আসক্তি পর্ব ৩২

আসক্তি পর্ব ৩২
লেখায়ঃআফিয়া আজাদ নিঝুম

“ভাই সাহেব এখন কেমন আছেন”-শর্মিলা বেগমের কথায় আস্তে ধীরে চোখ খোলেন পাখির বাবা শফিক সাহেব।বড্ডো দূর্বল লাগছে তাকে।
অস্ফুট স্বরে ঠোঁটে হাসি এলিয়ে জবাব দেন, “ভালো”
“ভাইয়া আপনারা ঠিক সময়ে বাবাকে নিয়ে এসেছেন।আর একটু দেরি হলে মারাত্মক কিছু হতে পারত।আমার সাথে আসুন কিছু কথা আছে।”-শান বলেই নিজের কেবিনের উদ্দেশ্যে যায়।সোহানও বিষন্ন মুখে শানের পিছে পিছে চলে যায়।
এদিকে পাখির মাকে শান্তনা দিয়ে চলেছেন শানের বাড়ির সকলে।সকলের চোখে মুখেই ভয়ের বলিরেখা এখনো কাটে নি।

শর্মিলা বেগম এবার জানতে চান,”বেয়ান কি হয়েছিলো কাল রাতে?”
পাখির মা রাশিদা বেগম চোখের জল মুছে বলতে থাকেন,”রাতে ভালো মানুষ খেয়ে ঘুমাতে গেলো।ওনার হার্টের একবার সমস্যা হয়েছিলো।যার চিকিৎসা এখনো চলছে নিয়মিত।কাল রাতে ঔষধ খেয়ে তিনি ঘুমিয়ে গেলেন।আমিও কাজকাম সব শেষ করে ঘুমাইলাম।হঠাৎ দেখি মানুষটা হাসফাস করছে।গা থেকে দরদর করে ঘাম ঝড়ছে।আর বুক চেপে বসে আছে।অস্ফুট স্বরে আমায় ডাকছে।আমি দ্রুত উঠে লাইট জ্বালালাম।ঘরিতে তখন ৩ টা।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

তার ঐ অবস্থা দেখে ঘাবড়ে গেলাম।কি করব, বুঝতে পারছিলাম না।ছেলেকে ডাকতে লাগলাম।ছেলে দ্রুত উঠে এসে ওর বাবার ঐ অবস্থা দেখে ঘাবড়ে যায়।ডাক্তারকে ফোন করলাম।ডাক্তার ওতো রাতে আসবে না বলে জানায়।ঐ মূহূর্তেই সদর হাসপাতালে নিলাম উনারা রংপুরে নিতে বললেন।তারপর তো জামাইকে ওতোরাতে ফোন দিলাম।তখন আমরা রাস্তায়।জামাই তাড়াতাড়ি নাইট্রেট ট্যাবলেট টা ওনার জিহ্বার নিচে দিতে বললেন আর আলো বাতাসে রাখতে বললেন।আমরাও তাই তাই করলাম।আর দ্রুত হাসপাতালে আনতে বললেন।তারপর তো….. “-বলেই মুখে আঁচল কেঁদে ফেলে পাখির মা।

“এতো ভেঙ্গে পড়বেন আপা।আল্লাহ্ আছেন।উনি সব ঠিক করে দেবেন।আর এখন তো ভাই সাহেব একটু সুস্থই আছেন।নিজেকে সামলান আপা।”-বলতে বলতেই পাশের চেয়ারে বসে পড়েন শানের চাচি।
এদিকে শান সোহানকে নিজের কেবিনে এনে বলে,”ভাইয়া বাবার এর আগেও হার্টে এ্যাটাক এসেছিলো,তাই না?”

সোহান বিষন্ন মুখে জবাব দেয়,” ২০ সালে একবার সাইলেন্ট এট্যাক হয়েছিলো।লক্ষন কোন কিছুই বুঝে উঠতে পারি নি।ডাক্তারের কাছে নিয়েছিলাম রংপুরেই। তিনি বলেছিলেন সাইলেন্ট এ্যাটাক।সে অনুযায়ী এখনো বাবার চিকিৎসা চলছে।কিন্তু শান এ ব্যপারে বাড়িতে তেমন কেউ কিছু জানে না। শুধু জানে হার্টে একটু সমস্যা।বুঝোই তো মহিলা মানুষ দূঃচিন্তা করে বেশি!”

“বুঝতে পেরেছি ভাইয়া।চিন্তা করবেন না।আপনারা একদম ঠিক সময়ে নিয়ে আসতে পেরেছেন।”
এরপর শান কিছু চিত্র দেখিয়ে বলে,”বিভিন্ন কারণে হার্টের রক্তনালীতে চর্বি ও রক্ত জমাট বেঁধে রক্তনালীতে ব্লক সৃষ্টি করে হার্টের কোষের মৃত্যু ঘটায়-চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় এই অবস্থাকে আমরা হার্ট এ্যাটাক বলি।যা বাবার হয়েছে।এক্ষেত্রে প্রথমে ইসিজি করা হয়, প্রয়োজনে অক্সিজেনও সরবারহ করতে হয়।আর তারপর এনজিওগ্রাম করে ব্লকের পরিমান নির্ধারন করা হয়। ব্লকের পরিমানের উপর বেইজ করে আমরা এনজিওপ্লাস্টি করে থাকি।অর্থাৎ বেশি মাত্রায় ব্লক ধরা পরলে যা ঔষধে সমাধান সম্ভব নয় তখন আমরা এনজিওপ্লাস্টি করি।এক্ষেত্রে প্রয়োজন অনুসারে হার্টে স্টেন্ট বা রিং পরানো হয়।”

শান হাতের কলম টা রেখে চশমাটা ঠিক করে দুহাত মুঠো করে বলে,”ভাইয়া বাবার যে এ্যাটাক টা হয়েছে তা কোন সাধারন এ্যাটাক নয়।এনজিওগ্রামে তিনটি ব্লক ধরা পরেছে।এর ফলে রিং বসাতে হয়েছে।দূঃচিন্তার কারণ একটাই ইতোপূর্বের এ্যাটাক টা। তবে এখন থেকে মেডিসিন একদম নিয়মিত নিতে হবে।ভারি জিনিস পাতি উঠানো টোট্যালি নিষেধ।উনাকে কোন ভাবেই উত্তেজিত করা যাবে না। খাবারে যথেষ্ঠ কেয়ারফুল হতে হবে।ভাজা পোড়া তো টোট্যালি অফ,গোস্তের পরিমান একদম কম।সবজির পরিমান বাড়াতে হবে।”
শান এবার কিছু প্রয়োজনীয় ঔষধ লিখে দেয়।

সোহান হাসপাতালের বিলের ব্যপারে জানতে চাইলে শান বলে,”এসব নিয়ে আপনাদের ভাবতে হবে না ভাইয়া।আমি অলরেডি ম্যানেজ করে নিয়েছি”
সোহানের ঠোঁটের কোণে কিঞ্চিত হাসি ফুটে উঠে।কিন্তু দূঃচিন্তার রেখা টা স্পষ্ট জানান দিচ্ছে।
“ভাইয়া!”
“হুমমম”-জবাব দেয় সোহান
“চিন্তা করবেন না, আল্লাহ্ আছেন।নিয়মিত ঔষধ সেবন করাবেন আর বাবাকে হাঁটাবেন নিয়মমাফিক। আর আমি তো আছি।”

শান আবার বলতে শুরু করে,”তবে একটা অনুরোধ বাবার এ্যাটাকের ব্যপারে পাখিকে কিছু জানাবেন না।আমি আমার বাড়িতেও বলে দিয়েছি সবাইকে। আর আপনারাও একটু খেয়াল রাখবেন যেন কোনভাবেই পাখির কানে না যায়।ও এমনিতেই অনেক চাপা স্বভাবের।এই নিউজ জানতে পারলে ভিতরে ভিতরে দূঃচিন্তা করবে।আমি চাচ্ছি না ও কোন রকম ভাবে খারাপ থাকুক”
শানের কথায় সোহান লম্বা নিঃশ্বাস ছাড়ে।এতো ভালো দায়িত্ববান ছেলে আজকাল পাওয়া ভার!আবার তার বোনেরও কতো খেয়াল রাখে।গর্বে যেন সিনা টান হয়ে আসে সোহানের।

হাসপাতালের কাজ মোটামুটি শেষ করে দুপুর তিনটার পর বিষন্ন বিধ্বস্ত শরীরে বাড়ি ফেরে শান।সাথে বাড়ির বাকি সদস্যরাও।পাখি তখন সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছে।চোখ পড়ে সবার দিকে।
“তোমরা সবাই কোথায় গেছিলে?”-শানের দিকে একনজর দেখে পাখি সবার উদ্দেশ্যে বলে।
সবাই কোন উত্তর না করে যে যার যার রুমে চলে যায়।শর্মিলা বেগম আর আহমেদ সাহেব গিয়ে সোফায় বসতে বসতে সুমির কাছে ফ্রিজের ঠান্ডা পানির ফরমায়েশ রাখে ।শান স্থীর দাঁড়িয়ে থাকে।
দরজার দিকে তাকিয়ে নিজের মা আর ভাবিকে দেখে অবাক হয়ে যায় পাখি।দ্রুত পদে এগিয়ে যায় সেদিকে।

“মা,ভাবি তোমরা এখানে?হঠাৎ?”
পাখির মা কিছু না বলে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে মেয়ের দিকে।
পাখি অস্থির হয়ে আবার বলে,”কি ব্যপার ভাবি, তুমি এসময়ে গাড়ি করে রংপুর এসেছো কেন?কি ব্যপার তোমরা কেন কিছু বলছো না আমায়?মা তোমাদের চোখ মুখ ফোলা কেন এমন?বাবা ভাইয়া কই?একা আসতে দিলো?”

শান অবস্থা বেগতিক বুঝতে পেরে দ্রুত পাখির হাত ধরে উপরে নিয়ে যায়।যেতে যেতে বলে,”মা, ভাবি আর মা কে ঘরে নিয়া যাও”
“তুমি কি পাগল?বাড়িতে মেহমান আসলে ওভাবে জেরা করতে হয় বুঝি?”-শান ঘরের মাঝে এনে পাখিকে দাঁড় করিয়ে বলে।
“কিন্তু মা ভাবি, একা? এভাবে? এসময়…..”
“উফফ আবার শুরু হলে!শোন আমাদের বাড়ির সবাই আজ হামিদা খালার বাড়ি গেছিলো।খালা হঠাৎ একটু অসুস্থ্য…… ”

“হামিদা চাচি!কি হয়েছে উনার!”আমায় কেন নিলো না কেউ!”-শানের কথা শেষ না হতেই পাখি অস্থির হয়ে জানতে চায়।হামিদা বেগমের প্রতি পাখির আলাদা একটা অনুভূতি কাজ করে। কারণ তারই মাধ্যমে এ বাড়িতে আসে।এ মানুষটার বউ হওয়া। আর আজ এতো সুখের খোঁজ পাওয়া।
“আগে তো শুনবা, নাকি?গাধি একটা”-দাঁতে দাঁত পিষে বলে শান।
“হুমমম”

“সামান্য একটু অঅসুস্থ্যতা আরকি।সবাই দেখতে যায়।বাড়িতে থাকার মতো কেউ ছিলো না তাই তোমায়, সামিহা ভাবিকে আর সুমিকে রেখে যায়।ওরা ত্রুত চলে যায় বলে তোমাদের জানিয়ে যায় নি।আর ওখানে গিয়ে খালার বাড়িতে তোমার মা আর ভাবিকে পায়।তাই তাদেরকে সাথে নিয়ে আসে।আর ভাবির প্রেগন্যান্সির কথা শুনে নিশ্চই তোমার ও বাড়ি যেতে ইচ্ছে হয়েছিলো!হুমমম। “-মুখে মিথ্যে হাসি রেখে গড়গড় করে কতোগুলো মিথ্যে বলে শান
পাখির যেন ব্যপার গুলো হজম হলো না।

“কিন্তু…..”
“কোন কিন্তু নয়।এবার সবার জন্যে ডায়নিং সাজাও প্রচন্ড ক্ষিদে লেগেছে বউ”-বলেই শান নিজের পেটে হাত বুলাতে থাকে।
পাখিকে তবুও আনমনে কিছু ভাবতে দেখে শান শক্ত করে ওকে জড়িয়ে ধরে বলে,”আর বেশিক্ষন সামনে থাকলে ভুল হয়ে যাবে কিন্তু!তুমি কি চাও এই অবেলায় ভুল করি?বলো বলো, হুমমম?”
শানের দুষ্টুমি মাখা কথাবার্তায় পাখির চোখমুখ কুচকে আসে।দুহাতে সজোড়ে ঠেলে হাসি প্রসস্থ করে বলে,”অসভ্য লোক একটা।”

এরপর এক ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে।শান তৎক্ষণাৎ ফেইক হাসি টা মিলিয়ে থমথমে মুখে লম্বা লম্বা কয়েকটা নিঃশ্বাস ছাড়ে।বিড়বিড় করে বলে,”আমি জানি তুমি মিথ্যে পছন্দ করো না।কিন্তু আমি হেল্পলেস।তোমাকে এই মিথ্যেটা না বললে সবটা জেনে যেতে। আর ভীষণ কষ্ট পেতে। আমি তোমাকে আর কোন কষ্ট পেতেই দেবো না।এভাবে সারাটা জীবন আগলে রাখবো।”

এরপর শান দ্রুত শাওয়ার নিয়ে নিচে নেমে আসে।ততোক্ষনে একে একে বাড়ির সবাইও চলে আসে।এক টেবিলে খেতে দেয়া হয় সবাইকে।সাথে পাখির মা ও ভাবি রয়েছেন।সবাই যযথাসম্ভব সবটা স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছেন।
“মা খাচ্ছো না কেন?”-পাখি তার মা কে দেখে বিষন্ন মনে ভাত নেড়ে চলেছেন।
পাখির কথায় শান সহ সবাই তার দিকে ফেরে।শান একবার পাখির দিকে আরেকবার পাখির মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখে।বুঝতে পারে না কি করা উচিত।হঠাৎ মায়ের দিকে নজর পড়তেই শর্মিলা বেগম চোখের ইশারায় তাকে পাখির মায়ের পাশের চেয়ারে বসতে বলেন।
শান উঠে সেখানে বসে বলে, “মা মনে হয় লজ্জা পাচ্ছে পাখি”

বলতে বলতেই প্লেট থেকে ভাত মেখে শ্বাশুরি মায়ের মুখের সামনে ধরে শান।রাশিদা এবার এবার সত্যি সত্যি লজ্জায় কুকড়ে যান।এভাবে মেয়ের জামাইয়ের কাছ থেকে তার হাতে খাওয়া এটা যেন ভীষণ লজ্জায় ফেলছে তাকে।
“আরে বেয়ান সাহেবা নিন না খান খান, কতোজন শ্বাশুরি আছে বলুন তো জামাইয়ের এমন সেবা পায়!”-হাসতে হাসতে বলে আহমেদ সাহেব। তার সাথে এবার সহমত পোষন করে শর্মিলা। একে একে সবাই।
“মা কি হলো, নিন না?”
শানের কথায় রাশিদা চমকে উঠে।বলে,”বাবা আমি একা খেয়ে নিতে পারব”
“শিওর!”
“হ্যা বাবা”-লজ্জামিশ্রিত কন্ঠে জবাব দেন রাশিদা।
পুরোটা সময় পাখি শানের সমস্ত কর্মকান্ড দেখছে আর ভালোলাগার অতল গহ্বরে তলিয়ে যাচ্ছে।

আসক্তি পর্ব ৩১

“মা ভাবি এসছে থেকে একটুও আলাদা করে কথা বলার সুযোগ হয় নি।যাই একটু, কথা বলে আসি”-যেই ভাবা সেই কাজ সন্ধ্যার দিকে গেষ্ট রুমে এগিয়ে যায় পাখি। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন দেখছে মাকে।ভাবি যেন কার সাথে ফোনে কথা বলছে।
“ভাবি কে আসবে তারপর তোমরা যাবে?ফোনে কাউকে বললে?আজ রাতে থাকবে না তোমরা?”
পাখির ভাবি চোরাচোখে জবাব দেয়,”কে আবার তোমার ভাইয়া আসবে। এসে আমাদের নিয়ে যাবে”
“কারোরই কোত্থাও যাওয়া হচ্ছে না ভাবি “-শানের গলার স্বরে ওরা দুজন দরজার দিকে তাকায়।
পাখি ভ্রুকুচকে ফেলে।

শান সেদিকে এক পলক তাকিয়ে আবার বলে,”হুমম,কারোরই কোথাও যাওয়া লাগবে না।ভাইয়া এসে আমাদের এখানে থাকবে”
“কিন্তু বা….”
ভাবির কথায় পাখি পিছু ফিরে প্রশ্নাতুর চোখে চায়।
“পাখি”
“কি?”
“এক গ্লাস পানি নিয়ে আসো তো,পিপাসা লেগেছে”
“আনছি “-বলেই পাখি চলে যায়।
“ভাবি আমি ওখানে টুয়েন্টি ফোর আওয়ার্স নার্স রেখে এসেছি।ওখানে কারোরই থাকার দরকার নেই।আর মায়ের ঘুমের ঔষধ টা দিয়েছেন?”
“হ্যা ভাই, দিয়েছি বলেই না তখন থেকে ঘুমাচ্ছে!”

৪ দিন মেডিকেলে কাটানোর পর বাড়ি ফিরে যায় পাখির বাবা।একটু নতুন জীবন তিনি পেয়েছেন তাও আবার একমাত্র মেয়ের জামাইয়ের বদৌলতে।খুশিতে যেন বুকটা ভরে ওঠে।পরোক্ষনে নিজের অসুস্থ্যতার কথা ভেবে ভয়ে শুকনো ঢোক গিলে ভাবে,”মেয়ের এতোসুখ দেখতে পারবেন তো তিনি! ”

আসক্তি পর্ব ৩৩