আসক্তি পর্ব ৩৬

আসক্তি পর্ব ৩৬
লেখায়ঃআফিয়া আজাদ নিঝুম

অপারেশন রুমে দরদর করে ঘেমে যাচ্ছে শান।বার বার চশমার গ্লাস ঝাপসা হয়ে আসছে তার।ছয় বছরের ডাক্তারি জীবনে এরকম নার্ভাস কখনোই তাকে লাগে নি।নিজেই নিজেকে চিনতে পারছে না শান।অজানা আশঙ্কা গ্রাস করে ফেলেছে তাকে ইতোমধ্যেই।বার বার শুকনো ঢোক গিলে নিজেকে ধাতস্থ করে শ্বশুরের ওপেন হার্ট সার্জারির জন্যে।

(কিছুক্ষন আগে)
শান ড্রাইভ করা বন্ধ করে ফোনের লক প্যাটার্ণ খুলেই চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়।
“সোহান ভাই!”-ভাবতেই বুকের ভেতর ধক করে ওঠে।দ্রুত কলব্যাক করে।
“হ্যালো, হ্যালো শান বাবার অবস্থা খুবই খারাপ। বুকের ব্যথায় বাবা একদম অসুস্থ্য হয়ে পড়েছে।কোন কথা বলছে না,না কোন নাড়াচাড়া করছে।ডাকলেও সাড়া দিচ্ছে না।কি করব বুঝতেছি না? “-অস্থিরতার চরম পর্যায়ে পৌঁছে সোহান হরহর করে কথাগুলো বললো।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

শান ভয় পেয়ে যায় ভীষণ।কারন রিং পরানোর তিন মাসের মধ্যেই আবার এ্যাটাক আসলে তো মুশকিল।
“ভাইয়া ইমিডিয়েট রংপুর তহুরা মেডিকেলে নিয়ে আসুন”-বলেই গাড়ি ঘোরায় শান।মাথায় শুধু একটাই চিন্তা গিজগিজ করছে।আবার এ্যাটাক এলে সবটা এলোমেলো হয়ে যাবে।
শান মেডিকেলে এসে সবকিছুর বন্দোবস্ত করে।কিছুক্ষন পরই সোহান তার বাবাকে নিয়ে মেডিকেলে চলে আসে।পরীক্ষা নিরীক্ষার পর শান বুঝতে পারে আবার এ্যাটাক এসেছে হার্টে।ঘাবড়ে যায় শান।কারণ এবার বাইপাস ছাড়া কোন উপায় নেই।নিজের কেবিনে ঢুকে সোহানকে ডেকে নেয় শান।

“ভাইয়া বাইপাস করতে হবে এবং সেটাও ইমিডিয়েট। কারণ বাবার হার্টে আবার এ্যাটাক এসেছে”-কথাগুলো বলতেই যেন শানের গলা কেপে ওঠে।
আঁতকে ওঠে সোহান।কিছু বুঝতে পারে না এই সময় কি বলা উচিত তার।
শান তার মুখের অবস্থা দেখে সোহানকে আশ্বস্ত করে বলে, “ভাইয়া ভয়ের কিছু নেই।আমি সার্জারির এ্যারেঞ্জ করে নিচ্ছি।আপনাকে একটা বন্ডে সিগনেচার করতে হবে ”

সোহানের ভয় যেন কিছুতেই কাটছে যেন। গাল বেয়ে দুফোটা নোনাজল গড়াতেই হাতের বুড়ো আঙ্গুলে তা মুছে নিয়ে বলে,”শান এটায় ঝুঁকি কেমন?”
“বাইপাস বা ওপেন হার্ট সার্জারিতে আমরা যেটা করি, পায়ের রগ কেটে নিয়ে পুরো বুক কেটে খুলে দুইভাগ করে সেই রগ হৃদযন্ত্রে বসিয়ে দেই।এর ফলে বন্ধ হয়ে যাওয়া ররক্তনালী বাদ দিয়ে প্রতিস্থাপিত নতুন রগকে রক্তসঞ্চালনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হয়।ঝুঁকি বলতে তেমন কোন ঝুঁকি নেই।এক্ষেত্রে মৃত্যুহার এক থেকে দুই শতাংশ। রোগীর যদি ডায়াবেটিস থাকে তবে ইনফেকশনের ভয় থাকে আর হাইপার টেনশন থাকলেই ঝুঁকি বাড়ে”

সোহান মাথা নিচু করে চোখের পানি আটকাবার বৃথা চেষ্টা করছে।
নত মুখেই বলে,”যা করা লাগে করো শান তবু প্লিজ বাবাকে সুস্থ করে দাও। ”
কথাটা বলতে না বলতেই একজন নার্স হুরমুর করে ভিতরে ঢোকে।
“স্যার আপনার পেশেন্টের অবস্থা খুবই খারাপ।প্লিজ চলে আসুন স্যার”
শান চকিত চোখে সেদিকে চায়।দ্রুত উঠে চলে যায় ২০৩ নং কেবিনের দিকে।শফিক সাহেবের অবস্থা বেগতিক দেখে শান নার্সকে বলে,”অটি রেডি করুন এজ সুন এজ পসিবল”

এরপর নিজেকে প্রস্তুত করে ঢুকে পরে অটিতে।এই প্রথম না।এর আগে রংপুর সহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় সে অপেন হার্ট সার্জারির নির্ধারিত হয়েছিলো কিন্তু কখনোই এরকম অবস্থার স্বীকার হতে হয় নি।অজানা ভয় চারদিক থেকে গ্রাস করে রেখেছে।
চোখ দুটো বন্ধ করলেই কেন জানি না পাখির হাস্যোজ্বল মুখঅবয়ব টা ভেসে উঠছে।
“পারব তো হাসিটা অক্ষুন্ন রাখতে!সবার ভরসা বজায় রাখতে!”
চোখ বন্ধ রেখেই কয়েকটা ভারী শ্বাস নিয়ে অপারেশন শুরু করে।

(বর্তমান)
অটির সামনে সমানতালে পায়চারী করছে সোহান।আহাজারি করে বুক ভাসাচ্ছে তার মা।বীনা ৫ পেরিয়ে ৬ মাসের সসন্তানসম্ভবা মানুষ।কাঁদতে পারছে না।দম খাটো হয়ে আসছে তার।এর মধ্যেই শানের বাড়ির সবাই চলে আসে।তাদের দেখে রাশিদা বেগমের কান্নার বেগ যেন দ্বিগুন বেড়ে যায়।কোন কথাই মুখ থেকে বেরোচ্ছে না তার।

“বেয়ান, শান্ত হোন বেয়ান সব ঠিক হয়ে যাবে।আল্লাহ্ র উপর ভরসা রাখুন।তিনি আছেন তো”-চোখের পানি সংবরন করে শান্তনা দিয়ে চলেছেন শানের মা
ফয়েজ গিয়ে সোহানকে যথাসম্ভব শান্ত করার বৃথা চেষ্টা করছেন।অটির বাহিরে যেন থমথমে গুমোট একটা পরিস্থিতি বিরাজ করছে।চাপা কান্নার আওয়াজে বিশ্রী লাগছে সবকিছু।

“তুই আসার সময় প্লিজ নিয়ে আসিস”
“আচ্ছা আচ্ছা ম্যাম আনব, তবে ট্রিট রেডি কর”
“আগে শিওর তো হই, হাদারাম”
“আচ্ছা আমি আসছি”

এতোক্ষন রাখির সাথে ফোনে কথা বলছিলো পাখি।নিজের শরীরে অস্বাভাবিক আচরনের ব্যপারে রাখিকে জানালো।সব শোনার পর রাখি তাকে বলে একবার প্রেগন্যান্সি টেষ্ট করাতে।কথাটা কানে আসতেই যেন পাখির সারা শরীর জুড়ে আলাদা এক শিহরণ খেলে যায়।ভালো লাগার অনূভুতি সৃষ্টি হয়।এ ভাবনা যে তার মনে উদয় হয় নি তেমন টা নয়। তারও মনে হয়েছিলো নিজের ভেতর কেউ একজন উকি দিচ্ছে।সন্দিহান মন কে শান্ত করতেই রাখিকে সবটা বলা।রাখিও একই কথা বলে।এবার পালা নিশ্চিত হবার।
ঘন্টা খানিক পর রাখি কলিং বেল চাপে। দৌড়ে এসে সদর দরজা খুলে দেয় পাখি।চোখেমুখে অস্বাভাবিক খুশির রেখা তার।

“এনেছিস?”
“হুমমমম,এনেছি। এই নে”
পাখি হাত বাড়িয়ে নেয়।রাখিকে নিয়ে নিজের ঘরে চলে যায়।যাবার সময় সুমিকে রাখির জন্যে নাস্তা নিয়ে আসতে বলে উপরে।
“তোর বাড়ির সবাই কই রে, কাউকে দেখছি না?”
“জানি না তো।আমি ঘুমাচ্ছিলাম এতোক্ষন।সকালে খেয়েই ঘুমাইছি আর একটু আগে উঠে গোসল সারলাম।শরীরটা ভালো লাগছিলো না বলে।আছে হয়ত সবাই সবার ঘরে ঘরে”

“ওহহহহহ”
“, পজিটিভ রেজাল্ট যদি আসে আমি কাউকে কিছুই বলব না;সার্জন সাহেব কে তো নয়।হিহি সারপ্রাইজ দিবো।কি বলিস?”
“হুমম তা ঠিক আছে।এবার যা টেষ্ট করে আয়।আমি কিন্তু খুব এক্সাইটেড “-রাখি জুসের গ্লাসটা মুখে নিতে নিতে বললো।
কিছুক্ষন পর পাখি থমথমে মুখ নিয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয়।রাখি শুকনো ঢোক গিলে প্রশ্নবান চোখে পাখির দিকে তাকায়।
“কি হলো?”
পাখি নিশ্চুপ। কোন কথা বলে না।
পেটের উপর হাত রেখে টেষ্টার টা এগিয়ে দেয় রাখির দিকে।
“আমি মা হবো রাখি,আমি মা….”

বাকি কথাটা শেষ করতে পারে না।চোখ দিয়ে বৃষ্টির ন্যায় জল গড়িয়ে পরে। জীবনের প্রথম এই অনুভুতিটা সত্যিই অন্যরকম একজন মায়ের কাছে।
রাখিও খুশিতে গদগদ হয়ে শুভকামনা জানায়।পাখি আবেশে জড়িয়ে ধরে রাখিকে বলে,”আমি মা হবো রাখি!”
“ভাবি এতো খুশি ক্যান দুইজনে?”-কথাটা বলতে বলতে ঘরে ঢোকে সুমি,ফাঁকা প্লেট গুলো নেয়ার উদ্দেশ্যে।
পাখি রাখি দুইজন দুজনার মুখের দিকে দেখছে।পাখি চোখ ইশারায় রাখিকে বাড়ন করে কোন কিছু না বলতে।রাখি চুপ করে যায়।

“তেমন কিছু না সুমি।বাড়ির সবাই কোথায় রে?”
“টিনাপু কম্পিউটারে ক্লাস করছে,রনি ভাই সকালে বের হইছে আর আসে নি।তুমি যখন ঘুমে ছিলা তখন বড় মা, বড় বাবা আর চাচি কোথায় যেন চলে গেলো।তোমাকে ডাকতে বাড়ন করেছিলো। ফয়েজ ভাই অফিসে, সামিহা ভাবি টিভিতে সিরিয়াল দেখছে আর মেঝ ভাইয়া হাসপাতালে। “-এক দমে কথা গুলো বলে দমে যায় সুমি

শানের কথা শুনেই আলাদা ভালো লাগা কাজ করলো পাখির মনে।আপনা আপনি হাতটা পেটের উপর চলে গেলো।চোখ বন্ধ করে ভাবতে লাগলো,”আজ আপনার একটা সারপ্রাইজ দেবার কথা ছিলো।কিন্তু রাতে আপনি নিজেই সারপ্রাইজড হয়ে যাবেন।”
মুচকি হেসে ওঠে পাখি।
সুমি ততোক্ষনে প্লেট গ্লাস গুলো নিয়ে নিচে চলে যায়।রাখি আবার পাখির হাত ধরে খাটে বসিয়ে বলে, “কতো মাস রে?
পাখি ঠোঁট উল্টে অপারগতা প্রকাশ করে।মানে সে জানে না।
রাখি চোখ মুখ কুচকে আবার বলে,”গাধি সেটাও জানিস না।আনুমানিক? ”
“মেবি দুই মাস পার হয়ে তিনে পরেছে”-গভীর চিন্তার ভঙ্গিতে বলে পাখি।

শফিক সাহেবকে অটিতে নেয়া হয়েছে ঘন্টা তিনেক হলো এখনো তেমন কোন খবর আসছে না ভিতর থেকে।বাহিরের সবার অস্থিরতা যেন বেড়েই চলেছে ক্রমশ।
“স্যার অবস্থা ভীষণ ক্রিটিক্যাল হয়ে যাচ্ছে”
ছুড়ি কাচি হাতে রেখেই শান চোখ তুলে তাকায় পাশে থাকা ডাক্তার রবিনের দিকে।
“রবিন প্লিজ স্টপ দিজ।আল্লাহ্কে ডাকো।কিচ্ছু হবে না”-চাপাস্বরে ধমক দেয় রবিনকে।অবস্থা যে সত্যিই ক্রিটিক্যাল তা শানের বোধগম্য হতে দেড়ি হয় না।তবুও মনে সাহস সঞ্চার করে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
শফিক সাহেবের অবস্থা দেখে হাত পা কাপা শুরু করেছে শানের।গায়ের লোম গুলো দাঁড়িয়ে যাচ্ছে বিশ্রীভাবে।

“কি জবাব দেবো আমি পাখিকে?জীবনের প্রথম ফেইলার অপারেশন ;নিজের শ্বশুরের। উফফ!বাহিরে দাঁড়ানো উৎসুক চোখ গুলোকে কি জবাব দিবো আমি?”-ভাবছে আর কাপা কাপা হাতে কাজ করছে। কিন্তু কাজে কোন সাকসেস আসছে না।দম গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়ে আসছে।
“স্যার”-নার্স ইকরার চাপা গলার স্বরে থমকে যায় শান।ছুড়ি কাচি পরে যায় হাত থেকে।মেঝের টাইলসে সেসবের ঘূর্ণায়মান শব্দ হয়েই চলছে।শান স্তম্ভের ন্যায় দাঁড়ানো।মেশিন থেমে গেছে আরো পাঁচ মিনিট আগে।

থমকে গেছে সময়টা মধ্যরাতের ঘোর আঁধারের মতো।
ডাক্তার রবিন আর ডাক্তার পলাশ শানের অবস্থা বুঝতে পেরে দ্রুত পাশের সোফায় এনে বসায়।তখনো অটির দরজা খোলা হয় নি।
সোফার হাতল ধরে সাবধানে বসে পরে শান।পুরো পৃথিবীটাই যেন থেমে গেলো আজ।
দুহাতে মুখ ঢেকে লম্বা শ্বাস নিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে।
চোখের পাতা বন্ধ করতেই পাখির করূন কান্নাজড়িত একটা মুখের ছবি ভেসে ওঠে।বুকটা ধরফরিয়ে ওঠে শানের।
“কি জবাব দিবো তোমায়?কি করে চোখে চোখ রাখব তোমার?”

অটির দরজা খুলে দেয়া হয়। ডাক্তার রবিন গিয়ে ফয়েজের কানে কানে কথাটা বলতেই গায়ে হিম শিতল বাতাস বয়ে যায় ফয়েজের।সোহান সন্দিহান চোখে তাকায় ফয়েজের দিকে।খুব কাছে এসে হাত ধরে জানতে চায়,”ফয়েজ ভাই সত্যি সত্যি বলবেন! ডাক্তার কি বললো?”
সোহানের কথায় হকচকিয়ে ওঠে ফয়েজ।
“লুকানোর মতো কিচ্ছু নেই আর কিন্তু কথাটা বলব কি করে?-আনমনে ভেবে ফয়েজ ক্ষীণস্বরে বলে দেয়

“সোহান ভাই আঙ্কেল আর নেই”
কথাটা বলা দেড়ি সোহানের লুটিয়ে পরা দেড়ি হয় না।সোহানের অবস্থা থেকে সেখানে দাঁড়ানো কারো আর বুঝতে অসুবিধা হয় না অপারেশন ফেইল্ড।আহাজারি করে ওঠে কোরিডোরে দাঁড়ানো রাশিদা বেগম।বীনা ফুফিয়েই কেঁদে চলছে তখন থেকে।শানের চাচি গিয়ে শান্তনা দিচ্ছে তাকে।অনাগত সন্তানের কথা বলে বুঝাচ্ছে ;কোন কাজ হচ্ছে না।
“স্যার, কন্ট্রোল ইওরসেলফ!আপনার কোন দোষ নেই এখানে!কেন নিজেকে ব্লেইম করছেন স্যার?”
“হুমমম”-বলে শান প্রলাপ বন্ধ করে

“ইকরা আমার জীবনের প্রথম ফেইলর অপারেশন এটাই ।সেটাও আমার ওয়াইফের বাবার?কি জবাব দিবো ওকে?”-শান অস্থির হয়ে বলতে থাকে।
“স্যার মৃত্যুর উপর আমাদের কারোর হাত নেই।আমরা তো উছিলা মাত্র।”-ইকরা তখন থেকেই শান্ত করার চেষ্টা করছে শানকে।
কিছুক্ষন পর শান চোখ মুখ মুছে লম্বা নিঃশ্বাস ছেড়ে সোফা থেকে উঠে দাঁড়ায়।যেভাবেই হোক তাকে বাস্তবতার মুখোমুখি হতেই হবে।গায়ের এপ্রোন টা খুলে হাতে নিয়ে দরজায় গিয়ে শটান হয়ে দাঁড়ায়।
সোহান মুখ ঢেকে শব্দহীন কেঁদেই চলেছে তখন থেকে।

দরজায় কারো অস্তিত্ব টের পেয়ে সেদিকে তাকায়।চোখভরা জল নিয়ে এগিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে সোহান।শান কি করবে বুঝে উঠতে পারে না।ব্যথায় বুকের ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে তার
“এটা কি হলো শান?পারলে না আমার বাবাকে বাঁচাতে?ভরসা করেছিলাম তোমার উপর?”-অনবরত কেঁদে চলেছে সোহান।
সোহানের কথার কোন প্রতিউত্তর শান করতে পারে না।
ফয়েজ এগিয়ে এসে সোহানকে সামলে নেয়।পিছনে স্ট্রেচারে করে বের করে আনা হয় শফিক সাহেবের নিথর দেহটাকে।কান্নার রোলে ভরে যায় করিডোর।

শান চোখ বন্ধ করে আবার খুলে সামনে তাকিয়ে নিজের কেবিনে চলে আসে।সবকিছুই কেমন যেন ধোঁয়াটে লাগছে।ফ্রেশ হয়ে চেয়ারে গা এলিয়ে দেয়।চোখ বুজে আসে নিমেশেই।পাখির কথা মনে হয়।
“বাহিরে তো কোথাও পাখিকে দেখলাম না।ও কোথায়? ”
চোখ খুলে ফেলে চমকে।উঠে দাঁড়ায় চট করে।বাহিরে আসার জন্য উদ্যত হতেই বাহিরে বিকট সড়গোলের শব্দে কান ঝালাপালা হয়ে যায় শানের।বুঝতে পারে না কি হচ্ছে!
জানালা খুলে নিচে তাকায়।যা হবার তাই’ই হয়!

প্রেস সাংবাদিক আর জনসমাগমে গিজগিজ করছে মেডিকেলের গেইট।
“বিশিষ্ট হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ফয়সাল আমহেদ শানের প্রথম ফেইলর অপারেশন। সেটাও নিজের শ্বশুরের। দেখা যাক তার শুভাকাঙ্ক্ষীরা ব্যপারটা কে কিভাবে গ্রহন করছে”-সাংবাদিকদের কথায় চক্ষু চড়কগাছ শানের।ব্যপারটা এতোদূর গড়াবে তার ছিটেফোঁটা ভাবনাও মাথাতে আসে নি।সে ভেবেছিলো কি করে পরিবারের মানুষদের চোখে চোখ রাখবে।এতোকিছু হবে ভাবতে পারে নি।
এলোমেলো পায়ে কেবিন ছেড়ে বাহিরে আসে শান।

“মা, পাখি কোথায়?”-শানের কথায় চোখের পানি মুছে শর্মিলা বেগম সেদিকে চায়।
ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় জবাব দেয়,”দুপুর বেলা যখন আসি তখন বৌমা ঘুমাচ্ছিলো।এখন তো সন্ধ্যা হয়ে গেছে।”
“তোমরা সবাই ওদের সাথে ও বাড়ি চলে যাও মা।আমি পাখিকে নিয়ে আসছি”-শান যথাসাধ্য নিজেকে নিয়ন্ত্রনে রেখে কথাটা বলে।

আসক্তি পর্ব ৩৫

শর্মিলা বেগম ছেলের শুকনো মুখ আলতো হাতে ছুঁয়ে বলে,”দূঃচিন্তা করিস না বাবা।এখানে তোর তো কোন হাত নেই।আমার ছেলে তুই আমি জানি তুই তোর কাজে কতো মনোযোগী।অন্য পেশেন্টের বেলায় যদি অতো মনোযোগ দিয়ে অপারেশন করতে পারিস, নিজের শ্বশুরের বেলায় নিশ্চই আপ্রান চেষ্টা করছিস।আমি জানি।ভয় পাস না।সব ঠিক হয়ে যাবে”

মায়ের কথায় শান নিজেকে আর কন্ট্রোল করতে পারে না।কোলে মাথা রেখে ফুফিয়ে কেঁদে ফেলে।শর্মিলা বেগম চোখের জল মুছে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।
“নিচের ভিড় কমে গেলে বৌমা কে নিয়ে সন্ধ্যার পর সাবধানে ও বাড়ি আসিস। কেমন!”
শান মুখ তুলে চোখ মুখ মুছে সোজা হয়ে দাঁড়ায়।
হসপিটালের ফর্মালিটিজ সম্পন্ন করে ফয়েজ সবাইকে নিয়ে পাখিদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়।

দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা হলো কারোরই বাড়ির ফেরার নাম নেই।পাখির এবার দূঃচিন্তা শুরু হলো।পরোক্ষনে পেটে হাত বুলিয়ে রাখির কথা ভাবতে থাকে, “কোন চাপ নেয়া যাবে না মনে রাখিস”
মুচকি হেসে সব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে চোখের সামনে সদ্য টাঙ্গিয়ে রাখা ফুটফুটে ছবিটির দিকে তাকায়।প্রফুল্লিত মনে পেটে হাত রেখে ভাবে,”তুই কবে আসবি রে?আমার ছোট্ট শান!”

কলিং বেলের কড়া শব্দে ভাবনায় ছেঁদ পরে পাখির।আস্তেধীরে সিঁড়ি বেয়ে নেমে পরে।
“সুমি টা যে কোথায়?”
বিড়বিড় করে বলতে বলতে সদর দরজা টা খুলে দেয় পাখি।দরজার ওপাশে দাঁড়ানো মানুষটাকে দেখে লজ্জা আর একরাশ মুগ্ধতায় ছেয়ে যায় পাখির চোখমুখ।ঠোঁট এলিয়ে হেসে ডান হাতটা টেনে নিয়ে সোজা উপরে চলে যায় পাখি।

আসক্তি পর্ব ৩৭