উষাকালে ঊর্মিমালা পর্ব ২

উষাকালে ঊর্মিমালা পর্ব ২
জিন্নাত চৌধুরী হাবিবা

কলিংবেলের শব্দে নাসিমা বেগম কে এসেছে দেখতে দরজা খুলে দিলেন। দরজা খুলেই তিনি চমকে গেলেন। আনোয়ার হোসেনের পাশেই শামীমের হাত ধরে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে উষা।
এতক্ষণ পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলেও নাসিমা বেগমকে দেখেই ঝটপট শামীমের হাত আঁকড়ে ধরে। নাসিমা বেগম সরাসরি আনোয়ার হোসেনকে প্রশ্ন করলেন,

-“এই মেয়ে তোমাদের সাথে কেন?”
আনোয়ার হোসেন জবাব দিলেন,
-“উষাকে শামীম বিয়ে করে নিয়েছে।”
নাসিমা বেগমের আবারও যেন চমকালেন, থমকালেন। দুনিয়াটা কেমন ঘুরে উঠল তার। তিনি চেঁচানো সুরে বলে উঠলেন,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-“আমার কথার অবাধ্য হয়ে তোমরা বাবা-ছেলে ওদের জালে পা দিয়েছো? এই মেয়ে কেন এসেছে বুঝতে পারছোনা? আমার সংসারটা ত*ছ*ন*ছ করতেই এসেছে। এক্ষুণি এই মেয়েকে বিদায় কর।”
যা বলার আনোয়ার হোসেনই বললেন। শামীম বাবার ভরসায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। আনোয়ার হোসেন ঠান্ডা মাথায় জবাব দিলেন,

-“তুমি নিজেই তো একসময় চেয়েছিলে উষা যেন তোমার ছোট ছেলের বউ হয়। তাহলে এখন তাকে দিয়ে আসার কথা উঠছে কেন?”
-“সেটা অতীত ছিলো। বর্তমান ভিন্ন।”
শাশুড়ীর ভেতরকার ভ*য়*ড*র বুঝতে পেরে মৃদু হাসলো উষা। শান্তভাবে বলে উঠলো,

-“আপনার ছেলে বাড়ি বয়ে গিয়ে আমাকে বিয়ে করে এনেছে। কোন কারণ ছাড়া বিদায় করতে চাইলে যে হাজত বাস হবে। আর ছেলেকে পরামর্শ দাতা হিসেবে আপনিও হাজত ঘুরে আসবেন। তারপর বসে বসে মা ছেলের মাথায় আর ছেলে মায়ের মাথার উকুন বেছে দিতে দিতে গল্প করবেন। ব্যাপারটা ম*ন্দ না।”

নাসিমা বেগমের চিৎকার চেঁচামেচিতে বাড়িসুদ্ধ সবাই এসে উপস্থিত হয়েছে। উষা ঘরে পা রাখতেই নাসিমা বেগম জ্ঞান হারালেন। অভিনয় না-কি সত্যিই জ্ঞান হারালেন বোঝা গেল না।
রাহাতের নতুন বউ সহ তার জ্ঞান ফেরাতে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
জ্ঞান ফিরতেই তাঁর আহাজারি শুরু হলো,

-“আমার সংসারে কা*ল*না*গি*ন ঢুকেছে। আমার ছেলেকেও বস করে নিয়েছে।”
উষা নিশ্চুপ হয়ে দেখে গেলো নাসিমা বেগমের নিখুঁত অভিনয়। এমন আহাজারি করার কথা তার মায়ের। ক্ষ*তিটা তাদের হয়েছে। অথচ তিনি কি সুন্দর হাপুসনয়নে কেঁদে যাচ্ছেন।
দুনিয়া বড্ড নি*ষ্ঠু*র।

পৃথিবীতে মানুষের চেয়ে যদি ভ*য়*ঙ্ক*র কোন প্রাণী থেকে থাকে, তবে সেটা একমাত্র মানুষই হয়।
রাহাতের স্ত্রী লিলি বারবার আড়চোখে পর্যবেক্ষণ করছে উষাকে। তার মনে হয়তো প্রশ্ন জেগেছে ‘কে এই মেয়ে? এসব হচ্ছেটাই বা কী?’

তার কৌতুহলী চোখজোড়ার কৌতুহল মিটিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে উষা খানিক হেসে বলল,
-“আমি আপনার ছোট জা হই ভাবি। আবার বলতে পারেন আপনার স্বামীর প্রাক্তন শালিকা।”
দ্বিতীয় কথাটি বুঝতে না পেরে লিলির কপাল কুঁচকে গেল। নাসিমা বেগম কান্না থামিয়ে ঝটপট লিলিকে সাবধানের বাণী শোনালেন,

-“খবরদার! এই মেয়ের সাথে কথা বলবেনা। এই জল*দ*স্যু তোমার জীবনটাও শেষ করে দেবে।”
-“আপনি ভুল বললেন আম্মা। জল*দ*স্যু সমুদ্র বা নদীপথে আ*ক্র*ম*ন করে। আমিতো শশুর বাড়ি এসেছি মাত্র।”
শামীম এতক্ষণ চুপচাপ থাকলেও উষাকে এবার খানিক ধ*ম*কে উঠলো।
-“চুপ করে ঘরে যাও।”

উষা দাঁড়ালোনা। ধুপধাপ পা ফেলে শামীমের ঘরে চলে গেলো। সে তো দো*ষে*র কিছু বলেনি। অথচ তাকে ধমক শুনতে হলো। কথায় আছেনা ‘কোদাল সবসময় বুকের দিকেই টা*নে’।
শামীম মায়ের পায়ের কাছে গিয়ে বসলো। নাসিমা বেগম মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। অভিমানের সুরে বললেন,
-“তুই আমাকে মুখ দেখাবিনা। এই চেহারা ওই মেয়ের সামনে দেখাবি। যেদিন ওকে ছেড়ে আমার কাছে আসতে পারবি সেদিনই মুখ দেখাবি।”

শামীম শান্ত স্বরে বলল,
-“মা, তুমি আমার মা। উষা এখন আমার স্ত্রী। আমি দুজনকেই সম্মান করি। কাউকে দূরে সরানোর ইচ্ছে আমার নেই। তুমি যদি ভাবির সাথে এই অ*বি*চা*র না করতে, তাহলে সংসারের সুখ হারিয়ে যেত না। ভাবি, উষা দুজনকেই তো তুমি অনেক স্নেহ করতে। তাহলে ছোট্ট একটা ঘটনায় কী এমন হয়ে গেলো যে, ভাবি আর এই বাড়ির বউ হওয়ার যোগ্য রইলোনা।”

নিজের দো*ষ টুকু চোখের সামনে ভাসতেই নাসিমা বেগম তেতে ওঠেন। কাঠকাঠ গলায় বললেন,
-“তুই এক্ষুনি আমার সামনে থেকে বেরিয়ে যা।”
-“মা আমার কথা শোন।”
-“ঠিক আছে, তুই না গেলে আমি বেরিয়ে যাচ্ছি।”

নিরুপায় হয়ে লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফে*ললো শামীম। মায়ের ঘর থেকে বেরিয়ে ভাবলো উষার জে*দের কাছে হার মেনে সে বড্ড ভুল করেছে। সাংসারিক শান্তির সাথে সাথে তার মানসিক শান্তিও হারাবে সে।
ঘরে ফিরেই দেখলো টেবিলের এক পাশে চেয়ার টে*নে বসে কিছু লিখে যাচ্ছে উষা। শামীম কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই তার হাতে একটা লিস্ট ধরিয়ে দিলো। দৃষ্টি নামিয়ে বলল,

-“আমার কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস। কাল সময় করে এনে দেবেন।”
শামীম লিস্ট পড়তে গিয়ে একটা জায়গায় দৃষ্টি আটকে গেলো। প্রয়োজনীয় বিভিন্ন জিনিসের সাথে সাথে ন্যাপকিন লিখা। তার পাশেই ছোট্ট করে লিখা ‘আমার শরীর অসুস্থ’।
এর মর্মার্থ বুঝে কাগজটি ভাঁজ করে পকেটে রেখে দিলো। ফ্রেশ হয়ে এসে দেখলো খাটের একপাশে গুটিশুটি মে*রে শুয়ে আছে উষা। শামীম ছোট্ট করে ডাকলো,

-“উষা, খেতে চলো।”
অবস্থানের পরিবর্তন না করেই উষা জবাব দিলো।
-“আমি এখন খাবো না। আপনি খেয়ে আসুন।”
শামীমের রা*গ হচ্ছে। নাকের পাটা ফুলিয়ে শ্বাস ছেড়ে নিচু স্বরে বলল,
-“তুমি একটু বেশিই জে*দ করো।”
উষা নির্বিকার ভঙ্গিতে জবাব দিলো,

-“এটা আমি জানি। নতুন কিছু থাকলে বলুন।”
শামীম জবাব না দিয়ে উষাকে টে*নে তুললো।
-“খেয়ে এসে ঘুমাও।”
রা*গে হাত ছাড়িয়ে নিলো উষা। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
-“সমস্যা কী আপনার? আমি খাবোনা বলছিতো। আপনার খিদে পেয়েছে আপনি খেয়ে নিননা। এত লা*ফা*লা*ফি*র কী আছে?”

-“সবার সাথে খেতে কী সমস্যা তোমার? চলো তাহলে, তোমাকে অন্য বাসায় রাখবো ওঠো।”
উষা অন্য বাসায় থাকার জন্য তো এখানে আসেনি। তাই চুপচাপ শামীমের কথা শুনে তার সাথে খেতে গেলো। তা দেখে মুচকি হাসলো শামীম।

উষাকে দেখে একজন এক এক দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে। এতে তার উপর বিন্দুমাত্র প্রভাব পড়লোনা। চুপচাপ বসে নিজের খাবার নিজে বেড়ে খেয়ে ঘরে চলে গেলো। শামীম খাবার শেষ করে উঠতেই তার বড় আপা শান্তি বললেন,
-“তোর কী খুব দরকার ছিলো সংসারে অ*শান্তি নামিয়ে আনা?”
শামীম কোনো জবাব দিলোনা। চুপচাপ বড় আপার কথা শুনে গেলো। আপা আর কিছুই বললেন না। শামীম আর না দাঁড়িয়ে ঘরে ফিরলো।

রাতে ঊর্মির ভাবি তানজিনা ঊর্মির জন্য খাবার নিয়ে গিয়ে পাশে বসলো। ঊর্মির ভাই শাকিল হাসিমুখে ঘরে ঢুকে শরীরের বেশ খোঁজ – খবর নিলো।
ঊর্মি জবাব দিলো, “ভালো আছি আমি।”
কিছুক্ষণ ইতিউতি করে আসল কথায় আসলো শাকিল। বলল,

-“তোর মোহরানার টাকা কি তোর কাছেই আছে?”
ঊর্মি ভাইয়ের চোখেমুখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে কি যেন বোঝার চেষ্টা করল। অতঃপর কি ভেবে একটু হাসলো যেন। বলল,
-“হ্যাঁ।”
শাকিল নরম হয়ে বলল,

-“এই টাকা দিয়ে আমরা বাজারের উপর একটা জমি কিনলে কেমন হয়?”
মোস্তফা সাহেব খাবার শেষ করে মেয়ের ঘরের দিকেই আসছিলেন। শাকিলের বক্তব্য কর্ণধারে পৌঁছাতেই তিনি শক্তভাবে জবাব দিলেন।
-“কোন দরকার নেই। এটা আমার মেয়ের টাকা। তার একটা ভবিষ্যত আছে।”
শাকিল বাবাকে বোঝালো,

-“ঊর্মিতো আমাদের কাছেই আছে। তার খাওয়া-পরা, প্রয়োজনীয় সবকিছুতো আমরা দিচ্ছিই। তার তো এখন টাকার প্রয়োজন নেই।”
মোস্তফা সাহেব তাচ্ছিল্য হেসে বললেন,
-“এই সামান্য টাকার লো*ভ সামলাতে পারছোনা? টাকা তার প্রয়োজন কি অপ্রয়োজন, সেটা তোমার বুঝতে হবে না।”

-“সে কি আমাদের উপর থাকছে- খাচ্ছে না? এই টাকা তো জলে যাচ্ছে না। বরং একটা কাজে লাগানো হচ্ছে।”
মোস্তফা সাহেব হুংকার ছেড়ে বললেন,
-“সে তোমার টাকায় নয়, তার বাবার টাকায় খাচ্ছে।”
বাবাকে উত্তেজিত হতে দেখে ঊর্মি বলল,

-“বাবা ভাইয়া তো খারাপ কিছুই বলেনি। আমার তো এখন টাকার প্রয়োজন নেই। জমি কিনলে বরং লাভই হবে।”
তানজিনা শক্ত করে চেপে ধরলো ঊর্মির হাত। চোখ দিয়ে ক্রমাগত ইশারা করে চলেছে ‘তোমার ভাইয়ের কথায় কান দিও না’।
ব্যাপারটা খুবই সুক্ষ্ম নজরে লক্ষ করেছে শাকিল। দাঁতে দাঁত চেপে মাথা ঝাঁকালো। এর অর্থ আজ তানজিনার উপর বড় ঝড় আসতে চলেছে।

মোস্তফা সাহেব সাফ জানিয়ে দিলেন,
-“ঊর্মির টাকা ওর চিকিৎসায় খরচ হবে। এই টাকার উপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নাও।”
শাকিল বেরিয়ে গেলো। তানজিনা বের হতে যেতেই ঊর্মি হাত চেপে ধরে বলল,
-“তুমি এখন ঘরে যেও না ভাবি। ভাইয়া কিন্তু ক্ষে*পে আছে তোমার উপর।”
-“বিয়ের কয়েকমাস পর থেকেই তোমার ভাইয়ের নতুন নতুন রূপের সাথে পরিচিত হচ্ছি। এ আর এমন কী? তুমি ঘুমিয়ে পড়” বলে তানজিনা বেরিয়ে গেলো।

ভোরে শামীম উঠে মসজিদ চলে গেলেও উষাকে ডাকলোনা। এখন যেহেতু নামায পড়বেনা। সুতরাং ভোরবেলায় ডেকে লাভ নেই। নামায শেষ করে বের হতেই অন্ধকার অনেকটা কে*টে গেলো। সকালের স্নিগ্ধ বাতাস গায়ে মেখে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করলো। সাতটার সময় বাসায় ফিরে দেখলো উষা বাথরুম থেকে বেরিয়েছে। শামীমকে দেখে জিজ্ঞেস করলো,

-“লিস্টের জিনিসগুলো এনেছেন?”
পাঞ্জাবি খুলে রাখতে রাখতেই শামীম জবাব দিলো,
-“এখনো দোকানপাট খোলেনি।”
উষা বিরক্তিতে “চ” শব্দ করে বলল,
-“এভাবে আমি আর কতক্ষণ থাকবো? বিরক্তিকর।”

শামীমের জবাবের অপেক্ষা না করেই বেরিয়ে গেলো সে। বাইরে গিয়ে দেখলো নাসিমা বেগম রাহাতের স্ত্রী লিলিকে নিজের ঘরে ডাকছেন। নিশ্চিয়ই তার নামে কান পড়া দেবেন। সেদিকেই গেলো উষা। উনার সাথে কিছু বোঝাপড়া আছে। শামীম আসার পূর্বেই ঊর্মির সাথে ফোনে কথা হয়েছে। নাসিমা বেগম তাদের বাসায় ফোন দিয়ে তার মাকে যাচ্ছে-তাই শুনিয়ে দিয়েছেন। রা*গ কন্ট্রোল করতে পারলোনা সে। এই অতিরিক্ত রা*গ জিনিসটাই ধ্বং*সের কারণ।
নাসিমা বেগমের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে উষা শক্ত কন্ঠে প্রশ্ন করলো,

-“আপনি আমার মাকে কেন ফোন করেছেন? আর কোন সাহসেই বা তাকে বে*হা*য়া নারী বললেন?”
-“ভুল কিছু বলিনি আমি। এক মেয়ে নিয়ে আরেক মেয়ে পাঠিয়েছি। এখানে বে*হা*য়া*প*না ছাড়া ভালো কিছুই দেখছিনা আমি।”
উষা দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

-“আমার মা কে নিয়ে আপনার মুখ থেকে যতগুলো কুরু*চিপূর্ণ কথা বের হবে, তার সবগুলোই আপনি।”
উষা দাঁড়ালোনা। বেরিয়ে যেতেই চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করলেন নাসিমা। শামীম মাত্র নাস্তা করতে বসেছে। মায়ের ঘর থেকে শব্দ পেয়ে সেদিকে গেলো।

শামীম মায়ের ঘরে থাকাকালীন উষা নাস্তা সেরে ঘরে গেলো। মিনিট দশেক পরই অন্য এক শামীমকে আবিষ্কার করলো। যার চোখেমুখে জ্বলন্ত আগুন। শক্ত চোয়ালের উপরিভাগে রগগুলো ফুলে উঠেছে। শক্ত হাতে কঠোরভাবে উষার হাত চেপে ধরে বাইরের দিকে টে*নে নিয়ে যাচ্ছে। ব্যথা পেয়ে উষা বলল,

উষাকালে ঊর্মিমালা পর্ব ১

-“ব্যথা পাচ্ছি আমি।”
শামীম হুংকার ছেড়ে ধ*ম*কে উঠলো,
-“একদম চুপ।”

উষাকালে ঊর্মিমালা পর্ব ৩