অনেক সাধনার পরে পর্ব ২১

অনেক সাধনার পরে পর্ব ২১
অরনিশা সাথী

মাঝে গত হয়েছে দুটো দিন। এ দুদিনে জারাফ বেশ কয়েকবার ফোন করেছে রুজবাকে, ও ফোন তুলে নি। শেষে বাধ্য হয়েছে নম্বর ব্লক করতে। সে মূহুর্তে যে ওর কতটা কষ্ট হয়েছে, সেটা শুধুমাত্র রুজবা ছাড়া কেউ জানে না। ভিতর’টা ঝলসে গেছে। এই ক্ষত যে কাউকে দেখানোর মতো না। এই কষ্ট যে কাউকে বলার মতো না। জারাফের কথা ভাবা’ও যে এখন পাপ। তপ্ত শ্বাস ফেলে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ায় ও। গায়ে উড়না জড়িয়ে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।

আজ সোমবার, বিয়ের মাত্র আর তিনদিন সময় আছে মাঝে। এখনই ওদের পুরো বাসা সুন্দর করে সাজানো হচ্ছে। রুজবার কাজিন’রা সব আবদার করেছে বৃহস্পতিবার যেন হলুদের আয়োজন করা হয়। সবার আবদার ফেলতে পারেনি রায়হান সাহেব। বাসার সামনে ফাঁকা জায়গায় ছোট করে স্টেজ করেছে ছেলে-মেয়েদের আনন্দ আয়োজনের জন্য। রুজবার অবশ্য এসবে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

রায়হান সাহেব বেশ কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছে নিজের বিয়ে নিয়ে ওর কোনো ইচ্ছে নাকি? ও নাকোচ করেছে। ইচ্ছে, স্বপ্ন সবই তো ছিলো দু’চোখ ভরা। তবে সেটা নুহাশকে নিয়ে নয়। জারাফ’কে নিয়ে ছিলো। সেই মানুষটা’ই যখন ওর রইলো না তখন সেসব ইচ্ছে স্বপ্ন দিয়ে আর কি হবে?

রায়হান সাহেব খুব বড় করেই আকদের অনুষ্ঠানের আয়োজন করছে। তার চেনাজানা সকল অতিথি এবং গ্রামের মানুষদের’ও দাওয়াত করা হয়েছে৷ বেশ বড়সড় ভাবেই আয়োজন করা হয়েছে, কোনো অংশে বিয়ের অনুষ্ঠানের থেকে কম না। এ বাড়ির বড় মেয়ের বিয়ে বলে কথা। আয়োজন না করলে কি হয়? ইচ্ছে আছে মেয়ে তুলে দেওয়ার সময় এর থেকেও তিন গুণ বেশি আয়োজন করবেন তিনি।

অলস ভঙ্গিতে বারান্দায় চেয়ারে পা তুলে বসে আছে রুজবা। দৃষ্টি সামনের রাস্তায়। সন্ধ্যা নেমেছে ধরনীর বুকে। পাখিরা যার যার নীড়ে ফিরে যাচ্ছে। মাঝে মধ্যে মৃদু বাতাস এসে ওর গাঁ ছুঁয়ে যাচ্ছে ওর। দুপুরের পর থেকেই বৃষ্টি নেমেছে ভীষণ। তাই এখন অল্প বাতাসে’ও ঠান্ডা লাগছে রুজবার৷ গায়ের উড়না’টা ভালো করে চাদরের মতো গায়ে পেচিয়ে বসে এফবি তে লগইন করলো।

তখনই দুই কাপ চা নিয়ে হাজির হয় রুপশা। বোনের পাশের খালি চেয়ারে বসে এক কাপ চা এগিয়ে দেয় বোনের দিকে। রুজবা একগাল হেসে চা নিয়ে নেয়। এই মূহুর্তে ওর চা’য়ের ভীষণ প্রয়োজন ছিলো৷ চা খেলে অন্তত শরীর’টা একটু গরম হবে। চা খেতে খেতে দুই বোন গল্পের ঝুলি খুলে বসেছে যেন।

কাপের চা শেষ কিন্তু দুই বোনের আড্ডা শেষ হচ্ছে না। মায়ের ডাকে দুজনেই বারান্দা থেকে ভিতরে চলে যায়। চিকেন রোল বানিয়েছে শারমিন বেগম। প্রতিদিন সন্ধ্যায় ওদের তিন ভাই বোনের কিছু না কিছু ভাজাপোড়া চাই। শারমিন বেগম’ও ছেলে মেয়েদের জন্য আনন্দের সহিত সন্ধ্যায় নাস্তা বানান। মাঝে মধ্যে রায়হান সাহেব বাজার থেকে নিয়ে আসেন।
রুপশা খেতে খেতে টিভিতে কার্টুন দেখছে। রুজবা’র নজর’ও টিভিতে। রাফাত ফোন ঘাটছে। রায়হান সাহেব রুজবাকে বললো,

–“কাল পরশু থেকেই তো বাড়িতে কাছের সকল মেহমান আসতে শুরু করবে। তুমি কাল গিয়ে কেনাকাটা করে নিয়ে এসো।”
রুজবা কিছু বলার আগেই রুপশা উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বললো,
–“আমিও যাবো আব্বু।”

রায়হান সাহেব মৃদু হেসে সম্মতি জানালো। সাথে রাফাতকে’ও যেতে বললে রাফাত বলে,
–“ডেকোরেশন তো হয়নি এখনো বাড়ির। এদিকে একজন থাকতে হবে। তুমি কত দিক সামলাবে একসাথে? আমি ফাঁক মতো গিয়ে কেনাকাটা করে নিবো সমস্যা নেই।”
রায়হান সাহেব হাসলেন। উনার ইন্টার পড়ুয়া ছেলের এই কথা শুনে রায়হান সাহেবের সারা চোখমুখে প্রশান্তির ছাঁয়া দেখা গেলো। উনার ছেলে এখনই উনার পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, বাবার উপর যাতে চাপ কম পড়ে।

রুজবা এখন প্রায়শই রান্নাঘরে টুকটাক কাজ করে। জারাফের সাথে সম্পর্ক বিচ্ছেদের পর থেকেই নিজেকে ব্যস্ত রাখার জন্য মাঝে মধ্যে রান্না করে। আজও রান্না করতে এসেছে, রাতের জন্য। শারমিন বেগম আগে থেকেই পেয়াজ মরিচ কেটে রেখেছিলেন। সাথে গরুর কলিজা সেদ্ধ করে পানি ঝড়িয়ে রেখে দিয়েছেন।

রুজবা এসে এখন শুধু মশলা কষিয়ে রান্না করলেই হবে। রান্না প্রায় শেষের দিকে৷ তীব্র শব্দে আওয়াজ তুলে রুজবার ফোন বেজে উঠে। রুজবা গ্যাসের আঁচ কমিয়ে রেখে নিজের ঘরের দিকে ছুট লাগায়৷ বিছানার উপর থেকে ফোন তুলে দেখলো স্ক্রিনে ইংলিশ ফ্রন্টে ‘নুহাশ’ নামটা জ্বলজ্বল করছে। সেদিন যাওয়ার সময় নুহাশ রুজবার নাম্বার নিয়ে গিয়েছিলো৷ সাথে ওর নাম্বার’টাও সেইভ করে দিয়ে গিয়েছিলো রুজবার ফোনে।

রিসিভ করার আগেই ফোন কেটে যায়৷ রুজবা ফোন করতেই ওপাশ থেকে কেটে দিয়ে নিজে ব্যাক করলো৷ এ দুদিনে রুজবা লক্ষ করেছে, নুহাশ ফোন দিলে রুজবা ধরতে না পেরে যদি এপাশ থেকে ব্যাক করে তাহলে নুহাশ কখনোই ফোন রিসিভ করে না। কেটে দিয়ে নিজে ব্যাক করে। আজ’ও তাই হলো। রুজবা ফোন রিসিভ করেই সালাম দিলো। নুহাশ সালামের জবাব দিয়ে বললো,

–“ব্যস্ত ছিলে?”
–“একটু।”
–“আচ্ছা তাহলে ফ্রি হলে মিসডকল দিও।”
–“সমস্যা নেই, বলুন কি বলবেন।”
–“তোমার বলার কিছু নেই?”
রুজবা নিরুত্তর। ও কি বলবে ও নিজেও জানে না সেটা। নুহাশ নিজেই বললো,

–“কাল ভাবীরা বিয়ের কেনাকাটা করতে যাচ্ছে। ভাবী চায় তুমিও তাদের সাথে যাও, নিজের পছন্দমতো সব কেনাকাটা করো।”
–“আ্ আমি?”
–“কেন কোনো সমস্যা?”
–“না মানে___ভাবীর পছন্দ মতো’ই নিয়ে আসতে বলুন।”
নুহাশ কিছু বলার আগেই পাশ থেকে আদিরা ফোন টেনে নিলো। প্রথমে ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করে বললো,

–“আমি কোনো কথা শুনতে চাই না রুজবা। আমাদের সাথে তুমিও যাবে এটাই ফাইনাল।”
–“কিন্তু ভাবী___”
–“কোনো কিন্তু শুনছি না। আমি মা‘কে দিয়ে আন্টিকে ফোন করাচ্ছি। তুমি ততক্ষণে আমার দেবরের সাথে প্রেম করো।”
রুজবাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই আদিরা নুহাশের হাতে ফোন দিয়ে শাহানা বেগমকে ডাকতে ডাকতে প্রস্থান করলো। নুহাশ বললো,

–“এবার আর কোনো সমস্যা নেই তো?”
রুজবা ছোট করে জবাব দেয়,
–“উঁহু।”
এরপর দুজনের নিরব। নিরবতা ভেঙে রুজবা বললো,
–“আপনি’ও যাবেন কাল?”
–“তুমি চাও আমি যাই?”
রুজবা কি বলবে ভেবে পেলো না। নুহাশ যে এই প্রশ্ন করে বসবে রুজবা ভাবেনি। তাহলে হয়তো প্রশ্ন’টা করতো না আর। রুজবা’কে নিরব দেখে নুহাশ নিঃশব্দে হাসলো। বললো,

–“কি হলো বলো? আমি গেলে খুশি হবে তুমি?”
–“জ্ জানি না।”
নুহাশ আবারো প্রশ্ন করলো,
–“আসবো?”
রুজবা অন্যমনস্ক থাকায় নুহাশের কথা ভালোভাবে খেয়াল না করেই বললো,
–“হু__”
নুহাশ হাসলো। চমৎকার হাসি যাকে বলে। ও নিজেও বুঝেছে রুজবা অন্যমনস্ক ভাবেই কথাটা বলেছে। তবুও রুজবাকে লজ্জা দিতে বললো,

–“আচ্ছা, আমার ব___মানে তুমি যখন বলেছো তাহলে আমি তো অবশ্যই যাবো।”
রুজবা হাঁসফাঁস করে উঠলো লজ্জায়। আমার ব___এইটুকু বলে নুহাশ থেমে যায়। কিন্তু রুজবা স্পষ্ট বুঝতে পারে নুহাশ কি বলতে চেয়েছিলো। আমার বউ? কথাটা মনে মনে একবার আওড়ালো। নুহাশের বউ? ভাবতেই লজ্জায় আড়ষ্ট হয় রুজবা। দ্রুত কন্ঠে বললো,

–“রাখছি।”
নুহাশ’কে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই রুজবা খট করে লাইন কেটে দেয়। বুকে হাত দিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নেয় কয়েকটা। বুক’টা ঢিপঢিপ করছে এখনো। ফোন কান থেকে নামিয়ে ঠোঁট কামড়ে হাসে নুহাশ। মেয়েটা আসলেই পাগল৷ ফোন চার্জে লাগিয়ে ড্রয়িংরুমের দিকে পা বাড়ায় ও।

শাহানা বেগম যেহেতু রায়হান সাহেবের থেকে অনুমতি নিয়েছে তাই রুজবা আজ নুহাশ’দের সাথে যাবে শপিংয়ে। কাল রুপশা’কে নিয়ে দুই বোন আবার যাবে নিজেদের মতো কেনাকাটা করতে। আজ তো আর নুহাশ’দের সাথে থেকে নিজেদের গুলো কেনাকাটা করা যায় না। নুহাশ রুপশা আর রাফাতকে নিয়ে যেতে বলেছিলো সাথে।

রাফাত যাবে না। আর রুপশা যেহেতু কাল শপিংয়ে যাবে আবার পরশু হলুদের আয়োজন করা হবে সেই হিসেবে দুদিন স্কুল কামাই যাবে নুহাশ এ বাড়ি আসলে তখনো স্কুল বন্ধ যেতে পারে তাই আজ আর স্কুল কামাই দিবে না। সুতরাং রুজবা একা’ই যাবে নুহাশ ওদের সাথে।

সাড়ে নয়টা নাগাদ রেডি হয়ে বসে আছে রুজবা। নুহাশ একা বের হতে বারণ করে দিয়েছে। জানিয়েছে ও এসে নিয়ে যাবে। তাই বাধ্য মেয়ের মতো রেডি হয়ে বসে আছে ও। মিনিট দুই গড়াতেই রুজবার ফোন বাজে। নুহাশ ফোন করেছে। রুজবা রিসিভ করে বাড়িতে আসতে বললো। নুহাশ মৃদু হেসে বললো,

–“দুদিন বাদে তো আসবোই, তখন তাড়িয়ে দিলেও বউ রেখে যাবো না। তাই আজ আর না আসি।”
রুজবা’র গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলো। নুহাশ মৃদু হেসে বললো,
–“লজ্জা পাওয়ার অনেক সময় পাবে, এখন তাড়াতাড়ি এসো।”

রুজবা সম্মতি জানিয়ে ফোন রেখে দেয়। রান্নাঘরে গিয়ে শারমিন বেগমকে গিয়ে নুহাশের কথা বলতেই উনি বের হয় বাসায় থেকে৷ শারমিন বেগমকে দেখে নুহাশ বাইক থেকে নেমে সালাম দেয়। শারমিন বেগম সালামের জবাব নিয়ে ভালোমন্দ সবার কথা জিজ্ঞেস করে বললো,

–“বাসায় এসো, বাড়ির কাছ অব্দি এসে চলে গেলে খারাপ দেখায় না?”
–“আজ না আন্টি, অন্যসময় আসবো।”
শারমিন বেগম জোর করলেন বেশ কয়েকবার। নুহাশ রাজি হলো না। বললো রুজবাকে ডেকে দিতে। শারমিন বেগম সম্মতি জানিয়ে ভিতরে যায়।
গুটিগুটি পায়ে রুজবা নুহাশের সামনে এসে দাঁড়ায়। নুহাশ’কে বাইক নিয়ে আসতে দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেললো। ধীর গলায় বললো,

–“বাইক কেন? বাকী সবার সাথে যাবো না?”
–“সবাই এতক্ষণে মার্কেটে পৌঁছে গেছে ম্যাডাম। আপনাকে নেওয়ার জন্য আমাকেই পাঠালো যে।”
রুজবা’র গাঁ কাঁপছে। নুহাশের সাথে বাইকে করে যাবে ভাবতেই ওর ভেতর’টা কেমন জানি করে উঠলো। নুহাশ বললো,
–“দাঁড়িয়ে আছো যে? এর আগেও তো একবার আমার বাইকে উঠেছিলে।”
–“কিন্তু তখন তো আপনি নুহাশ ভাই ছিলেন এখন তো___”

রুজবার বিড়বিড়িয়ে বলা কথাগুলো নুহাশ শুনতে পেয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে মৃদু হাসে। অতঃপর রুজবাকে সম্পূর্ণ কথা শেষ করতে না দিয়েই বাঁকা হেসে বললো,
–“এখন কি জামাই? উমম স্যরি, জামাই তো এখনো হইনি, হবু জামাই রাইট?”

রুজবা আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে লজ্জায়। লোকটা তো আগে এমন ছিলো না। এমন কি ওর সাথে তেমন ভাবে কথা’ও বলতো না। আর এখন? যেই এনগেজমেন্ট হলো, বিয়ের দিন তারিখ ঠিক হলো ওমনি ভোল পাল্টে ফেললো? কি সব কথা বলে শুধু লজ্জা দেয়। নুহাশ রুজবার কাচুমাচু অবস্থা দেখে এবার ক্ষানিকটা শব্দ করে হাসে। তাতে রুজবা’র লজ্জা আরো বেড়ে যায়। নুহাশ বললো,

–“বাইকে উঠো, আমরা এমনিতেই লেট রুজবা।”
রুজবা ইতস্তত করে উঠে বসে বাইকে। নুহাশকে ধরবে কি ধরবে না দ্বিধায় পড়ে যায়। নুহাশ নিজেই বললো,
–“ধরে বসো।”
রুজবা কাঁপা কাঁপা হাতে নুহাশে’র কাঁধ স্পর্শ করতেই নুহাশ বললো,

অনেক সাধনার পরে পর্ব ২০

–“শক্ত করে ধরো।”
রুজবা বাধ্য মেয়ের মতো তাই করলো। নুহাশ লুকিং গ্লাসে রুজবার মুখশ্রী দেখে আগের ন্যায় ঠোঁট কামড়ে ধরে নিঃশব্দে হাসে। তারপর বাইক চালিয়ে চলে যায় নিজেদের গন্তব্যের দিকে।

অনেক সাধনার পরে পর্ব ২২