অনেক সাধনার পরে বোনাস পর্ব 

অনেক সাধনার পরে বোনাস পর্ব 
অরনিশা সাথী

দু’বছর বাদে মেয়ে তুলে দিবেন কথাটা নুহাশের পছন্দ হলো না। গত পাঁচ’টা বছর তো অপেক্ষা করেছে। এখন আরো দু’বছর যোগ হলো? নুহাশের বলতে ইচ্ছে করছে ’আমি এতদিন অপেক্ষা করতে পারবো না’ কিন্তু কথাটা বলার কোনো স্কোপ নেই। নেহাৎ’ই অভদ্র ভাববে বলে কথাটা চুপ করে সয়ে গেলো। নুহাশের মনের কথাটা চট করেই কিয়ান ধরে ফেললো। বাঁকা হেসে বলে,

–“আরো দুইটা বছর অপেক্ষা করতে হবে নুহাশ, পারবি তো?”
নুহাশ চোখ কটমট করে তাকালো কিয়ানের দিকে। কিয়ান দাঁত বের করে জ্বালাময়ী হাসি দিলো। যা দেখে নুহাশের মেজাজ আরো চটে যায়। আদিরা ওদের দিকে ঝুঁকে বললো,
–“এই কি কথা হচ্ছে দুজনের?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

কিয়ান নুহাশের দিকে তাকায়। ও ফোনে ব্যস্ত। মূলত নিজেকে ব্যস্ত রাখার প্রয়াশ চালাচ্ছে। রুজবার সাথে এতটা কাছাকাছি বসে আছে যার ফলে ওর মনের ভেতরে তোলপাড় শুরু হয়েছে। মন অন্যদিকে ঘুরানোর জন্যই ফোনে ব্যস্ত সে। রুজবা’ও কাচুমাচু করে বসে আছে। এই মানুষ’টার এত’টা কাছে আসবে কখনো সেটা কল্পনা করেনি কিনা। শরীর তো থরথর করে কাঁপবেই। কিয়ান দাঁত বের করে হেসে বললো,

–“আদিরা ভাবী, তোমার দেবরের পক্ষে দুই বছর অপেক্ষা করা সম্ভব না, সেটাই বলছিলো ও আমাকে।”
রুজবা নিজের শাড়ি খামচে ধরলো কিয়ানের কথা শুনে। নুহাশ দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
–“একদম উল্টাপাল্টা বলবি না। এই কথা কখন বললাম আমি?”
–“তুই মুখে বলিস নি, কিন্তু আমি বুঝে নিয়েছি।”
আদিরা অবাক কন্ঠে বললো,

–“এমা দুই বছর অপেক্ষা করবে কেন? সামনে শুক্রবার আকদ হবে বললো তো।”
–“তুলে দিবে দুই বছর পর শুনলে না? অতদিন তোমার দেবর বউ ছাড়া থাকবে?”
আদিরা মৃদু হাসলো। তারপর একগাল হেসে বলে,

–“উনারা মেয়ে শ্বশুর বাড়ি পাঠাবেন দুই বছর পর। নুহাশ’কে তো আর শ্বশুর বাড়ি আসতে বারণ করেনি। বর প্রবাসী থাকলে সেই ক্ষেত্রে মানা যায়, কিন্তু এখানে বর বউ দুজনেই দেশে। তার উপর কাছেপিঠেই দুজনের বাড়ি। রাস্তাঘাটে বের হলেই তো দুজন দুজনকে দেখবে। এভাবে দুই বছর বউকে ছাড়া থাকা মুখের কথা নাকি? নুহাশের যখন ইচ্ছে হবে আসবে। শুধু রুজবা যাবে না, ব্যাস!”
কিয়ান বাঁকা হেসে বললো,

–“যাক, বাঁচলি নুহাশ। বউকে ছেড়ে দুই বছর থাকতে হবে না। তোর চিন্তায় তো আমার জান বেরিয়ে যাচ্ছিলো। তাহলে তোর কি অবস্থা হচ্ছিলো এতক্ষণ এটাই ইমাজিন করছি আমি।”
নুহাশ পরবর্তীতে কিছু না বলে নিরব থাকে। এরা ওর কোনো কথা’ই কানে তুলবে না। তাই চুপ করে থাকাই শ্রেয় মনে করলো। কিয়ান আর আদিরা আবারো উঠে পড়ে লাগলো ওদের দুজনকে লজ্জা দিতে।
রুজবা বসে বসে হাঁসফাঁস করছে। আর একটু হলেই জান বেরিয়ে যাবে যাবে অবস্থা। মনে মনে নুহাশ’কে গালি দিতে ভুললো না কয়েকটা। এই লোকটা তো পারে এখান থেকে উঠে অন্য কোথাও বসতে। রুজবার হাঁত-পা ঘামছে। এভাবে কতক্ষণ থাকা যায়?

নোমান সাহেব বিকেলেই যাওয়ার উদ্যেগ নিয়েছিলো। রায়হান সাহেব যেতে দেয়নি। প্রথমত জান্নাতের শ্বশুর বাড়ির লোকজন। তার উপর এখন রুজবার’ও হবু শ্বশুর বাড়ির লোকজন তাই জোর করেই রেখেছে। রাতে না খাইয়ে ছাড়বেন না কিছুতেই। ইতিমধ্যেই মাগরিবের আযান পড়েছে। শাহানা বেগম আদিরা আর কিয়ানকে বললো,
–“এই অনেক লেগেছিস মেয়েটার পেছনে এবার ছাড় তো ওকে। গিয়ে চেঞ্জ করুক। এভাবে গাদাগাদি করে একটা সোফায় চারজন বসে আছিস মেয়েটার অস্বস্তি হচ্ছে না? ছাড় এবার ওকে।”

রুজবার চোখমুখ জ্বলজ্বল করে উঠলো। এতক্ষণে বুঝি কেউ ওর দিকে নজর দিলো। কিয়ান ভ্রু কুঁচকে বললো,
–“সে কি ছোট মা? এখনই যাবে কেন? নুহাশের সাথে আলাপচারিতা করবে না?”
–“সে করা যাবে এখনো ছয়দিন সময় আছে হাতে। এই গরমের মধ্যে মেয়েটার সাথে সবগুলো বদমাশের দল চিপকে বসে আছিস কেন।”
কিয়ান আর আদিরা হাসলো। নুহাশ তখনো ব্যস্ত ফোনে। এদিক ওদিক নজর দিচ্ছে না ইচ্ছে করেই। শাহানা বেগম রুজবাকে বললো,

–“তুমি ঘরে যাও মা। গিয়ে চেঞ্জ করো। অনেকটা সময় বসিয়ে রাখলাম কিছু মনে করো না আবার।”
রুজবা মৃদু হেসে উঠে গেলো দ্রুত। শাহানা বেগম আর আমিনা বেগম(কিয়ানের মা) দুজনে উঠে গেলো নামায আদায় করতে। রুজবা দ্রুত ঘরে গিয়ে দরজা আটকে দিলো। দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে ফ্লোরে বসে স্বস্তির শ্বাস নিচ্ছে। এতক্ষণ দম বন্ধ করে বসে ছিলো যেন। নুহাশের এতটা কাছে কখনো নিজেকে কল্পনা করেছে কি? করেনি তো। মন তো উথাল-পাতাল করবেই। মিনিট তিনেক ওভাবে বসে থেকে উঠে দাঁড়ায়। আলমারি থেকে একটা নতুন চুড়িদার নিয়ে চেঞ্জ করতে চলে যায়। একেবারে ফ্রেশ ট্রেশ হয়ে বের হলো ও। ফোন বেজে উঠতেই সেদিকে নজর দেয় ও। এগিয়ে যায় ফোনের কাছে। সাহিলের ফোন। এক চিলতে হাসি ফুঁটে উঠে রুজবার মুখে। ফোন রিসিভ করে বলে,

–“কেমন আছো সাহিল ভাই?”
–“ভালো তুই?”
–“ভালো। কি করছো?”
–“বন্ধুদের সাথেই আছি। তোর কি খবর বল, কি করছিস?”
রুজবার মুখটা ছোট হয়ে গেলো। বন্ধুদের সাথে আছে তারমানে জারাফ’ও আছে নিশ্চয়ই? চোখ ভেঙে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। মানুষটা হয়তো ওকে ঠকিয়েছে কিন্তু ও’কি কখনো ভুলতে পারবে? ওর ভালোবাসাটা তো আর মিথ্যে ছিলো না।

আচমকা রুজবার নজর ওর বা হাতের অনামিকা আঙুলের উপর পড়লো। একটু আগে নুহাশের পড়িয়ে দেওয়া গোল্ডের রিংটা জ্বলজ্বল করছে অনামিকায়। তপ্ত শ্বাস ফেললো রুজবা। জারাফের কথা আর ভাবা’ও যে পাপ ও যে এখন নুহাশের বাগদত্তা, ক’দিন বাদেই ওদের আকদ। রুজবাকে চুপ থাকতে দেখে সাহিল বললো,

–“ব্যস্ত তুই? এর আগেও ফোন করলাম পেলাম না যে।”
রুজবা ছোট শ্বাস ফেলে নিজেকে সামলে নেয়। আশেপাশে এলোমেলো ভাবে চোখের পলক ফেলে বললো,
–“নুহাশ ভাইয়ের সাথে এনগেজমেন্ট হয়ে গেছে সাহিল ভাই। সামনে শুক্রবার আকদ।”
কথাগুলো শুনে সাহিল বেশ খুশি হলো। কন্ঠে খুশির আভাস স্পষ্ট। বললো,

–“সত্যি বলছিস?”
–“হুম।”
–“আচ্ছা আর একবার রিপিট কর কথাটা।”
কথাটা বলেই সাহিল ফোনের স্পিকার অন করলো। পাশে জারাফ মাহিন সাথে আরো দুজন বন্ধু আছে। জারাফ এতক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে ছিলো সাহিলের দিকে। ও প্রথমেই বুঝতে পেরেছে রুজবার সাথে কথা বলছে সাহিল। সাহিল অদ্ভুত হেসে বললো,

–“হ্যাঁ রুজবা বল।”
–“একটু আগেই নুহাশ ভাই’র সাথে এনগেজমেন্ট হয়েছে সামনে শুক্রবার আকদ।”
–“এটা খুব খুশির খবর রুজবা৷ এভাবেই হাসিখুশি থাক সবসময়। নুহাশের সাথে কখনো খারাপ থাকবি না তুই।”
–“হু দোয়া ক___”
পুরো কথা শেষ করার আগেই জারাফ সাহিলের থেকে ফোন টেনে নেয়। সাহিল কপাল কুঁচকে তাকায়৷ জারাফ ফোনের স্পিকার অফ করে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

–“নুহাশের সাথে বিয়ে তোমার? এনগেজমেন্ট’ও সেরে ফেলেছো? তার মানে আগে থেকেই ওর সাথে গোপনে সম্পর্ক রেখেছিলে তুমি? দুই বছর আগে বিয়ে ভাঙার মিথ্যে নাটক সাজিয়েছিলে? আমার প্রতি তো আর অনূভুতি নেই, থাকবে কি করে? আগে থেকেই তো নুহাশের সাথে সম্পর্ক চলছে তোমার। সেজন্যেই তো ব্রেক-আপের পর আর একটা বারের জন্যও ফোন করো নি। সম্পর্ক ভাঙার তিন মাসের মধ্যেই আবার বিয়ে করে ফেলছো। আমাকে ভালোবাসলে নিশ্চয়ই এরকমটা করতে না। তুমি, তুমি তো আমার থেকে বড়___”

–“একদম আমার সাথে গলাবাজি করবে না জারাফ। সবাইকে নিজের মতো ভেবো না। তুমি নিজে যে কাজগুলো করেছো সে কাজের জন্য আমাকে দোষারোপ করছো কেন? তুমি নিজে আমাকে ছেড়ে নিদ্রা’র কাছে গিয়েছো, আমি ছেড়েছিলাম তোমাকে? এখন তোমার জন্য সারাজীবন কি কেঁদে কেঁদে মরবো আমি? তুমি নিজে সামনে মাসে বিয়ে করছো আর আমি বিয়ে করলেই দোষ? মগের মুল্লুক পাইছো নাকি?”

–“তুমি নুহাশ’কে বিয়ে করতে পারো না___”
–“তোমার কথাতেই?”
–“হ্যাঁ আমার কথাতেই, আমি আসছি তোমার বাসার সামনে, তুমি বের হও। সামনাসামনি কথা___”
সাহিল ফোন কেড়ে নেয় জারাফের থেকে। রুজবাকে বললো,
–“পরে কথা বলছি।”
এইটুকু বলেই লাইন কেটে দেয় ও। জারাফ রাগান্বিত স্বরে বললো,

–“তুই সব জানতি তাই না? নুহাশের সাথে ওর___”
–“থাকলেও বা তাতে তোর কি? তুই তো নিদ্রাকে ভালোবাসিস, আর ওকেই বিয়ে করছিস। ওর জন্য না রুজবাকে ছাড়লি? এখন রুজবা যাকে ইচ্ছে বিয়ে করুক তোর সমস্যা কোথায়?”
–“ও আমার জীবনে প্রথম নারী ছিলো সাহিল।”

–“ছিলো, এখন আর নেই। এখন ও নুহাশের বাগদত্তা। আর তুই নিজে ইচ্ছে করে হারিয়েছিস ওকে।”
জারাফ দোটানায় পড়ে গেলো। নিদ্রা নাকি রুজবা? ও তো নিদ্রাকে বিয়ে করার সময় রাজি হতে এতটা কষ্ট হয়নি ওর, রুজবাকে ছেড়ে দিতেও দুবার ভাবেনি। তাহলে আজ যখন শুনলো রুজবা নুহাশের বাগদত্তা তখন ওর এত কষ্ট হচ্ছে কেন? কেন রুজবার এনগেজমেন্ট হয়েছে এটা মানতে পারছে না? জারাফ কিছু না বলে উঠে দাঁড়ালো। সাহিল সামনে দাঁড়িয়ে বলছে,

–“কোথায় যাচ্ছিস?”
–“রুজবার বাসার সামনে, আমি গেলে ও না এসে থাকতে পারবে না।”
–“কোত্থাও যাবি না তুই। ওদের বাড়িতে মেহমান আছে এখন। অনেক লোকজন। ওখানে গিয়ে একদম সিনক্রিয়েট করার চেষ্টা করবি না।”
জারাফ কিছু না বলে এগোতে গেলে মাহিন বললো,

–“এসব করার মানে কি জারাফ? ভুলে যাচ্ছিস কেন রুজবার যেমন এনগেজমেন্ট হয়েছে তেমনি তোর’ও নিদ্রা’র সাথে বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। মেয়েটা যখন তোর আশায় পথ চেয়ে বসেছিলো তখন তুই নিদ্রা’কে নিয়ে মেতে ছিলি তাহলে আজ যখন মেয়েটা নিজের কথা ভাবছে তখন তোর সহ্য হচ্ছে না কেন?”
জারাফ উত্তর দিতে পারলো না। তবুও পা বাড়ালো রুজবাদের বাসার উদ্দেশ্যে। ওর পেছনে সাহিল আর মাহিন’ও দ্রুত ছুটলো।

বিছানায় হাটু মুড়ে বসে কাঁদছে রুজবা। ভীষণ রকমের কষ্ট হচ্ছে ওর। জারাফ এখন কেন এরকম শুরু করছে? ছেলেটা কি চায় না রুজবা একটু ভালো থাকুক? ওর কি ভালো থাকার অধিকার নেই? নিজে তো ঠিকই নিদ্রা’কে নিয়ে ভালো আছে, সামনের মাসে বিয়ে করবে। তাহলে ও বিয়ে করলে সমস্যা কি? কেন এসব বলছে এখন? এগুলো ভেবেই ডুকরে কেঁদে উঠে রুজবা। এমন সময় দরজায় কড়া আঘাত করে কেউ। রুজবা দ্রুত মুখ তুলে চোখের পানি মুছে নেয়৷ নিজেকে স্বাভাবিক করে দরজা খুলে দেয়৷ ফারিন আর আদিরা ঘরে ঢুকে। ফারিন বললো,

–“সেই কখন এসেছিস চেঞ্জ হতে, এত সময় লাগলো?”
–“না মানে___”
আদিরা রুজবাকে নিয়ে বিছানায় বসলো। একপাশ থেকে রুজবাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
–“আরেহ বিয়ে ঠিক হলো না? তার উপর হবু বর আছে এখানে তাই বোধহয় লজ্জা পেয়ে আর ঘর থেকে বের হয়নি।”
রুজবা কি বলবে ভেবে পেলো না। ফারিন বললো,

–“লজ্জা পাওয়ার কি আছে রুজবা? আগে তো পায়ে পাড়া দিয়ে ঝগড়া করতি মাঝে মাঝে।”
–“তখন তো আর জানতো না এই লোকটাই ওর বর হবে।”
আদিরার কথায় ফারিন ঠোঁট চেপে হাসলো। রুজবা লজ্জায় মাথা নিচু করে বসে আছে। আদিরা এটা সেটা বলে রুজবাকে স্বাভাবিক করে। অতঃপর তিনজনে মিলে আড্ডা দিতে শুরু করে। রুজবা আর ফারিনের আগে থেকেই আদিরার সাথে বেশ ভাব। আজ নুহাশের সাথে এনগেজড হতেই লজ্জা লজ্জা লাগছিলো রুজবার। সংকোচ হচ্ছিলো আদিরার সাথে কথা বলতে। কিন্তু আদিরা সেই সংকোচ বেশিক্ষণ স্থায়ী হতে দেয়নি।
আড্ডার এক পর্যায়ে কিয়ান দরজায় টোকা মারে। কথা থামিয়ে তিনজনেই সেদিকে তাকায়। কিয়ান দাঁত বের করে হেসে ভিতরে ঢুকলো। আদিরা বললো,

–“আমার দেবর’টাকে একা বসিয়ে রেখে এখানে গার্লস গ্রুপের কাছে আসলে কেন?”
–“এখানে যে আমার প্রাণভোমরা আছে তাই।”
ফারিন লজ্জায় হাঁসফাঁস করে উঠলো। এই কিয়ান’টা দিনকে দিন অসভ্য আর ঠোঁটকাটা হচ্ছে। আদিরার সামনে এভাবে কেউ বলে? ফারিন কিয়ানের বাহুতে থাপ্পড় মেরে বলল,
–“বাই দ্যা ওয়ে রুজবা, তোমাকে কি ভাবী বলবো? নাকি শালীকা’ই থাকবে আমার? আবার বেয়াই-বেয়ানের সম্পর্ক’ও কিন্তু আছে আমাদের।”
রুজবা মৃদু হেসে বললো,

–“শালী দুলাভাই বেস্ট কিয়ান ভাই।”
–“ওকেহ ডান ভাবী।”
কিয়ানের কথায় আদিরা ফারিন দুজনেই হেসে দিলো। রুজবা চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে ক্ষানিক বাদে ও নিজেও হেসে দেয়। কিয়ান কিছু মনে পড়ার ভঙ্গিতে বললো,
–“আমি তো ভুলেই গেছিলাম, নুহাশ ছাদে অপেক্ষা করছো চলো তো রুজবা। তোমাদের’ও তো একটু আলাদা কথা বলা দরকার নিজেদের মধ্যে তাই না?”
রুজবা আমতা আমতা করে বললো,

–“আমি আবার কি কথা বলবো নুহাশ ভাইয়ের সাথে?”
–“ভাইকে এখন থেকে জামাই মানতে শেখো রুজবা৷ আর মাত্র কয়েকটা দিন তারপর কিন্তু পার্মানেন্টলি তোমাকে নিজের বউ করে নিচ্ছে আমার দেবর।”
রুজবা চুপ করে গেলো। কথার পরিবর্তে কোনো জবাব নেই ওর। আদিরা হেসে বললো,
–“ফারিন, ওকে ছাদে নিয়ে যাও। দুজনেই কথা বলুক।”

রুজবা যেতে না চাইলেও ফারিন জোর করে রুজবাকে টেনে ছাদে নিয়ে যায়। নুহাশ ছাদের রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়ে আছে। এখান থেকে রুজবাদের বাড়ির সামনের রাস্তা’টা স্পষ্ট দেখা যায়। ফারিন রুজবাকে নুহাশের দিকে ধাক্কা দিয়ে বললো,
–“নুহাশ ভাই? এই যে আপনার হবু বউ, কোনো কথা বলার থাকলে বলে নিন।”
নুহাশ পেছন ফিরে তাকায়। কিয়ান ফারিনকে নিয়ে চলে যায় অন্য সাইডে। রুজবা ধীর পায়ে নুহাশের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। দুহাতে রেলিং আঁকড়ে ধরে দৃষ্টি রাখে সামনের রাস্তায়। বেশ কিছুক্ষণ দুজনেই নিরব থাকে। এক পর্যায়ে নুহাশ বলে,

–“তোমাকে নিয়ে আমার শখের কোনো কমতি নেই রুজবা জানো?”
রুজবা প্রশ্ন চোখে তাকায়। নুহাশ নিজে থেকেই বলে,
–“তোমাকে নিয়ে সমুদ্র দেখার শখ, দূর পাহাড়ের চূড়ায় উঠে বলার শখ, “তুমি মানুষ’টা একান্ত আমার”। শহরের অলিতে-গলিতে তোমায় নিয়ে রিকশায় চড়ার শখ। জোৎস্না রাতে চাঁদ দেখবো, একসাথে বৃষ্টিতে ভিজবো, রাত দুপুরে তোমায় নিয়ে ছাদে উঠে আকাশের তারা গুনবো, ইচ্ছে হলেই দুজন মিলে বেসুরা কন্ঠে গান গাইবো। এরকম আরো কত্ত কত্ত শখ আমার যা তোমাকে বলে শেষ করতে পারবো না।”

রুজবা তখনো এক দৃষ্টিতে নুহাশের দিকে তাকিয়ে আছে। নুহাশ তপ্ত শ্বাস ফেলে বললো,
–“সেদিন যখন জারাফের জন্য তুমি আমার পায়ে পড়ে গেলে, আমি যাতে বিয়েটা ভেঙে দেই সেদিন আমার এই শখ গুলোকে মাটিচাপা দিয়েছিলাম আমি। নিজের মনকে বুঝিয়েছি তুমি রুজবা আমার জন্য না। তোমার সাথে এই শখগুলো আমার কোনকালেই পূরণ হবে না৷ কিন্তু তবুও আমি চাইতাম, মনে প্রানে চাইতাম যাতে কোনো একটা মিরাক্কেল হয়, আর তোমাকে পাওয়ার একটা সুযোগ যাতে আমার আল্লাহ আমাকে মিলিয়ে দেয়। দেখো আল্লাহ সে সুযোগ’টা দিয়েছে আমাকে। আমি পেয়েছি তোমাকে।”

জারাফের কথা বলতেই রুজবার মন আবার খারাপ হয়ে যায়৷ চাপা কষ্ট অনুভব করে বুকের বা পাশে। নুহাশ ছোট একটা শ্বাস ফেলে বললো,
–“আমি তোমাকে শুরু থেকেই হালাল ভাবে চেয়েছি, তাই হয়তো আমার চাওয়াটা’কেই আল্লাহ প্রাধান্য দিয়েছে। তোমাকে আমার করে দিয়েছে।”

কথাটা সত্যি, নুহাশ বরাবরই রুজবাকে হালাল ভাবে চেয়েছে। কখনো প্রেমের প্রস্তাব নিয়ে সামনে দাঁড়ায়নি। সরাসরি দুই পরিবারে জানিয়ে বিয়ের প্রস্তাব নিয়েই ওর সামনে দাঁড়িয়েছে তা’ও দুই দুইবার। নুহাশ রুজবার দিকে ঘুরে বললো,
–“যদিও’বা এনগেজমেন্ট হয়ে গেছে আমাদের, বিয়ের দিনক্ষণ’ও পাকা হয়েছে। এখনো বিয়েটা হয়নি। আবারো তোমার মতামত জানতে চাইছি আমি। আমি অতটা সিনেম্যাটিক নয়। হিরোদের মতো হাটু গেড়ে ভালোবাসি বলতে পারবো না। কিয়ানের মতে তো আমি গম্ভীর আনরোমান্টিক কাটখোট্টা পুরুষ মানুষ। যে কিনা তেঁতো তেঁতো কথা বলে। আমার ওসব প্রপোজ ট্রপোজের অভিজ্ঞতা নেই। আমি আমার মতো করে বলছি, ❝তুমি কি আমার বউ হবে?❞

কথাটা বলে নুহাশ সরাসরি রুজবার চোখের দিকে তাকায়৷ নুহাশের ওরকম দৃষ্টিতে এলোমেলো হয়ে যায় রুজবা। মাথা নিচু করে ধীর কন্ঠে বলে,
–“রাজি না থাকলে আজ আপনি আর আমি এখানে থাকতাম না নুহাশ ভাই।”
রুজবার কথায় নুহাশ নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে নিঃশব্দে হাসলো। রুজবা ওর দিকে না তাকিয়েও বুঝতে পারলো লোকটা ঠিক হাসছে ওর পানে চেয়েই। নুহাশ বললো,

–“তোমার হাতটা একটু খানি ধরবো?”
রুজবার বুক কেঁপে উঠলো। কি বলবে ভেবে পেলো না। ধরতে বলবে? নাকি বলবে না? নুহাশ আবারো বললো,
–“আচ্ছা সমস্যা নেই, একেবারে বিয়ের পরেই___”
–“ধ্ ধরুন।”

নুহাশ এবারে’ও হাসলো। নিঃশব্দে, ঠোঁট কামড়ে ধরে। রুজবার দুই হাত’ই রেলিং ধরে আছে। নুহাশ রুজবার হাতের দিকে তাকালো কিছু সময়। অতঃপর ক্ষানিকটা সময় নিয়ে নুহাশ রুজবার হাতের উপর হাত রাখলো। নুহাশের স্পর্শ পেয়ে রুজবা আরো জোরে রেলিং আঁকড়ে ধরে। নুহাশ আলতো অথচ গভীর ভাবে ধরে রুজবার হাত৷ রুজবার শরীর আবারো মৃদু কেঁপে উঠে। নুহাশ নিঃশব্দে হাসে, প্রশান্তির হাসি এটা৷

অনেক সাধনার পরে পর্ব ২০

–“তুমি আমার শখ না রুজবা, তুমি আমার সবকিছু।”
কথাটা শুনে রুজবা তড়িৎ গতিতে তাকায় নুহাশের দিকে। নুহাশ আগে থেকেই ওর দিকে তাকিয়ে ছিলো। তা দেখে রুজবা লজ্জা পেয়ে দ্রুত চোখ সরিয়ে নেয়। দৃষ্টি রাখে সামনের রাস্তায়। আর তখনই দেখতে পেলো জারাফকে। ও ক্ষানিকটা সময় রুজবা আর নুহাশের হাতের দিকে তাকিয়ে থেকে রাগে গজগজ করতে করতে প্রস্থান করে।

অনেক সাধনার পরে পর্ব ২১