আসক্তি পর্ব ১৩

আসক্তি পর্ব ১৩
লেখায়ঃআফিয়া আজাদ নিঝুম

“এভাবে কতোক্ষন থাকবে মানুষটা। উফফ,ছাড়ে না কেন বদ লোক একটা।দম আটকে আসছে তো রে ভাই,ছাড় না এবার। খবিশ, খচ্চোর,বদমাইশ, বদ রাগি,কচু সার্জন “-এমন হাজার টা গালি মনে মনে আওরাতে থাকে পাখি।এদিকে বেহিসেবি সময়ের পর শান চোখ মেলে পাখির দিকে একবার চেয়ে আবার নিজের কাজে মন দেয়।

একটু পর পাখির অস্বস্তি কেটে যায়,হাত পা ছোড়াছুড়ি থেমে যায়।অজানা আবেশে চোখ বুজে ফেলে।
শান পাখির হঠাৎ থেমে যাওয়ায় শঙ্কিত মনে নিজের কাজ ছেড়ে মুখের দিকে চায়।, “শিটটট কি করে পারলাম ।না নিজেকে আরেকটু কন্ট্রোল করতে হবে!। ওর কি সেন্স আছে নাকি সেন্সলেস হলো মেয়েটা”
“পাখি পাখি, অপেন ইওর আইস ”
পাখির দুগালে হালকা হাতে ঝাকি দিতেই ধীরেধীরে পাখি চোখ খুলে অজানা চাহনীতে একদৃষ্টে চেয়ে রয় শানের দিকে।
“তুমি ঠিকাছো পাখি?”
…….(পাখি নিশ্চুপ)

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“এরপর আমায় না জানিয়ে কোথাও গেলে এর থেকেও বড় শাস্তি পাবে। ওকে ফ্রেশ হয়ে নাও।আর আমায় কিছু খেতে দাও।কখন থেকে তোমার জন্যে বসে আছি। ক্ষিদে লেগেছে তো নাকি”-বলেই পাখির থেকে একটু দূরে সরে আসতে নিতেই পাখি পিছন থেকে শার্টের কলার চেপে ধরে।শান থমকে যায়।পাখির দিকে মুখ করে ভ্রু নাচিয়ে কারণ জানতে চায়। পাখি কিছু না বলে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রয়।
এদিকে এই প্রথম পাখির মাঝে কাঙ্খিত সেই অনূভূতিগুলোর দেখা পেয়ে শান স্তম্ভিত।
“কি হলো পাখি, ককিছছু বলবে?”-কন্ঠনালি কাঁপছে শানের।

…..(পাখি তবু নিশ্চুপ)
“খুব খারাপ লেগেছে”
মাথা দু দিকে নাড়িয়ে “না”সূচক অর্থ বোঝায়।
“তারমানে ভালো লেগেছে!?”-বিষ্ময় নিয়ে বলে শান।
“হুহহ,না না না না”
“হাহাহা…ওহহহ পাখি ধরা পরে গেলে আজ”
পাখি শানের কথায় ভীষণ লজ্জা পেয়ে সংকোচ নিয়ে এদিক সেদিক তাকাতে থাকে।দুই গালে লজ্জা রেখা স্পষ্ট আজ।

দুই হাতে পাখির মুখটা তুলে ধরে।পাখিও একবার শানের দিকে চোখ তুলে তাকাতেই চোখাচোখি হয়ে যায়।আর তরিৎ গতিতে শান আবারও পাখির ওষ্ঠদ্বয় নিজের করে নেয়।এবার আর পাখির মাঝে কোন অস্বস্তি খুঁজে পায় নি শান।যা পেয়েছে তা হলো লজ্জা।

কতোক্ষন পার হলো দুজনার কারোরই সেদিকে খেয়াল নেই।দরজায় কারো কড়া নাড়ার কঠিন আওয়াজে দুজনেই সম্বিৎ ফিরে দুদিকে সরে যায়।পাখি দ্রুত দরজা খুলে জেনিকে দেখতে পায়।লজ্জা যেন আজ তরতরিয়ে বেড়ে চলছে।শানের মনে নতুন অনুভূতির পরশ খেলে যায়।কিছুক্ষন আগেকার সময়টা কে বেঁধে ফেলতে মন চাচ্ছে তার।

তারপর পাখি আর শানের সামনেও আসে নি।ডায়নিং টেবিলে খেতে খেতে দুবার চোখাচোখি হয়ে যায়।পাখি স্বলজ্জে চোখ নামিয়ে নেয়।রাতে ঘুমানোর সময় খাটের এক কোণায় জড়সড়ভাবে ঘুমিয়ে পরে পাখি।কোন কথাই বলতে পারছে না সে। শান সেদিকে আড়চোখে কয়েকবার দেখে হেসে ফেলে।
এদিকে নিজের মাঝে আজ অন্য পাখিকে খুঁজে পায় পাখি।নিজের অবয়বকে আর বিশ্বাস হচ্ছে না যে এটা তার অবয়ব।অন্য রকম অনুভূতি হচ্ছে তার।

সকাল সকাল জরুরী মিটিং থাকায় শান দ্রুত মেডিকেলে চলে আসে।সারাদিন অনেক ব্যস্ততার মাঝেও পাখির লজ্জারাঙ্গা মুখটা শানের মন ভুলতে পারে নি।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যার আভা ছড়াচ্ছে চারদিকে। পাখিরা সবাই বসে গল্প করছে।সবার মাঝেও পাখির মনে শানের কালকের স্মৃতি গুলো চলে আসছে নিজের অজান্তেই মুচকি হেসে উঠছে মেয়েটা।
“কি রে এতো ব্লাশিং কেন হুমম”-জেনির কথায় সবাই পাখির দিকে ফেরে।
“কই কিছু না তো, কোথায়”-বলতে বলতে গালে হাত দিয়ে লজ্জার রেখা লুকানোর চেষ্টা করে।
কিন্তু ব্যর্থ হয় সে। সবাই জেকে ধরে ওকে।এক প্রকার বাধ্য হয়ে দৌড়ে গিয়ে নিজের রুমে গিয়ে দরজা লাগায়।

ধীরেধীরে রাত বেড়ে চলেছে। আজ পাখি একা ঘুমিয়েছে।জেনির বর এসেছে তাকে নিতে। তাই তাদেরকে আলাদা ঘরে থাকতে দেয়া হয়েছে।ডিনার সেড়ে যে যার ঘরে চলে যায়।পাখির কেমন যেন খুব দূঃচিন্তা হচ্ছে।
“মানুষটা কি আজ আসবে?নাকি ও বাড়িতে থাকবে?একটা ফোন করব?যাহহ কি ভাববে তখন।”-হরেক রকম চিন্তা ভাবনা করে শেষমেশ কল দেয় শানকে।
কিন্তু ফোন কেটে দেয় শান।পাখির খুবই খারাপ লাগলো ব্যপার টা।কেমন যেন অভিমান জমে গেলো শানের ব্যবহার টা।

“ব্যস্ত থাকলে কেটে দেবে কেন, বললেই তো হয় আমি ব্যস্ত পরে কথা বলি”
একরাশ অভিমান নিয়ে ঘুমাতে যায় পাখি।
ফোনের কড়া টোনে ঘুম ভাঙ্গে পাখির।প্রচুর বিরক্ত সে এখন।এই ডক্টরের পাল্লায় পরে জীবন শেষ তার।তিনিই জেনারেলে রাখতে বলেছে ফোন। একবার কল কেটে যায়।পাখি আবারও আগের মতো ঘুমায়।
আবারও ঘ্যানঘ্যান করে ফোন টা।
রিসিভ হতেই বিরক্ত ভরা কন্ঠে পাখি জবাব দেয়

“কেন এমন করছেন? ঘুমাবো না আমি? ”
“গেইট খুলে দাও তারাতারি গাধি”
চমকে চোখ বড় বড় করে তাকায় ফোনের দিকে।রাত তখন ২ বেজে ১৫ এর ঘরে।এতো রাতে উনি!
এদিকে শান হ্যালো হ্যালো বলেই চলেছে।পাখি কল কেটে বেলকোনিতে গিয়ে দেখে সত্যিই গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে।দ্রুত নিচে গিয়ে গেইট খুলে দেয়।শান গাড়িটা পার্ক করে রেখে নিঃশব্দে ড্রয়েং রুমে এসে সোফায় বসে পরে।দেখেই বুঝা যাচ্ছে অনেক ক্লান্ত সে।

“আপনি? এতো রাতে? এখানে কেন?”
শান দাঁত মুখ চেপে রাখে কোন কথা না বলে রাগ সংবরনের চেষ্টা করে। শানের মুখ দেখে পাখি খানিকটা ঢোক গিলে আবার গড়গড় করে বলতে থাকে,”না মানে আসলে তো সন্ধ্যেবেলায়ই আসতেন তাই আর কি!?”

পাখির বোকামি মার্কা কথায় শানের রাগ যেন ধরে না আর।
“আমি একটা প্রফেশনে থাকি, ব্যস্ত থাকতেই হয়।সন্ধ্যেবেলা ব্যস্ত ছিলাম। তাই…
এই লিসেন, তুমি কাবার্ড ফাঁকা করে চলে এসছো কেন?সংসার করার ইচ্ছে নাই?যদি সেরকম টা হয় শোন পাখি, তোমায় কেটে পিচ পিচ করে ব্রহ্মপুত্রে ভাসিয়ে দিবো, মগজে ঢুকাও”চিবিয়ে চিবিয়ে কথাগুলো বলে।
থমথমে মুখে পাখি জবাব দেয়, “আমি সন্ধ্যায় ফোন দিছিলাম একবার রিসিভ হয় নি।আর আমি কখন বলেছি সংসার করব না!এখানে কি পরব তাই নিয়ে এসছি সবকিছু”

শানের রাগ যেন উবে যায়।পাখির মুখে স্পষ্ট অভিমানের ছাপ দেখা যাচ্ছে।উঠে গিয়ে পাশে দাঁড়াতেই পাখির গত রাতের কথা মাথায় আসে, একটু সরে দাঁড়ায়।
“এতো লজ্জা পেতে হবে না,আমি এতোটাও অভদ্র নই যে যখন তখন শুরু হয়ে যাবো।তবে তুমি যদি চাও আমি সবসময়ই রেডি “-বলতে বলতেই বাঁকা হেসে পাখির আরো কাছে যায়।
“ভাবি!”

শান ফিরে দেখে কেউ নেই, তারমানে পাখি তাকে বোকা বানালো!
সামনে তাকিয়ে দেখে পাখি কোথাও নেই।
চারিদিকে চোখ বুলিয়ে চাপা স্বরে ডাক দেয়,”পাখি,পাখি খুব ক্ষিদে লেগেছে খাইতে দাও”
পাখি ততোক্ষনে রান্না ঘরে এসে লজ্জা লুকাতে ব্যস্ত।
“ঠোঁট কাটা লোক।একটুও লজ্জা নেই।”
“পাখি!”-একটু রাগ দেখিয়ে বলে শান।
পাখি চমকে উঠে সেদিকে তাকায়।এরপর লম্বা লম্বা পা ফেলে ফ্রিজ থেকে খাবার গরম করে । প্লেট ভর্তি করে খাবার এনে শানের সামনে ডায়নিং এ রাখে।

“পাখি ”
“হুমম”
“একটা লঙ্গি নিয়ে আসো ড্রেস চেঞ্জ করব আমি।ট্রাউজারও নাই এ বাড়িতে।”
“লিসেন একটা অতিরিক্ত আওয়াজও করবা না। আর কেউ যদি সকালে জিজ্ঞেসা করে আমার কথা তাহলে বলবা আমি সন্ধ্যায় এসেছি”
পাখি ঘার বাঁকিয়ে জবাব দেয়।

এরপর বাবার ঘর থেকে একটা লুঙ্গি এনে শানকে দেয়।শান লুঙ্গিতে অভ্যস্থ না।তার কাছে নাকি খুলে যায়।
পরদিন সকাল বেলা পাখি ফজরের জন্যে ঘুম ভেঙ্গে যায় ।নিজেকে বন্দি মনে হয় তার। মনে হয় কেউ আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে তাকে।পিটপিট করে চোখ খুলে দেখে সত্যিই শান ওকে জড়িয়ে রেখেছে।ছাড়াতে চাইছে কিন্তু পারছে না এদিকে পাখির নিজেরও বেশ ভালো লাগছে শানের বুকের সাথা শুয়ে থাকতে। কিন্তু নামাজের সময় চলে যাচ্ছে।তাই একপ্রকার জোড় করে উঠতে গিয়েই ঘুম ভেঙ্গে যায় শানের।বিরক্ত সুচক শব্দে মাথা তুলে তাকায় সে।

পাখি বিছানা ছেড়ে উঠে যাওয়ার সময় চোখে পরে শানের পরনে লুঙ্গি নেই।চোখ বড় বড় হয়ে যায় পাখির।শান ওর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিজের দিক দেখে হা হয়ে যায়।পাখির হাবভাবে মনে হচ্ছে বড় কোন কেলেঙ্কারি করবে সে।তাই শান দ্রুত বিছানা ছেড়ে পাখির মুখ চেপ ধরে।লজ্জায় যেন মরে যেতে মন চাচ্ছে আজ পাখির।দুজন দুজনের চোখের দিক চেয়ে দেখছে।লজ্জায় চোখ নামিয়ে ফেলে পাখি।
“চিল্লাবা না প্লিজ, আমি লুঙ্গি সামলাতে পারি না “-শেষের কথাটা অপারগ মুখ বলে দেয় শান।

সকাল নয়টার দিকে মেয়ে জামাইকে ডায়নিং এ দেখে বেশ অবাক হয় সবাই।
“জামাই তুমি কখন এসেছো?”
“এইতো সন্ধ্যার….
“বাবা উনি তো রাত দুইটার পরে এসছে।কি নাকি কাজ ছিলো! ”
সবাই হতভম্ব হয়ে যায়।ঠোঁট টিপে হাসছে সবাই।আর শান অগ্নি দৃষ্টিতে চেয়ে আছে পাখির দিকে।পাখি জেনেই এমনটা করে।নিজের ভুলে পরোক্ষনেই জিহ্ব কাটার ভাব ধরে সে।শান খেপাতে ইদানিং বেশ মজা পায় ও।

টেবিলে কেউ আর কোন কথা বলে নি।শান আজ আবারও শ্বশুরবাড়ি থেকেই মেডিকেলে চলে আসে।
আজ জেনিরা চলে যাবে এ জন্যে পাখির বেশ মন খারাপ। সকাল গড়াতে না গড়াতেই ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়।পাখির বৃষ্টি খুব পছন্দ।মুশলধারায় বৃষ্টিতে তার ভিজতে ইচ্ছে করছে। তাই তো সবার অগোচরেই পা টিপে টিপে ছাদে চলে আসে।মনের মতো ভিজেছে আজ পাখি।রুমে এসে দ্রুত ড্রেস চেঞ্জ করে নয়।
সন্ধ্যার কিছু আগে জেনি রা চলে যায়।

আসক্তি পর্ব ১২

কেমন যেন একলা লাগে আগের মতো।সময়গুলো আর কাটতেই চাইছে না।শরীর টা কেমন যেন করছে।নিজের ঘরের বেলকোনিতে দাড়িয়ে আকাশ দেখছে আনমনে।কিন্তু কেমন যেন ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে শরীর টা। ডিনার না করেই বিছানায় পাতলা চাদর টা গায়ে টেনে শুয়ে পরে।
শান চলে এসে পাখিকে খোঁজে কিন্তু পায় না।ঘরে গিয়ে চোখ পরে বিছানার উপর।সাথে গোঙ্গানির অস্পষ্ট আওয়াজ। শান ফ্রেশ হয়ে এসে পাখির গায়ে হাত রাখে।সাথে সাথেই হাত সরিয়ে নেয় শান

“জ্বরে তো গা পুরে যাচ্ছে।”
দ্রুত চেইক করে বুঝতে পারে ১০৪ ডিগ্রী জ্বরে পাখির গা পুরছে।মেডিকেলে ইমারজেন্সি রুম বুক করে পাখিকে আস্তে আস্তে ডাক দেয় শান।পিটপিট করে চোখ খোলে পাখি। কিন্তু চোখ খুলে রাখার ক্ষমতা ওর হচ্ছে না।
“পাখি চোখ খোল।খুলে রাখো।”-বলেই হন্তদন্ত হয়ে নিজের ড্রেস পরে নিচ্ছে শান।এরপর পাখির পাশে এসে বসে মাথায় রেখে জানতে চায়
“এতো জ্বর কেমনে আসল তোমার?হাউ? ”

পাখি কোন জবাব দেয় না।ডান হাত আস্তে করে উঁচিয়ে শানের বাম গালে হাত রাখে।খোঁচা খোঁচা দাড়িগুলো হাতে লাগছে ওর।শান পরম যত্নে পাখির হাতটার দিকে চেয়ে এগিয়ে আসে পাখির মুখের কাছে।
পাখির মুখের গরম বাতাস আছড়ে পরছে শানের মুখে।সেদিকে খেয়াল হচ্ছে না তার।সে অপলক চোখে গভীর চাহনীতে চেয়ে আছে পাখির দিকে।মনে হচ্ছে পাখি তাকে গভীর ভাবে ডাকছে। শানের পুরো পৃথিবী থেমে যায়।পাখির অনেকটাই কাছে চলে আসে…….

আসক্তি পর্ব ১৪