আসক্তি পর্ব ২০

আসক্তি পর্ব ২০
লেখায়ঃআফিয়া আজাদ নিঝুম

“রনি আই নিড ইওর হেল্প।তোমার ভাইয়া, তোমার ভাই….এই মূহূর্তে সাহায্যের জন্যে কাউকে পেলাম না রনি।আমায় হেল্প করো প্লিজ।”-বলতে বলতেই কান্নায় ভেঙ্গে পরে পাখি।গা কেঁটে লবন দিলে যেমন যন্ত্রনা হয় সেরকম যন্ত্রনা হচ্ছে পাখির।

রনি ঘাবড়ে গিয়ে মনিটরের সামনে থেকে দৌড়ে এসে পাখির সামনে দাঁড়ায়।অবাক হয়ে যায় সে।যে ভাবি কখনোই তার সাথে অকারনে কথা বলে না, সামনে আসে না সে আজ তার রুমে!
“ভাবি, কি হয়েছে? ভাইয়ার কি হয়েছে?”-উদ্বিগ্ন কন্ঠে জানতে চায় রনি
“তোমার ভাইয়ার নাকি এক্সিডেন্ট করেছে, মেডিকেলে এডমিটেড রনি।আমায় নিয়ে চলো সেখানে”
(কিছুক্ষন আগে….)

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

নিজের ঘরটা মনের মতো গুছিয়ে নিয়ে পাখি ফোন টা হাতে নেয়।অনেক দিন হলো ফেসবুকে যাওয়া হয় না।ডাটা অন করে ফেসবুকে ঢুকতেই ‘রংপুর বার্তা'(কাল্পনিক নাম)ফেইসবুক পেইজে বড় বড় অক্ষরে লেখা হেডলাইনে পাখির চোখ আটকে যায়।

“গুরুতর দূর্ঘটনার স্বীকার রংপুরের স্বনামধন্য হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ফয়সাল আহমেদ শান।”
পাখির হাত থেকে ফোনটা নিচে পরে যায়।চারদিকে অন্ধকার আর অন্ধকার লাগে সবকিছু।সাহসে কুলাচ্ছে না পুরো নিউজ টা পড়ার।তবুও কাপা কাপা হাতে ফোনটা উঠিয়ে নিয়ে নিউজটার উপর ক্লিক করে।গলা শুকিয়ে আসছে পাখির।দম যেন বন্ধ হয়ে আসছে।ওয়াটার পটও ফাঁকা।শুকনো গলায় কয়েকবার ঢোক গিলে নিজেকে প্রস্তুত করে নিউজ পড়ার।

“কিছুক্ষন আগেই গুরুতর দূর্ঘটনার হোন রংপুর শহরের হার্ট সার্জন ডাক্তার ফয়সাল আহমেদ শান।খোঁজ নিয়ে যায় নিজস্ব গাড়িতে বাড়ি থেকে মেডিকেলে আসার সময় মালবাহী এক ট্রাকের ধাক্কায়…….”
পুরোটা পড়তে পারলো না পাখি।চোখ দুটো ঘোলাটে হয়ে গেলো।কোন ঘেঁষে পানি গড়িয়ে পড়লো দুফোটা।নিজেকে কোণমতে ধাতস্থ করে উঠে দাঁড়ালো।পা দুটা চলছে না তার।বড় বড় শ্বাস নিতে লাগল এবার।

টলমলে পায়ে মা মা বলে নিচে নেমে আসলো।হাজার ডাকার পরেও কাউকে পেলো না। বাড়ি পুরো ফাঁকা লাগছে।তার ভয় আরো মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো।
“তারমানে সবাই জানে তার এক্সিডেন্টের কথা আমি ছাড়া?না হলে সবাই কোথায় গেলো?”-ভাবতে ভাবতেই জিহ্বা দিয়ে শুকনো ঠোঁট দুটো ভিজিয়ে কাপা কাপা হাতে “হার্ট সার্জন”নামে সেভ করা নম্বরে ডায়াল করলো।নম্বর যে বন্ধই থাকবে তা অজানা নয়। তবুও কল করলো পাখি।ফলশ্রুতিতে ফোন বন্ধই পেলো।মাথার চুল দুহাতে মুঠো করে ধরে চিৎকার করে কেঁদে উঠে ড্রয়িং রুমের মেঝেতে বসে পড়ল পাখি।তার কলিজা ছিড়ে যাচ্ছে আজ।এই প্রথম কোন ছেলে মানুষের প্রতি অজানা এক তীব্র মায়া অনুভূত হলো তার।

“আপনার কিচ্ছু হবে না। আপনাকে অনেক কথা বলার আছে আমার সার্জন সাহেব।আমাকে এভাবে একা করবেন না। নিজেকে আপনার কাছে উজাড় করে দেওয়া বাকি আছে সার্জন সাহেব।আপনাকে অনেক বেশি ভালোবাসি হার্ট সার্জন।আমি কি করে আপনাকে ছেড়ে থাকব”-কাঁদতে কাঁততে হেচকি উঠে গেছে মেয়েটার।হঠাৎ খেয়াল হলো ঘর থেকে বের হবার সময় রনির ঘরের দরজা টা হালকা ভিড়ানো ছিলো।শানের খবরটা চোখে পড়ার পর হিতাহিত জ্ঞান ভুলে নিচে নেমেছে তাই তখন চোখে পড়ে নি।
পাখি নিজেকে সামলে নিয়ে রনির ঘরের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়।দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে পরে পাখি।রনি কানে হেডফোন গুজে মনিটরে কি যেন কাজ করছে….

টিনা সবে মাত্র অনলাইন ক্লাস শেষ হয়েছে।হেডফোন টা খুলে রাখতেই তৎক্ষণাৎ পাখির গলার আর্তনাদ শুনে দৌড়ে আসে।
” রনির ভাইয়ার ঘরে ছোট ভাবি কাঁদছে মানে?”-ভাবতেই গা শিউড়ে ওঠে টিনার।পাখির কান্নাটা যেন প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসছে।বুকফাটা আর্তনাদ করেই চলছে একনাগাড়ে।
টিনা ঘরে এসে দেখে পাখি রনির বিছানায় বসে একনাগাড়ে কেঁদেই চলছে।আর রনি ফোনে কাউকে ট্রাই করছে।

রনি টিনার দিকে একবার দেখে অসহায় ভঙ্গিতে দেখে পাখিকে দেখালো।টিনা দৌড়ে এসে পাখিকে ধরতে আসতেই পাখি আরেক কান্ড করে বসে।দ্রুত নেমে রনির পা ধরে আর্তনাদ করে, “রনি আমায় একবার তোমার ভাইয়ার কাছে নিয়া যাও রনি।দোহাই আল্লাহ্ র। আমি উনারে ছাড়া বাঁচব না রে ভাইয়া।”
পাখির কান্না দেখে রনি টিনা দুজনেই কেঁদে ফেলে।

“চুপ করো ভাবি, এভাবে কেঁদো না তোমার সমস্যা হবে গো। আগে বলো কি হয়েছে ভাইয়ার?”-টিনা পাখিকে জড়িয়ে ধরে বলতে থাকে।পাখি কোন প্রতিউত্তরের ভাষা পায়।
এদিকে রনি বার বার শানের নম্বরে ট্রাই করছে বন্ধ পাচ্ছে।মেডিকেলের টেলিফোন নম্বর,শানের কেবিনের টেলিফোন নম্বর সবটাই কল যাচ্ছে কিন্তু রিসিভ হচ্ছে।এবার রনির সন্দেহ পুরোদমে বেড়ে গেলো।
মুখে বিরক্তি সূচক শব্দ করে পাখির দিকে অসহায় ভঙ্গিতে তাকায়।

“কিরে ছোট ভাইয়া তুই অন্তত বল না, কি হয়েছে মেঝ ভাইয়ার”-টিনা কাঁদতে কাঁদতে বলে।
রনি নিজেকে কন্ট্রোল করে জবাব দেয়, “ভাইয়া নাকি এক্সিডেন্ট করেছে”
টিনা পাখিকে ছেড়ে দুহাতে মুখ ঢেকে চিৎকার করে ওঠে।
রনি ধমক দিয়ে বলে, “মা, বড় মা কোথায়?”
ওরা ঐ যে হামিদ ভাইয়াদের ফ্ল্যাটে গেছে আন্টি নাকি অসুস্থ্য তাকে দেখতে”-কাঁদতে কাঁদতে জবাব দেয় টিনা।

“তুই এতোক্ষন কি করছিলিস,ভাবি যে এতোক্ষন হলো আমার রুমে কান্না করছে চিৎকার করছে কানে যায় নি তোর”-রনি টিনার কাছে দাঁতে দাঁতে চিপে চোয়াল শক্ত করে তেড়ে আসে।
টিনা ভয়ে ভয়ে জবাব দেয়,”ভাইয়া আমার অনলাইন ক্লাস চলছিলো”
রনির রাগ কিছুটা কমে যায়।

“তুই ভাবিকে সামলা, আমি মা’দের ডেকে আনি”-বলতে বলতেই রনি বাহিরে যেতে ধরে। কিন্তু পাখি সামনে এসে দাঁড়ায়।ঘন ঘন দম ফেলে পাখি কড়া চোখে রনির দিকে তাকিয়ে বলে,”তোমায় বলছি না আমায় মেডিকেল নিয়া চলো?যাবা নাকি আমি একাই যাবো।ওকেহহহ ওকেহহ,আমি যাচ্ছি।তোমরা তোমাদের মা বাবাদের ডাকতে থাকো।”
“ভাবি প্লিজ, ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড।আপনি অনেক বেশি দূর্বল লাগছে।নিজেকে একটু শক্ত রাখুন ভাবি।আমি যাচ্ছি ভাইয়ার কাছে”

“রনি”-পাখির চিৎকারে যেন পুরো বাড়ি কেঁপে উঠলো।ভাবির এমন অগ্নিমূর্তি দেখে ঘাবড়ে যায় রনি আর টিনা।বাধ্য হয়ে পাখিকে নিয়ে টিনাকে বাড়িতে রেখে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে গাড়ি স্টার্ট করে রনি।
সারা রাস্তা দূঃচিন্তায় অস্থির পাখির দমের স্থায়িত্ব যেন কমে আসছে।
“ভাবি প্লিজ এমন করবেন না। আগে যাই ভাইয়ার খোঁজ নিই তারপর না হয়…..”
বলেই পানির বোতল পাখির দিকে এগিয়ে দেয়।পাখি তা উপেক্ষা করে শানকে তাড়া দেয় দ্রুত ড্রাইভ করতে।
রনি আজ অন্য পাখিকে দেখে বার বার অবাক হচ্ছে।

গাড়ি পার্ক না করতেই পাখি দরজা খুলেই চলন্ত গাড়ি থেকে নেমে যায়।কোন কিছুর ভয় আজ তার কাজ করছে না।দৌড়ে ভিতরে ঢুকে জানতে পারে শান এখানে নেই।পাখি মুখে দুহাত চেপে কাঁদতে থাকে।তারমানে সত্যিই তার হার্ট সার্জনের কিছু একটা হয়েছে।রনি গাড়িটা তাড়াতাড়ি পার্ক করে হসপিটালে ঢুকে দেখে পাখি মুখ চেপে কাঁদছে আর দুজন মেয়ে তাকে শান্তনা দিচ্ছে।

“হার্ট সার্জন ফয়সাল আহমেদ শান কোথায়?”
“আজকে তো স্যার এখনো আসেনই নাই হসপিটালে।”
“তারমানে সত্যিই ভাইয়ার এক্সিডেন্ট…. ওহহ নো”
রিসেপশনিস্ট মেয়েটা শানের নম্বরের বার কয়েক ডায়াল করে কিন্তু বন্ধই পায়।
“স্যার মনে হয় তোহুরা মেডিকেলে (কাল্পনিক নাম)আছে।ওখানে ক্রিটিক্যাল একটা সার্জারির জন্যে স্যারের উপস্থিত থাকার কথা শুনেছি।আপনারা যদি কাইন্ডলি ওখানে চেইক করতেন তাহলে হয়তো পেয়ে যেতে পারেন।”

পাখি মেয়েটার কথা শুনে উঠে দাঁড়িয়ে পরে।
“রনি উই হ্যাভ টু গো দেয়ার।প্লিজ নিয়ে চলো আমাকে।রনিইই”-পাখি কাঁদতে কাঁদতে বলে।
“স্যারের কি হয়েছে আমাদেরকে যদি একটু ইনফর্ম করতেন”
রনি পিছু ফিরো জবাব দেয়,”এক্সিডেন্ট ”
অবাক হয়ে যায় রিসেপশনিস্ট মেয়ে দুটো।
“কাইন্ডলি টেলিফোনের কলগুলো রিসিভ করার চেষ্টা করবেন”-বলেই রনি পাখিকে সাথে নিয়ে মেডিকেল ছেড়ে যায়।

রংপুরের কিছুটা ব্যাকসাইডে তোহুরা মেডিকেল। পাখির কাছে রাস্তা যেন ফুরাচ্ছেই না। চোখে বার বার শানের মুখটা ভেসে উঠছে।চাপা চাপা স্বরে আর্তনাদ করে উঠছে পাখি।
কিছুক্ষন পর মেডিকেলের গেইট দিয়ে রনিদের গাড়ি পার্কিং সাইটে রাখতেই পাখি পূর্বের ন্যায় আবারও গাড়ি থেকে নেমে যায়।নিজেকে প্রস্তুত করে মেডিকেলের ভিতরকার দৃশ্য দেখার জন্যে।শানের কোন আঁচ সে মানতে রাজি না। কিন্তু মনে বার বার আজে বাজে ধারনা আসছে।

রনি পাখিকে নিয়ে মেডিকেলে ঢুকেই শুনশান অবস্থা বুঝতে পারে।জনসমাগম একদমই নেই এদিকটায়।একদম কোরিডোড় ধরে সামনে শেষ প্রান্তে চোখে পড়ে কয়েকজন মানুষ।চাপা স্বরে সবাই আর্তনাদ করছে।রনির পা থেমে যায় মূহূর্তেই।”তারমানে ভাইয়া….”
পাখি টলমলে পায় অশ্রুশূন্য চোখে এগিয়ে যেতে থাকে।কিছুদূর যেতেই বামে মোড় নিয়ে আরেকটা কোরিডোড়। সেটার শেষ প্রান্তে প্রাণপন এক করে দৌড়াতে থাকে।রনি পাখির অবস্থা দেখে থ হয়ে পিছনে দৌড় দেয়।

হিতাহিত জ্ঞান ভুলে পাখি দৌড়ে গিয়ে অপারেশন থিয়েটার থেকে সদ্য বেরনো ডক্টর শানের গলা জড়িয়ে ধরে।এরপর গলা জড়িয়েই করূন স্বরে কান্না করে দেয়।মুখ দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছে না আজ।এদিকে হঠাৎ এমন হওয়ায় শান বেশ ঘাবড়ে যায়।নিকাবের আড়ালে কিছু সময়ের জন্যে পাখিকে চিনতে কষ্ট হয়।এরপর পাখির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করে।আশেপাশের সবাই যেন মূহূর্তের মাঝেই স্তম্ভিত হয়ে যায়।

আসক্তি পর্ব ১৯

কে ইনি, কেন ডাক্তারের গলা জড়িয়ে ধরলো, আর কেনই বা অটির সামনে এমন কেউ কিছু বুঝতে পারলো না?সবার মাঝেই ফিসির ফিসির কথা চলছে।শান এক নজর সবার দিকে চেয়ে সিনিওর,জুনিয়র,নার্স, ব্রাদার্স সকলের উদ্দেশ্যেই আমতা আমতা করে বলে,”আমার ওয়াইফ!স্যার…..”
“ওকে নো প্রবলেম ডক্টর শান।তাকে শান্ত করুন।মেবি আপনার মিসেস আপনি রিলেটেড কোন ব্যপারে খুব বেশিই টেন্সড হয়ে গেছে”-বলেই উচ্চপদস্থ স্যার সকলকে যার যার কাজে যেতে বললেন।

“বাই দ্য ওয়ে শান, গুড জব”
“ওয়েল ডান”
“কংগ্রাচুলেশনস”
সবাই শানকে তার কাজের প্রশংসা করছে।ততোক্ষনে পাখি কান্নার আওয়াজ কমিয়েছে কিন্তু বন্ধ হয় নি ; হেচকি উঠে গেছে কাঁদতে কাঁদতে।
রনি দূর থেকে ভাইকে দেখে আল্লাহ্ র দরবারে কৃতজ্ঞতার দুফোটা জল ঝড়িয়ে দেয়।আর পাখির কান্ডে বার বার অবাক হয়ে যাচ্ছে।ঠিক কতোটা ভালোবাসলে দূর্ঘটনার মতো এমন মিথ্যে রটনায় এতো কষ্ট পেতে পারে!

শান ধীরেধীরে পাখিকে নিজের কেবিনে নিয়ে আসে।দরজা জানালা বন্ধ কর এসি অন করে দেয়।পাখির নিকাব টা খুলে এক গ্লাস ফ্রিজের ঠান্ডা পানি এগিয়ে দেয়।এতো সময়ের মাঝে একবারো পাখিকে কোন প্রশ্ন করে নি শান।
পাখি কিছুটা শান্ত হলে আবার শানের মুখের দিকে দেখে উঠে গলা জড়িয়ে কাঁদতে লাগে।শান বেশ বুঝতে পেরেছে পাখি তাকে নিয়ে ভয়ে আছে।তাই সেও পাখিকে দুহাতে নিজের একদম কাছে নিয়ে বলে,”পাখি রিল্যাক্স, এইত আমি!”
পাখির কান্না যেন বাঁধ মানছে না আর।শান পাখিকে চেয়ারে বসিয়ে নিজে হাঁটু ভেঙ্গে নিচে বসে পরে পাখির চোখের পানি মুছিয়ে দিচ্ছে……

আসক্তি পর্ব ২১