়। হয়তো আপনি আমার জীবনে না আসলে আমার জীবনটা অন্যরকম হতো। তবে আমার সব কষ্ট দূর হয়ে যেতো যখন আমি মায়ার দিকে তাকাই। ওর মুখে আপনার চেহারার ছাপ স্পষ্ট। আমি চেয়েছিলাম সংসার করতে। একটা সুখী পরিবার হতে। কিন্তু আমি আমার সংসার গুছাতে গিয়ে যে আরেকটা সংসার ভাঙতে চেয়েছিলাম, সেটা মনে হয়নি।

আমি জানি আমি আর বেশিদিন বাঁচবো না। আমার নিজের জীবন নিয়ে আমার কোনো আশা নেই আর। কিন্তু আমার ভীষণ ভয় হয় আমার মায়াকে নিয়ে। ওর মায়াভরা মুখটার দিকে তাকালে আমার মনে হয় না জানি আমার পাপের ফল আমার বাচ্চা মেয়েটাকে না ভোগ করতে হয়।

এক জীবনে সবকিছু পেতে হবে, তার কোনো মানে নেই। তবে, আমি আমার জীবনে মায়াকে ছাড়া আর কোনো কিছুই অর্জন করতে পারলাম না। ভেবেছিলাম এই জীবনে আপনাকে না পাই, পরকালে তো আপনাকে পাবো। কিন্তু আপনি আমার সেই আশাটুকুও শেষ করে দিলেন।

আপনি মায়াকে আপনার কাছে রাখার বিনিময়ে পরকালেও আমার থেকে নিজেকে আলাদা করে দিলেন। আমার দোষটা কি এতোটাই বেশি ছিল? আমি তো আর আপনার সংসারে কখনোই কোনো ঝামেলার সৃষ্টি করিনি। আমাকে শেষ জীবনে কাছে রাখলে কি খুব বেশি ক্ষতি হতো? আপনি আমাকে কি বললেন? আপনার স্ত্রীর হক নাকি আপনি নষ্ট করতে চাননি। সে যে আপনার জন্য সব ছেড়েছুড়ে এসেছে।

আপনার উপর আমার কোনো অভিযোগ নেই। কোনো অভিমানও নেই। কারণ, আমার যে সেই অধিকারটুকুও নেই। আমি সেই অধিকার অর্জন করতে পারিনি। আমি শুধু চাইবো আমার মেয়েটাকে আপনি দেখে রাখেন। সাগরিকা যে মায়াকে প্রথমে মেনে নিতে পারবে না, সেটা আমি জানি।

তবে আমার মায়ার মায়ায় পড়ে তাকে যে ভালোবাসতেই হবে। আপনি আমার উপরের কোনো রাগ আমার মায়ার উপরে দেখাবেন না। দোহাই লাগি আপনার। আপনারা ছাড়া আমার মায়ার যে আর কেউই নেই এই দুনিয়ায়। আমি শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করবো যাতে আমাদের ডিভোর্স না হয়। সংসার হয়তো নেই আমাদের কিন্তু আমার তো আছে। একটা বাচ্চা, মাসে দু একবার স্বামীর দর্শন, এই তো অনেক। আর কি চাই জীবনে? আমি আপনার প্রতি কোনো অভিযোগ রাখবো না। কারণ, আমার যে অভিযোগ করার অধিকারও নেই।

ইতি
আপনার বিষাক্ত সাপ
চিঠিটা পড়ে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো রিজভী। নিজের অতীতের সাথে যে আরো একবার সাক্ষাৎ হবে, সেটা আশা করেনি সে। সবতো ঠিকই ছিল। কেন হঠাৎ করেই চিঠিটা সামনে এলো? না এলেই কি ভালো হতো না? সেই কবে সাগরিকার হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে কোনো এক পুরোনো ফাইলের মাঝে রেখে দিয়েছিল সে।

আজ সেইসব ঘাটাঘাটি করতে গিয়েই সামনে পেয়ে গেছে সে। মোহিনীর জন্য মাঝে মাঝে করুনা হয় তার। মেয়েটি একটা মোহে পড়ে সবই হারিয়েছে। সাথে করে তার নিজের জীবনটাকেও বিষিয়ে দিয়ে গেছে। মুহুর্তেই আবার তেতো হয়ে উঠে রিজভীর মন মোহিনীর প্রতি। তার দুঃখ কষ্ট গুলোকে নিজের করে নিতে পারেনা সে।

সে তার কেউ না। কেউ ছিলও না কখনোই। চিঠিটাকে কুটি কুটি করে ছিড়ে ফেলে সে। তার জীবনে এইসব ফালতু মেয়ের কোনো কিছুরই দরকার নেই। কিন্তু মায়াকে সে কিছুতেই ফেলতে পারবে না। সে যে তারও অংশ। সে তার নিজের মেয়েকে ভালোবাসে। পরের কথায় কেন সে ভালোবাসবে? সে এখন বেশ ভালো আছে। মায়াও ভালো আছে। সবাই ভালো আছে। সে তার সাধ্যমতো চেষ্টা করেছে সবাইকে ভালো রাখতে।

“মিয়াভাই, মায়া সাগরিকা ভাবি আর তোমার মেয়ে না? ও অন্য মহিলার মেয়ে?” অবাক চোখে জিজ্ঞেস করে রিতু।
আচমকাই এইরকম প্রশ্নে চমকে উঠে রিজভী। রিতু কিভাবে জানে এইসব? কেউ কি তাকে বলেছে?রিতুর দিকে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকায় সে। রিতু সে দৃষ্টি বুঝতে পেরে বলে,”সাব্বির বলেছে।”
“সাব্বির? কি বলেছে ও?” অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে রিজভী।

রিতু একটু ইতস্তত করে বলে,”বলেছে আমার মাও কি মরে গেছে নাকি যে আমি মায়ার মতো এখানে এসে থাকছি?”
রিজভী বিরক্তিতে মুখটা বিকৃত করে ফেলে।
“আমারে কি বলা যায়না মিয়াভাই সবকিছু? ”
“কেন বলবো না? অবশ্যই বলবো৷ কিন্তু কথা দিতে হবে তোকে,মায়াকে ভিন্ন চোখে দেখবি না মোটেও। এখন যেভাবে দেখছিস, সেইরকমই দেখবি।”

ভাইয়ের কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারে না রিতু। কিন্তু হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায় সে।
ভরসা পেয়ে রিজভী একে একে সবকিছু খুলে বলে তাকে। রিতুর দুচোখে পানি টলমল করে। চোখ বন্ধ করলেই যেন পানিগুলো মুক্তোর দানার মতো টপটপ করে পড়বে। রিজভী তাকে কোনো সান্ত্বনা দেয় না। কাঁদুক সে। সেও জানুক তার ভাইও ভালো ছিল না কোনো কালেই। দুঃখ যে তাদের কারো পিছুই ছাড়েনি।

গভীর রাত। আজকের সারাটাদিনই মোহিনীর স্মৃতিগুলো তাড়া করে বেড়িয়েছে রিজভীকে। বিন্দুমাত্র ঘুম আসছে না তার চোখে। পাশ ফিরে সাগরিকাকে একবার দেখে নেয় সে। এই মানুষটা সবকিছু এতো সহজভাবে নিয়েছে বলেই তার জীবনটা এতো সুন্দর আজ।কিন্তু বুকের মধ্যে কিছু একটা হচ্ছে তার৷সে উঠে পড়ে বিছানা ছেড়ে। প্রথমে সাব্বিরের রুমে উঁকি দেয় সে। ছেলেটার ভবিষ্যত নিয়ে সে ভীষণ চিন্তিত। তারপর সে যায় বোনের ঘরের কাছে।

ভিতরে ঢুকতে গিয়েও ঢুকতে পারে না সে। ঘুমুচ্ছে তারা। বোন আর বোনের মেয়ে আছে রুমে। কি এক অদ্ভুত জড়তা কাজ করছে। সে উল্টো ঘুরে আসলো মায়াদের রুমে। গিয়েই অবাক হয়ে গেল সে। খাটে শুধু সাবিহা শুয়ে আছে। বুকটা ধ্বক করে উঠে তার। মায়া কোথায়? লাইট জ্বালিয়ে দেয় সে। ওয়াশরুমের সামনে গিয়ে দেখে বাইরে থেকে ছিটকিনি দেওয়া। তবুও দরা খুলে দেখে নেয় সে। কেউ নেই সেখানে।

রিজার কাছে গিয়েছে কি না দেখার জন্য তড়িঘড়ি করে পা বাড়াতেই বারান্দা থেকে মিহি স্বরে কান্না শব্দ শুনতে পায় সে। পা টিপে টিপে সেখানে গিয়ে দেখে মায়া একটা শাড়ি বুকে জড়িয়ে ধরে নিজের মুখ নিজে চেপে ধরে কান্না থামানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছে। থমকে দাঁড়ায় সে। তবে কি মায়া ভালো নেই?

ধীরে ধীরে হেটে মায়ার কাছে গিয়ে তার পাশে বসে পড়ে। মায়ার মাথায় হাত রাখতেই মায়া হতচকিত হয়ে তার দিকে তাকিয়ে অপ্রস্তুত হয়ে যায়। নিজেকে একবার সামলে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেও আবার বসে পড়ে সে। ছোট্ট শিশুর মতো বাবার গা ঘেঁষে বসে পড়ে। রিজভী মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,”কি হয়েছে মায়া? কেউ কি বকেছে? কষ্ট দিয়েছে?”

মায়া নাক টানতে টানতে বলে,” নাহ।”
“ব্যথা পেয়েছো কোথাও? কোনো অসুখ করেছে মা?”
“নাহ।”
“কারো সাথে ঝগড়া করেছো? কোনো সমস্যা হয়েছে? স্যার রা বকেছে?”
“নাহ।”
“তাহলে কি হয়েছে?”

মায়া বাবার দিকে তাকিয়ে বলে,”তোমার মনে নেই বাবা?”
“কি আজকে? কিছু হয়েছিল?”
মায়াকে দেখে মনে হলো মায়া আশাভঙ্গ হলো। কিছুই বললো না সে। রিজভী তাকে চুপচাপ থাকতে দেখে আবার বলে,”বাবাকে বলা যায় না কি হয়েছে?”

মায়া বাবার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে,” আজ আমার মায়ের মৃত্যুবার্ষিকী বাবা। রাত ২ টা ১৮ মিনিটে আমার মা আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে বাবা। আমাকে একা করে দিয়ে চলে গেছে সে।” বলেই হুহু করে কান্না করে উঠে সে।
রিজভী আর বসে থাকতে পারে না সেখানে। মায়ার সেই হাসিমাখা মুখের চোখের চাহনির মাঝে কি একটা অভিমান লুকিয়ে রেখেছে সে।অথচ মুখে হাসি। কি ভয়ানক।

মায়ার সেই দৃষ্টির সামনে দাঁড়ানোর ক্ষমতা নেই তার। উঠে পড়ে সে দ্রুতই। বড় বড় পা ফেলে চলে আসে নিজের ঘরে। নিজেকে বড্ড অপরাধী লাগছে তার এখন। মনে হচ্ছে মোহিনীর ভুত তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে আজ সারাদিন। মায়ার সামনে যাওয়ার সাহস তার নেই। কিন্তু সে যদি পেছনে ঘুরতো, তবে দেখতে পেতো মায়া অঝোর ধারায় কান্না করছে। মায়ার এখন তাকে ভীষণ দরকার।

মায়ার যে তার বাবার প্রতি কোনো অভিযোগ নেই। তার মা ই যে তাকে কোনো অভিযোগ করতে বারণ করে গেছে। শত হোক, মা তো। যতো খারাপ কাজই করুক না কেন, মায়ের সব কথাই সে মেনে নিয়েছে। বাবা যাই করেছে, সবই পরিস্থিতির শিকার হয়ে করেছে।

আমি মায়াবতী পর্ব ৩৪

নিজের স্ত্রী আর সন্তানদের কথা ভেবে করেছে। তবুও মায়াও যে আদম সন্তানদেরই একজন। তার মাঝেও যে হিংসা আছে, ক্ষোভ আছে। সেটাকে দমিয়ে রাখার ক্ষমতা মায়ার নেই। সাগরিকা যতোই ভালোবাসুক না কেন, মা তো মা ই হয়। সে ভালোবাসলেও মা, ভালো না বাসলেও মা।

আমি মায়াবতী পর্ব ৩৬