আসক্তি পর্ব ৩১

আসক্তি পর্ব ৩১
লেখায়ঃআফিয়া আজাদ নিঝুম

বিকেল বেলা সূর্য ঢলের পরার দৃশ্য বরাবরই বেশ সুন্দর লাগে।কেমন লাল লাল একটা আভা ছড়ায়।এমন মনোরোম দৃশ্য উপভোগ করার লোভ পাখি সামলাতে পারে না।মন চাইলেই দৌড়ে ছুটে আসে ছাদে।শানদের ছাদ থেকে ব্যপার টা আরো বেশিই মনোরোম লাগে।পিছনেই সুন্দর বিশাল শাপলা বিলটার কারণে।

আজও পাখি ছাদে এসেছে সূর্য ডোবা দেখতে।চেয়ে আছে অপলোকে।ফোনের রিংটোনে স্ক্রীনে তাকিয়ে ভাবি নামটা দেখে ভ্রুকুচকে যায়।সঙ্গে সঙ্গে ঠোঁটে হাসি এলিয়ে কল রিসিভ করে।
“সত্যিই!কংগ্রাচুলেশনস ভাবি!”কতো মাস বলো না প্লিজ ভাবি”-কল রিসিভ করতেই এক প্রকার চিল্লিয়ে বলে পাখি।খুশি যেন উপচে পড়ছে চোখেমুখে।খুশি হবে না’ই বা কেন জীবনে প্রথম ফুপি হওয়ার মতো সুসংবাদ জেনেছে সে।হ্যা পাখির ভাবি তাকে সুসংবাদ দিতেই ফোন করে।পাখির যেন তর সইছে না কখন তার সার্জন সাহেব আসবে আর কখন সুখবর টা দেবে।টিকটিক করতে করতে ঘরির কাটা চলছিলো।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

রাত ৯ টার দিকে শান চলে আসলো।ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিচে আসলো।পাখির ইচ্ছে থাকলেও যেতে পারল না।রান্নার কাজে সাহায্য করতে হচ্ছে মা, চাচীকে।ডিনারের সময় হয়ে এলো।পাখির মুখের অতিরিক্ত আভা টা সবার নজর কাড়তে সক্ষম হয়েছে।
শ্বশুরি মা ব্যপার টা বুঝতে পেরে ভ্রুকুটি করে বলল,”কি ব্যপার বৌমা, আজ তোমায় খুব খুশি লাগছে যে। কি হয়েছে মা!”

শর্মিলা বেগমের কথায় সবাই উত্তরের আশায় পাখির মুখের দিকে চায়।
“মা আমাদের বাড়িতে নতুন সদস্য আসতেছে”-মুখে এক গাদা অম্লান হাসি রেখে জবাব দেয় পাখি।সবার চোখেমুখে অন্য রকম খুশি বিরাজ করছে।শান সবে মাত্র এক ঢোক পানি মুখে নিয়েছে। গিলতে না গিলতেই এতো বড় অসম্ভব কথা তার হজম হলো না। বিষম খেয়ে উঠলো।বাকি সবার খুশিটা বেশিক্ষন স্থায়ী হলো না শানের অবস্থা বেগতিক দেখে।শর্মিলা বেগম দৌড়ে গিয়ে পিঠ চাপড়ে দিচ্ছেন আস্তে আস্তে।শান তখনও আড় চোখে পাখিকেই দেখছে আর ভাবছে,”এটা কি করে সম্ভব!পাখি মিথ্যা বলছে কেন?”

“কি রে বাবু কেমন লাগছে তোর এখন”-হঠাৎ মায়ের কথায় হুশ ফেরে শানের।আস্তে করে উত্তর দেয়, “হ্যা মা একটু ভালো লাগছে”
শর্মিলা বেগম উঠে নিজের চেয়ারে বসতে বসতে বলে,”বউ মা যে খবর দিয়েছো আমরা সবাই অনেক অনেক খুশি হয়েছি। অনেক দিন পর আমাদের বাড়িতে নতুন সদস্য আসবে।আমি তো ভাবতেই পারছি না গো মা”
শ্বাশুরি মায়ের কথা শুনে পাখি কিছুক্ষন ভেবে বলে,”মা এ বাড়িতে নাতো”
“মানে”
“মানে সুসংবাদ এ বাড়ির নয়। আমাদের বাড়ির।মানে, মানে আমার ভাবির”-আমতা আমতা করে উত্তর দেয় পাখি।

সবাই হতাশ চোখে মুখ নামিয়ে নেয়।শানও যেন স্বস্তি পায় পাখির কথায়।
মাঝখান থেকে দাদিজান বলে উঠেন,”কবে যে এ বাড়িতে এমন একটা সুসংবাদ পাবো!”
দাদিজানের কথায় পাখির চোখ মুখ লাল হয়ে যায়।লজ্জায় কান দিয়ে ধোঁয়া বের হবার উপক্রম।
“মা, আমি আসছি”-আস্তে স্বরে বলে নিজের রুমে চলে যায় পাখি।
শান খেতে খেতে বলে,”এখন এসব নিয়ে কোন প্ল্যান নেই দাদিজান, ওর মাস্টার্স টা শেষ হোক।তারপর দেখা যাবে”

“ততোদিনে বয়স কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে ভেবেছিস?”
“ওহহহহ দাদিজান,এযুগে এসেও এসব নিয়ে দূঃচিন্তা করতে হবে না।আল্লাহ্ চাইলে সবই সম্ভব”
শানের কথা দাদিজানের পছন্দ হলো কিনা কে জানে।মাথা নিচু করে খাবার মুখে দিলেন।

ডিনার সেড়ে যে যার মতো ঘরে চলে গেলেন।সবার খাওয়ার পর্ব শেষ হয়েছে।শান নিচ থেকে হেঁটে এসে সিঁড়িতে পা রাখতেই মনে হয় পাখি তখন খায় নি।তাই দ্রুত পদে রান্না ঘরের দিকে যায়।প্লেটে সামান্য ভাত আর তরকারী সমেত উপরে নিজের ঘরে যায়।
“ঐ গাধি হইছে আর সরম পাইতে হবে না।খাবার টা খেয়ে নাও”
পাখি কিছু না বলে খাবার খেয়ে প্লেট নিচে রেখে আসে।

শানের সামনে থাকতে কেমন যেন লজ্জা লাগছে আজ।আগে তো এমন হয় নি।লজ্জায় মাথা তুলে তাকাতে পারছে না।বেলকোনিতে গিয়ে রেলিং ধরে বাহিরে তাকিয়ে আছে।শান খানিক টা বুঝতে পেরে পাখির গা ঘেঁষে দাঁড়ায়।পিছন থেকেই রেলিং এ রাখা পাখির হাতদুটোর উপর নিজের হাত রাখে।পাখি চোখ বন্ধ করে ফেলে। পাখির গালের সাথে গালটা ঘঁষে ঘোরলাগা কন্ঠে বলে,”এতো লজ্জা পাচ্ছো কেন,নতুন বউয়ের মতো হুমমম?”

পাখি কোন জবাব দিতে পারে না।চুপ করে আছে।যেন মুখটা সেলাই করে দেয়া হয়েছে।পাখি কিছু বোঝার আগেই শান চট করে কোলে তুলে নেয়।বেলকোনির দরজাটা আস্তে করে বন্ধ করে ঘরে ঢোকে।
“তুমি কি দিন দিন মোটা হচ্ছো”-শান হাফানোর ভান করে বলে।
মূহূর্তেই পাখির রাগ উঠে যায়।
“নামান বলছি, নামান।কে বলেছে আমায় কোলে নিতে।”

পাখি এবার কোল থেকে নেমে আবার বলে,”সবে মাত্র দুইমাস হলো বিয়ের তার মাঝেই কতো বিরক্ত হয়েছি। আমি নাকি মোটা হয়েছি। আর একটা বাবু হলে না জানি আমায় ছুড়ে ফেলে দেয়া হয়!”
কথাটা বলতে না বলতেই শান ওর হাত চেপে ধরে,”আজকেই প্রথম, আজকেই শেষ।এমন কথা দ্বিতীয় বার উচ্চারন করলে মেরে ফেলব।তোমার প্রতি আমার যে আমার ভালোবাসা তা নির্দিষ্ট সময়ের না,না নির্দিষ্ট রুপের।মাথায় রেখো”

বলেই শান পাখির হাত টা ছেড়ে বিছানার দিকে যায়।
পাখি হুট করে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলে, “সরি। আর বলব না ”
শান ওর হাতদুটো নিজের বুকের মাঝে চেপে ধরে।এরপর হাতে চুমু দিয়ে বলে,”চলো, ঘুমাবে।আমার একটু কাজ আছে। তুমি ঘুমানোর পর করব।চলো”

“আমার একটা ছোট্ট শান চাই”-পাখি লাজ লজ্জা একপাশে রেখে শানের পিঠে মুখে গুঁজে বলে।
শান ভ্রুকুচকে ফেলে, হাত ধরে সামনে নিয়ে এসে পাখিকে বিছানায় বসায়।মুচকি হাসির রেখা শানের চোখেমুখে। পাখি দুচোখ বন্ধ করে রেখেছে লজ্জায়।
“আবার বলো তো!”
শানের কথায় পিটপিট করে চোখ খুলে পাখি কিছু বলতে পারে না।চুপ করে থাকে।
“কি যেন বলছিলে তুমি, ছোট্ট কি চাই?”
“শাাআআন”-জড়তা নিয়ে পাখি জবাব দেয়।

এই প্রথম পাখির মুখে নিজের নাম শুনে হেসে দেয়ে শান।বসা থেকে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলে,”এখন না আগে মাস্টার্স শেষ হোক তোমার। তারপর”
পাখিও দাঁড়িয়ে একরোখা জবাব দেয়,”না এক্ষুনি”
শান পিছু ফিরে ভ্রুকুচকে বলে,”তোমার সাথে তো আর আমিও গাধা হতে পারব না তাই না”.
“আমার বাবু চাই, ব্যাস”-থমথমে মুখ পাখির।এমন থমথমে মুখে পাখির মুখটা বেশটা ছোট বাচ্চাদের মতো লাগে।ঠোঁট দুটো ফুলে ওঠে।শান আচমকাই পাখির ওষ্ঠদ্বয় নিজের দখলে নিয়ে নেয়।নিমিশেই অভিমানটা গায়েব হয়ে যায় পাখি।

শান চেয়ে আছে কিছু একটা সম্মতির অপেক্ষায়।পাখির বুঝতে বাকি থাকে না কিসের সম্মতি চাইছে সার্জন সাহেব।মুচকি হাসিতে জবাব দেয় সে।শান একহাতে ঘরের লাইট অফ করে দেয়।

রাত তখন ৩ বেজে ৪০ মিনিট। সবে মাত্র দুচোখের পাতায় ঘুম চলে এসেছে শানের।অনেক আগে ঘুমিয়ে গেছে পাখি।শানের বুকে ওর গরম শ্বাস আছড়ে পরছে।হঠাৎ ফোনের চাপা টোনে ফোন হাতরিয়ে ঘুমো ঘুমো চোখে শান সেদিকে চায়।এতো রাতে কখনো কেউ শখে ফোন দেয় না।তাও এমন একটা নম্বর থেকে ফোন, শানের যেন কলিজা কেঁপে উঠে।গলা শুকিয়ে আসে তার।আস্তে করে পাখির মাথাটা সরিয়ে বালিশে রাখতে রাখতে কলটা কেটে যায়।

কিছুক্ষন পর আবার কল আসে।পাখি নড়েচড়ে বালিশে মাথা রেখে পাশ ফিরে শোয়।এ সুযোগে শান ফোনটা হাতে নিয়ে দ্রুত বেলকোনিতে চলে আসে।ফোন রিসিভ করে সালাম জানায়।অপর দিক থেকে চাপাকান্নার আওয়াজ।শানের হাত পা হিম হয়ে আসে।কেউ কোন কথা বলে না। শান নিজেকে সামলিয়ে বলে,”হ্যালো, হ্যালো ভাইয়া কি-ই হয়েছে? সবটা ঠিক আছে তো!”

ওপাশ থেকে আসা জবাবে শানের হাড় হিম হয়ে যায়।অসহায় চাহনীতে চেয় দেখে পাখির ঘুমন্ত মুখটার দিকে।
“কি করে জানাব তোমায় সবটা”-বিড়বিড় করে বলে শান।
এরপর জবাব দেয়,”ভাইয়া কোন চিন্তা করবেন না আপনারা চলে আসুন।আমি আসসছি। আর বাদ বাকি সব কিছুর ব্যবস্থা আমি করে দিচ্ছি”

এদিকে ঘুমের মাঝে পাশ ফিরে হাত দেয় শানের গায়ে।ফাঁকা জায়গায় হাত পরে পাখির।মূহুর্তেই চমকে উঠে চারদিকে তাকায়।ড্রিম লাইটের আবছা আলোয় বুঝতে পারে শান বেলকোনিতে দাঁড়িয়ে কারোর সাথে কথা বলছে।ঘুমো ঘুমো চোখে টলমলে পায়ে পাখি এগিয়ে যায় সেদিকে।
“ইমিডিয়েট ইমারজেন্সি ভিআইপি কেবিন বুক করো,কুইক।আর তারপর আমায় ফোন করে রেজাল্ট জানাও”-শান অস্থির কন্ঠে ফোনে কাউকে বলছে।
হঠাৎ ঘারে কারো হাতের স্পর্শে চমকে পিছু ফেরে শান।

“কার কি হয়েছে? ”
শান নির্বাক, কিছু বলার ক্ষমতা তার নেই।
পাখি একটু এগিয়ে এসে বলে,”কি হলো কিছু বলছেন না যে!কার জন্যে ভিআইপি কেবিন তাও ইমারজেন্সি! ”
শান আমতা আমতা করে জবাব দেয়,”আমায় এক্ষুনি মেডিকেল যেতে হবে।দূঃচিন্তা করো না।ইমারজেন্সি পেশেন্ট আছে।আমি সকাল হতে হতেই ফিরে আসব।আর ফজরের সময়ও হয়েছে নামাজ টা সেড়ে নিতে হবে তো নাকি!”

শান পাখির আগ্রহকে কিছুটা দমানোর বৃথা চেষ্টা করছে।পাখি কিছু বলতে যাওয়ার পূর্বেই শান বুঝতে পেরে সেখান থেকে সিটকে সরে যায়।দ্রুত ওয়াশরুমের দরজা বন্ধ করে।
এদিকে পাখির ঘুমের ঘোর এখনো কাটছে না দেখে আবার বিছানায় গা এলিয়ে দেয়।
কিছুক্ষন পর শান শাওয়ার নিয়ে বের হয়ে দেখে পাখি আবার ঘুমাচ্ছে।মুখটা দেখে কেমন যেন শানের ভিতর মোচর দিয়ে ওঠে।

“পাখি জানলে কিভাবে রিএ্যাক্ট করবে?নিশ্চই খুব কষ্ট পাবে।আমি জানাবো না। দেখি কেইস টা কতোদূর জটিল”-ভাবতে ভাবতেই কাবার্ডের দিকে আসে শান।
ড্রেস পরে রেডি হয়ে নেয় ।পুরোপুরি রেডি হয়ে পাখিকে আরেকবার ডাক দেয়।উঠছে না দেখে মাথার কাছে চলে যায়।বসে আবার ভালো করে ডাকে, “পাখি, এই পাখি উঠবা না? নামাজ পড়তে হবে তো! উঠো। আমি গেলাম”-বল উঠে যেতেই পাখি হাত চেপে ধরে।
বলে ওঠে,”আপনি নামাজ পড়বেন না!”

“বাহিরে মসজিদে পড়ে নিবো”-বলেই পাখির কপালে চুমু দিয়ে দ্রুত ঘরের বাহিরে চলে যায়।
পাখির কেমন যেন শানাকে বড্ডো খাপছাড়া মনে হচ্ছিলো।কিছু একটা যে তিনি লুকাচ্ছে তা পাখির কাছে স্পষ্ট।কিন্তু কি সেটা?তাই বোধগম্য হচ্ছে না পাখির।

আসক্তি পর্ব ৩০

সকাল হতে হতেই পাখি ভেজা টাওয়াল সমেত কাপড় চোপড় নাড়তে ছাদে যায়।কাপড় নেড়ে গাছগুলোতে পানি দেয়।রেলিং ঘেঁষে দাঁড়াতেই নিচে চোখ পড়ে যায় পাখির।বাড়ির সবাই কোথায় যেন যাচ্ছে।
“এতো সকালে কোথায় যাচ্ছে সবাই?আমায় তো কেউ কিছু জানাইলো না”-ভ্রুকুচকে ভাবতে থাকে পাখি।এরপর ভেজা চুল গুলো আঙ্গুল দিয়ে ঝাড়তে ঝাড়তে দ্রুত নিচে নেমে আসে।
“সুমি কি হয়েছে, সবাই কোথায় গেলো?”

সুমি কিছু বলার আগেই সামিহা সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে বলে,”সুমি আমায় এক কাপ লেবু চা দে না।মাথা টা ধরেছে খুব”
বলেই সোফায় বসে মাথা চেপে ধরে সামিহা।
পাখি সেদিকে একপলক চেয়ে সুমির পিছু পিছু রান্না ঘরের দিকে চলে যায়।
পাখি রান্নাঘরে এসে সুমির হাত ধরে বলে,”সুমি সবাই কোথায় গেলো কিছু বলছিস না কেন?”

“ছোটভাবি সবাই একটু বাহিরে গেলো, এখনি চলে আসবে”-পাখির দিকে না তাকিয়েই জবাব দেয় সুমি।
এদিকে পাখির মন খচখচ করছে খুব।মনে হচ্ছে বড় কোন বিপদ হয়েছে ওর।মনে কেমন যেন অস্থির অস্থির লাগছে।
সব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে সকলের জন্যে নাস্তার আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পরে পাখি।

আসক্তি পর্ব ৩২